আমি যখন কিশোরী, চপলা চঞ্চলা আমার মন
তখন আমার জীবনে এক বাউণ্ডুলে আসে
প্রেমের ঝড় তুলে আমার হৃদয়ের কোণে কোণে।
মন ভুলানো কথায়; কি জাদু করেছিলো আমায়
তাঁকে কেবলই মনে পড়তো ক্ষণেক্ষণে --
প্রেমের উত্তাল সুর বেজে উঠেছিল বনে-বনে।
আকাশের শুভ্র মেঘকে তুলি, রামধনুর রঙকে বানিয়ে কালি
মনের মাধুর্য মিশিয়ে কিভাবে চিঠি লিখে আমি পারতামনা
তাই পাশের বাড়ির কামরুন্নাহার আপাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে
অজস্র চিঠি তাঁর নামে পোস্ট করতাম।
লাজলজ্জার মাথা খেয়ে,পড়াশোনার লাগাম টেনে
আমি কেবলই মাতাল ছিলাম তাঁর প্রেমে --
আমার ভালোবাসার পাপড়িগুলো সে
স্নিগ্ধ ভোরে প্রস্ফুটিত গোলাপের পাপড়ির মতো ফুটিয়ে তুলেছিলো।
তখন আমার কাছে একমাত্র সে-ই ছিলো প্রাধান্য
তাঁর জন্য বিভিন্ন মানুষের মন্দ কথার মালা গেঁথে গলে পরেছিলাম --
মন্ত্রমুগ্ধ কথায় এতোটাই পাগল হয়েছিলাম --
প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা কেবল তাঁকে নিয়েই ভাবতাম --
তাঁর ছবি আঁকতাম হৃদয়ের ক্যানভাসে।
আমি আগে কখনো মিথ্যে বলতাম না
তাঁকে ভালোবাসার পর প্রতিনিয়ত মিথ্যে বলতে হতো
মিথ্যে বলতে বলতে এক সময় পাক্কা মিথ্যেবাদী হ'য়ে গিয়েছিলাম।
বান্ধবীর বাড়ির কথা ব'লে
খাতা-কলম-বই কেনার ছলে --
পার্ক,রেষ্টুরেন্ট,স্টেশনে তাঁকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম
ঘন্টার পর ঘন্টা অনিন্দ্য সুন্দর সময় কাটাতাম।
আমার সাথে দ্যাখা করতে সে ছুটে আসতো
বোমারু বিমান কিংবা শঙ্খচিলের মতো
তাঁর শক্ত হাতটি ধরে রেললাইনের পাশদিয়ে হাঁটতাম, প্রেমের আলাপ বাঁটতাম।
মনটা সারাক্ষণ মনমরা, উদগ্রীব, বিমর্ষ, বিষন্ন হয়ে থাকতো
সকল বাঁধা বিপত্তি পেড়িয়ে তাঁকে বাহুডোরে বাঁধতে চাইতো
আপন করে খুব কাছে পেতে চাইতো প্রতিটি মুহুর্তের জন্য।
সে আমাকে বলতো --
আপন করে আমাকে কাছে না পেলে নাকি তাঁর জীবন ধুসর মরুভূমির মতো হ'য়ে যাবে --
ঝরে যাবে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের পাপড়িগুলো।
সে নাকি শঙ্খচিল হয়ে উড়ে-উড়ে সূর্যের খুব কাছে গিয়ে প্রখর তাপে তাঁর ডানাগুলো পোড়াবে
স্বপ্নগুলো শিমুল তুলোর মতো সমস্ত আকাশে উড়াবে।
পৃথিবীতে ঝড় আসে
ডানা ভেঙে পাখি পড়ে থাকে গাছতলা
আমার জীবনেও এক ঝড় এসেছিলো
ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলো আমার ঘর
ছড়িয়ে ছিটিয়ে, এলোমেলো, এবড়ো-খেবড়ো পড়েছিলো আমার স্বপ্নগুলো।
বিনামূল্যে, বিনাশ্রমে অমূল্য রতন পেলেও
ধীরে ধীরে এর অবমূল্যায়ন, উপক্ষয় করতে শুরু করে
আমার ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে --
আমাকে পেতে গিয়ে তাঁকে দুর্বিপাকে পড়তে হয়নি
জড়াতে হয়নি কোন ধরনের ফেসাদে।
তাঁর সেই শক্ত হাত আমার দুঃসময়ে কোন কাজে আসেনি
কাছে টানতে পারেনি আমার বেদনাবিধুর রাতগুলোতে --
প্রতিহত করতে পারেনি অন্যের ছুঁড়া তীর।
আমি আজও কাঁদি --
আমার ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোর জন্য --
শীতের স্নিগ্ধ ভোরে শিশিরস্নাত সবুজ ঘাসের মতো ছিলো আমার দিনগুলো।
আমি কখনো ভাবিনি সে এতোটাই বাউণ্ডুলে হবে
অবজ্ঞার ধনুক থেকে অবহেলার তীর ছুঁড়বে --
চাবুকাঘাত করবে আমার চপলা-চঞ্চলা কিশোরী হৃদয়ে।
আমাকে কুঠরিতে রেখে --
গভীর রাত পর্যন্ত সে আড্ডা দিতো দোকানপাটে
ঘরে ফেরার তাড়া থাকতো না, ফিরলেও কাছে ডাকতো না
অপরদিকে মুখ ফিরিয়ে গভীর ঘুম দিতো --
আমার ভালোমন্দ, সুখদুঃখের খোঁজ নাহি নিতো।
বেশিরভাগ রাত আমাকে কাটাতে হতো তাঁর মায়ের সাথে
আমার দীর্ঘশ্বাসে ভারী হতো মৃত্তিকার ঘর --
কখনো ঘুম আসতো না দুচোখের পাতায়, বালিশ ভিজতো
আমার মতো জোনাকিপোকারাও জেগে থাকতো
তারা-ও ভীষণ যন্ত্রণায় রাত অতিবাহিত করতো।
আমি পশ্চিমের ঘরে শুয়ে থাকতাম --
দ্বিপ্রহরে বাড়ি ফিরে সে যখন দক্ষিণ ঘরের দরজা খিল লাগাতো
আমি স্পষ্ট শুনতে পেতাম খিল লাগানোর শব্দ
কান দুটো খাঁড়া করে রাখতাম --
তাঁর ডাক পেলে দক্ষিণ ঘরে গিয়ে তাঁর বুকের উপর মাথা রেখে --
এক ঘুমে এককোটি বছর কাটিয়ে দেবো ব'লে।
সে আমাকে কক্ষনও ডাকেনি --
তাঁকে ছাড়া আমি যতোটা রাত পশ্চিমের ঘরে ঘুমিয়েছি
প্রতিটি রাতেই বর্ষা নেমে আসতো আমার দুচোখে।
তাঁর এই অবহেলা, তাচ্ছিল্যতা দূরত্ব বাড়িয়ে দেয় আমাদের মাঝে
বসন্ত এলে কেবলই মনে পড়ে তাঁকে ---
আমি আজ যে প্রেম উথলে দিচ্ছি --
সবটাই তাঁর কাছ থেকে শেখা --
প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া --
প্রথম প্রেম, প্রথম মাতৃত্ব তা কখনো যায়না ভুলা।