কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য; যার পৈতৃক নিবাস ছিল আমাদের ফরিদপুরের কোঠালিপাড়ায়। বিপ্লবী ভাবধারার এই কবি মাত্র একুশ-বছর(১৯২৬-১৯৪৭)বয়েসে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।


কবিতার আসর সূত্রে জানতে পারি সদ্যপ্রয়াত আমাদের নবীন কবি ‘স্বার্থপর ছেলে’ মাত্র উনিশ-বছর বয়েসে (৩ জুন. ২০১৫) মৃত্যুবরণ করেন।


বাংলা-কবির-পাতা থেকে পাওয়া তথ্য মোতাবেক -
“স্বার্থপর ছেলে ২ মাস হলো বাংলা-কবিতায় আছেন।এখন পর্যন্ত তিনি কবিতার আসরে ২৭টি কবিতা প্রকাশ করেছেন।“


বস্তুতঃ আসরের এই কবির কবিতার সংখ্যা বা কাব্যমান নিয়ে এই লেখা নয়। সুস্থ-বোধের একটা মানুষ যে কতটুকু স্বজ্ঞানে ও উপলব্ধি পূর্বক কী নির্মমতায় মৃত্যুকে অবলোকন করেছেন আর তিলে তিলে মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখেছেন তা তার কয়েকটি রচনা থেকে উদ্ধার করতে পেরে মরমে গভীর ব্যথা অনুভব করেছি। সেই তাগিদ থেকেই তার মৃত্যু ও মৃত্যু-বিষয়ক কষ্ট আর সেই বিভীষিকার চিত্রটি পাঠক সম্মুখে তুলে ধরার জন্য এই প্রয়াস:
----------------------------


মৃত্যুর বিভীষিকাকে পায়ে পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে গত ১২/০৫/২০১৫ তারিখে তিনি লিখেছেন:


[নিষ্ঠুর পৃথিবীর কাছে পরাজয়]


এই নিষ্ঠুর পৃথিবী কি দিয়েছে আমায়
ঘৃণা, দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্চনা ব্যয়তীত
প্রতিনিয়ত হতে হয়েছে আমায় প্রতারিত, লাঞ্চিত, অপমানিত
ঠুকরে ঠুকরে আমার সর্বস্ব শেষ করে দিচ্ছে
তিলে তিলে আমাকে মেরে ফেলছে
আমার সাজানো স্বপ্নগুলোকে এক নিমেষে বিলীন করে ফেলেছে
আমার সাজানো পৃথিবীটাকে এক মুহূর্তে চুরমার করে দিয়েছে
আমার বুক খালি করে সমুদ্র পরিমাণ দুঃখ দিয়েছে
সেই সমুদ্রের পানি আমার চোখ দিয়ে পড়ে আমার বুক ভিজিয়ে ফেলে
সামান্যম কিছু জিনিস আঁকড়ে ধরে বাচঁতে চেয়েছিলাম
এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে টানাপড়েনের খেলায় তাও হারিয়েছি
আমি যতবার জিততে গিয়েছি
এই নিষ্ঠুর পৃথিবী ততবার আমাকে হারিয়েছে
আজ আমি হারতে হারতে ক্লান্ত
এই টানাপড়েনের খেলায় নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে
নতুন উদ্যোুমে সবকিছু শুরু করার মতো শক্তি আমার মধ্যেি আর নেই
বারবার হারতে হারতে আজ আমি সেই শক্তি হারিয়ে ফেলেছি
তাই চলে যাবো এই নিষ্ঠুর পৃথিবী ছেড়ে
ঐ দুর আকাশের তারা হয়ে
ভেবেছিলাম এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়ে জয়ী হবো আমি
তবে আজ আমি আমার পরাজয় স্বীকার করছি
এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার সাথে আমি আর পারলাম না
এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার কাছে আমি পরাজিত


• ওফ্- জীবন ও নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রতি কী নিদারুণ ক্ষোভ আর জ্বালা নিয়েই না তিনি এমন করে লিখছেন। একটা মানুষের জীবনে এরচে’ কঠিন বাস্তবতা আর কি থাকতে পারে! এভাবে মৃত্যুকে অবলোকন করে একটা আশাহীন মানুষ আর কীভাবে মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে!


------------------------------


মৃত্যুকে যখন তিনি একেবারেই সন্নিকটে দেখতে পাচ্ছিলেন, তখনো কী স্বজ্ঞানেই না তিনি ০১/০৬/২০১৫ তারিখে লিখতে পেরেছিলেনে:


[মৃত্যু  দুয়ারে]


উনিশটা বছর ধরে হেঁটেছি জীবনের পথে
হাঁটতে হাঁটতে আজ জীবন-পথের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছেছি


দু’চোখে হাজারো স্বপ্ন ছিল আমার
আজ সব ভেঙে-চুরে চুরমার


অনেক কিছু করার ছিল জীবনে
কিছুই আর করা হয়ে উঠল না


রোগটা আমার দেহ গ্রাস করে ফেলেছে
আর কিচ্ছু করার নেই সময় গোনা ছাড়া


চেয়েছিলাম - ঐ দুর আকাশের তারাদের ধরতে,
আর কিছুদিন পর নিজেই হয়ে যাবো ঐ দুর আকাশের সবচেয়ে উজ্জল তারা


যখন আর বাঁচতে চাই নি
তখন জীবনের পথের শেষ সীমানা অনেক খুঁজেও তার দেখা পাই নি
আজ যখনই বাঁচতে চাইলাম যখনই মনে একটু বাঁচার আশা জাগল
তখনই এসে পরল মৃত্যুই দুয়ারে...


• অভিব্যক্তির এই যে প্রকাশ - তা কী নির্মম, কী কষ্টের, হৃদয়-বিদারক আর বিভীষিকাময় তার সীমা পরিমাপ করা কঠিন। একমাত্র ভোক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বোঝার কথা নয়। অথচ তিনি সজ্ঞানে সবই বুঝতে পারছিলেন কিন্তু নিয়তির কাছে এতই অসহায় ছিলেন যে কিছুই করার ছিল না তার। তবু তিনি ব্যতিক্রম স্বাক্ষর রেখে গেছেন যে, তার মৃত্যুকালীন সময় ও পর্বগুলোতে তার মনের কথাগুলো সুন্দর ভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে আজকের জীবিত মানুষদের জন্য লিখে রেখে গেছেন। তাই আমরা তার অভিব্যক্তির কথা পড়তে পারছি। সত্যিই তিনি আজ নিজেই হয়ে গেছেন ‘ঐ দুর আকাশের সবচেয়ে উজ্জল তারা’!


----------------------------


যখন তিনি বুঝতে পারছিলেন - আর সময় নেই, এখনই বিদায় নিতে হবে। কিন্তু মৃত্যুর পর তো আর অনুভূতির কথা লিখে প্রকাশ করার কোন সুযোগ নেই! তাই নিচের লেখাটি লিখে তার কোন এক নিকট বন্ধুকে নিজের আইপি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে অনুরোধ করে গেছেন যেন লেখাটি তার মৃত্যূর পর আসরে পোস্ট করা হয়। তার মৃত্যুর পূর্বে লিখে যাওয়া কবিতাটি ০৩/০৬/২০১৫ তারিখে সেই নিকট বন্ধু পোস্ট দিয়ে তার শেষ আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করেন:


[প্রয়াত স্বার্থপর ছেলের শেষ কবিতা]


স্বপ্ন ছিল তারকা হবার
তবে ঐ দুর আকাশের তারা যে হয়ে যাব তা ভাবি নি
বহু কষ্টেও নিজেকে সামলে নিয়েছি


আজ বুঝি আর সামলাতে পারবো না
এই মা হারা ছেলে আজ


দুনিয়া ছেড়ে যাবে
ভালোবাসার মানুষটিকেও পাই নি


তবুও হার মানি নি
তবে আর নয়, বিধাতা থামিয়ে দিল


বিধাতার কাছে হার মানতেই হলো
বিদায় সকল কে


বিদায় দিয়ে দিলো আমায় এই পৃথিবী
আর একটি দিনও পেলাম না


মায়ের কোলে ঘুমানোর জন্য  
আর একটি মুহুর্তও পেলাম না


ভালোবাসার মানুষটিকে জড়িয়ে ধরার জন্য  
ভালো থেকো সবাই


আমি আর নাই
মৃত্যু এসে গেল দুয়ারে


বাঁচতে আর পারলামনা
জীবনের নিয়ম মেনে সব কিছুই ঠিক থাকবে
আজ থেকে শুধু আমি আর থাকবো না


কবিতার ফুটনোটে ছিল সেই নিকট বন্ধুর ভাষ্য:
[আমি স্বার্থপর ছেলে নই ।। আমি ওর কাছের বন্ধু।। এটা ওর লেখা শেষ কবিতা ।। ও অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগে আমাকে এটা পোস্ট করতে বলে যায় ।। ও আজ দুপুরে মারা যায় ।। ওর ব্রেইন টিউমার হয়ে ছিলো ।। ওর বয়স মাত্র ১৯ ছিল ।। আমরা সবাই গভীর ভাবে শোকাহত ওর অকালমৃত্যুপতে ।। আপনারা সবাই ওর জন্য  দোয়া করবেন]


----------------------------


মৃত্যুর ঠিক পূর্বমুহূর্তে – ধীর-পায়ে মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখা আর তার স্বজ্ঞান-প্রকাশ ঘটাতে পারে খুব কম মানুষই। জীবনের শেষ আকাঙ্ক্ষার কথা এমন ভাবে প্রকাশ করে যেতে পারে ক’জন? ‘স্বার্থপর ছেলে’ চলে গেছেন কিন্তু তারকা হওয়ার মতই কবিতার আসরে পোস্ট দেয়ার জন্য তার শেষ কবিতাটাও রেখে গেছেন। এমন পরিকল্পিত আর সাজানো-গোছানো প্রস্থান যেন মহামানবের কথাই স্মরণ করায়! এই পৃথিবীর জীবিত মানুষ আমরা তার জন্য আর কিছুই করতে পারব না। বড়জোর তার বিদেহী-আত্মার শান্তি কামনা করতে পারি। ‘স্বার্থপর ছেলে’ তোমায় জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা আর ভালবাসা। যুগ-যুগ জিয়ো বন্ধু।