কবিতা, কবি এবং কবিতার আসর নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। আমার লেখাটি তার কোনটির সাথে একমত, দ্বিমত বা বিতর্কের জন্যে নয়। নিতান্তই আমার নিজস্ব ভাবনাগুলো অনেকের সাথে ভাগাভাগি করার জন্যে। এর থেকে কেউ অনুপ্রাণিত হলে ভালো, না হলে বা ভিন্ন মতের হলে কোন বিতর্কের দরকার নেই। কারণ এ ব্যাপারে সর্বসম্মত মত বলে কিছু নেই।


আমি তিনটি অংশে লিখব। আজকের অংশটি কবিতা, এরপরের অংশটি কবি এবং সবশেষ অংশটি হবে কবিতার আসর। এ লেখাটির উদ্দেশ্য আমার মতো যারা কবিতা ও কবিদের সপর্কে অল্প জ্ঞানসম্পন্ন সৌখিন কবি তারা যেন তত্ত্ব ও তথ্যবহুল বিভিন্ন লেখার মাঝে বিভ্রান্ত বা হতাশ হয়ে কবিতা লেখা থেকে বিদায় না নেয়, কবিতার আসর থেকে বিদায় না নেয়।


কবিতাঃ যাহা দেখিতে কবিতার মতো, পড়িতে কবিতার মতো ও শুনিতে কবিতার মতো তাহাই কবিতা।


কবিতা সাধারণতঃ গদ্যের চেয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা হয় পাঠককে একটি বিশেষ ভঙ্গিতে পড়তে সাহায্য করার জন্যে, অথবা অনেকটা বাধ্য করার জন্যে। কবি যে ধারায় চিন্তা করে, কবির মন যে বহমানতায় কথা বলে, কবি যেখানে থামতে চায়, পাঠককে ঠিক সেইভাবে চলার জন্যে লাইনগুলোকে বিরতি দিয়ে ছোট বা বড় করে সাজানো হয়, অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিরতি চিহ্নের সাথে। অনেক ক্ষেত্রে সবগুলো লাইন সমান হলেও, সাধারণত: লাইনগুলো ছোট হবে যাতে সবগুলি লাইন একই ভঙ্গিমায় পড়া যায়। আবার একটা লাইনের ভিতর শব্দগুলোকে বিশেষ শৃঙ্খলায় আনা হয়। এই নিয়মগুলো প্রয়োগ করে একটা সুন্দর গদ্যকে সুন্দর কবিতায় রূপ দেওয়া যায়। এই হলো কবিতার বাহ্যিক কাঠামো, যা লেখাটিকে দেখতে কবিতার মতো করে।


বাহ্যিকভাবে একটি লেখা যখন কবিতার মতো দেখায়, তার কিছু অংশ পড়ার পরেই বুঝা যাবে কবি কোন ভঙ্গিমায় পড়ার জন্যে লেখাটির মধ্যে অন্তর্নিহিত বিন্যাস ঘটিয়েছে। এবং সেই বিন্যাস অনুসারে পড়তে থাকলে পড়ার মাঝে একটা ছন্দ (rhythm) অনুভূত হবে, এবং এই ছন্দ একটা নির্দিষ্ট বিরতিতে পুনরাবৃত্ত হতে থাকবে। একটা পূর্ণ ছন্দ বিরতির মাঝখানে আবার সংক্ষিপ্ত ছন্দ নির্দিষ্ট বিরতিতে পুনরাবৃত্ত হতে পারে। অনেকটা সমুদ্রের পূর্ণ ঢেউ যেমন নির্দিষ্ট বিরতিতে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে, এবং একটা পূর্ণ ঢেউয়ের মধ্যে যেমন ছোট ছোট ঢেউ পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। লেখাটির বিষয় বস্তু অনুযায়ী পাঠকের মনের ভিতর, সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, ঘৃণা, ভক্তি, প্রেম, বিরহ, রাগ, প্রতিবাদ, নিন্দা,  ভালো লাগা অথবা যে কোন অনুভূতি ওই ছন্দের ধারায় আন্দোলিত হতে থাকবে।


পাঠক যখন শব্দ করে পড়তে থাকবে, নিজে শুনবে বা তার চারপাশের লোকেরা শুনবে তারা ওই ছন্দের ধারাটা পরিষ্কারভাবে বুঝবে এবং তাদের অঙ্গ ভঙ্গিমায় তার একটা প্রতিফলন, আলোড়ন দেখা যাবে; যেমন দর্শক, শ্রোতারা একাত্মবোধ করে যাত্রার অনেক কাব্যিক সংলাপের সাথে। এখানে বলা দরকার ক্লাসিক বাংলা কবিতায় অন্তমিল (rhyme) এই ছন্দের পুনরাবৃত্তি সৃষ্টি করার একটা কৌশল হিসাবে ব্যবহার করা হতো। তবে অন্তমিল থাকলেই যে লেখায় নিখুঁত ছন্দ আসবে তা কিন্তু নয়। অন্যদিকে আধুনিক গদ্য কবিতা সার্থকভাবে প্রমাণ করেছে অন্তমিল ছাড়াও কত সার্থক ছন্দ তৈরী করা যায়।

একটি লেখার লাইন এবং শব্দ বিন্যাসের পরও যদি কোনো ছন্দ ও তার ধারাবাহিকতা লেখাটিই না আসে, তবে তা দেখতে কবিতার মতো হলেও, তা কবিতা নয় গদ্য। সেক্ষেত্রে গদ্যে প্রচলিত শব্দ ও বাক্য প্রথায় লিখতে যত্নবান হলে, বিষয় বস্তু অনুযায়ী লেখাটি একটি সার্থক গদ্য হতে পারে। একটি সার্থক গদ্যের মূল্য একটি সার্থক কবিতার চেয়ে কম নয়, আর একটি অসার্থক কবিতার চেয়ে অনেক বেশী। ঠিক তেমনি একজন অসার্থক কবির চেয়ে একজন সার্থক গদ্য লেখকের মূল্য সাহিত্যে ও পাঠকের কাছে অনেক বেশী। সুতরাং নিতান্তই গদ্য লিখে পদ্য হিসাবে চালানোর কোন যৌক্তিকতা আমি দেখি না, বরং নিজের প্রতিভার প্রতি অবিচার করা হয়। কবিতার ছন্দ কি এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আমি মনে করি যে লেখা আবৃত্তি করা যায়, এবং আবৃত্তি করলে অনেক শ্রোতার মনোযোগ একসাথে আকর্ষণ করা যায় তাতেই ছন্দ আছে। অর্থাৎ যা পঠনে ও শ্রবনে মাধুর্য আনে তাই ছন্দ।


আমার মনে হয় মানুষের মন/চিন্তা  বিভিন্নভাবে কাজ করে যা  তার প্রকাশের বিন্যাসকে প্রভাবিত করে। তাই কেউ কবিতা লেখায় দক্ষ হয় আর কেউ গদ্য লেখায় দক্ষ হয়। সহজাতভাবে যাদের মন কবিতার বিন্যাসে কাজ করে, তারা গদ্য লিখলেও বা গান লিখলেও দেখা যায় তার ভেতর কাব্যিক ছন্দ/বিন্যাস এসে যায়। তাদের লেখা গদ্য প্রকৃত গদ্য লেখকদের লেখা গদ্যের চেয়ে একটু অন্যরকম হয়। অনেকের মন গদ্য ও কবিতা দুই ধরণের প্রকাশ বিন্যাসের জন্যেই কাজ করে। যখন যেটি লেখে, সজ্ঞানে সেটিকে খোলা রেখে অন্যটিকে বন্ধ করতে হয়। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন ছন্দ/মাত্রার ব্যাকরণ তা মনের প্রকাশকে কাব্যিক বিন্যাসে সাজাতে সাহায্য করা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বাভাবিক বিন্যাসে যেখানে ছন্দ আসতে চায় না সেখানে সজ্ঞানে মাত্রার কাজ করে ছন্দ আনা যায়। তবে স্বাভাবিকভাবে যেখানে ছন্দ এসে যায়, সেখানে জোরপুর্বক মাত্রার প্রয়োগ করার দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। মাত্রার সামান্য অমিলেও অনেক সময় যতিচিহ্ন ও বিশেষ কোন শব্দের উপর উচারণে জোর  (ইংরেজিতে যেটাকে অ্যাকসেন্ট বলে) দেওয়ার উপর নির্ভর করে পাঠে ও শ্রবনে কাব্যিক মধুরতা আসতে পারে বলে আমি মনে করি।


বাংলা কবিতার অসংখ্য কবিই বিভিন্নভাবে কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন। সেসব সংজ্ঞার সাথে আমার উপরের নিজস্ব ধারণা মিলুক বা না মিলুক তা নিয়ে সে সব সংজ্ঞার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। নীচে কবিতা সম্পর্কে ইংরেজিতে কিছু উক্তি তুলে দিলাম - অসংখ্য উক্তির মাঝে যে কয়েকটি আমাকে বিভিন্ন কারণে আকৃষ্ট করেছে। এর কিছু ইংরেজ কবিদের উক্তি ও কিছু অন্য ভাষার কবিদের উক্তি যা ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। উক্তিগুলি প্রমান করে সব ভাষার কবিগণই কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে ভাবেন এবং বিভিন্ন ধরণের সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন। সুতরাং কবিতার বিশিষ্ট ধরাবাঁধা কোন সংজ্ঞা নেই এবং আমার উপরের মতামতও সর্বজন সমর্থিত নয়।


'Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings: it takes its origin from emotion recollected in tranquillity.'   William Wordsworth.


'In my view a good poem is one in which the form of the verse and the joining of its parts seems light as a shallow river flowing over its sandy bed.' Basho (Translated by Lucien Stryk).


'Poetry is simply the most beautiful, impressive, and widely effective mode of saying things, and hence its importance.' Matthew Arnold.


'Poetry is what in a poem makes you laugh, cry, prickle, be silent, makes your toe nails twinkle, makes you want to do this or that or nothing, makes you know that you are alone in the unknown world, that your bliss and suffering is forever shared and forever all your own.' Dylan Thomas.


‘Prose; words in their best order; - poetry; the best words in the best order.' S.T.Coleridge.


'Writing free verse is like playing tennis with the net down.' Robert Frost.


তাই কবিতা সম্পর্কে আমার উপসংহার হলো সুন্দর শব্দে, ছন্দে, ভাবনায় কবিতা লিখতে থাকুন পঠন ও শ্রবণ মাধুর্যতায়। আর আপনার দ্বারা যে ভঙ্গিমায় লেখা ভালো আসে সে ভাবেই লিখতে থাকুন: পুরাতন ধারা ও ভঙ্গিমায়, নতুন বা আধুনিক ধারায়, বৈজ্ঞানিক বা অবৈজ্ঞানিক ধারায় - যে ধারায়ই লিখেন তা পাঠক যেন বুঝতে পারে, সহজে যেন পাঠকের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।


আগামীতে কবি সম্পর্কে কিছু লেখার ইচ্ছা রইল।