কবিতার কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক কবিতার জন্মলগ্ন থেকে ছিলো, আজও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে l
এই বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল দুর্বোধ্যতা l
কবিতার দুর্বোধ্যতার এমন অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কতজনই না আলোচনা করে গেছেন! রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব বসু; এলিয়ট থেকে অডেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কবিদের দুভাগে ভাগ করেছিলেন - এক ভাগে স্পষ্ট কবি, অন্যভাগে অস্পষ্ট কবি! আর তাঁর মতে, অস্পষ্ট কবিদের অগ্রণী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধে প্রকৃত সত্যের সঙ্গে সাহিত্যের সত্যের যে একটা বিশেষ পার্থক্য রয়েছে সেটি বেশ জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন। এই প্রবন্ধে কবি বলছেন, "সাহিত্যের মা যেমন করিয়া কাঁদে প্রাকৃত-মা তেমন করিয়া কাঁদে না। তাই বলিয়া সাহিত্যের মা-র কান্না মিথ্যা নহে।" এরপরই তিনি তাঁর সাহিত্য-চিন্তার সূত্রের একটা বড়ো রকমের সিদ্ধান্তের কথা সবাইকে জানিয়েছিলেন, "সাহিত্য ঠিক প্রকৃতির আরশি নহে। শুধু সাহিত্য কেন, কোনো কলাবিদ্যাই প্রকৃতির যথাযথ অনুসরণ নহে। প্রকৃতিতে প্রত্যক্ষকে আমরা প্রতীতি করি, সাহিত্যে এবং ললিতকলায় অপ্রত্যক্ষ আমাদের কাছে প্রতীয়মান। অতএব এ স্থলে একটি অপরটির আরশি হইয়া কোনো কাজ করিতে পারে না l"  
অপরদিকে দ্বিজেন্দ্রলাল মনে করতেন, "কাব্যের জড়তা সাধারণত আইডিয়ার জড়তা হইতেই প্রসূত হয়। যেখানে আইডিয়া স্পষ্ট, সেখানে ভাষা প্রাঞ্জল। যেখানে আইডিয়া অনেকাংশে কবির নিজের নিকটেই প্রচ্ছন্ন, সেখানে ভাষা অবশ্য অস্পষ্ট হইতে হইবে। কিন্তু সেটা বৃহৎ আইডিয়ার ফল নহে, অস্পষ্ট আইডিয়ার ফল।"


সে-আলোচনা এখনো থামেনি। বলা যায় তার রেশ এখনো সাহিত্যে বেশ জমজমাটভাবেই রয়েছে - থাকবেও। ‘কবিতা’ সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র শাখা, কাজেই তার প্রকার এবং প্রকাশ স্বাভাবিকভাবেই আলাদা হবে।
বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন হল চর্যাপদ l চর্যাপদকে বলা হয় সন্ধ্যাভাষা l তাতে দিনের আলোর সুস্পষ্টতা নেই। আছে গোধূলির মায়াবী আবছায়া। তাই বলা যায় দুর্বোধ্যতায় বাংলা কবিতার জন্মসিদ্ধ অধিকার।


কবি অজিত চক্রবর্তী বলছেন, "আমরা যাহা জানি, স্পষ্টই জানি, তাহার ভাষা গদ্য - কিন্তু আমরা যাহা জানি, অথচ সম্পূর্ণরূপে জানি না, যাহাকে অনুভূতির মধ্য দিয়া হাতড়াইয়া বলিতে হয়, তাহার ভাষা পদ্য।"
সাহিত্য পাঠকেরা যেমন কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগ করেন, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর “ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো” কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন “আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠকের হাতে”। উৎসর্গে পাঠকের প্রতি তাঁর অভিমান পরিষ্কার। কবির বক্তব্য, আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য নয়, তার প্রতি পাঠকের অনীহাই দুর্বোধ্য।


কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে একের পর এক এসেছে নতুন যুগ l একই ভঙ্গিতে চর্বিতচরণ কবিদের পছন্দ নয় l বারবার তাই চলেছে নিয়ম ভাঙার খেলা আর নতুন নিয়ম গড়া l প্রতিটি নতুন ধারার প্রয়োগের সময় এসেছে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ l


পাঠক কবিতা পাঠ করে তার মর্ম বুঝে কবিতার স্বাদ অনুভব করতে চায় । তাই কবিকুলের কাছে সাধারণ পাঠকের পক্ষ থেকে যেন অনুরোধ থাকে কবিতাকে সহজবোধ্য করার l প্রতীক যত বিমুর্তই হোক না কেন প্রথম লাইনটি থেকে দ্বিতীয় লাইনে গমনের যেন একটি যৌক্তিক সুত্র থাকে l কিন্তু কবি কি এই দায় নিতে বাধ্য ? আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, না বাধ্য নন l কবি তাঁর ভাব মনের মাধুরি মিশিয়ে যেভাবে খুশী সে ভাবেই লিখতে পারেন l এটা তার স্বাধীনতা । কবির লেখা সম্বন্ধে কোনোরকম বিরুপ মন্তব্য না করে পাঠককে কাব্য-কবিতা নিজের মতো করে বুঝে নিতে হবে l এই যে পাঠক তাঁর নিজের মতো করে কবিতা বুঝে নিলেন, সেই বোঝা যদি কবির কবিতাভাবনার সঙ্গে না মেলে, সেক্ষেত্রে কবিরও আর কিছু বলার থাকে না l  পঠিত কবিতা সম্পর্কে পাঠকের চিন্তা, চেতনা, অনুভুতি, ভাবপ্রকাশ যাই হোক না কেন, কবিকেও তা সানন্দ চিত্তেই মেনে নিতে হয় । কবির লেখার মুর্ত বিমুর্ত রূপকল্প পাঠককে যেমন গিলতে হয়, তেমনি পাঠকের মুর্ত বিমুর্ত প্রতিক্রিয়াকেও অকুন্ঠচিত্তে কবিকে গলাধবরণ করতে হয়। কবিতার ক্ষেত্রে কবি ও তাঁর পাঠক-পাঠিকার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এরকমটা হয়ে থাকে।


আসলে চলচ্চিত্র বা চিত্রকলার যেমন নিজস্ব ভাষা থাকে, কবিতারও তাই । সেই ভাষার শৈলী গদ্য থেকে আলাদা। কবিতা কবির নিভৃত অনুভূতির ফসল। তাই তাতে শৃঙ্খলা কম, অস্থিরতা বেশি। তবু সব শিল্পের মত কবিতারও দায়বদ্ধতা আছে l এই দায়বদ্ধতা হল পাঠকের উপলব্ধির কাছে পৌঁছনোর l অন্যদিকে কবিরা সর্বদাই পুরনো প্রকাশভঙ্গীকে নস্যাৎ করে নতুন বাক্ শৈলী, নতুন পরিকাঠামোর সন্ধানে তৎপর । দুর্বোধ্যতার উৎস এখানেই l
কাব্যের প্রকাশ আসলে ভাবের প্রকাশ এবং ভাব আমাদের গভীর সচেতনতার মধ্যে থেকে  তিলে তিলে ফুটে উঠে। ইঙ্গিত এবং সংকেত কবিতাকে রহস্যময় করে। সার্থক কবিতায় তাদের ব্যবহার অপরিহার্য। পাঠক  সেগুলিকে অতিক্রম করে কবিতার বোধ নেন l অপারগ হলে কবিতার ভাব স্পষ্ট হয় না l অন্যদিকে কবির দায়িত্ব সেই সঙ্কেতগুলি কবিতায় এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা যাতে সেগুলি পাঠককে সমাধানের দিকে নিয়ে যায়।
মিতকথন কবিতার বৈশিষ্ট্য l প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ পাঠককে ক্লান্ত করে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় কম শব্দ ব্যবহার কবিতাকে কখনও কখনও ধাঁধাঁ বা রিডল - এ পর্যবসিত করে। কবির মনে রাখা জরুরী যে সে কবিতা লিখতে বসেছে, ধাঁধাঁ তৈরি করতে নয়।
যে দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে তার মধ্যে একটিকে অনুক্ত রেখে আধুনিক কবিতায় প্রতীক ব্যবহার করা হয়। ফলে দুর্বোধ্যতা থাকে l এই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গন্তব্য খুঁজে নেবার দায়িত্ব কিন্তু সংবেদী পাঠকের।
শুধু ভাব দিয়ে যেমন কবিতা লেখা হয় না, তেমনি শুধুই শব্দও একটি কবিতাকে প্রকাশ করতে পারে না। শব্দ একটি ভাবকেই ভাষায় রূপান্তর করে l অতিরিক্ত মাত্রায় প্রতীকের ব্যবহার কবিতাকে অর্থহীন করে তোলে। সঙ্গতিহীন বিকল্প শব্দের ব্যবহার তাকে ভারাক্রান্ত করে।
কবিতার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হল কবিতার শেষে পাদটীকা লাগানোর প্রচলন নেই। পাঠকের দায়িত্ব সেগুলি খুঁজে নেবার। বিষ্ণু দে’র কবিতার ইতিহাস ও সমাজচেতনার নাগাল পেতে হলে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পড়াশোনা থাকলে সুবিধা হয় l  সুধীন্দ্রনাথের ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনার’ কাছাকাছি পৌঁছোতে হলে পাঠককে তৎসম শব্দ ভেদ করার মানসিক পরিশ্রম করতে হবে। আধুনিক কবিতা  পাঠকের মেধা ও মননের কাছে এটা দাবি করে l আর কবির দিক থেকে বলতে গেলে বলতে হয়,
প্রেরণার পাশাপাশি, একজন কবির অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ l কোনো বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতনতা ছাড়া একজন কবির পক্ষে কাব্য-রচনা রীতিমতো বিপজ্জনক। কবিতায় যে আইডিয়া বা ভাবের কথা বলা হয়ে থাকে, সেটি আকাশ থেকে শ্রাবণের বৃষ্টির ধারার মতো কবির মাথায় ঝরে পড়ে না। কবি যখন বলেন, ‘আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে’ - তখন তারও একটা বাস্তব ভিত্তি কিন্তু থেকে যায়, যার উৎপত্তি কবির ওই সচেতনতা থেকে। তবে বাস্তব-সত্যের সঙ্গে কাব্যের সত্যের একটা পার্থক্য রয়েছে। সেই পার্থক্য তো আমরা বাস্তব-সত্যের মধ্যেও দেখতে পাই। সত্যের রূপ তো আর একটা নয়। প্রত্যেক সত্যের উলটো পিঠে সর্বদাই অসত্য থাকে না। থাকতে পারে অন্য সত্য। এই সতর্কীকরণ কবি ও পাঠক উভয়ের জন্যই l
শব্দকে আকারে আবদ্ধ করে মানুষ। মানুষের পরিবর্তন হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই আকার বদলে যায়। চেনা আকারের বাইরে তার যে রূপ তাকে উপলব্ধি করার দায়িত্ব আধুনিক পাঠকের l মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ কবিতার একটি লাইন, “ভাত খেয়ে আচাবার পর পরিষ্কার নখগুলোকে কেমন মহানুভব মনে হচ্ছে”। এই লাইনে ‘মহানুভব’ শব্দটির অর্থ সমগ্র কবিতার প্রেক্ষিতে বুঝে নিতে হয়। আলাদা করে এই ছত্রের মানে বুঝতে অসুবিধা হয়।
এ কথা বলাই বাহুল্য যে পরিকাঠামো দাবি করে লেখার একটি বিশেষ ধারা বা প্যাটার্ন। প্রায়শই কবি এবং কবিতা তার মধ্যে আটকে পড়ে । ফলতঃ বোধ দুর্বোধ্যতাকে জায়গা ছেড়ে দেয়। কবি ভুলে যান যে কবিতার প্রয়োজনে পরিকাঠামোর আয়োজন। পরিকাঠামোর স্বার্থে কবিতা নয়। বিষয় বিচারে সঠিক পরিকাঠামো বেছে নেবার দায় কবির। বিষয় যদি পরিচিত পরিকাঠামো অতিক্রম করতে চায় নতুন পরিকাঠামো গড়ার দায়িত্বও তার।


দুর্বোধ্যতার সংজ্ঞা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। আজ যে কবিতা দুর্বোধ্য বলে মনে হচ্ছে কাল হয়তো সেটি পাঠকের কাছে সাদরে গৃহীত হবে। একটি মত হল, সৎ এবং পরিণত কবিতার মধ্যে সারল্য অনিবার্য। “সহজ কথা যায় না বলা সহজে।” তার জন্য অনেক পথ পরিক্রমা করতে হয়। দুর্বোধ্যতা পথ আগলে দাঁড়ায় গলি ঘুঁজি পার হয়ে রাস্তা খোঁজার সময়। একবার পাকা সড়ক পেয়ে গেলে সোজা সরল যাত্রা। অনেকের সারা জীবন লেগে যায় পৌঁছোতে। অনেকে চট করে খুঁজে পেয়ে যান।
আধুনিক বাংলা কবিতা মূলত জটিল নাগরিক জীবন যাপনের প্রতিচ্ছবি। তাই বিষয় ও গঠনের বিচারে তার সহজ সরল না হওয়াই স্বাভাবিক। যাপনের যান্ত্রিক একঘেয়েমি তাকে বিরক্ত করে। মেকি সামাজিকতা তাকে একাকী ও বিষণ্ণ করে তোলে। সে ক্রমাগত বহির্বিমুখ, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। এই ব্যাপারটি মেনে-বুঝে নিলে কবিতার দুর্বোধ্যতার কারণ খোঁজা সহজ হয়ে যায়। পাঠক যদি কবিতার সঙ্গে সরাসরি রিলেট করতে পারে তবে কবিতাকে তার আর দুর্বোধ্য মনে হয় না।
কবিতা শুধু আলোকোজ্জ্বল রাস্তায় হাঁটা নয়, তার মধ্যে অন্ধকারও থাকে। কিন্তু উত্তমপুরুষে তা স্বীকার করা অনেক সময় মুস্কিল। তাই প্রয়োজন মুখোশের l অন্য পুরুষের l যতক্ষণ না পাঠক কবিতার মধ্যে এই আলো-কালোর সন্ধান পাচ্ছে, ততক্ষণ সেই কবিতা তার কাছে দুর্বোধ্য। রিলেট করার জন্য তারও ওই আড়ালটুকুর নিতান্ত প্রয়োজন। অন্তরাল তাকে স্বস্তি দেয়।
পাঠকের দেখা সম্পূর্ণভাবেই তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং মানসিকতা নির্ভর। আবার কবিতা বোঝার জন্য নির্লিপ্তিও জরুরী। হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক দিয়েও যাচাই করে নেওয়া দরকার। বুদ্ধিবেত্তা ও আবেগের যথাযথ এবং তুল্যমূল্য সংমিশ্রণ কবিতার অন্তর্লীন বোধ এর সন্ধান দেয়।