এবার তুমি আমায় নাকছাবিটা দেবে তো?
আর কোনো অজুহাত শুনবো না কিন্তু!
স্বগতোক্তিতে বলা কথাগুলো শুনে গেলো বুধাই,
খড়ের চালে গুঁজে রাখা কাস্তে নামিয়ে—
ফুলমনি উঠোনের ধারে রেখেছে আগেই;
কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ মাখা পান্তার জলে—  
শেষ চুমুটা দিয়ে বুধাই যাবে তার জমিতে;
তার জমি—তার নিজের জমিতে!
গেলো বছর সরকারি অফিস থেকে,
একটা কাগজ পেয়েছিল, মুহুরী বলেছিল,
এটা তোর পাট্টা, এ জমি এখন তোর।
তারপর থেকেই সেই কাগজ, জমি—
যত্ন করে আগলে রেখেছে বুধাই।
সকল স্বপ্ন জড়ো করে সে এবার ফলিয়েছে ধান—
কুলকুচি ফেলে গামছাটা কাঁধে নিয়ে—
ফুলমনির নাকছাবিটার কথা ভাবছে সে,
এমন সময় মশলা দেওয়া পান সেজে;
ফুলমনি এসে দাঁড়াল তার সামনে!
এই নাও, হাঁ করো—
ঠোঁটের কোনে একফালি স্বপ্নের হাসি মেশানো আবদারে ,
নিজের হাতে খাইয়ে দিল তার ভালোবাসায় মোড়া পানের খিলি!  
পান টা মুখে গুঁজে দুপা এগিয়েই,থমকে দাঁড়াল বুধাই!
পিছন ফিরে দেখে,
ফুলমনি তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে!
তা দেখে কিছুতেই আর পা সরছিল না তার,
ফিরে এসে জড়িয়ে ধরে তার ফুলমনিকে,
এরপর কখন অজান্তে ফুলমনির মুখখানা—
আশ্রয় পেয়ে যায় বুধাইয়ের দুহাতের মধ্যে;
দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হবে আজ—
তার দুচোখে ভাসে—ফুলমনির নাকছাবি পরা মুখ;
লজ্জায় রাঙা মুখ সরিয়ে নিয়ে ফুলমনি বললো,
যাও; ছাড়ো এবার, লজ্জা করে না বুঝি!
বুধাই মনে মনে ভাবলো, এই লজ্জা রাঙা মুখে;
নাকছাবিটায় বেশ মানাবে।
আজ সে আর কোনো অজুহাত দেবে না,
ফসল বেচে, নাকছাবিটা আনবেই।  
সন্ধ্যা নেমেছে পশ্চিমে, লাল সূর্যের আলো—
আকাশ, নদী প্রান্তর সব আজ খুব অন্যরকম,
গামছার খুঁটে বাঁধা অনন্ত স্বপ্ন নিয়ে ফিরে বুধাই।
নিরাভরন শরীর শুধু সাজতে চেয়েছে যে;
ছোট্ট স্বপ্নের ছোঁয়ায়,
সাজানোর স্বপ্নে রঙিন ছবি এঁকে চলে বুধাই—
ফেরে বাসায়;
খিড়কির বকুল গাছের ফাঁক দিয়ে তখন পুর্ণিমা চাঁদ;
একটুখানি জায়গা খুঁজে— এসেছে তার ঘরে;
ফুলমনি—ফুলমনি—এভাবেই ডেকেছে বেশ ক বছর;
আজ সেই নামটা কিছুতেই গলা থেকে বেরতে চাইছে না যেন!
উঠোনে পা রেখেই চমকে ওঠে সে!
সব যেন খুব বেশি এলোমেলো লাগছে;
ছোট্ট কুঁড়েটাকে দুমড়ে মুচড়ে কারা যেন,
সব রস রক্ত শুষে নিয়ে গেছে!
কালবৈশাখীর আদিম ক্ষুধায় নিশ্চিহ্ন,
আদিম চিরকালীন সেই ক্ষুধা—ভেঙে দিয়ে গেছে সব!
ভেঙে দিয়ে গেছে তিলে তিলে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য—
নরখাদকের থাবায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীর!
নীথর ছড়িয়ে চারিদিকে অসীম নিস্তব্ধতায়!
শেষবারের মতো বাড়ানো হাতে,
আর পারেনি ছুঁতে, পারেনি যেতে বুধাইয়ের কাছে!  
অসহায় ফুলমনির আর্তি পৌঁছয়নি বুধাইয়ের কাছে;
চোখের কোন থেকে ঝরে পড়া জলের স্রোতের দাগ—
স্বপ্ন ধুয়ে যাওয়া ছবি, এসবই এখন রয়েছে পড়ে;
ফুলমনির সকল কিছু পশুদের তৃপ্ত উল্লাসে ছারখার;
তার সকল যৌবন, সকল স্বপ্ন, সকল প্রাণ—
পরিণত আজ এক তাল মাংসের পিণ্ডে!
নীথর ফুলমনি রয়েছে পড়ে—
পড়ে আছে তুলি থেকে ঝরে পড়া—
ক্যানভাসে টান দেওয়া লাল রঙের স্রোতে!  
পুর্ণিমা চাঁদ তখন আকাশের অনেকটা উপরে;
স্বপনের কুঁড়ে ঘরে বুধাই নিশ্চুপ পাথরের মূর্তি!
ভাঙ্গা ছাউনির ফাঁক দিয়ে একফালি জ্যোত্স্না ;
ফুলমনির নাকের পরে—
গামছার খুঁটে বাঁধা নাকছাবিটা—
ধীরে ধীরে পরিয়ে দেয় বুধাই ফুলমনিকে;
তোমায় বেশ মানিয়েছে—
দেখ আজ তোমার কথা রেখেছি আমি;
একবার চেয়ে দেখ আমার দিকে;  
ফুলমনি—ফুলমনি—ফুলমনি—
দু হাতে জড়িয়ে ধরে বুধাই—
আর্ত চিত্কায়রে ফুলমনির নাম—
মিলিয়ে যায় তখন আকাশে বাতাসে—
বুধাই ফুলমনিদের স্বপ্নগুলোও—
আর কোনদিন ফুলমনি আদর করে চাইবে না নাকছাবি!!!!