কবির মনে একটা ভাব এল l সেই ভাবকে আশ্রয় করে তিনি কবিতা লিখলেন l সেই কবিতা পড়ে কবির মনোভাব পাঠক কি পুরোটা বুঝতে পারেন ? কবিতাটির উৎসমুহূর্ত, তার প্রেক্ষাপট কবি যদি বলে দেন, সেক্ষেত্রে কবিতার ভাব, কবির মনোভাব বুঝতে পাঠকের একটু সুবিধা হবার কথা l কিন্তু কবিতা বিষয়টি এমনই ব্যঞ্জনাপূর্ণ, এখানে ভাবের এত গভীরতা, অর্থের এত আড়াল থাকে যে, কোনো কবিতার ক্ষেত্রে বোধের ঐক্য গড়ে তোলা অর্থাৎ কবি যা বলতে চেয়েছেন, পাঠক সেটাই বুঝবেন - এমনটা নিশ্চিত করে হয় না l কবি তার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা বোধ থেকে কবিতা লিখলেন l তাঁর বোধের খন্ডচিত্র ঐ কবিতাটি l কবির জ্ঞান ও বোধের যে অংশটি কবিতায় সরাসরি এলো না, তা কিন্তু কবির স্মরণে ও মননে আছে l ফলে তিনি যখন কবিতাটির বোধ নিচ্ছেন তখন কবিতাটিতে সরাসরি যা বলা আছে এবং কবিতার বাইরে ঐ কবিতাকেন্দ্রিক আনুষঙ্গিক যা তাঁর স্মরণে ও মননে আছে - এই দুয়ের সংমিশ্রণে তিনি তা করছেন l
এখানে সময় নিজেও এক ঘটক l কবি একটি কবিতা যখন লিখছেন, তখন কবিতাটি নিয়ে যা ভাবছেন, পরবর্তী কোনো সময়ে ভিন্ন মানসিক অবস্থায় ঐ কবিতা সম্বন্ধে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হতে পারে l ভাবের ভিন্নার্থ করতে পারেন তিনি l
আর পাঠকের দিক থেকে বলতে গেলে, তাঁর পরিবেশ, পটভূমি ভিন্ন l তিনি তাঁর নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিন্ন এক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কবিতাটি পড়ছেন এবং তার পাঠোদ্ধার করছেন l তার সামনে কবিতাটির উৎস, তার প্রেক্ষাপট নেই,  আছে কেবল কবিতাটি l  কবিতার মধ্যে যা বলা আছে তার মধ্যেই তাঁর বোধ তৈরি হয় l ফলে এখানে কবি ও পাঠকের বোধের অনৈক্য হতেই পারে l ব্যাপারটি স্বাভাবিক l
প্রকৃত সাহিত্যচর্চা ও তার উন্নতির জন্য সৃজনশীল সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সত্যিকারের গঠনমূলক, সৎ সমালোচনা সাহিত্যেরও প্রয়োজন আছে l এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন কবি-লেখক ও আলোচকদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক l শুধু অন্ধ প্রশংসা নয়, সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে সততার সঙ্গে সাহিত্যের আলোচনা প্রয়োজন l ভালোকে ভালো বলতে হবে l দুর্বলতা থাকলে সেটাও বলতে হবে খোলাখুলি l  আবার কোনো এক আলোচকের বিশ্লেষণই শেষ কথা নয় l সাহিত্যের বিচারে বিতর্কের প্রচুর অবকাশ আছে l
এখানেও সময় এক আলোচক ও বিচারক l এমন বহু উদাহরণ আছে যেখানে কোনো সাহিত্য রচনা তার সমকালে সাহিত্য সমালোচকদের দ্বারা বাতিল হয়েছে, পাঠকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন l কিন্ত সময় তার প্রকৃত মূল্যায়ন করেছে পরবর্তী কালে l কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর জীবনকালে তাঁর রচনার জন্য সেরকম খ্যাতি পান নি l শনিবারের চিঠি পত্রিকা ও তার সম্পাদক সজনীকান্ত দাস জীবনানন্দ দাশের কবিতার সুবিচার ও সম-আলোচনা করেন নি l কিন্তু কালের বিচারে সজনীকান্তের মূল্যায়ন পরিত্যক্ত হয়েছে l জীবনানন্দ দাশ আজ বাঙলার প্রাণের কবি, আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বলে সম্মানিত l মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন "মেঘনাদবধ কাব্য" লেখেন, যা প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে, তখন তার অন্যায় সমালোচনা হয়েছিল l ব্যঙ্গ করে "ছুছুন্দর বধ কাব্য" লেখা হয়েছিল l কবি রবীন্দ্রনাথও কিশোর বয়সে ১৮৭৭ ও ১৮৮২ সালে যখন তাঁর বয়স যথাক্রমে ১৬ ও  ২১, তখন মেঘনাদবধ কাব্যের বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর রচনায় l আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আক্রমণাত্মক। আলোচনার শেষে বিশ্বকবি লিখেছিলেন, ‍'আমি মেঘনাদ বধের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লইয়া সমালোচনা করিলাম না। আমি তাহার মূল্য লইয়া, তাহার প্রাণের আধার লইয়া সমালোচনা করিলাম, দেখিলাম তাহার প্রাণ নাই। দেখিলাম তাহা মহাকাব্যই নয়।' এতে সমকালে ঐ মহাকাব্যের ক্ষতি হয়েছিল, মহিমা ধূলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল l রবীন্দ্রনাথের যুক্তি ছিল "সীতাহরণকারী পাপিষ্ঠ রাবণের স্মরণে যাঁঁর কল্পনা উত্তেজিত হয় এবং ধার্মিক রামচন্দ্রের স্মরণে যাঁর ঘৃণা - এ হেন ইতর ব্যক্তিকে মহাকবি কেন, কবিও বলা চলে না l" রবীন্দ্রনাথের আরও যুক্তি ছিলো, একটি মহাকাব্য এক বা একাধিক মহাবীরকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় l তেমন মহৎ চরিত্র এই কাব্যে কোথায় ? মহাকাব্যিক গুণগুলি যেমন - ঘটনার মহত্ব, মহৎ অনুষ্ঠানের বর্ননা, চরিত্রে অনন্যসাধারণতা, অমরতা - অনুপস্থিত l শুভশক্তির প্রতীক রামকে যেখানে খলনায়ক এবং অশুভ শক্তির প্রতিভূ রাবণ ও মেঘনাদকে যেখানে নায়ক হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে, সেটা মহাকাব্য তো নয়ই, কবিতাও হয় নি l তাছাড়া মধুসূদনের কাব্যের কাহিনীটিও মহাকাব্যের উপযোগী ছিলো না বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন l তৎকালীন কোনো কবি সমালোচক রবীন্দ্রনাথের এই অভিযোগ খন্ডন করে মেঘনাদ বধ কাব্যের সঠিক মূল্যায়ন করার সাহস দেখান নি l ১৯১২ সালে নিজের ৫১ বছর বয়সে পরিণত রবীন্দ্রনাথ নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং ঐ কাব্যের মহাকাব্যিক গুণের প্রশংসা করে মধুকবিকে মহৎ কবিরূপে মেনে নেন l
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই বিলম্বিত মূল্যায়ন পাঠকমহলে কোনো সাড়া ফেলে নি l


যদিও মেঘনাদবধ কাব্য সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী মহাকাব্যের গৌরব সর্বাংশে দাবী করতে পারে না। মধুসূদন দত্ত তাঁর কাব্যকে অষ্টাধিক সর্গে বিভক্ত করেছেন এবং সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী এতে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, যুদ্ধ, মন্ত্রণা প্রভৃতির সমাবেশও করেছেন। কিন্তু সর্গান্তে তিনি নূতন ছন্দ ব্যবহার করেননি, সর্গশেষে পরবর্তী সর্গকথা আভাসিত করেননি। তিনি বলেছিলেন -
"গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত ”
কিন্তু তাঁর কাব্যে করুণ রসেরই জয় হয়েছে।
এছাড়াও, সংস্কৃত মহাকাব্য মিলনান্তক, মধুসূদনের মহাকাব্য বিষাদাত্মক। সর্বোপরি, মধুসূদনের কাব্যের নায়ক রাবণ এবং রাবণ অনার্য্যবংশ সম্ভূত - সদ্বংশজ এবং ধীরোদাত্তগুণ সমন্বিত নন। সুতরাং, সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের মতে একে মহাকাব্য বলে অনেকে স্বীকার করতে চান না। কাজেই মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণ-আহৃত কাহিনীর পুণরাবৃত্তি নয় - এটি নবজাগ্রত বাঙালীর দৃষ্টি নিয়তি-লাঞ্ছিত নবমানবতাবোধের সকরুণ মহাকাব্যের রূপে অপূর্ব গীতি-কাব্য। মেঘনাদবধ কাব্য এ দিক দিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক অনন্য সৃষ্টি।


মধুসূদন অতি আশ্চর্য্যজনকভাবে নির্মাণ-কুশলতা গুণে মহাকাব্যোচিত কাব্য-বিগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। এ কাব্যের তাৎপর্য্য রাবণ-চরিত্রের প্রতীকতায়। তাঁর সৃষ্ট রাবণ চরিত্রে পরম দাম্ভিকতা প্রকট হয়ে উঠেনি। রামায়ণকে তিনি  যে মানবতার আলোকে বিধৌত করে রচনা করেছেন, তা আসলে রোমান্টিক মহাকাব্য। এ কারণে আকারে 'মেঘনাদবধ কাব্য' মহাকাব্যোচিত হলেও, এর প্রাণ-নন্দিনী সম্পূর্ণ রোমান্টিক এবং মধুসূদন এ কাব্যে জীবনের যে জয়গান করেছেন, তা বীররসের নয়, কারুণ্যের। মিলটন রচিত প্যারাডাইস লস্ট মহাকাব্য ছিল মধুসূদনের প্রেরণা l


"মেঘনাদবধ কাব্য" কে বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে প্রকৃত মহাকাব্যিক মর্যাদায় স্থাপন করেন ১৯২১ সালে বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের জনক কবি সমালোচক শশাঙ্কমোহন সেন মহাশয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায় l পরে এই বক্তৃতাটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় যার নাম "মধুসূদন : তাঁঁর অন্তর্জীবন ও প্রতিভা" l এই গ্রন্থে তিনি মধুসূদনকে বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত মহাকবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন l তিনি ইউরোপীয় ও গ্রীক উদাহরণ সহযোগে এই রচনার মহাকাব্যিক গুণাবলী উল্লেখ করেন, যে কাব্যাদর্শে নায়ক শত প্রতিকূলতা এবং বিরাট ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েও নতি স্বীকার করে না, অনমনীয় মেরুদন্ড নিয়ে অটল থাকে l
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "সোনার তরী" কবিতাটি  প্রকাশিত হওয়ার পর তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়ে বহু বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বহু বিশিষ্ট আলোচক এই কবিতাটির ভিন্ন ভিন্ন ভাবার্থ উদ্ধার করেন l কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রবীন্দ্র বিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন l
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গদর্শনে দ্বিজেন্দ্র লাল রায় লিখলেন, "পাঁচজন শিৰিত ব্যক্তি সেই নগন্য কবিতাটির ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বের করে নিজেদের মধ্যে বিবাদ করেছেন_ তখন এ সিদ্ধান্ত অমূলক নয় যে, কবিতাটির মধ্যে সত্যিই কোন অর্থ নাই।......
এ কবিতাটি দুর্বোধ্য নহে - অবোধ্য নহে - একেবারে অর্থশূন্য, স্ববিরোধী l"
(সূত্র: কবিতা পরিচয় _সম্পাদনা: অমরেন্দ্র চক্রবর্তী)।
আজ আমরা সবাই জানি এই বিরুদ্ধ আলোচনা সত্বেও "সোনার তরী" আজ বিশ্ব সাহিত্যে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে স্বীকৃত l


সুতরাং কোনো মহৎ শিল্পকর্মের সমকালে বিরূপ সমালোচনা হলেও সময়কালে কোথায় ধুলায় মিশে যায় সেই বিরোধিতা l সময় শ্রেষ্ঠ বিচারক, শ্রেষ্ঠ আলোচক, শ্রেষ্ঠ রসিক l কাল, মহাকাল সাহিত্য তথা যে কোনো শিল্পকর্মের শ্রেষ্ঠ বিচারক l
কিন্তু কালের এই বিচারটাও হয় সেই সম-আলোচনার পথ ধরেই l আলোচনা,সমালোচনা, সাহিত্য-কর্মের রসাস্বাদন ও সুস্থ বিকাশের সহায়ক
l
বাংলা সাহিত্য আলোচনার জগৎ যাদের যোগদানে সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের কথা বলতে গেলে বলতে হয় শশাঙ্কমোহন সেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব  বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, নীহার রঞ্জন রায় প্রমুখের নাম l মধুসূদনের চিঠিপত্রের মধ্যেও আমরা বিশ্বসাহিত্যকে মন্থনকারী অসাধারণ সাহিত্য সমালোচনার পরিচয় পাই l আর সাহিত্যের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণমূলক ইতিহাসকার হিসাবে পেয়েছি দীনেশ চন্দ্র সেন, সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মহম্মদ এনামুল হক প্রমুখদের l  
এরকম বহুধা বিস্তৃত আলোচনার উপযুক্ত পরিসর সুস্থ সাহিত্য রচনা ও তার বিকাশের অন্যতম শর্ত l
যখন থেকে সৃজনশীল সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছে, অনতিকাল পর থেকেই সেই সাহিত্যকে বোঝার জন্য, তার রসোপলব্ধির জন্য সমালোচনা সাহিত্যের বিকাশ হয়েছে l কোনো সৃজনশীল কর্ম কেন অসাধারণ, কোথায় তার সৌন্দর্য্য ও মাধুর্য রয়েছে, পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে তা উদ্ভাসিত করেন আলোচকেরা l কবিগুরুর ভাষায়, "একটি ফুলের পাশে আর একটি ফুল ফোটানো" l


** চলন্তিকা তৃতীয় বর্ষ ৯ম সংখ্যা, বৈশাখ সংখ্যা, ২০১৯ এ প্রকাশিত, পৃষ্ঠা - ৬৫