মাগো তোমায় মনে পড়ে


উরুম্চি, চাইনা, ৬ জুলাই, ২০১২

মাগো তোমায় মনে পড়ে
আজও দেখি তোমার চোখে সেই যে অশ্রু ঝরে।
রাতের বেলা বুকের কাছে অভাগারে নিয়ে
ঘুম পাড়াতে বড় ভাইয়ের গল্পখানা দিয়ে।
সে ছিল যে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়
তার বুদ্ধিদীপ্ত মধুর মা ডাক সদাই স্মরণ করো।
সে ডাক হঠাৎ থামল সে'দিন নদীর ঘাটে গিয়ে
নদীর জলে ডুবলো যে'দিন সবকে ফাঁকি দিয়ে।
তাইতো তুমি ধরতে আমায় শক্ত হাতে বুকে
হাসির মাঝে কাঁদতে জানি তার হারানোর দুখে।
আমায় নিয়ে হাঁটতে যখন তোমার পিছে পিছে
ভয়ে তোমার বুকটা সদাই কাঁপত মিছে মিছে।
পিছন ফিরে চাইতে তুমি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
এমন মায়ের হারায় ছেলে! ভাবতাম মনে মনে।


আমার না-দেখা সেই বড় ভাই, আজও দেখি তাকে
হাজার রাতের দুঃস্বপ্নে মনটা তারে ডাকে।
অন্ধকারে বদ্ধ ঘরে হাত পা আমার বাঁধা
দৈত্যরা সব আসছে ধেয়ে বিকট কালো, সাদা
উদ্বিগ্ন এক মায়ের মুখটি বিবর্ণতায় ভরা
অসহায় তার ছোট্ট ছেলে পড়বে নাকি ধরা?
অসহায় সেই মায়ের কান্না, কোথায় আছে কে -
উদ্ধার কর এই বিপদে আমার ছেলেকে।
হঠাৎ দেখি, মাগো তোমার হারিয়ে যাওয়া ছেলে
আমার বড় ভাই আসে যে বিশাল দু'হাত মেলে।
দৈত্যরা সব পালায় দূরে, তোমার মুখে হাসি
জেগে উঠে বালিশ বুকে নয়ন জলে ভাসি।


মাগো তোমায় মনে পড়ে
সে সব দিনের কথা বলো ভুলি কেমন করে?
ভাতের পাশে শাকটি দিয়ে ডাকতে খোকন আয়
অনেক খানি বেলা হলো, তোর পেটে কিছুই নাই।
ভাতের থালা ছুড়ে দিয়ে তোমার খোকন পালায়
মাছ, মাংশ, ডিম ছাড়া কি খাবার খাওয়া যায়?
বলতে তুমি, ভাত জোটেনা, শাক জোটেনা ওসব পাবো কোথায়
বেলা হলো, তুই না খেলে কেমন করে খায়?
মাগো, তোমার গোধরা সেই দুষ্ট ছেলে বসতো খিড়কী দ্বারে
তুমি যেতে পাশের বাড়ি ডিম যদি পাও ধারে।
রান্না হলে সে ডিমখানা, ডাকতে, খোকন আয়
মায়ের কোলে বসে তখন খোকন সোনা খায়।
খোকন বলে, মাগো, তুমি একটুখানি খাও
তোমার পেটে ক্ষুধা, তবু সবটা কেন খাওয়াও?
বলতে তুমি, এই যে খোকন, তোর পেটে আমার হাত
পেটটা আমার ভরেই গেল, আর কি লাগে ভাত?


মাগো তোমায় মনে পড়ে
বুকের মাঝে ব্যথা বাজে চোখ যে জলে ভরে।
সন্ধ্যা বেলায় ফিরে এলাম ছিপ ঝুলিয়ে কাঁধে
নদীর ঘাটে মাঝ ধরেছি, মা যদি তা রাঁধে।
কেরোসিনের প্রদীপ জেলে মাছটা দিলে কেটে
বোন আর আমি ধুতে গেলে, ফেললে মশলা বেটে।
খাওয়ার সময় আমার পাতে দিলে মাছের মাথা
বললাম আমি, মাগো, তুমি কি যে কর যা তা
যা ছিল তার সবই দিলে, তোমার জন্যে কই?
বললে তুমি, অনেক খাবে, যদি আমরা বড় হই।
বললে তুমি, তুই মাথা খা, তোর মাথা হবে ভালো
লেখাপড়া ক'রে জ্বালিস এ সংসারে আলো।
এমন মাছ আর মাথা সেদিন আসবে কত ঘরে
আল্লাহ তাদের নিশ্চয় দেই, যারা ধৈর্য ধরে।


মাগো তোমায় মনে পড়ে
সব মা'রাই কি আশায় বাঁচে তোমার মত করে?
মনে পড়ে, তোমার আশা, তোমার সে বিশ্বাস
সাধ্য কী মা স্বপ্ন ভাঙি, তোমায় করি নিরাশ?
জীবন পথের প্রতি পদে যতই বাধা ভয়
তোমার দৃপ্ত মুখটি দিত সাহস ও প্রত্যয়।
গ্রীষ্ম শেষে বর্ষা আসে, বৃষ্টি পড়ে ঘরে
শীত-বসন্তে একটি ছেলে, এক তপস্যাই করে।
চৌকির উপর ছেড়া কাঁথা, অধ্যয়নে রত
মধ্যরাতে জেগে শুধাও, রাত যে হলো কত?
চুলের ভেতর হাতটি রেখে বলতে তুমি, ঘুমাতে যা বাপ
খালি পেটে পড়লে এতো, মাথা হবেই খারাপ।
ধরার বুকে কত আলো, কত হাসি, গান
ছেলেটি চায় একটি মায়ের দারিদ্র অবসান।
মাঠির উঠান খাতা হতো, আর সে ভাতের থালা
বলতে তুমি, কি যে করিস? একি হলো জ্বালা?
দিস নারে দাগ উঠোনে আর, দেনা বাড়ে তাতে
দেনায় দেনায় ডুবে আছি, নেই যে কিছু হাতে।
সেই ছেলেটি ভাবতো বসে আকাশ পানে চেয়ে
পাশের বাড়ির ভাই যে বেকার, মন বেদনায় ছেয়ে।
কেমন করে চাকুরী মেলে লেখা পড়ার শেষে?
ভরসা দিয়ে বলতে তুমি, সবই যে হয় আল্লার নির্দেশে।


মাগো তোমায় মনে পড়ে
কেমন করে বিলিয়ে দিলে তোমায় আমার তরে।
তোমার আমার কথাগুলো হাজার কাজের মাঝে
তারই সাথে তোমার দোয়া আমার কানে বাজে।
দিনটা ছিল বৃষ্টি ঝরা রাস্তায় ছিল কাদা
কলেজ যাব, তৌরি হচ্ছি, তুমিই দিলে বাধা।
বললে তুমি, কাজ নেই তোর কলেজ গিয়ে এমন বাদল দিনে
আয় না খোকন, ধান কটা যে হয়না ভানা একটা মানুষ বিনে।
ঢেকিখানা উঠছে, নামছে আমার পায়ের চাপে
তারই সাথে উঠা-নামা বুকটা আমার কেমন যেন কাঁপে।
কেমন করে বলি মাগো, কলেজের ফিস দিতে চাই যে টাকা
আমার চেয়ে কে আর জানে তোমার দু'হাত কতখানি ফাঁকা।
সাধ্য কি মা তোমার দুটো চোখ কে দেব ফাঁকি
বুঝলে, কিছু ব্যাপার ছাড়া চুপ ক'রে কি থাকি।
বললে তুমি, ভাবছিস কি? বল্ না আমায় খুলে
হঠাৎ আমার কান্না এলো, বুকটা উঠলো দুলে -
ঢেকির পাড়ে বসে বলি কান্না ভেজা স্বরে
মাগো আমার কী হবে আর লেখাপড়া ক'রে?
নুন আনতে পান্তা ফুরায়, কলেজ যাওয়া সাজে?
মুচকি হেসে বললে তুমি, বকিস নাতো বাজে,
কত টাকা লাগবে তাই বল, তার ব্যবস্থা হবে।
বললাম আমি, বেচলে তো সব, কিইবা তোমার রবে?
বললে তুমি, ভাবিস নাতো, আছে ওরে আছে
তোকে দেওয়ার দুটো জিনিস আছে আমার কাছে।
তার একটা হলো মায়ের দোয়া, আজকে দিলাম তাই
দেখতে পাবি, তোর জীবনে টাকার অভাব নাই।
আর একটা কি বুঝতে আমার কয়েকটা দিন গেলো
ফাঁকা তোমার কান দু'খানা যখন চোখে এলো।


কেমন করে অভাব গেলো নেই তা আমার জানা
বিধাতা কী ফিরায় মাগো তোমার দোয়াখানা?
আজকে আমার সবই আছে চাওয়ার কিছুই নেই
বুকের ভিতর তোমার অভাব, ভুলি কথার খেই।
একটি চাওয়াই বাকি আছে, চাইব তা প্রাণ ভ'রে
আল্লাহ! আমার মাকে রেখো বেহেস্তের এক ঘরে।
যে মা শুধুই দিয়ে গেছে, নেয়নি কারো কাছে
তার বেহেস্তি সুখটি শুধুই আমার চাওয়ার আছে।