একটি মেয়ে, গাঁয়ের মেয়ে, গায়ের রঙটা
অমাবশ্যা রাতের মতো আঁধার কালো।
তবু মেয়ের ভ্রমর কাজল চোখ দুটিতে
জ্বলতো যেন কিসের আলো। সবাই তাকে
আদর করে চান কপালি, কৃষ্ণ কলি বলেই ডাকে।
সেই মেয়েটির অভাব ছিলো, ভাতের অভাব
হাড়ি ভরা দুঃখ ছিলো, ভাতের বদল
তবু যে তার স্বপ্ন ছিলো আকাশ সমান।
বুকের মাঝে উঁকি দিতো অন্যসকল মেয়ের মতো
তারও একটা বিয়ে হবে, সংসার হবে আপন মনে
আয়না দেখে একাই সাজে একাই হাসে খিলখিলিয়ে।


তেল পড়ে না মাথার চুলে, তবু মেয়ে হেলেদুলে
হৈ-হুল্লোড়ে পাড়াখানি মাথায় তোলে। মেয়ের গায়ে-
দখিন হাওয়া, মাঠের সবুজ ধানের মতো
বুক জুড়ে তার, উঁচু নিচু ঢেউয়ের দোলা
দুই চোখে তার পদ্ম পুকুর, মনের আকাশ-
বৃষ্টি শেষের দিনের মতো উজ্জ্বলতায় রঙ ছড়ানো।
দুই পায়ে তার জলের নূপুর, দিনগুলো তার
দীর্ঘতর ঘুঘু ডাকা মন কেমনের উদাস দুপুর।


শস্যে ভরা, বুকের বাগান, এই মেয়েটির নজর কাড়ে
সেই গাঁয়ের এক ধনীর দুলাল। পতঙ্গরা
যেমন করে আটকা পড়ে আলোর ফাঁদে
তেমন করে সেই মেয়েটি নোটের গন্ধে মাতাল হলো
পেটের ক্ষুধা নির্বাসনের আশা নিয়ে হাত বাড়ালো
মন রাঙালো অলীক সুখের প্রজাপতির হরেক রঙে
সরল মনে ধুকুরপুকুর মনের ভেতর সঙ্গোপনে
বাবুই পাখির বাসা বোনে আপন মনে আর সে সুখের
দিন যাপনের প্রহর গোনে চলতে থাকে প্রেমের খেলা।


কদিন বাদেই সেই ছেলেটি হঠাৎ উধাও। সেই যে গেলো
আর এলো না। অন্তরদাহী তীব্র তাপে ব্যথার পাহাড়
গলিয়ে তার চোখ ভাসালো, বুক ভাসালো
সব হারিয়ে ওই মেয়েটি শীতের নদীর জলের মতো
স্থিত হলো, শরীর তাহার বরফ শীতল নিথর স্থিত।
কপালে তার লাল টুকটুক সূর্য আঁকা
হাত ভরা তার কাঁচের চুড়ি, কলার পাতায়
যত্নে তোলা কুপির কালি চোখের কাজল
অমাবশ্যা রাত্রি দিয়ে শক্ত বাঁধা চুলের বেণী
লাল শাড়িটার আঁচল টেনে বউ সেজেছে
আলতা রাঙা পা দুখানি, দেখেনি কেউ, কাঁদেনি কেউ
কেবল তাহার ঝোলার সময় গোঙানিতে শান্ত জলের
নদীটাতে ওঠেছিলো ব্যর্থতা ও বিষণ্নতার
খুন উগারি করুণ ঢিলে ব্যথার কিছু দুরন্ত ঢেউ
আর বারোটি স্বপ্ন ভাঙা মেয়ের মতো
সন্তর্পণে অনন্তের ওই গহবরে একলা একা হারালো সেও।


কাঁদলো আকাশ, কাঁদলো বাতাস, কান্নাগুলো
শিশির হয়ে ঘাস ভিজালো, একটি মুকুল অবহেলা
অনাদরে ঝরে যাওয়ার ব্যথার ভারে এই সমাজের
মূক ও বধির অন্ধ সুধীর কাঁদলো না কেউ।
সমাজ ক্ষতের ব্যথার ভীড়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো
কৃষ্ণ কলির বক্ষে জমা দুঃখগুলোর দুরন্ত ঢেউ।
২৪-১০-২০২১