বাংলা কবিতার ছন্দ-এর আলোচনা করতে গিয়ে কবিতার বিভিন্ন প্রত্যয়গুলো তুলে ধরা হলো। পরবর্তীতে ছন্দ প্রকরণ বিষয়ে আলোচনা হবে। আপনি পড়ে প্রশ্ন করলে খুশি হবো। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আমাদের জানাকে আরো শাণিত করবে।


ছন্দের ব্যাপারে সে সকল বন্ধু ভালো ধারণা রাখেন; দয়া করে আপনারাও এ লেখাকে এগিয়ে নিয়ে গেলে আনন্দিত হবো।


আধুনিক কবিরা বাধাধরা এই নিয়ম মানতে না চাইলেও অনেকেই ছন্দ মেনে চলেন। তবে অনেকে আবার নিয়ম ভাঙার পক্ষে। নিয়ম ভাংতে হলে নিয়ম ভাঙ্গার নিয়মও জানতে হয়। এ জন্যেই ছন্দ সম্পর্কে জানা খুব জরুরি।


==================================


ছন্দ কবিতারই অন্তরগত একটি বিষয়। যা কবিতা কাব্যালোচনার প্রয়োজনে তারই ছন্দ-বিচার করতে হয়। একটি ভাষার কবিতার ছন্দের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট ঐ ভাষার উত্তম কাব্যসমূহের আলোচনার মাধ্যমেই বুঝতে সহজ হয়।
কবিতার ছন্দ সম্পর্কে আলোচনার আগে কতকগুলো পরিভাষা জানা আবশ্যক।
বাংলা কবিতায় ছন্দ মূলত তিন প্রকারঃ-
১) স্বরবৃত্ত
২) মাত্রাবৃত্ত  এবং
৩) অক্ষরবৃত্ত।


এই তিন শ্রেণির প্রকৃতিগত পার্থক্য প্রধানত নির্ভর করে কবিতার ‘অক্ষর’-এর মাত্রাগণনার নিয়মের উপর।
নিম্নে কবিতায় ব্যবহৃত কতগুলো পরিভাষাকে সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞায়ন করা হলো-


(ক) ধ্বনিঃ
ধ্বনি দুই ধরনের-
(১) স্বরধ্বনি ও (২) ব্যঞ্জনধ্বনি।
স্বরধ্বনিঃ যে সমস্ত ধ্বনি জিহ্বা, চোয়াল ও ঠোঁটের অবস্থাভেদ ঘটে; কিন্তু কোথাও আটকিয়ে যায় না, তাকে স্বরধ্বনি বলে। যেমন- আ, ই, উ ....
অন্যান্য ধ্বনিকে বলা হয় ব্যঞ্জনধ্বনি।


(খ) অক্ষরঃ
এক প্রয়াসে উচ্চারিত ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির নাম অক্ষর ।
অক্ষর দু’ধরনের-
(১) মুক্তাক্ষরঃ যে সমস্ত অক্ষর উচ্চারণকালে আটকে যায় না, ইচ্ছেমতো টেনে পড়া যায় প্রয়োজনে প্রলম্বিত করা যায়, তাকে মুক্তাক্ষর বলে। যেমন, না, কি, সু .......  এবং
(২) বদ্ধাক্ষরঃ যে সমস্ত অক্ষর উচ্চারণ কালে আটকে যায়, তাকে বদ্ধাক্ষর বলে। যেমন, ধ্যান, হাত, ফুল .........


(গ) মাত্রাঃ বাংলা কবিতার ছন্দে ব্যবহৃত এক একটি অক্ষরের উচ্চারণের নিম্নতম সময়ের পরিমাণকে মাত্রা বলে। সকল ধরণের ছন্দে মুক্তাক্ষরকে এক মাত্রা হিসেবে গণনা করা হয়।
বদ্ধাক্ষরের ক্ষেত্রে ছন্দ অনুযায়ী মাত্রা গণনার বিভিন্ন রীতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন, স্বরবৃত্ত ছন্দে এক মাত্রা, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে দুই মাত্রা এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের প্রথম ও মধ্যে হলে এক মাত্রা ও শেষে হলে দুই মাত্রা হিসেবে গণনা করা হয়।
উদাহরণ- ‘বন্ধুর’ শব্দটি স্বরবৃত্তে ‘বন’ + ‘ধুর’ = ১ + ১= ২ মাত্রা।
                          মাত্রাবৃত্তে ‘বন’ + ‘ধুর’ = ২ + ২= ৪ মাত্রা।
                          অক্ষরবৃত্তে ‘বন’ + ‘ধুর’ =১ + ২= ৩ মাত্রা।


এক নজরে ছন্দ গণনা
http://jalchhabibatayan.com/wp-content/uploads/2013/11/chando-table.jpg


(ঘ) যতিঃ কবিতা বা ছন্দ সাহিত্যই হচ্ছে আবৃত্তি করার একটি বিষয়। কবিতা আবৃত্তি করার বেলায় স্বাভাবিক ভাবে যে স্থানে উচ্চারণ বিরতি ঘটে তাকে যতি বলে। যেমন-
‘‘কোন ছেলেরে ঘুম পাড়াতে / কে গাহিল গান-
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, / নদেয় এল বান \’’
                            বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


অধরের কানে যেন / অধরের ভাষা,
দোঁহার হৃদয় যেন / দোঁহে পান করে-
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ / দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে / অধরসংগমে।
               চুম্বন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


(ঙ) পঙক্তি বা চরণঃ কবিতার এক একটি ছত্র বা লাইনকে পঙক্তি বলে।
আবার কখনো কখনো কাব্য এক পঙক্তিকে দুই  ছত্রেও  সাজানো হয়।


(চ) পর্বঃ
পর্বকে তিনটি পর্যায়ে দেখা যায়।
(১) পূর্ণ পর্ব-চরণের শুরু থেকে বা এক যতিচিহ্ন হতে পরবর্তী যতিচিহ্ন পর্যন্ত কাব্যাংশকে পূর্ণ পর্ব বলে।
(২) অপূর্ণ পর্ব - পর্ব অপেক্ষা ক্ষুদ্র মাপের যে কাব্যাংশ চরণের শেষে বর্তমান থাকে তাকে অপূর্ণ পর্ব বলে।
(৩) অতিপর্ব - কখনো চরণের প্রথমে পূর্ণ পর্ব অপেক্ষা ক্ষুদ্র মাপের কাব্যাংশ থাকে, তাকে অতি পর্ব বলে।


যেমন,
আমি /  যুগে যুগে আসি / আসিয়াছি পুনঃ / মহাবিপ্লব / হেতু
এই /   স্রষ্টার শনি / মহাকাল ধুম / কেতু।


এখানে, 'আমি' ও 'এই' শব্দদ্বয় অতি পর্ব; আর, 'হেতু' ও 'কেতু' অপূর্ণ পর্ব এবং মাঝের পর্বগুলো পূর্ণ পর্ব।


(ছ) মধ্যখণ্ডণঃ  কাব্যপঙক্তিকে পর্ব বিভাগ করার সময় কখনো কখনো কোন শব্দ বা পদকে ভাগ করার দরকার হয়, একেই বলে মধ্যখণ্ডন।


যেমন,
শৈল চূড়ায় নীড় বেঁধেছে সাগর বিহঙ্গেরা।


এখানে 'বিহঙ্গেরা' শব্দটির মধ্যখন্ডন হবে নিম্নরূপ-
শৈল চূড়ায় / নীড় বেঁধেছে / সাগর বিহঙ্ / গেরা।


(জ) প্রস্বর বা ঝোঁকঃ  কবিতা আবৃত্তি করার সময় কোনো কোনো অক্ষর অন্য অক্ষরের তুলনায় বেশী প্রস্বরিত বা শ্বাসাঘাত দিতে হয়, একে প্রস্বর বলে।


যেমন,
এখন যাঁরা / বর্তমান / আছেন মর্ত / লোকে
ভালোই লাগতো / তাঁদের ছবি / কালিদাসের / চোখে।


উপড়ের শব্দগুলোকে পড়ার সময় একটু খেয়াল করলে অনুভব হবে ঐগুলোর মধ্যে 'এখন', 'বর্তমান', 'আছেন', 'লোকে', 'ভালোই', 'তাদের', 'কালিদাসের' এবং 'চোখে' বেশি শ্বাসাঘাত দিতে হয়; একেই প্রস্বর বলে।


(ঝ) স্তবকঃ কবিতার ভাব প্রকাশের সুবিধার্থে কবি তাঁর কবিতা বিশিষ্ট ভঙ্গির চরণগুচ্ছে সজ্জিত করেন- এই চরণগুচ্ছকে স্তবক বলে।



এখানে বাংলা কবিতার ছন্দের কিছু পরিভাষার ধারণা তুলে ধরলাম। পরবর্তিতে বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবিদের বিভিন্ন কবিতাকে বিশ্লেষণ করে ছন্দের প্রকৃতি তুলে ধরা প্রয়াস চালাবো।