একটি কবিতা l কেমন করে জন্ম নেয় ? প্রথমে তো একটি বিষয় চাই l কবিতার উপযোগী বিষয় l এই বিষয় নির্ধারণের কোনো সীমা পরিসীমা নেই l যুগ যুগ ধরে দেশে বিদেশে এত যে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি কবিতা লেখা হলো, বা হয়েই চলেছে, তার কতো যে বিষয়, তার কি কোনো হিসাব আছে ? শুধু দেশ কালের একটা শৃঙ্খলা মানতে হয় এই যা l দক্ষ কবির হাতে যে কোনো বিষয়ই নেচে ওঠে l কিন্তু যারা তরুণ কবি, তাঁদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত বিষয় নির্বাচনের একটা ব্যাপার থাকে l কবি তার নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী, যে বিষয়ে তিনি স্বচ্ছন্দ, এরকম বিষয় নিলে কবিতা নির্মাণের কাজটা স্বতস্ফুর্ত হয় l
বিষয় নির্বাচন হলো l এবার চাই ভাব l কবিতার ভাব l আবেগ l কি জাতীয় কবিতা হতে যাচ্ছে ? প্রেমের কবিতা ? করুন রসের কবিতা ? বীররসাত্মক ? দেশপ্রেমের কবিতা ? হাসির কবিতা ? প্রকৃতি বর্ননামূলক ? শিশুকল্পনার কবিতা ? সমাজ সংস্কারমূলক কবিতা ? বিদ্রোহী কবিতা ? Satire ? মহৎ জীবনকেন্দ্রীক ? উপদেশ মূলক ? মূল্যবোধ ভিত্তিক ? ইত্যদি ইত্যাদি l
কবিতার বিষয় যখন তার ভাব প্রকাশের ধরনটা পেল, তখন সেই অনুযায়ী শব্দ, বাক্য আসবে l শব্দ হবে বিষয় ও ভাবের অনুসারী l শব্দ বাক্য এলো l এবার সেই শব্দগুলিকে, বাক্যগুলিকে সাজাতে হবে l তার বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে, যেন সেটা শুনতে ভালো লাগে, ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি হয়, কবিতার বিষয়টি তার ভাব অনুযায়ী ফুটে ওঠে l কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কিছু লাইন পড়লে শব্দের সুচারু ব্যবহারে ধ্বনিমাধুর্য কেমন সৃষ্টি হয়, তার ধারনা পওয়া যায় l


"শ্রাবণগগন ঘিরে  ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে" (সোনার তরী)
"গুরুগুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে, গরজে গগনে l" (নববর্ষা)
"চলচপলার চকিত চমকে করিছে চরণ বিচরণ -" (আবির্ভাব )


এখানেই এলো ছন্দের ব্যবহার l ছন্দ ব্যাপারটি ঠিক কি রকম ? যেমন কবিতার একটি লাইনকে বলে পঙ্ক্তি l একটি পঙক্তিতে কতগুলি শব্দ নিবো ? একটি পঙ্ক্তির যতটুকু অংশ একবারে পাঠ করছি সেটাকে বলছি পর্ব l এরকম কয়টি পর্ব থাকবে একটি পঙক্তিতে ? আবার একটি পর্বে মাত্রা কয়টি থাকবে l পর্বে মাত্রার এই সংখ্যার ওপরই তো ছন্দের নামকরণ হবে l এই বিষয়গুলিই হলো ছন্দ l আছে মুক্ত স্বর l বদ্ধ স্বর l মুক্ত স্বর সর্বদাই এক মাত্রা l বদ্ধ স্বর স্বরবৃত্ত ছন্দে এক মাত্রা l মাত্রা বৃত্ত ছন্দে দুই মাত্রা l অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের শুরুতে ও মাঝে এক মাত্রা কিন্তু শব্দের শেষে হলে দুই মাত্রা l
কবিতা রচনার ক্ষেত্রে মূল যে দুটি factor কাজ করে, তা হল পরিস্থিতি এবং ভাবনা l একটা পরিস্থিতির সাপেক্ষে কবির মনে কিছু ভাবনার জন্ম হয় এবং সেই ভাবনাকে তিনি কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেন l এখন পরিস্থিতির উদ্ভব ও কবিতার জন্ম - এর মধ্যে সময়ের ব্যবধান গুরুত্বপূর্ণ l সময় বিষয়টিও আপেক্ষিক l পরিস্থিতির কারণে শক্তিশালী আবেগের যে উত্তেজনা কবি অনুভব করলেন, তা প্রশমিত হওয়ার সময়কাল ব্যক্তিভেদে, পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন হতে পারে l কিন্তু সেই পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ কবিকে বিস্মৃত হতে হয় l এই আংশিক বিস্মরণের পর, আবেগের উত্তেজনা প্রশমিত হবার পর মনের শান্ত অবস্থায় ঐ পরিস্থিতিকে স্মরণ করে তিনি যখন কবিতা লিখবেন, তখন ঐ পরিস্থিতির কবিতাযোগ্য বিষয়গুলিই তার কবিতায় আসবে, কবিতাযোগ্য নয় এমন প্রসঙ্গগুলি বাদ যাবে l


কবিতার মধ্যে আমরা এক অদ্ভুত জগতের সন্ধান পাই l আমাদের অতিবাহিত জীবনের যন্ত্রণা-কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে আমাদের এক স্বস্তির সন্ধান দেয় l
কবির জীবনের বেদনা তাঁর ব্যক্তিগত l কিন্তু সেই যন্ত্রণার কথা কবি যখন প্রকাশ করেন, তখন তা দেশের, দশের, মানুষের অনুভবের রূপ নেয় l  
জীবন নিত্য রহস্যময় l পদে পদে বিস্ময়, অনিশ্চয়তা l জীবন-মৃত্যু এক বিচিত্র প্রহেলিকা l ব্যক্তির মৃত্যু হয় l কিন্তু তাতে জীবনের প্রবাহ থেমে যায় না l প্রবহমান এই জীবনের মধ্যে সমগ্রের যে ধারণা - তার অনুভব ও প্রকাশ- ই কবিতা l


সবশেষে কবিপ্রতিভা বিষয়টি তো আছেই l "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি l"
উক্তিটি কবি জীবনানন্দ দাশের l কবি বলতে চেয়েছেন
শুধু চার লাইন কবিতা লিখে ফেললেই কেউ কবি হয়ে যায় না l প্রকৃত কবি হতে গেলে চাই কবিহৃদয় এবং কল্পনাশক্তি l আর তার চেয়েও যেটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো সাধনা l কবিতা লেখার পাশাপাশি, অন্যের কবিতা পাঠ করা এবং বিশেষ করে কবিতা চর্চা সংক্রান্ত আলোচনা পাঠ করা এবং মত বিনিময় করা খুব জরুরী l এর ফলে কাব্যচর্চা কখন কোন পথে চলে তার ধারনা পাওয়া যায় l কবিতা চর্চার পথে সুবিধা হয় l


জীবনানন্দ দাশ ছিলেন এক আত্মসচেতন কবি l ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ এই উক্তির ব্যাখ্যা কবি নিজেই দিয়েছেন, যাঁরা কবি তাঁরা “কবি—কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে।”
কি পেলাম জীবনানন্দ দাশের ব্যাখ্যায় ? পেলাম -
যিনি কবি তাঁর
১) কবি-হৃদয় থাকবে
২) এই হৃদয় কল্পনাময় হবে
৩) কল্পনায় চিন্তা ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন থাকবে
৪) বিগত অনেক শতাব্দী ধরে যে কাব্যচর্চা হয়েছে তার সম্বন্ধে মোটামুটি ধারনা থাকবে
৫) আধুনিক সময়ে যে কাব্যচর্চা হচ্ছে তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে
৬) কাব্য সাহিত্য চর্চা সর্বদা এক পথে চলে না l মাঝে মাঝে বাঁক নেয় l নব নব কাব্যিকরণ প্রক্রিয়া আসে l এই সব কিছুই কবিকে সাহায্য করে l
৭) এই সাহায্য পেতে হলে কবিকে তাঁর হৃদয় দিয়ে, কল্পনা দিয়ে, চিন্তাশক্তি দিয়ে, অভিজ্ঞতা দিয়ে যতো নব নব কাব্যিক অভ্যাস বিগত দিনগুলিতে হয়ে গেছে এবং বর্তমান দিনেও হয়ে চলেছে - তার অধ্যয়ন করে তার নির্যাস তাঁর কবিতায় আনতে হবে l এটা নিজে থেকেই আসবে l শুধু ওপরের অনুশাসনগুলি কবিকে মানতে হবে l
এটা যাঁরা করে উঠতে পেরেছেন, জীবনানন্দের ব্যাখ্যায় তাঁরাই কবি, "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি l"