আলোচনা পাতাটি বেশ জমে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে l
কবিতাচর্চার কোনো একটি বিষয় নিয়ে একটি আলোচনা হচ্ছে l তাকে কেন্দ্র করে আর একটি l তার রেশ ধরে আর একটি l একটি আলোচনা যেন রিলে রেসের মতো ব্যাটন পরবর্তী আলোচকের হাতে তুলে দিচ্ছেন l সেই আলোচক আলোচনাটাকে একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার ব্যাটন হাতবদল করছেন l প্রায় এক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও তার ভাব, ভঙ্গি আলোচক ভেদে কতো বিচিত্র রকমের। মূল মতটি আপাতদৃষ্টিতে এক হলেও চর্চা ও চর্যায় ভিন্নতা উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্যনীয় l
বর্তমান দিনে সোশাল মিডিয়ায় (ফেসবুকে) কবিতা প্রকাশ বিষয়ে একটি আলোচনা ছিল l আরেকটি ছিল কবিতা ও অকবিতা বিষয়ে l যথাক্রমে আলোচনাগুলি করেছেন আসরের কবি শমশের সৈয়দ ও প্রণব মজুমদার l তার রেশ ধরে আমার আলোচনা ছিল, যার মধ্যে আমি বলেছিলাম কঠোরতম বিরুদ্ধ সমালোচনা করেও একটি সার্থক কবিতা বা একজন প্রতিভাবান কবিকে আটকে রাখা যায় না l এই প্রসঙ্গে সজনীকান্ত দাস ও জীবনানন্দ দাশের নাম নিয়েছিলাম l এই বক্তব্যের সমর্থনে আসরের শ্রদ্ধেয় প্রবীণ কবি প্রবীর চ্যাটার্জী তাঁর আলোচনায় উদাহরণ সহ বলেছেন কিভাবে সজনীকান্ত দাস "শনিবারের চিঠি" পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশের "ক্যাম্পে" কবিতাটিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং কিভাবে সেই পক্ষপাতদুষ্ট আলোচনা সত্বেও কবিতাটি শেষ পর্যন্ত পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়েছে l সেই আলোচনার সূত্র ধরেই আমি "ক্যাম্পে" কবিতাটি আলোচনা করছি l  
বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ উত্তর আধুনিক কবি। প্রকৃতি, মুগ্ধতা, নির্জনতা, যুগযন্ত্রণা, প্রেম, প্রত্যাখ্যান, বিষন্নতা, সমাজ-সমকাল তাঁর কবিতার বিষয়। রূপসী বাংলার কবি তিনি। স্বদেশ তাঁর কবিতার অন্যতম বিষয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থেকে তিনি কবিতার উপরকরণ সংগ্রহ করেন। সমাজলগ্নতা ও বিষয় বৈচিত্র্য তাঁর কবিতাসমূহের বক্তব্যকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় আকর্ষণীয় করে তোলে। যে বাংলায় তাঁর জন্মগ্রহণ, বেড়ে ওঠা, দিন যাপন, সুখ-দুঃখ অবগাহন সে বাংলা তাঁর অতি প্রিয়। প্রকৃতি, প্রকৃতির সঙ্গী ফুল-পাখি, নদী, নারী, প্রিয় মানুষ আর অন্তর্গত বোধ জীবনানন্দ দাশকে আলোড়িত করেছে। অশ্লীলতার দায়ে তাঁকে অভিযুক্ত হতে হয়েছে কখনো। আবার কখনো প্রশংসিত হয়েছেন কাব্য সমালোচকদের কাছে।


বিগত দেড়শত বছর ধরে বাংলা কবিতা নিরন্তর আধুনিকতার সন্ধান করেছে প্রকাশের নতুন নতুন মাত্রায় । এই দেড় শতাধিক বছর কালের বাঁকবদলের সময়ে বেশ কিছু কবিতা এসেছে যারা নিজেরাই একেকটি বিদ্রোহ, এক একটি পরিবর্তন।
'ক্যাম্পে' কবিতাটিকে এই শ্রেণীভুক্ত কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিতাপর্বে আধুনিকতার উন্মেষকারী কবিতা হিসেবেও এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এছাড়াও জীবনানন্দের আত্মানুসন্ধান ও নিজস্ব পথযাত্রার প্রারম্ভ হিসাবেও 'ক্যাম্পে' কবিতাটি  উল্লেখযোগ্য।


১৯৩২ সালে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত 'পরিচয়' পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হয় l প্রকাশের সাথে সাথে সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়। কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু জোছনা রাতে হরিণ শিকার। কিন্তু মূল বিষয় নর নারীর, মানুষে মানুষে শিকার ও শিকারীর সম্পর্ক। শিকারের প্রয়োজনে প্রলোভনের প্রসঙ্গ।


কবিতাটিতে একটি অসমীয়া শব্দ 'ঘাই' ব্যবহৃত হয়েছে - 'টোপ' অর্থে। মনে হতে পারে কবি কখনো আসামে গিয়ে থাকবেন, বা শিকার অভিযানে গিয়ে থাকবেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ সম্বন্ধে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ভীষণ অন্তর্মুখী এবং নিজের গন্ডির ভেতরে চিরকাল বসবাস করা এই কবি জীবনে কখনো আসামে যান নি, শিকারেও যাননি। কবির ভাই অশোকানন্দের বিবৃতি থেকে জানা যায়, তিনি মুনিরুদ্দি নামে এক ব্যক্তির সাথে কথা বলতেন, যিনি ছিলেন একজন শিকারি। তার কাছে কবি শিকার সম্বন্ধীয় অনেক কিছুই শুনতেন। ধরে নেয়া যেতে পারে এই লোকটির কাছ থেকেই তিনি অসমীয়া এ শব্দটি শুনেছেন।
'ক্যাম্পে' কবিতার প্রেক্ষাপট ও চরিত্র চিত্রণে কবি নিপুণ পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। ক্যাম্পে অবস্থানরত কথক শুনতে পাচ্ছেন এক ঘাই হরিণীর ডাক
"আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি –
কাহারে সে ডাকে!
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন"


ঘাই হরিণী বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে জ্যান্ত হরিণী, যাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘাই হরিণীর ব্যবহার সম্ভবত জীবনানন্দের জীবনের এক অসফল অধ্যায়ের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে প্রেমিকা তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে, তাঁর সরল বিশ্বাস ও ভালবাসাকে অমর্যাদা করেছে অবজ্ঞা ভরে।
ঘাই হরিণীর মৃদু শব্দময় বিষন্ন আর্তনাদ ইঙ্গিত দেয় তার প্রণয়সঙ্গী পুরুষ হরিণের অথবা তার খাদক চিতার আগমনের। একই সাথে, ঘাই হরিণী যেহেতু শিকারের টোপ - হরিণের জন্য এবং চিতার জন্যও, সে আরো ইঙ্গিত দেয় শিকারির দল কাছেপিঠে আছে। কবি পরের অংশে বর্ণনা দেন সরলমনা চঞ্চল হরিণের দল কিভাবে প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছে-
"আজ এই বিস্ময়ের রাতে
তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;
তাহাদের হৃদয়ের বোন
বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে
জোছনায় –
পিপাসার সান্ত্বনায়—অঘ্রাণে—আস্বাদে!"


তাদের হৃদয়ের বোন অর্থাৎ ঘাই হরিণী ফাল্গুনের এই সোনালি রাতে ডেকে যাচ্ছে। বাঘের দল এখন অনুপস্থিত। লক্ষণীয় শিকারের দুই প্রকরণ এখানে উপস্থিত - টোপ ও শিকার - যার একদল অপরদলকে আহ্বান করছে বিনাশের কাছাকাছি। ভয় ভুলে গিয়ে সরলবিশ্বাসে হরিণের দল জল জঙ্গল পেরিয়ে হরিণীর ডাকে জ্যোত্স্নালোকে সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের তলায় মিলিত হবার জন্য ছুটে আসে।


"একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
দাঁতের—নখের কথা ভূলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই
সুন্দরী গাছের নীচে—জোছনায়!"


বনপথ ছেড়ে ঘাইমৃগীর সাথে মিলিত হতে আসা মৃগের দল জলের শব্দ পিছে ফেলে আসে সুন্দরী গাছের নীচে। কবিতাটি স্পষ্ট আমাদের নিয়ে যায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বিস্তৃত সুন্দরবন অঞ্চলে, যেখানে অসংখ্য খালে বিলে নদীতে ছেয়ে আছে বিপুলা বনাঞ্চল যার মধ্যে রয়েছে শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদ-সুন্দরী। সকাল হতেই, ভোরের আলো ফুটতেই দেখা যায় ঘাইহরিণীর পাশে মৃত মৃগের সারি।
"কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া;
সকালে—আলোয় তারে দেখা যাবে –
পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা পড়ে আছে।"


কথকের ভূমিকা পাঠকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দেখা দেয় যখন পাতে আসা হরিণের মাংস তিনি আরাম করে খান, স্বাদ নেন ঝলসানো মাংসের। অথচ এর আগে মনে হয়েছিল তিনি ক্যাম্পে এসেছিলেন শুধু ভ্রমণের স্বাদ পেতে। যেখানে তিনি শিকারির শিকারের নীরব দর্শক। প্রথমাংশে কবি তাকে উপস্থাপন করেছেন সহৃদয় এক ব্যক্তি হিসেবে যিনি হরিণের পালের প্রতারিত হবার দু:খে ব্যথিত। এই অংশ পাঠ করে অনুমান হয় তিনি শিকারিদের সাথেই  ছিলেন, কিংবা নিজেই শিকারে মত্ত হয়েছেন।
"আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাব,
মাংস খাওয়া হল তবু শেষ?
কেন শেষ হবে?
কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে
তাদের মতন নই আমিও কি?"


কথক চরিত্রটি ধরে নেয়া যায় সময়ের একটা প্রতিভূ, যাকে নৈতিক অনৈতিক সব রকম কাজের শুধু দর্শক হতে হয়, দেখে যেতে হয় পরাজিত মানবতার বিপন্নতা, ক্রম অবক্ষয়। কবিতার বাঁক এখানেই বদলে যায় আশ্চর্য রূপে যখন কথক প্রশ্ন করেন তাদের মতন নই আমিও কি? কথক নিজেকেই প্রশ্ন করছেন, যে প্রশ্নের অসীম উত্তরের সবটুকুই তার জানা, কিন্তু মাঝে মাঝে অজানা হয়ে ধরা দেয়। পৃথিবীর সব হিংসা ভোলা সাহসী মৃগশাবক ঘাইহরিণীর মায়াজালে ধরা দেয় l
"আমার হৃদয়—এক পুরুষহরিণ –
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয়—চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?"


এই পঙক্তিগুলোতেই ফুটে ওঠে না পাওয়ার বোধ, প্রতারণা, হারানো ক্ষতের যন্ত্রণা। যখন বুকের আরশিতে জমাট হয়ে থাকা রক্তধারার মত উৎসারিত প্রেম মিশে যায় ধুলোয়, মৃত মৃগদের মতন। পরমুহূর্তেই কবির অন্তিম কৌতূহল আমাদের চিরন্তন মানবিক বোধটাকেই তুলে ধরে। নিজের বিনাশ মাঝে মাঝে তুচ্ছ মনে হয় যখন হৃদয়ের বোনের বেঁচে থাকাটা অনেক বড় অর্থ বহন করে।
"আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো
যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে
এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিলে নাকি
জীবনের বিস্ময়ের রাতে
কোনো এক বসন্তের রাতে?"


বিস্ময় নিয়ে বেঁচে থাকা জীবন কোন প্রলোভন,  ঘাইহরিণীর মত রমণীর ভাবনা ভাবতে থাকে।সময়ের অতলান্তে ডুব দেয় সমস্ত বনানী, নিঃস্পৃহ কথক, মৃত মৃগের দল, এমনকি দোনলা রাইফেলে যারা কিনে নেয় জীবন। কবিতা শেষ হয় আমাদের অন্তরের রক্তক্ষরণের শাশ্বত চিত্র তুলে ধরে।
"যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়
হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে
তাহারাও তোমার মতন–
ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদের ও হৃদয়
কথা ভেবে— কথা ভেবে— ভেবে।"


যথার্থ অর্থেই কবিতার মূল সুর তাই। কবিতাটি আমাদের জানায় আমাদের জীবনের যাবতীয় অজাচার, প্রেমের অস্ফুট প্রকাশ, বেদনার নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব সব কিছুর শেষ কথা সার্বজনীনতা, সার্বজনীন নিঃসঙ্গতা। যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের, কীটের, বন বেড়ালের সে জীবনের ছায়া মানবের মাঝেও বিদ্যমান। এ জীবনে হাসি কান্না আনন্দ বেদনার অন্তিমে আছে বিপন্ন বিস্ময়, অর্ন্তগত ক্ষয়ের সূত্র।


ত্রিশের দশকে নতুন কবি ও কবি যশোপ্রার্থীদের যম হিসেবে পরিচিত সজনীকান্ত দাশ "শনিবারের চিঠি"তে কবিতাটির বিরুদ্ধতা করেন। তার লেখায় ফুটে ওঠে ক্ষোভের সীমাহীন প্রকাশ। বস্তুত ঘাই হরিণী শব্দের ব্যবহারে তার কাছে কবিতাটি ভীষণ অশ্লীল মনে হয় এবং তিনি ঘাই হরিণী শব্দটিকে যৌন প্রলোভন হিসেবে নেন। "হৃদয়ের বোন" শব্দটি নিয়েও তিনি কবিকে কটাক্ষ করেন।
“বনের যাবতীয় ঘাই-হরিণকে 'তাহাদের হৃদয়ের বোন' ঘাই-হরিণী অঘ্রাণ ও আস্বাদে'র দ্বারা তাহার পিপাসার সান্ত্বনা'র জন্য ডাকিতেছে। পিসতুতো, মাসতুতো ভাইবোনদের আমরা চিনি। হৃদতুতো বোনের সাক্ষাৎ এই প্রথম পাইলাম।"


'পরিচয়' এর মত উচ্চশ্রেণীর পত্রিকা, যাতে রবীন্দ্রনাথ, হীরেন্দ্রনাথের লেখা ছাপা হয় সেখানে এরূপ অশ্লীল কবিতা কিরূপে ছাপা হয় এই প্রশ্নও তোলেন তিনি।
প্রকৃতপক্ষে সজনীকান্ত দাসের মত দ্বিতীয়শ্রেণীর নেতিবাচক সমালোচকের দ্বারা বাংলা কাব্য ধারার বাঁকবদলকারী এমন একটি কবিতার এমন রূঢ় সমালোচনা হবে এটা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়। এ কবিতায় সুন্দরী গাছের উল্লেখ করেও কবিকে কটাক্ষ করেন তিনি। বলেন, "কবির তন্ময়তায় না হয় গাছও সুন্দরী হইল!" সম্ভবত সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী গাছের কথা তিনি জানতেন না।


বিরূপ সমালোচনায় অতিষ্ঠ হয়ে জীবনানন্দ প্রথম বারের মত তার কবিতার সমালোচনা বিষয়ে কলম ধরলেন। জীবনানন্দ অনুগ্রাহী কবি ভূমেন্দ্র গুহর কাছে লেখাটি ছিল। তিনি সেটি শতভিষা পত্রিকার ভাদ্র ১৩৮১ সংখ্যায় প্রকাশ করেন l
"আমার ক্যাম্পে কবিতাটি সম্বন্ধে দু একটা কথা বলা দরকার বলে মনে করি। কবিতাটি যখন শেষ হয় তখন মনে হয়েছিল সহজ শব্দে-শাদা ভাষায় লিখেছি বটে, কিন্তু তবুও হয়তো অনেকে বুঝবে না। বাস্তবিকই ’ক্যাম্পে’ কবিতাটির মানে অনেকের কাছে এতই দুর্বোধ্য রয়ে গেছে যে এ কবিতাটিকে তাঁরা নির্বিবাদে অশ্লীল বলে মনে করেছেন। কিন্তু তবুও ’ক্যাম্পে’ অশ্লীল নয়। যদি কোন একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এই কবিতাটিতে থেকে থাকে তবে তা জীবনের-মানুষের-কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নি:সঙ্গতার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নি:সহায়- ক্যাম্পে কবিতাটির ইঙ্গিত এই; এইমাত্র l"


কবিতাটির এই সুর - শিকারি প্রলোভনে ভুলিয়ে শিকারকে আয়ত্ত করে, হিংসায় সফলতা পায় l   পৃথিবীর এই ব্যবহারে কবি বিরক্ত, বিষন্ন, নিরাশ্রয়। ’ক্যাম্পে’ কবিতায় কবির মনে হয়েছে শুধু হরিণ শিকারিই প্রলোভনে ভুলিয়ে হিংসার জয় সংঘটিত করছে না, সমস্ত সৃষ্টিই যেন তেমন এক শিকারি, আমাদের সকলের জীবন নিয়েই তার সকল শিকার চলছে l প্রেম-প্রাণ-স্বপ্নের ওলট পালট হচ্ছে l ধ্বংসের নিরবচ্ছিন্ন আয়োজন যেন সবদিকে l


আমাদের সমাজে প্রতারক মানুষ আছে। আছে কিছু বিশ্বাসী মানুষও। স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা আমাদের রক্তাক্ত করে। দয়িতার অস্থিতি, সামাজিক অবক্ষয়, অন্তর্ধান- সব সত্য জেনে নিয়েও পরম আরাধ্য ‘প্রেম’ চৈতনালোকে আলো ছড়ায়।


বাংলা কাব্যে পবিত্র কঠিন নিরাশ্রয়তার সুর, "জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মত আমরা সবাই" এক নতুন আবেশ নিয়ে আসে l এই সুর আগে এসেছে কিনা জানিনা। এ সুরের সঙ্গে চলতি বাঙালি পাঠক ও লেখক যে খুব কম পরিচিত তা নি:সঙ্কোচে বলা যেতে পারে। যে জিনিস অভ্যস্ত বুদ্ধি বিচার কল্পনাকে আঘাত করে-যা পরিচিত নয় তার অপরাধ ঢের। তাই অশ্লীলতার দোষে ’ক্যাম্পে’ কবিতাটি অপরাধী।


এই কবিতাটি নিয়ে তৎকালে অব্যাহত সমালোচনায় বিরক্ত হয়েই হোক, কিংবা তৎকালীন লেখক সমাজের প্রতি অভিমানবশতই হোক, কিংবা নিজের সাহিত্য কীর্তির সামর্থ্য বিষয়ে সন্দিহান হয়েই হোক, জীবনানন্দ দাশ বেশ কিছুদিন আর পত্রিকায় কোনো কবিতা প্রকাশ করেন নি l  ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫ কবিতা প্রকাশ বন্ধ রাখেন l তবে আপন মনে নিভৃতে লিখে গেছেন এই নির্জনতার কবি। সম্ভবত জীবনানন্দ এই সময়ের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আজ তিনি শুদ্ধতম কবি বলে খ্যাত। ১৯৩৫ সালে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমরসেন সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় আবার তাঁর কবিতা বের হয়