বেশ কিছু দিন আগে বলেছিলাম- কবিতার মা'কে খুঁজছি। কারন কবিতা লিখা আর হচ্ছিল না। অনেক দিন পর সেই কবিতার মা' কে খুঁজে পেয়ে এবার তার ইতিহাস নিয়ে এ কাব্যর প্রয়াস। আশা করি বন্ধুদের ভাল লাগবে...
..............................................................................


কবিতার মা ছিলেন রাজার দুলালি
যেন সে নেপালের নিসর্গ লালি,
নাম তার আহামরি চর্যাপদ।
ছিল না তার অসুখ বিসুখ কিংবা গদ,
ছিল প্রজাপতির মত রঙ্গিন ডানা,
হিমালয়ের মত শুভ্র শরীর খানা-
চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল গড়ানো আনন্দ সরবর,
পদ্মা মেঘনা যমুনা বরাবর,
বাঙলা ভাষাভাষি কত দেশ ও প্রান্তর,
দিয়েছে প্রেম ভালবাসা আর আদর,
করছে এখনও লালন কত গ্রাম অনন্ত জনপদ,  
কবিতার রাণী- মা আমার আহামরি চর্যাপদ।


সেই ৯৫০ খৃষ্টাব্দ থেকে জন্ম বেড়ে উঠা।
নেপালি পর্বতময় আকাশ ছুঁয়া ভিটা-
১২০০ খৃষ্টাব্দ অবধি আগলিয়ে রাখল তাকে।
তার ২৪ জন সন্তান কবিতার মূল শাঁখে
গাইল মায়ের গুন-কীর্তণ সভ্যতার অন্তঃপূরে,
শত শত বছর বাঙ্গালির প্রাজ্ঞ জনপদ ঘুরে।
কাহ্নপাদ, সরহপাদ, চাটিল্লপাদ, শবরপাদ
আরও কত নাম উপেক্ষিত গুনছে প্রমাদ
তবু ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে আছে বুকে,
করেছে সম্মানিত মায়ের চরণ সুখে দুঃখে
বিশ্বদরবারে নত মাথা করেছে উঁচু ভুলেছে আপদ
কবিতার মমতাময়ী মা আমার আহামরি চর্যাপদ।


মা’য়ের মুখের ভাষায় মিষ্টি ছন্দ পাই-  
‘গঙ্গা জউনা মাঝে রে বহই নাঈ’
(গঙ্গা যমুনার মাঝে নৌকা চলে)
‘সনে ভরিলী করুনা নাবী’
(সোনায় ভরা আমার করুনা নৌকা)
মা চর্যাপদ ছিলেন যেন এক মহা কবি।
বাঙ্গালি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র কি ভাগ্য
নেপালি রাজ দরবার থেকে ভোগ্য
পণ্যের চেয়েও পেলেন শ্রেষ্ঠ উপহার,
বাঙ্গালির অস্তিত্বের রসালো শেঁকড় হল উদ্ধার।
গর্ব আমাদের নিজস্ব বর্ণ আর মুখের ভাষা,
নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে নিজস্ব স্বপ্ন কত আশা,
সেই আবহমান কাল থেকে চলমান ছিল এ রথ
কবিতার ইতিহাস- মা আমার আহামরি চর্যাপদ।


চারটি পুঁথি যেন চৌরঙ্গী ইতিহাস
বাঙ্গালির কাব্য গানের ঐতিহ্যের দীর্ঘ-শ্বাস
দ্বৈত দেহাকোষ, ডাকার্নব আর চর্যাচর্যবিনিশ্চয়
তান্ত্রিকগাঁথায় ধর্মীয় ধ্যানে সেকি বিস্ময়!
এ যেন আলো আঁধারির সন্ধ্যা ভাষা  
আ মরি প্রানের ভাষা বাংলা ভাষা!
তাই কি রফিক শফিক জব্বার সালাম,
বুকের রক্তে রাঙ্গাল এ বালাম
তবু মা’র বুকের ভাষা হতে দেয়নি বিলিন,
এ ভাষা থেকেই ভ্যান্ত চুমে হয়েছি স্বাধীন।
পেয়েছি দেশ পেয়েছি পতাকায় আপন অস্তিত্ব,
রক্ষা পেয়েছে মা’র সকল নিগূঢ় সতিত্ব,  
উপেক্ষিত হল বাংলা নিয়ে নানা মুনির নানা মত
জগত ভাষার মধ্যমনি মা আমার আহামরি চর্যাপদ।


এর পর মা আমার কোন কষ্টে অভিমানে,
ছিলেন হাত পা গুটিয়ে নিঃশ্চুপ তিরোধানে।
১২০০ থেকে ১৩৫০ ছিল তার ক্রান্তিকাল,
কোন গান নয় কবিতা নয় শুধুই আকাল।
তেমনি মায়ের স্বভাব থেকে থেকে সন্তানের মধ্যে,
চাঁড়া দিয়ে উঠে কি কবিতা গান, কি গল্প পদ্যে,
তাই বুঝি কখনও কখনও থমকে থাকে কাব্য সময়,
তখন কেবলই দ্বীধা, কেবলই ভয় আর ভয়।
কবিতা কি আমায় দিয়েছে ছুটি?  
যদিও কাব্য লিখে আজকাল মেলে না রুটি!
তবুও পাগলের মত কবিতাকে ভালবাসি,
মা যে আমার কবি এবং কবিতায় বিশ্বাসী।
সব কালের কোলে বসে খেয়েছে দোল ধ্রুপদ
পরম আহ্লাদী মা আমার আহামরি চর্যাপদ।


১৩৫০ থেকে ১৮০০ খ্রীস্টাব্দ ছিল মায়ের মধ্য যুগ,
সে প্রান ছিল দেহের ভেতর কেবল ক্ষীণ ধুক্‌ ধুক্‌ ।
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” নিয়ে এ যেন যমুনার কলতান,
তবুও অন্তরে ছিল পরমপরার অনাদি আহ্বান ।
“আকুল শরীর মোর বে আকুল মন,
বাঁশীর শব দেঁ মোর আউলায়লোঁ রান্ধন।।”
মধ্যযুগের প্রথম প্রদীপ দেবতা পাঁচালী “মঙ্গলকাব্য”
চার মহাকবি তাঁদের কাকে নিয়ে যে ভাবব্য
বিদ্যাপতি, চন্ডিদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস
কবি শাহ্‌ মুহাম্মদ সগীর এর প্রথম প্রয়াস
ছন্দময় কবিতার “ইউসুফ-জুলেখা”
এরপর বাংলা সাহিত্যে আরও কত লেখা জোখা-
এবার কাব্যে এলো নতুন বিষয়, লাইলি-মজনুর কেচ্ছা,
রাজা প্রজা প্রশংসায় পুঞ্চমুখ,বলল- আচ্ছা বহুত আচ্ছা।
বাংলা ভাষার ঐতিহ্য আরও বৃদ্ধি পেয়ে হল নিরাপদ
পুরাতন থেকে নতুন হল মা আমার আহামরি চর্যাপদ।  


উনিশ শতকে সূচিত হল আধুনিক বাংলা সাহিত্য,
প্রথম গদ্য গ্রন্থ রাজরাম বসুর “প্রতাপাদিত্য চরিত্র”।
গদ্য-পদ্য তখন নাবালিকা, ছিল না দাড়ি,যতি চিহ্ন, কমা ,
তারপর কত কাব্য, গল্প নিয়ে কবিতার সেই মা-
দিনে দিনে ঐশ্বর্য্য আর হাজারও অলংকারে হল অলংকৃত,
সে অহংকার নিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি হল মহা আন্দোলিত ।
ইতিপূর্বে মা আমার পরলেন ঠাকুর বাড়ির মনিহার,
নভমন্ডলে নোবেল প্রাপ্তির আনন্দে পেলেন প্রকান্ড সিংহ দ্বার।
বাংলা ভাষা নিয়ে এলো ভাষা দিবস বিশ্বের দরবারে,
সম্মান পেল সকল মুখের ভাষা বাংলা ভাষার তরে।
রফিক শফিক জব্বার সালাম রক্তে গড়ল ইতিহাস,
উদবেলিত হল বুকের মধ্যে রাখা চাপা দীর্ঘশ্বাস।
মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা পেল বিশ্বময় স্বীকৃতি,
একে একে বাঙ্গলার ইতিহাস গড়ল বাঙ্গালিজাতি।  
বাংলা ভাষা হল তাই যেন মানবতার সম্পদ
কবিতার দুলালি মা আমার আহামরি চর্যাপদ।