যুদ্ধ বাঁধে রাজায় রাজায়, যুদ্ধ হয় যুদ্ধক্ষেত্রে
যুদ্ধ করে সৈনিকে, যুদ্ধ চলে যুদ্ধাস্ত্রে
যুদ্ধ আসে রাজধানীতে, পাওয়ার আন্দোলনে
গাঁয়ের ক'টা রেডিওতে গাঁয়ের লোকে শোনে।


তাদের যুদ্ধ মাছ ধরাতে নদীর গভীর জলে
ক্ষেতের ফসল গোলায় আনায় তাদের যুদ্ধ চলে।
অন্য সকল দিনের মতই তাদের আসে দিন
নেতার কথায় শোনে তারা দেশটা হবে স্বাধীন।


তবু তাদের খড়ের চালে দিতেই হবে ছন
জমির বুকে চলে লাঙল, খাটে কত জন
রাজা যাবে, আসবে রাজা, দিন তো যাবে এমন
যোদ্ধা যারা যুদ্ধে আছে - তাদের সরল জীবন।


এ বিশ্বাসে হঠাত এলো ভাঙন
গায়ের ভেতর ঘটে এখন যুদ্ধ-বিস্ফোরণ
পাকসেনারা গাঁয়ে ঢুকে ছনের বাড়ী জ্বালায়
বুলেট খাওয়া জখম মানুষ প্রাণের ভয়ে পালায়।


বিলাপ ওঠে গগন জুড়ে, রক্তে ভেজা কাপড়
ইজ্জতহারা মা বোনেদের বুকে হাজার চাপড়।
একটি ছেলের বয়স তখন হবে বছর বারো
কেউ জানে না তার জীবনে যুদ্ধ এলো আরো।


বাবা যখন দেখল হঠাত যুদ্ধ-জখম লোক
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসে উদ্ভ্রান্ত চোখ -
যে চোখদুটো নিদ্রাকে আর করেনি বিশ্বাস
নির্ঘুম রাত জেগে কাটে পরের ক'টি মাস।


হাঁটতো রাতে নিদ্রাবিহীন, যেন এক উন্মাদ
মাঝে মাঝে হাউ মাউ আর করতো আর্তনাদ।
যুদ্ধ এখন গাঁয়ে, দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে
যুদ্ধের আগুন বাড়ির পিছের ঝোপে ও বাঁশঝাড়ে।

যুদ্ধ এখন মাঠে, ঘাঁটে, যুদ্ধ ঘরের কোণে
যুদ্ধ এখন আবাল, বৃদ্ধ আর বনিতার মনে
যুদ্ধ এখন গাঁয়ের পাশের পাট ও আখের খেতে
মা ও বোনের সম্ভ্রমকে লুকিয়ে রাখতে যেতে।


সেই ছেলেটি মাটির উপর কান পাতে আর শোনে
কোথায় ক'টি মেশিনগানের গর্জন তা গোনে।
ক্লান্ত, জখম মুক্তিযোদ্ধার খাদ্য ও জল আনে
পাকসেনারা কোথায় এখন আস্তে বলে কানে।


গাঁয়ের লোকের অন্যরকম যুদ্ধগুলো দেখে
পাশের ঘরে মুক্তিযোদ্ধা লুকিয়ে কেমন রেখে
পাকসেনাদের খাদ্য ও জল দিতে হতো তুলে
তার সাথে বিষ মিশিয়ে দেবার ইচ্ছাটাকে ভুলে।


পাকসেনারা সামনে এলে, পতাকা চাঁদতারা
হাতে নিয়ে পাকিস্থানী হওয়ার কী পায়ঁতারা!
মুখে যখন স্লোগান ওঠে - পাকিস্তান জিন্দাবাদ,
বুকের ভেতর খুঁজে ফেরে তাদের মারার ফাঁদ।


মুজিবনগর দাঁড়িয়ে তখন পাকসেনাদের বলা
চিনি নাতো বুজিবনগর, এটা বৈদ্যনাথতলা।
সেই ছেলেটির একটা দিকে পাকসেনাদের থাবা
অন্যদিকে উদ্ভ্রান্ত, রুগ্ন ও দুর্বল তার বাবা।


পাঁচটি মুখের পাঁচটি কণা নেইকো ঘরে খাবার
খাবার খোঁজে বাইরে গেলে যুদ্ধের ক্রসফায়ার।
অন্য যুদ্ধ আমার শুরু, এক সে গভীর রাতে -
ভাই, বোন আর মা, বাবাকে লুকিয়ে নিয়ে সাথে


ওপার বাংলায় শরনার্থী হওয়ার পথে হাঁটা
পাকহায়েনার জ্বলন্ত চোখ পথের মাঝের কাঁটা।
উদ্ভ্রান্ত বাবা হাঁটে মা ও আমার মাঝে
জল ও স্থলের সে পথ চলা, শেষ আর হয় না যে।


পথের পাশে হাজার জনের আহাজারি শুনি
ফেলে যাওয়া রুগ্ন, অচল, আর পঁচা লাশ গুনি।
অবশেষে সড়ক-পাশে একটা ঝুপড়ি বেঁধে
নতুন জীবন শুরু হলো রিলিফের চাল রেঁধে।


রুগ্ন বাবা বাঁচবে কিনা, মনের ভেতর ভাবি
দশ বছরের ছেলে মিটাই পরিবারের দাবি।
সপ্তাহান্তে রিলিফ ক্যাম্পে ধরি লম্বা সারি
মাথায় বস্তা, সাঁঝের বেলায় ফিরি যখন বাড়ি,
উদ্বিগ্ন মুখগুলোতে একটু হাসি ফোটে
চুলার উপর আতপ চালের ভাতের হাড়ি ওঠে।


জলের ভেতর যুদ্ধ করে খাল বিলে মাছ ধরি
দুখের মাঝে মাছের ঝোলে সুখের সময় গড়ি।
আবার দেশে ফিরব কবে, নেই তা কারো জানা
বাবা কী আর ফিরবে দেশে? ভয় মনে দেয় হানা।


হঠাত সে'দিন খবর পেলাম দেশ হয়েছে স্বাধীন
ফিরব দেশে সবাই মিলে আনন্দে মন রঙিন।
ওজনশূন্য বাবা এলো সবার কাঁধে-পিঠে
নিজের দেশের আলো, বাতাস, মাটি লাগলো মিঠে।


ঔষধ হলো নিজের দেশের আলো, বাতাস, জল
রুগ্ন বাবার রোগ মুক্তি, হলো আবার সবল।
সেই ছেলেটি শিখল আবার সবল বাবার কাছে
এই জীবনে বাঁচতে হলে আরও যুদ্ধ আছে।


শিক্ষা হলো, অল্প পেয়ে খুশী থাকার যুদ্ধ
উদ্দেশ্য ও উপার্জন হতেই হবে শুদ্ধ।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে যুদ্ধের শেষ
লক্ষ বীরাঙ্গনার ত্যাগে পেয়েছি যে দেশ।


নিঃস্বার্থ দেওয়ার মন্ত্রে সদাই থেকে উদ্বুদ্ধ
সেই দেশকে ভালোবাসা আর এক মহাযুদ্ধ।
সেই যুদ্ধে আজও আছে শত্রুপক্ষের সেনা
মায়ের শাড়ী চুরি করে পরায় তাকে তেনা।


যুদ্ধ এখন, মায়ের গায়ে তুলতে হবে শাড়ি
লোভের গলায় দিতে হবে ত্যাগের তরবারি।
যুদ্ধ এখন, মায়ের সোনা করে যারা চুরি
প্রাসাদ থেকে ধুলায় তাদের ফেলতে হবে ছুড়ি'।


যুদ্ধ এখন, নিত্য যারা সত্য করে খুন
শোষক, ত্রাসক জোকের মুখে দিতে হবে নুন।
যুদ্ধ এখন, মুক্তকণ্ঠে সত্যি কথা বলার
যুদ্ধ এখন, স্বাধীন দেশে ভয়হীন পথ চলার।


যুদ্ধ এখন, শুদ্ধ চিত্তের স্যালুট ও বন্দনা
পায় যেন সেই দিনের সকল যোদ্ধা, বীরঙ্গনা।
যুদ্ধ এখন, মূর্খ-গরীব দেশবাসীকে রেখে সিংহাসনে
কর্তারা সব নিজকে তাদের সেবক ভাবুক মনে।