ছড়া, পদ্য, কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কি ধরনের শব্দ ব্যবহার করা উচিত, কি ধরনের শব্দের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন - বিষয়টি কবিতা চর্চাকারী সকল কবির কাছে খুবই প্রাসঙ্গিক l  


প্রথমত, এটা বুঝে নিতে হবে যে একটি কবিতা পাঠ করে কবিতাটির ভাবার্থ যদি স্পষ্ট বোঝা যায়, সেটা খুবই ভালো l কিন্তু, কবিতার ক্ষেত্রে কবিতাটির ভাবার্থ কি অর্থাৎ কবিতাটিতে কবি কি বলতে চেয়েছেন এটা বোঝা বিষয়টা একেবারে জরুরী নয় l  
অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলো কবিতাটি পড়ে ভালো লাগার একটা অনুভব তৈরি হওয়া l
সেই ভালো লাগার অনুভব তৈরি হবে তখন, যখন কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ, পদ, বাক্য পাঠকের মনে একটা দোলা, একটা ঢেউ এর সৃষ্টি করবে l
এই দোলা, এই ঢেউ পাঠকের মনে সৃষ্টি হবে তখন, যখন কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ, বাক্যগুলি হবে সুর তাল ও ছন্দময় l একথা অন্তমিলযুক্ত ছড়া, পদ্য, কবিতার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনই প্রযোজ্য গদ্যকবিতা, ও মুক্তকছন্দ কবিতার ক্ষেত্রেও l


শব্দ, বাক্য কবিতায় ছন্দময় হবে তখনই, যখন তা সুপ্রযুক্ত হবে l কবিতায় উপযুক্ত শব্দের ব্যবহার বিষয়টি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ l এজন্যই বিশিষ্ট কবিগণ সঠিকভাবেই বলেছেন, একটি কবিতা লেখা হবার পরে আবার সেটি বারবার পড়লে কিছু শব্দের পরিবর্তন অনুভূত হয় এবং যত এইভাবে কবিতাটিতে উপযুক্ত শব্দ আনা হবে, ততই সেই কবিতাটি ছন্দময় হবে, সুরে তালে আসবে l এবং তখনই কোনো পাঠক সেই কবিতাটি পাঠ করার পর যদি কবিতাটির অর্থ নাও বুঝতে পারেন, কবিতাটির ছন্দ, সুর, তাল, লয় তাঁর মধ্যে একটা ভালো লাগার অনুভব আনবে এবং তিনি ভালবেসে কবিতাটি পুনরায় পড়তে চাইবেন l মনে রাখতে হবে একজন ভালো কবি কিন্তু একজন ভালো গীতিকারও বটে l কবিতার এই লিরিক সত্তা কবিতা পাঠের আনন্দ বাড়িয়ে দেয় l


কবিতায় উপযুক্ত শব্দের ব্যবহার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলেই কবিগুরু বহুবার তাঁর কবিতা সংশোধন করতেন এবং শব্দের পরিবর্তন করতেন l সব ভালো কবিদের ক্ষেত্রেই কথাটি খাটে l  তাঁদের এই আচরণ থেকে নবীন কবিদের অনেক কিছু শেখার আছে l


ভাষা সতত পরিবর্তনশীল l কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেটা বলা হয়, যে যুগে কবিতাটি লেখা হচ্ছে, কবিতায় সেই যুগের ভাষা ও শব্দাবলী ব্যবহার করা সমীচীন l তবে সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে কবিতাটিকে আধুনিক বলা যাবে l
চর্যাপদের যুগে আমরা কবিতায় পেয়েছি এরকম শব্দ ও বাক্য,
"গঙ্গা জউনা মাঝে রে বহই নাঈ" - গঙ্গা যমুনার মাঝে নৌকা চলে l
মধ্যযুগে বড়ু চণ্ডীদাস রচিত "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন" কাব্যে পেয়েছি এরকম শব্দের ব্যবহার,
"আকুল শরীর মোর বে আকুল মন
বাঁশীর শবদেঁ মোর আউলায়লোঁ রান্ধন l"
মধ্যযুগের আধুনিক কবি আব্দুল হাকিমের কবিতায় শব্দের ব্যবহার এরকম,
"যেজন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি l"
চতুর্দশ শতকের শেষ পর্যায়ে "বৈষ্ণব পদাবলী"তে ব্যবহৃত শব্দাবলী এরকম,
"সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম l
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ l"


বাংলা কবিতায় আধুনিক যুগের শুরু ১৮০০ সাল নাগাদ l এই যুগের কবি ঈশ্বর গুপ্ত এক ইংরেজ রমণীকে তাঁর কবিতায় বিদ্রুপ করছেন এরূপ শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে,
"বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছোটে
আহা তায় রোজ রোজ কত রোজ ফুটে l"


বিভিন্ন যুগে বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের এই হলো নমুনা l বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে ঐ শব্দগুলির কিছু দুর্বোধ্য বা বেখাপ্পা মনে হলেও সমকালীন যুগে এরূপ শব্দ ও ভাষাই ছিলো মনের ভাবপ্রকাশে সাহিত্যের অবলম্বন l
কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে l মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সত্যেন্দ্রনাথ,  শামসুর রহমান, আল মাহমুদ,  নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ প্রমুখের হাত ধরে বাংলা কবিতায় শব্দ ব্যবহার আধুনিক রূপ পেয়েছে l বর্তমান দিনে বসে কবিতায় এই আধুনিক শব্দই ব্যবহার করা উচিত l
আর একটি বিষয়, গদ্যের মতো কবিতার ক্ষেত্রেও সাধু চলিত শব্দের জগাখিচুড়ি ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত l আজকের যুগে চলিত ভাষাতেই কবিতা লেখা উচিত l


শুরুতে যেটা বলেছিলাম, ছড়া, পদ্য, কবিতার প্রথম শর্ত হলো সেই রচনাটি পড়ে ভালো লাগতে হবে, পাঠকের মনে একটা ভালো লাগার অনুভব জাগতে হবে l সেটা তখনই সম্ভব যখন ছড়া, পদ্য, কবিতার শব্দচয়ন উপযুক্ত হবে, যুগানুসারি হবে, ছন্দময় হবে l রসময়, শ্রুতিমধুর, শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে  কবিতার বাক্যে এক সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাস সৃষ্টি হয় যা অনুভবযোগ্য, এবং কবিতার সেই চরণ পাঠ করলে পাঠকের মনে সৌন্দর্যের এক অনুভব হয়, একটা রিদম বা ঢেউ সৃষ্টি হয় l এটাই ছন্দ l ছন্দ দেখা যায় না, কিন্তু তার অনুভবে এক সুখানুভূতি জাগে, হৃদয় মনে নৃত্য ও আনন্দের দোলা তৈরি হয় l এক্ষেত্রে কবিতাটি বোঝা গেল কি না, সেই বিচার পাঠকের কাছে গৌণ হয়ে যায় l


কিছু উদাহরণ -
১) দূরের পাল্লা : সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


ছিপখান তিন-দাঁড় –
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিন-ভোর
দ্যায় দূর-পাল্লা!
পাড়ময় ঝোপঝাড়
জঙ্গল-জঞ্জাল,
জলময় শৈবাল
পান্নার টাঁকশাল |


২) পাল্কীর গান : সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


পাল্কী চলে
পাল্কী চলে!
গগন-তলে
আগুন জ্বলে!


স্তব্ধ গাঁয়ে
আদুল গায়ে
যাচ্ছে কারা
রৌদ্রে সারা l


৩) তেজীয়ান : সুকুমার রায়


চলে খচ্‌খচ্ রাগে গজ্‌গজ্ জুতো মচ্‌মচ্ তানে,
ভুরু কট্‌মট্ ছড়ি ফট্‌ফট্ লাথি চট্‌পট্ হানে।


৪) ছাত্রদলের গান : কাজী নজরুল ইসলাম


আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।
মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান
ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
আমরা ছাত্রদল।।


৫) আমাদের ছোট নদী : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি l


৬) তালগাছ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তালগাছ          এক পায়ে দাঁড়িয়ে
                        সব গাছ ছাড়িয়ে
                                উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ,          কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
                         একেবারে উড়ে যায়;
                                কোথা পাবে পাখা সে l l
তাই তো সে        ঠিক তার মাথাতে
                          গোল গোল পাতাতে
                                 ইচ্ছাটি মেলে তার,--
মনে মনে             ভাবে, বুঝি ডানা এই,
                           উড়ে যেতে মানা নেই
                                  বাসাখানি ফেলে তার।
সারাদিন               ঝরঝর থত্থর
                            কাঁপে পাতা-পত্তর,
                                 ওড়ে যেন ভাবে ও,-
মনে মনে               আকাশেতে বেড়িয়ে
                             তারাদের এড়িয়ে
                                 যেন কোথা যাবে ও। l
তার পরে               হাওয়া যেই নেমে যায়,
                             পাতা-কাঁপা থেমে যায়,
                                   ফেরে তার মনটি
যেই ভাবে,             মা যে হয় মাটি তার
                             ভালো লাগে আরবার      
                                    পৃথিবীর কোণটি।l


৭) স্বাধীনতা তুমি : শামসুর রহমান


স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-


৮) কর্ম : যতীন্দ্রমোহন বাগচী


শক্তি মায়ের ভৃত্য মোরা- নিত্য খাটি নিত্য খাই,
শক্ত বাহু, শক্ত চরণ, চিত্তে সাহস সর্বদাই |
ক্ষুদ্র হউক, তুচ্ছ হউক, সর্ব সরম-শঙ্কাহীন—
কর্ম মোদের ধর্ম বলি কর্ম করি রাত্রি দিন l


৯) আত্মবিলাপ : মাইকেল মধুসূদন দত্ত


আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু,হায়,
তাই ভাবী মনে?
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন,—


১০) কবর : জসীমউদ্দীন


এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।


১১) দুঃখের আরেক নাম : হেলাল হাফিজ


আমাকে স্পর্শ করো, নিবিড় স্পর্শ করো নারী।
অলৌকিক কিছু নয়,
নিতান্তই মানবিক যাদুর মালিক তুমি
তোমার স্পর্শেই শুধু আমার উদ্ধার।
আমাকে উদ্ধার করো পাপ থেকে,
পঙ্কিলতা থেকে, নিশ্চিত পতন থেকে।


১২) নিঃসঙ্গতা : আবুল হাসান


অতোটুকু চায় নি বালিকা!
অতো শোভা, অতো স্বাধীনতা!
চেয়েছিলো আরো কিছু কম,


আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিলো
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!


অতোটুকু চায় নি বালিকা!
অতো হৈ রৈ লোক, অতো ভিড়, অতো সমাগম!
চেয়েছিলো আরো কিছু কম!


একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিলো


একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী l


বিশিষ্ট কবিদের কবিতার উপরোক্ত অংশগুলি সন্নিবেশিত করলাম দেখাতে যে -
১) এই কবিতাগুলি পাঠ করলেই পাঠক একটা ঢেউ, একটা দোলা অনুভব করেন, যা তাঁর মধ্যে ভালো লাগার একটা অনুভব সৃষ্টি করে l সেক্ষেত্রে কবিতাটির অর্থ তিনি বুঝলেন কি না, এই বিষয়টি তাঁর কাছে গৌণ হয়ে যায় l তিনি একবার কবিতাটির পাঠ শুরু করলে সেটি শেষ না করে থামেন না l শুধু তাই নয়, তিনি কবিতাটির প্রেমে পড়ে যান l কবিতাটি হয়তো মুখস্থ করে ফেলেন l যখন তখন তাঁর মুখ থেকে ওই কবিতাটির কলি ঝরে পড়ে l
২) তাঁরা তাঁদের ছড়া  কবিতায় কোথাও শ্রুতিকঠিন ছন্দহীন শব্দ চয়ন করেন নি l এরকম সাবলীল শব্দই কবিতার উপযোগী ভাষা l


কিছু আধুনিক কবিদের কবিতায় এরকম প্রবণতা দেখি বেশকিছু দুর্বোধ্য কঠিন শব্দসম্ভারে তাঁরা কবিতার শরীরকে ভারী করে তোলেন l কবিতায় কঠিন শব্দ একেবারেই থাকবে না এমন নয় l কিন্তু তা হতে হবে ছান্দিক বা ঝংকৃত বা রিদমিক, শ্রুতিমধুর - যা কবিতার আনন্দপাঠে সহায়ক l


আধুনিক কিছু কবি ছন্দ না জেনে কবিতা লিখতে গিয়ে অকবিতা লিখে ফেলেন l দুর্বোধ্য কঠিন শব্দসম্ভারে কবিতার শরীরকে ভারী করে তোলেন l পাঠক বিভ্রান্ত হন l ছন্দহীনতায় বিরক্ত হন l কারণ ছন্দহীন কবিতা সাবলীল পাঠ বা আবৃত্তি করা যায় না l কবিতার সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা হলো তাকে আবৃত্তিযোগ্য হতে হবে l যে কবিতা সাবলীলভাবে আবৃত্তি করা যায় না, হোঁচট আসে, বুঝতে হবে সেটা কবিতা হয়ে ওঠে নি l এরকম কবিতা বা অকবিতা পাঠে পাঠক বিরক্ত হন l    কবিতাবিমুখ হন l এটা কবিতার দোষ নয়, পাঠকের দোষ নয়, দোষ সেই কবির যিনি কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যত্নশীল ছিলেন না, মনোযোগী ছিলেন না, আন্তরিক ছিলেন না l


নবীন কবি যাঁরা কবিতা চর্চা করছেন তাদের পরামর্শ দেয়া হয় প্রচুর পরিমাণে বিশিষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতা পাঠ করতে l এর মাধ্যমে শব্দকে কিভাবে কবিতায় ব্যবহার করতে হয়, কবিতায় ব্যবহৃত বাক্যে বিভিন্ন চরণে, নানা পর্বে ছন্দ কিভাবে রক্ষা করতে হয়, একটি কাব্যভাবকে সুশৃঙ্খলভাবে কেমন করে সুর তাল ও ছন্দে মেলে ধরতে হয়, কিভাবে নানা অলঙ্কার কবিতায় আসে - এগুলির শিক্ষা পাওয়া যায় l


সুতরাং কবিতাকে যদি কবিতা হয়ে উঠতে হয়, তাহলে সেই কবিতায় উপযুক্ত শব্দ ব্যবহারের যে যথেষ্ট গুরুত্ব আছে, একথা মেনে নিতেই হয় l