আমি সূর্য বানু
বয়সের ভারে নতজানু
তোমাদের মাঝে হয়নি কোন ঠাঁই
রাস্তার ধারেই শুয়ে থাকি, ভাঙ্গা চুলোয় রেঁধে দুমুঠো খাই।
পায়ে নেই বল, গায়ের শক্তি হয়ে গেছে ক্ষয়,
ভুগি রোগে-শোকে, লাগে এখনও লোকলজ্জার ভয়।
ভাঙ্গা ঘরে জ্বলে শুধু প্রদীপের মিটিমিটি আলো,
কেউ আসে না দেখতে, আমি কতটা আছি ভালো!


সত্তর পেরিয়ে গেছি কবে,
কবে যে মরণযাত্রা শুরু হবে!
চোখ, কান, হাত, পা, সব যেন শেষ।
আমার জীবনে নেই এতটুকু ভালো থাকার রেশ।
অনাহারে-অর্ধাহারে পড়ে থাকি একা,
স্বামী গেছে ছেড়ে ঐ পরপারে,
দুঃখ বেদনা যেন নিয়তির লেখা।
সব হারিয়ে শুধু কলঙ্কিনী আমি আয়মনা
শয্যাশায়ী আমি, করি মৃত্যুই কামনা।


সংসার বলে কাকে বুঝিনি তখনও
কোমল হাতে পরেছি লাল নীল চুরি
কোথা থেকে এলো সব শুকুন যে উড়ি
চোখের পানিতে ঢাকি সেই লজ্জা এখনও।
কেউ শুনেনা আমার সে কষ্টের বাণী,
আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদি আমি চম্পা রানী।


তরুণী আয়েশা আমি
স্বপ্ন ছিল কত!
সুখের সংসার হবে এক
ভাবি অবিরত।
সব আশা ভেঙ্গে গেল, সব মনোবল,
আমায় লুটিয়ে নিল হায়েনার দল।
স্বামী ছাড়া, দিশেহারা, করবো কী যে আমি!
শেষ জীবনে কী আর হবে, জানেন অন্তর্যামী।  


চৌদ্দ বছরে আমি, চপলা, চঞ্চলা ছোট জয়গুন,
আমায় পুড়িয়ে করে গেছে ছাই,
সম্ভ্রম সে হারিয়েছি কবে!
সবার মাঝে থেকে বাঁচবার অধিকারও নাই।
দুচোখে আসে না ঘুম, থেকে থেকে লাগে শুধু ভয়,
মানুষ কখনও এমন হিংস্র হয়?
নির্মম যা ঘটেছিল সেই ছেচল্লিশ বছর আগে
এখনও তা ভেবে ভেবে কত ঘৃণা জাগে!


চৈত্রের কোন এক পরন্ত দুপুরে
ঘর ছিল, সংসার ছিল, স্বামী গিয়েছিল কাজে,
ছোট শিশুটা ছিল শুয়ে বিছানার উপরে,  
স্নান করতে গেছি ঘর-ঘেঁষো পুকুরে,  
আমায় যে শেষ করে দিল মনুষ্য কুকুরে।
সব শুনে স্বামী হল বাকহারা লজ্জায়,
নিজেরে ঢলিয়ে দিল তার শেষ সয্যায়।
গ্রাম ছাড়া, সমাজ ছাড়া, কাটাই আজ দিনক্ষণ,
মরে যেন বেঁচে আছি কলঙ্কিনী করিমন।


কান্নাই বুঝি পাওনা ছিল,
দুচোখ ভরে জলে, করে ছলছল
আমি তো অমানুষ এক,
মানুষের সমাজে আমাকে জায়গা কে দেবে বলো?
তোমরা পেয়েছো দেশ,
সবে মিলে আছো বেশ!
আমার’তো সম্ভ্রমটুকুও নাই,
আমারও সব ছিল,
স্বামী ছিল, সংসার ছিল, ছোট এক সন্তানও ছিল।
কোথা থেকে নরপশু এসে সব যে লণ্ডভণ্ড করে দিল।
একাত্তরের দুপুরে সেই যে নেমেছে দুর্ভাগ্যের কালো
আমাকে করেছে শেষ, কখনও থাকতে দেয়নি ভালো।
‘ষাট পেরিয়ে গেছি, কিছু সাহায্য কর আমায়, রহিমা আমার নাম,’
এ কথা বলতে গেলে লোকে বলে, “ওহ তুই! ওরে পোড়ামুখী থাম!’
লাঞ্ছনা, গঞ্জনা শুধু আস্টে পিষ্টে ধরে,
পেটে যে ক্ষুধার জ্বালা, কবে যাবো মরে?


সেদিন ছিল উঠোন ভরা রোদ,
মায়ের সাথে বসে করছিনু রান্না,
কী যে হয়ে গেলো! শুধু চোখে ছিল কান্না।
কিশোর বয়স ছিল, চঞ্চলতাও ছিল,
চোখের পলকে যেন সব ছাই করে দিল।
মাকেও তুলে নিয়ে গেলো,
বন্দুকের মুখে জীবন দিল মোর বৃদ্ধ বাপ,
এখনও বয়ে বেড়াই আমি সেই কালো অভিশাপ।
গ্রামে গ্রামে কাপড় বেচি, খাদ্যও তো চাই।
নিজেরে নিজেই দেখি, দেখার তো কেউ নাই।
স্বাধীন দেশেও বলো কী বা আর পানু?
তাই এক কোণেতে পড়ে থাকি সব হারানো ভানু।


সেই তো একাত্তরে আমি সম্ভ্রম হারিয়েছি,  
আজ আমি ঘরে ঘরে কাজ করার ঝি।
কখনও কখনও মিলে বসে সুতা কাটি।
হায়েনার দল এ জীবন করে দিছে মাটি।
কম মারেনি স্বামী আর সৎ ছেলে মেয়ে,
এখনও তো বেঁচে আছি এক-দু বেলা খেয়ে।
শরীরে রোগ দানা বেঁধে ভুগি আমি শোকে,
নুরজাহানটা কেমন আছে, তা ভাবে না লোকে।


তালাবদ্ধ দুয়ারখানি লাথি মেরে খুলে
হানাদারের পাষণ্ডরা নিয়ে গেল তুলে।
মানটুকুও গেলো চলে, সব হারালাম আমি,
আমারে একা ফেলে চলে গেলো স্বামী।
কেন যে মুখে তুলে নেইনি বিষদানী
এ সমাজেই রয়ে গেছি ধরে প্রাণখানি।
হাসিনা বেগমের ভাগ্যে ঘোরে কষ্টের যাতা,
হাত বাড়িয়ে বসে থাকি, পাবো কি আমি বিধবা ভাতা?


একাত্তর নিয়ে গেছে সব, দিয়ে গেছে কালি,
আজ হামিদার চার পাশ জনশুণ্য, খালি।
দুবেলা দুমুঠো খেয়ে শুধু বেঁচে থাকা,
রোগে ভুগি, কোথায় পাবো ঔষধের টাকা?
ডোগি ডোগি করেই হয়তো কিছু টাকা পাই,
স্বামী সন্তানহীনা আমি শুধু কেঁদে যাই।
কেউ তো আসে না নিতে এই হামিদার খবর,
মরে গেলে এসো সবে, দিয়ে যেও কবর।


হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে
আমি তো সম্ভ্রমহারা, জীবন কাটে কীর্তন করে।
স্বামী হয়েছে গত, আছে তিন ছেলে মেয়ে,
লজ্জা ঢাকে তারাও আমি থেকে দূরে যেয়ে।
আমি আর তবলা-ডুগি, ঘরেতে দিয়েছি তালা,
কী করে যে বেঁচে আছি, তা জানে এই রাজুবালা।


পশুর দলে সদলবলে ক্যামনে জানি এলো
পায়ে পিষে জীবনটারে ভস্ম বানায় গেলো।
গুলি দিলো স্বামীর বুকে,  
আগুন দিলো আমার সুখে,  
সব হারিয়ে জীবন আমার শুধু এলোমেলো।
এই হাজেরার দিন যে কাটে লাঠি হাতে খুঁড়িয়ে,
মরণ বুঝি এসেই গেলো, গেছি কত বুড়িয়ে!  


শক্ত হাতের ধাক্কা বুঝে দুয়ার দিলাম খুলি
সবকিছু তো লুটেই নিল, করলো আবার গুলি।
এখনও সেই গুলি আমি বই যে আমার শরীরে,
দু চোখ বেয়ে অশ্রু নামে, কখন যে যাই মরি রে।
ছয়টা টিনের ঝুপড়ি ঘরে কষ্টে আছি বাঁচিয়া,
ধুঁকে ধুঁকে আর কতদিন বাঁচবে বৃদ্ধা আছিয়া?


সূর্য উঠার আগেই আমি উঠি,
চেয়ারম্যানের বাড়ি যাই ছুটি,
এ সমাজে সবাই আমাকে করে হেলা,
কাজ না করলে খাবার জোটে না দু’বেলা।
শরীর চলে না আর, তবু কাজে আমি থামি না।
এভাবেই বেঁচে আছি, সব হারানো সামিনা।


সে দিনের ভয়াল স্মৃতি
আমার পেছনে আজও যেন ছোটে,
স্বামীকে বেঁধে রেখে
আমার উপরে নরপশুদের সেই নির্যাতনের কথা ভাবলেই
বুকটা ধরফর করে ওঠে।
এ লজ্জা ঢাকবো কিসে?
কষ্ট যে ধরেছে পিষে।
সে যন্ত্রণা কি করে যাই ভুলি?
দুঃখে কষ্টে বাঁচি সুরাইয়া বেগম ধুলি।


ঝুপড়ি ঘরে একলা থাকি, শরীরটাও যে শীর্ণ,
তিনটা টিনের ঘরের ভিতর জীবন বড় জীর্ণ।
রোগে-শোকে, অর্ধাহারে দিন কাটে না, বাবা।
কেউ কি আমার মরার তরে বিষটা দিয়া যাবা?
কমলা বানুর জীবনটা যে হয়ে গেছে ছাই,
লোকলজ্জার ভয়ে বলো, কোন দিকেতে যাই?
স্বাধীন দেশের মানুষগুলাও ক্যামনে এমন হয়?
এখন খালি মরণ ছাড়া চাওয়া কিছু নয়।


জ্বলেছি সেই একাত্তরে
এখনও তো জলছি।
শেষ বেলাতে মাথা তোলার সম্মানটুকু দাও,
কেউ কি এ আকুতি শুনতেও না পাও?
ছেচল্লিশ বছর পরেও
কেন এতো জ্বলছি?
আমরা বঙ্গকন্যা, বঙ্গমাতা, বীরাঙ্গনা বলছি।