ভাষাকে শুদ্ধ করে লেখার নানান উপায় ও নিয়মকানুনের জন্য ব্যাকরণ শেখা খুবই প্রয়োজন – একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বাস্তবতা হ’ল; কী ছাত্রজীবনে আর কী-বা কর্মজীবনে কমবেশি সবারই ব্যাকরণ ভীতি লেগেই আছে। কার কেমন লাগে জানি না, আমার তো ব্যাকরণের কথা ভাবতে গেলেই পালাই পালাই অবস্থা! আমি যা খুঁজে পেয়েছি তা হ’ল – আমার কাছে ব্যাকরণ কখনোই সুখপাঠ্য বিষয় বলে মনে হয় না।


ছাত্রজীবন কিংবা কর্মজীবনে তো নয়ই এমন কি সাহিত্য আসরে বিচরণের স্বার্থেও বারবার ব্যাকরণের দ্বারস্থ হয়ে দেখেছি, একে কোনভাবেই কোলে টেনে নিতে পারি না! এমন হবার কারণ কি? আমার কাছে মনে হয়েছে - চর্চার চেয়ে আমরা শেখার চেষ্টাটাই বেশি করে থাকি। আরে শেখা মানেই মুখস্ত করা বা হৃদয়ঙ্গম করা। কিন্তু বাস্তব অনুশীলনের অভাবে তা যেমন মননে পৌঁছুতে চায় না তেমনি সুখপাঠ্যও বোধ হয় না। তাই আমি বাস্তবতার নিরিখে যেটুকু শিখি সেটুকু চর্চার মাধ্যমে স্থায়ী করার প্রয়াস নিই। তাতে একদিকে যেমন ব্যাকরণ ভীতি কমে পাশাপাশি চর্চার মাধ্যমে খানিকটা উন্নতিও ঘটে।


আজ বলব বাংলা বর্ণমালার ব্যঞ্জনবর্ণের ‘ব’ অক্ষরটি নিয়ে কিছু কথা। শিশুকালে বর্ণ-পরিচয়ে দুটি ‘ব’য়ের সন্ধান পেয়েছিলাম; তার একটি ‘প’ বর্গের ‘ফ’ অক্ষরের পরে বসা ‘বর্গীয়-ব’ (বর্তমানে যার অস্তিত্ব আছে) অপরটি অন্তঃস্থ বর্ণের ‘ল’ অক্ষরের পরে আশ্র্রিত ‘অন্তঃস্থ-ব’ (বর্তমান বর্ণমালায় ‘অন্তঃস্থ-ব’য়ের অস্তিত্ব না থাকলেও প্র্রচুর বানানে এর প্রভাব কিন্তু বেশ গুরুত্ববহ)। একে আবার ‘অল্পপ্রাণ-ব’ হিসাবেও চিহ্নিত করা হত। আমাদের চিরাচরিত ব্যাকরণ সে বিষয়ে বিশদ কিছু বলেছে বলে আমার জানা নেই। স্বরবর্ণে ‘ঋ’য়ের পর (৯) ‘লী’ নামে অপর একটি বর্ণ ছিল (বর্তমানে নেই)। কী তার ব্যবহার ছিল তা কোন দিনই জানতেও পারি নি। বর্ণ পরিচয়ে কেবল দেখতাম ‘কাঠবিড়ালী’র বাঁকা লেজ দেখিয়েই একে পরিচয় করানো হত। ওই পর্যন্তই - অক্ষরটির বিষয়ে এরচে’ বেশি কিছু জানি না।


ফলা কাকে বলে?
ব্যঞ্জনবর্ণ বা যুক্তব্যঞ্জনবর্ণের নিচে আর একটি ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্ত হলে তাকে ফলা বলে। অর্থাৎ যে বর্ণটি যুক্ত হ’ল সেটিই ফলা। আমরা জানি; ব্যঞ্জনবর্ণে ৮ প্রকারের ফলা হয় যথা; ণ, ন, ব(বর্গীয়), ম, য, র, ল, ব(অন্তঃস্থ)। লক্ষণীয়; সব ফলাই ব্যঞ্জনবর্ণের নিচে বসলেও ‘য-ফলা’ কিন্তু বর্ণের পাশে বসে। আর য, র, ল, ব এই চারটি অক্ষর আবার অন্তঃস্থ বর্ণ।  


ফলার ব্যবহার ও প্রকারভেদ:
‘ণ-ফলা’= (অপরাহ্ণ, তীক্ষ্ণ);
‘ন-ফলা’= (অগ্নি, স্নেহ, মধ্যাহ্ন);
(বর্গীয়)‘ব-ফলা’= (শব্দ, জব্দ);
‘ম-ফলা’= (যুগ্ম, লক্ষ্মী);
‘য-ফলা’= (বর্ণের নিচে নয় পাশে বসে) যেমন – (অন্য, বাহ্য);  
‘র-ফলা’= (প্রিয়, ত্রাস, হ্রাস);
‘ল-ফলা’= (শুক্লা, ম্লান);
(অন্তঃস্থ) ‘ব-ফলা’= (স্বয়ং, ধ্বনি)।


এখানে ‘ব-ফলা’ দুই রকমের; ‘ব’ অক্ষরটি যখন কোন ব্যঞ্জনবর্ণের নিচে বসে তখনই সে ভেলকি দেখায়। সেই জন্যেই ‘অন্তঃস্থ-ব’ এর বিষয়ে কিছু জানা প্রয়োজন।


বিদ্বান, দ্বিতীয়, ধ্বনি, তন্বী, বিশ্ব, দ্বন্দ্ব, নিস্ব, স্বপ্ন, দ্বার ইত্যাদি শব্দে দেখুন ‘ব’-ফলায় ‘ব’য়ের উচ্চারণ নেই – অর্থাৎ এখানে ফলা’র ‘ব’গুলো সবই ‘অন্তঃস্ত-ব’ - যার উচ্চারণ ইংরেজি ‘W’ অক্ষরের মত।


আবার - নিঃশব্দ, উদ্বেল, চুম্বক, বুদ্বুদ, অব্দ, উদ্বৃত্ত, জব্দ, দিগ্বিজয় ইত্যাদি শব্দে ‘ব’য়ের সশব্দ উচ্চারণ বিদ্যমান – অর্থাৎ এখানে ফলা’র ‘ব’গুলো সবই ‘বর্গীয়-ব’ - যার উচ্চারণ ইংরেজি B অক্ষরের মত।


বর্ণীত ‘ব’ অক্ষর দুটি কিন্তু দেখতে ও লিখতে অবিকল এক কিন্তু দুয়ের ব্যবহার ও উচ্চারণে বিস্তর ফারাক আছে। ব্যাকরণ থেকে শেখা নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে; ‘অন্তঃস্থ-ব’ মূলত অবাঙালী (আরবি, ফারসি, হিন্দি, উর্দু ইত্যাদি থেকে আগত) ভাষার নিখুঁত উচ্চারণের স্বার্থেই ব্যবহৃত হত। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উদাহরণ দিচ্ছি:


Cricket Club of India (CCI) Dinsa Waccha Road, Bombay (অধুনা Mumbai)-তে এক বন্ধুকে চিঠি লিখতাম। দিব্বি চিঠি যাচ্ছিল, সমস্যা বাঁধল যখন ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে দেখা করতে গেলাম। ভুল উচ্চারণের কারণে কেউই আমাকে সাহায্য করতে পারছিল না। Waccha’র স্বদেশি উচ্চারণ ‘ওয়াচা’ বলায় হিন্দিভাষী কোন বন্ধুরই সাহায্য পেলাম না। অবশেষে স্বনামধন্য Cricket Club of India নামটিই সেবারে আমায় রক্ষা করেছিল।


ওখানে সমস্য কি ছিল? সমস্য ছিল Waccha’র উচ্চারণ ‘ওয়াচা’ নয় বরং (‘অন্তঃস্থ-ব’য়ের উচ্চারণে ‘বাচা’ যা – ‘ওয়াচা বা ভাচা’র উচ্চারণের কাছাকাছি। যেমন; আরবি ‘ওয়াও’ হরফের নিচে ‘জের’ প্রয়োগে যেরূপ উচ্চারণ হয়) যেমন ‘মোসাব্বির’ (এখানে দুটি ‘ব’ই ‘অন্তঃস্ত-ব’), তদ্রুপ; নওয়াব>নবাব, জওয়াব>জবাব, ভিক্রম>বিক্রম, তালাউ>তালাব (পুকুর অর্থে), তানভীর>তানবির, তসভীর>তছবির (ছবি অর্থে), ভওন>ভবন... উল্লেখিত শব্দগুলোতে একটি করে ‘অন্তঃস্থ-ব’ রয়েছে – যার উচ্চারণ্ ইংরেজী ‘V’ অথবা ‘W’ এর কাছাকাছি। বর্তমানে একমাত্র ফলা ছাড়া আর কোথাও ‘অন্তঃস্থ-ব’য়ের (ব্যবহার থাকলেও) অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।


আজ এ পর্যন্তই থাক। অন্যদিন ভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে হাজির হবার বাসনা রইল। ততক্ষণ চর্চা অব্যাহত রাখুন। শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ সবাইকে -