বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিক, গল্পকার ও বিশিষ্ট সমাজসেবক মরহুম ড. মির্জা মাসুদ হোসেন ১৯৫৪ সালের ১ এপ্রিল ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে (৯৩ নিউ সার্কলার রোডে আবস্থিত তার নিজ পৈতৃক নিবাস লিলি প্লাজা তে) জন্মগ্রহন করেন। সেখান থেকেই মূলত তার জীবনের গল্পের প্রারম্ভ। লেখকের ডাকা নাম ছিল টিটো। তার পিতার নাম মরহুম মির্জা মোরছাল হোসেন ও মাতা মরহুম শামসুন্নাহার লিলি। তার পিতা মরহুম মির্জা মোরছাল হোসেন তৎকালীন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যারয়ের স্নাতক ডিগ্রী অর্জণ করনে ও একজন সৎ কাস্টমস্ অফিসার হিসেবে সুনামের সাথে কর্মময় জীবন অতিবাহত করেন। তার মাতা মরহুম শামসুন্নাহার লিলি ছিলেন বিশিষ্ট সেতার বাদক (বাফা, নজরুল একাডেমি)। লেখকের একমাত্র ছোট বোন মরহুম ডাঃ আখতার জাহান মির্জা দিপু ছিলেন বোর্ড স্ট্যান্ডধারী এবং আখতার জাহান মির্জা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। লেখক ও গল্প রচয়িতা মরহুম ড. মির্জা মাসুদ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মান ও স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমবিএ ও পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। এরপরেও থেমে থাকেনি তার জ্ঞান অর্জনের অভিযাত্রা। ইনফরমেশন টেকনোলজী, পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট ও মার্কেটিং এ তিনি সফলতার সাথে পোষ্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী অর্জন করেন। ছাত্র জীবনে তিনি ছিলেন একজন ভাল এ্যাথলেট ও দক্ষ তবলা বাদক। তিনি ছিলেন মাসিক প্রতিফলন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক এবং প্রতিফলন মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন এর প্রধান নির্বাহী।


ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তা এবং অত্যান্ত সৎ, সুন্দর ও পরিশিলীত জীবন যাপনে অভ্যস্ত একজন আদর্শ মানুষ। তিনি ছিলেন যেমন সৎ সাহসী, ঠিক তেমনি আকাশের মত বিশাল হৃদয়ের অধিকারী একজন উদার-মানবতাবাদী ও দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের অধিকারী সমাজ ও সংস্কৃত বান্ধব মানুষ। তিনি আমৃত্যু বিপদে-আপদে, সুথে-দুঃখে অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন বন্ধু ও আপনজনের মত। মানবিতার যে উজ্জ্বল স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তার আলোকচ্ছটায় সমাজে সৃষ্টি হতে পারে হাজারো দাতা ও সমাজসেবক। একজন সফল সংগঠক হিসেবে তিনি লায়নীজম, মাদকদ্রব্য বিরোধী আন্দোলন, এইডস আন্দোলন ও বিশটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১১ সালে সূবর্ন প্রকাশনী থেকে ‘গল্প সমগ্র’ নামে একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় এবং সুধীজন ও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হন।এই গ্রন্থে তিনি মোট পনের টি গল্প সন্নিবেশিত করেন। কেউ কি কনাকে বুঝবে না?; হিংস্র থাবা; বুকের দিকটা অক্ষত ছিল; চেতনা; বিপন্ন অধিবাসীরা; ঝরা পাতা; স্মৃতি উড়ে যায় আবার ফিরে আসে; হতাশ; খুনী; শামুক কুড়ানো;  অপেক্ষা; নববর্ষ; বন্যা; মা ও যখন যেমন তখন তেমন নামে মোট পনেরটি অসাধারন, নান্দনিক ও শিল্পসম্তত গল্প রচনা করেছেন যাতে মানুষের বৈচিত্রময় জীবনের নানান দিক কে বাস্তবতার নিরিখে উপজীব্য করে তুলেছেন। তার লেখা গল্পসমূহ অত্যান্ত শিক্ষনীয় । জীবনের দার্শনিক সত্যকে তিনি গভীর অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করেছেন এবং জীবনের সূদীর্ঘ অভিজ্ঞতার নিরিখে সৃষ্টি করেছেন নতুন ও চিত্তাকর্ষক গল্প। তার লেখায় আছে বাস্তবতার সাথে মানুষের খাপ খাইয়ে চলার সক্ষমতার শক্তি, প্রেম, ভালবাসা, প্রকৃতি, মা, মাটি, স্বদেশ, বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য, সুবিধাবঞ্চিত, ক্ষুধাপীড়িত মানুষের কথা ও জয়গান। সার্বিক বিবেচনায় তার লেখা শিল্পসম্মত ও সফল রচনা বলে আমি মনে করি। পাঠক হিসেবে তার লেখা আমাকে দারুনভাবে অনুপ্রানিত করেছে। লেখককে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তার সততা আমাকে মুগ্ধ করেছে বারবার। তার রাজ্যে তিনিই ছিলেন একজন রাজা। তিনি এক রাজকন্যা ও এক রাজপুত্রের জনক। বড় কন্যা নাহরীন মির্জা তৃষা বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। নাহরীন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজি তে স্নাতক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। তুখোর মেধাবী নাহরীন এর লক্ষ্য ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ এবং সম্প্রতি তিনি সে পথের সূচনাও করেছেন যুক্তরাষ্টের একটি বিশ্ববিদ্যারয়ের স্কলারশিপ লাভের মধ্য দিয়ে। তার একমাত্র পুত্র মির্জা মুন্নাফ বেগ ব্যারিস্টার হবার স্বপ্ন জয়ের পথে এখন নিউ ক্যাসেল ল’একাডেমি তে এলএলবি শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র। লেখক এই দু’জন সুসন্তানের গর্বিত জনক। লেখকের স্ত্রী মোসলেমা আক্তার মির্জা টুকটুক বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের যথাক্রমে বিশেষ ও প্রথম বিভাগের একজন নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীত সাধক। তিনি ছিলেন তার সন্তানদের কাছে একজন আদর্শ পিতা এবং স্ত্রীর কাছে একজন আদর্শ ও দ্বায়িত্ববান স্বামী। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর অধিকার সংরক্ষনের বিষয়েও ছিলেন সদা সজাগ।


তিনি ছিলেন নাকোল ডিগ্রী কলেজ, মাগুরার প্রতিষ্ঠাতা। সাবেক সভাপতি, নাকোল ডিগ্রী কলেজ। বিজিএমই- এর সাবেক সদস্য; চেয়ারম্যান, হেলথ্ এন্ড ভলান্টারী সেন্টার; চেয়াম্যান, এইডস এন্ড নারকোটিকস কন্ট্রোল ফাইন্ডেশন; চেয়ারম্যান, মির্জা মাসুদ হোসেন ফাউন্ডেশন; সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ এন্ট্রি ড্রাগ ফেডারেশন; সাবেক সভাপতি, লায়ন্স ক্লাব অব ঢাকা-মতিঝিল; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন; জি.এস., অ্যাডাপ্স সয়েল সাইন্স এক্স স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); এক্স-জিএস (প্রতিষ্ঠাতা)- এক্স শাহীন; ডাইরেক্টর, সুইড, ঢা.বি. ট্রাস্ট; জীবন সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ এইডস নারকোটিকস এন্ড টোবাকো কন্ট্রোল সোসাইটি- সহ আরো অনেক সামাজিক সংগঠনেরর সাথে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।
বর্নাঢ্য জীবন শেষে গল্পকার ও বিশিষ্ট সমাজসেবক মরহুম ড. মির্জা মাসুদ হোসেন টিটো আজকের এই দিনে, ২০১২ সালের ৫ জুন রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে তার বনানী পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাতের জন্য তার স্ত্রী-পুত্র ও কন্যা দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থণা করেছেন। তার চতুর্থ মৃত্যবার্ষিকীতে আমরাও তাকে স্মরন করছি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়। সেই সাথে পরম করুনাময় ও মহান দয়ালু আল্লাহর কাছে তার জন্য জান্নাতুল ফেরদাউস কামনা করছি। তার জন্য সমগ্র বাঙালি তথা সাহিত্য ও সমাজসেবকগণের পক্ষ থেকে জানাই গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞলি।


লেখক: কবি ও লেখক
talukder84@yahoo.com