প্রগতির আশীর্বাদে যেকোন সময়ের চেয়ে এখন শিল্প-সাহিত্যের চর্চা বেশি হচ্ছে। যেমন এই প্রগতির আশীর্বাদেই আমার মত অপেশাদার লেখিয়েও আজ বিষয়টি নিয়ে দু কথা পাঠকের সামনে বলতে পারছি। শিল্প-সাহিত্যের একটি অগ্রসরমান ধারা হিসাবে কবিতা কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই। অনেককেই বলতে শুনি; বাঙালি নাকি কাব্য-বিমুখ তাই কবিতার পাঠক কম। আমি মনে করি; অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন কাব্যচর্চা বেশি হচ্ছে। এখন যত মানুষ কবিতা রচনা করে প্রতিদিন বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ করছেন নিকট অতীতে তত পাঠকও ছিলো কি না সন্দেহ। প্রতিদিন অসংখ্য ব্লগ-পোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগ ও প্রিন্ট মিডিয়ায় মন্দ-ভালোয় মিলিয়ে প্রচুর কাব্য প্রকাশিত হচ্ছে। সেসবের পাঠকও অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে – এ বিষয়ে কারো কোন সংশয় থাকার কথা নয়।


কবিতা ও গান মিলিয়ে দুই বাংলা থেকে আমার তো মনেহয়; প্রতিদিন প্রায় হাজারের কাছাকাছি রচিত ও প্রকাশিত হচ্ছে! সেসবের সবই হয়তো ভাল মানের কবিতা নয়। যুক্তির বিচারে সে অভিযোগ মেনে নিয়েই বলছি; একজন স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত কবির সব কবিতাই কি আর ভাল মানের হয়ে উঠে? সেই সব প্রকাশিত কবিতার বেশির ভাগই মান বহির্ভুত বিবেচনা করে বাতিল করে দিলেও অন্তত কয়েক শ ভাল মানের গান-কবিতা নিশ্চয়ই টিকবে! দৈনিক হিসাবের এই কয়েক শ ই বা কম কীসের? অপুষ্ট, রুগ্ন-রচনা বাদ দিলেও মাসে কয়েক হাজার, বছরে প্রায় লাখ খানেক! বছরে লাখ কবিতা কি নিকট অতীতে কখনো হয়েছে? আশার কথা; দিন দিন এই সংখ্যাটা বাড়ছে বৈ কমছে না।


যারা কবিতার সাধক, কবিতা নিয়ে গবেষণা করেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি; আজকের এই অন্তর্জালিক (Internet) সুবিধার আধুনিক সময়ে সহজলভ্য ব্লগ-পোর্টালের কল্যাণে আমরা যে কেউ যেমন নিজেদের রচনা থেকে ভাবনা পর্যন্ত নিমিষেই প্রকাশ করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছি (এক দেড় যুগ আগেও কিন্তু বই, পত্রিকা কিংবা সাময়িকীর প্রকাশনায় সুযোগ পাবার জন্যে হা করে বসে থাকতে হতো। আর খুব কম ভাগ্যবানই সে সুযোগটা পেতেন।) তেমনি এখন এক ক্লিকে বিশ্ব-সাহিত্যের নাড়ি-নক্ষত্র ঘেটে দেখারও সুযোগ পাচ্ছি। ফলে বিশ্ব-সাহিত্যের সাথে পরিচিত হওয়া সহ তাকে সহজে জানার সুযোগ তৈরী হয়েছে। তেমনি নিজেদের সাহিত্যকে বিশ্ব-সাহিত্যের আঙ্গিকে যাচাই করার সুযোগটাও অবারিত হয়েছে। এর ফলে মন্দ-ভালো দুটো সম্ভাবনাই তৈরী হয়েছে।

সেই সুবাদে কেউ কেউ আমাদের ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যকে বিশ্ব-সাহিত্যের অপরাপর সাহিত্য থেকে কম অগ্রসরমান ভেবে রাতারাতি পরবর্তনের জন্যে উদ্বিঘ্ন হয়ে উঠেন। তাদের মনে রাখতে হবে; যেকোন সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্যই স্ব-স্ব পরিবেশ তথা - ভৌগোলিক অবস্থান, রাজনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক-মানবিক ও  অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতেই সৃষ্ট এক একটি প্রবহমান ধারা। এটা যুগে যুগে সৃষ্ট (ব্যতিক্রম কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া), রাতারাতি যেমন তৈরী হয়নি তেমনি রাতারাতি পরিবর্তনও সম্ভব নয়, কাম্যও নয়। এতে হীতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

শিল্প-সংস্কৃতির ধারাকে জোর করে পরিবর্তন করতে গেলে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ধারাটি হারিয়ে ভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণে সৃষ্ট শংকরধারাটি মানুষের মনন চেতনাকে বিভ্রান্ত করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সুতরাং, নিয়ম-শৃংখলার নামে যেমন অযাচিত কাঠিন্যের বাঁধ দেয়া উচিৎ নয় তেমনি তাকে জোর করে পরিশীলিত করে তুলতে চাওয়াটাও কাম্য নয়। সাহিত্য-সংস্কৃতি তার আপন ধারাটি চর্চাকারীদের অনুশীলন থেকে আপনা-আপনিই তৈরী করে নেয়। তাকে জোর করে প্রভাবিত করার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। কাজেই ধার করে নয় অথবা জোর করে অনুকরণে উদ্ভুদ্ধ হওয়াও নয়। নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখেও আপনাপন সংস্কৃতির উন্নততর চর্চার মাধ্যমে একে বিশ্বমানে উন্নীত করা সম্ভব।

আমি মনে করি; সাহিত্য-চর্চা কোন ধর্মীয় চর্চা নয় যে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুপালনীয়। এটি এক মননশীল চর্চা - মুক্ত গবাক্ষের খোলা হাওয়া এর জন্যে যেমন স্বাস্থ্যকর তেমনই সুখপ্রদ। তবে নিজেদের স্বার্থেই খেয়াল রাখতে হবে যেন; সেই খোলা গবাক্ষের সুযোগ নিয়ে কোন অবাঞ্চিত কিছু ঢুকে না-পড়ে। স্বাভাবিক গতি-প্রবাহে সাহিত্য যেখানে তার আপন অবস্থান তৈরী করবে, বুঝতে হবে সেটাই তার অধিষ্ঠান। তবে তাকে উন্নততর অবস্থানে এগিয়ে নেয়ার পথটা সর্বদা নিষ্কণ্ঠক ও মসৃণ রাখার দায়িত্বটা কিন্তু কবি-সাহিত্যিক বা শিল্পীদেরই। তাই বলে এ নিয়ে যে কোনরূপ উন্নাসিকতা বা বাড়াবাড়ি এর মঙ্গল বয়ে আনবে না বরং ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।


আর একটা কথা; সভ্যতা আর কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে আমরা অনেকেই গুলিয়ে ফেলি। কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং শিল্প-সাহিত্য সভ্যতার পরিমাপের অপর দশটা অনুঘটকের একটা মাত্র শাখা। বোঝার সুবিধার্থে একটা সহজ সূত্রে সভ্যতা আর কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে এভাবে মনে রাখা যায়:


সভ্যতা হলো - What we have? আমাদের কি আছে?
আর কৃষ্টি-সংস্কৃতি হলো What we are? আমরা কি?


আমরা কতটুকু সভ্য, তা যাচাইয়ের মাপকাঠি হলো – জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রুচি-মননে আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি কতটুকু উন্নত ও সমৃদ্ধ। অর্থাৎ জাতিগতভাবে আমরা কতটা সমৃদ্ধ কৃষ্টি-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। মৌলিক মানবিক প্রয়োজন মোকাবেলায় উৎকর্ষতার পাশাপাশি সমৃদ্ধ কৃষ্টি-সংস্কৃতির সম্মিলিত অর্জনই হলো সভ্যতা - What we have? অনেক ত্যাগ ও রক্তে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশ আছে আমাদের। পৃথিবীর বুকে ব্যতিক্রম ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি ভাষা ও গর্ব করার মত অনেক ঐতিহ্য আছে আমাদের। জাতিসত্ত্বায় আমরা বাঙালি - ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির গর্বিত ধারক বাহক। এর সবই হলো আমাদের সভ্যতা পরিমাপের প্রধান বিষয়াদি।


সুতরাং, আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে যত উন্নত করতে পারবো জাতি হিসাবে আমাদের সভ্যতা তত উন্নত বলে গণ্য হবে। কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সেই সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়ার কাজটি নিপুণভাবেই করে থাকেন। কাজেই কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীদেরকে অনেক বেশি পরিবেশ ও পরিস্থিতি সচেতন, দেশপ্রেমিক এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। তাঁদের কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। তাই শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকরা যেন সেই দায়বদ্ধতা যথাযথ পালন করেন সেই প্রত্যাশাই রইলো।


- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -  - - - - - - - - - -
** নিবন্ধটি কোলকাতা থেকে প্রকাশিত কবি রুমা ঢ্যাং সম্পাদিত ছোট কাগজ - 'শারদ খেয়া' (১ম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ১৪২৩)-তে প্রকাশিত।