"অলৌকিক আনন্দের ভার
বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার,
তার নিত্য জাগরণ; অগ্নিসম দেবতার দান
ঊর্ধ্বশিখা জ্বালি চিত্তে আহোরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ।"
                  ভাষা ও ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


সারাদিন কর্মব্যস্ততার শেষে যখন ক্লান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে পড়তে চায়, সৃজনশীল মানুষজনেরা তখন এক ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত হন। কবির ভাষায় "রাতের জ্বর"। সারা শরীরে ঘুমের আবেশ আসে। কিন্তু চোখ দুটিকে জাগিয়ে রাখতে হয়, খুলে রাখতে হয়। ঘটে যাওয়া বিবর্ণ অতীতের ক্যানভাস থেকে নতুন সৃষ্টির জন্য রঙীন রসদের অন্বেষণে রাতের অন্ধকারে লুব্ধ চোখে ফুটে ওঠে এক প্রবল আকাঙ্খা।
রাতের সুখ হলো ঘুম l এই ঘুম ক্লান্ত দেহ, শ্রান্ত মনকে আরাম দেয় এবং আবার পরের দিনে কঠোর পরিশ্রম করবার জন্য, সমস্ত রকমের দায় দায়িত্ব পালন, ঝুট ঝামেলা সামলানো ইত্যাদির জন্য শরীরকে নতুন জীবনীশক্তি প্রদান করে প্রস্তুত করে দেয় l কিন্তু নতুন কিছু সৃষ্টি করার যে উন্মাদনা, তা রাতের সুখের পরোয়া করে না l তার মধ্যে কাজ করে ভিন্ন ভাবে বেঁচে থাকার এক প্রেরণা l সেই প্রেরণার তাড়নায় রাতের ঘুম তাড়িয়ে, জৈব এই প্রয়োজন এড়িয়ে, সরল সুখের পথ মাড়িয়ে, চিন্তার জগতে চলতে থাকে বোধের বাছবিচার l যে সৃজনভাবনা মনের মধ্যে খেলা করে তাকে ঘিরে নানান বিকল্প মাথায় ভীড় করে আসে l নিজের বোধ দিয়ে সেগুলির গ্রহণ বর্জনে নিশিযাপন চলে l


সৃজনশীলতার দহনে প্রকৃতির রূপ রঙ রস গন্ধের সন্ধান চলে সন্ধ্যা থেকে সকাল, অর্থাৎ রাত্রিভর l কখনো সুন্দর সব ভাবনা পরপর স্বতস্ফুর্তভাবে মনের আঙিনায় এসে ভীড় করে l সৃষ্টি হয় অনুপম কাব্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা l কখনো বা ভাবনার জগতে চলে খরা l একটিও সুন্দর, নতুন ভাবনা মনের কোণে উঁকি মারে না l তখন পুরনো ভাবনাগুলিকেই নতুন ব্যাখ্যায়, সহজ কথাগুলিকে ঘুরিয়ে বেঁকিয়ে, নতুন আঙ্গিকে, একটু পরিবর্তন, পরিমার্জন করে নিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করা হয় l মনকে প্রবোধ দিয়ে তখনকার মতো সৃজনশীলতার খরাকে কাটিয়ে উঠে সৃষ্টির ধারাটিকে প্রবহমান রাখার প্রয়াস চলে l চলে রাত্রিভর, জাগরণে l


সৃজন ইচ্ছা আছে l সৃজন প্রয়াস আছে l কিন্তু মৌলিক সৃজন ভাবনা আসছে না l পুরনো ভাবনাকে ঘুরিয়ে বেঁকিয়ে জটিল কুটিল অসৎ প্রচেষ্টায় রঙের ওপর রঙ চড়ছে তথাকথিত নতুন সৃষ্টির গায়ে অর্থাৎ দেয়ালে l সৃজন দুর্বলতা আড়াল করতে এত বেশি বাজে উপকরণ তার ওপর আরোপ করা হয় যে তার ভারে মূল যে সৃষ্টি সেটিই অন্তরালে চলে যায় অর্থাৎ তার কোনো বিশেষত্ব থাকে না l
জীবন নশ্বর l কিন্তু এই ভাবনাকে পেছনে ফেলে মন ভবিষ্যৎ ভাবনায় নিয়োজিত হয় l প্রকৃতি থেকে নানা রসদ ঋণ নিয়ে বর্তমান দিন পর্যন্ত যে সৃষ্টিকর্ম করা গেছে,  তার থেকে অমরত্বের কোনো আভাস আসে নি l কিন্তু মন সে কথা শোনে না l  ভবিষ্যতে তার প্রাপ্তির লোভ থাকে l ফলে কষ্টকৃত সৃজনকর্ম ও সৃজনসাধনা অব্যাহত থাকে l
এইভাবেই একজন কবি শিল্পীর জীবন অতিবাহিত হয়ে চলে l জীবনে তাঁদের সুখ শান্তি বিশ্রাম - এই সরল প্রাপ্তিগুলি বিসর্জন দিতে হয় l সাধারণ মানুষের জন্য যেটা আসল জীবন, সুখ, শান্তি, ভোগের জীবন, সেই জীবন ছেড়ে দিয়ে কবি শিল্পীরা এক নকল জগতের সন্ধানে নিমগ্ন থাকেন l তাঁদের ভাবনা, তাঁদের মনন এক ভিন্ন জগৎ, এক ভিন্ন দ্বীপের প্রতি নিবদ্ধ l ভিন্ন এই জগতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাদের এক মিলনসুখ দান করে l এই মিলনের পরিণতিতে জগৎ সংসার নব নব সৃষ্টি কর্মে ভাস্বর হয়ে ওঠে l


কবি কেতন শেখ এর অন্য একটি কবিতা "নক্তচারী" তেও একই ভাবনার প্রকাশ দেখি l


"সন্ধ্যা এখন ডাকছে আমায়
আর ডেকো না তোমার কাছে,
ধূপ ছায়া দিন হয় তো তোমার
আমার শুধু নিশাই আছে।


আমার আমির এষণ শুরু
প্রদোষ গগন বর্ণ মায়ায়,  
যেই আমাকে তোমার ভাবো
তার বিরতি বিকেল ছায়ায়।


সেই আমিটার রোজনামচায়
ভোরও তোমার তোমারই দুপুর,
এই আমিটা তিমিরের নট
শর্বরী তার পায়ের নূপুর।


অংশুমালীর সাথে আমার
জৈব গরজ আর কিছু নেই,
সাঁঝের আলো নিভবে কখন
মনটা থাকে সেই আশাতেই।


রোদ মাখা ক্ষণ হয় তো সবার
অন্ধকারে আমার শ্বসন,
দেহের খবর কে রাখে আর
তমসা স্নানেই মনের সাধন।


নিরালোকে মুক্তি আমার
সমর্পণও রাতের কোলে,
রজনী সুধায় প্রমত্ত হই
আটকে থাকি নক্ত জালে।


কাব্য আমার নৈশ পূজা
ছন্দমালায় জোনাক আলো,
শ্বেত জোছনার রাফ খাতাতে
ভাবনা লেখে ক্ষপার কালো।


এই আমি তাই ঘুম ভুলে রোজ
হচ্ছি রাতের পরাণ দোসর,
সুপ্ত ধরা ... ঝলমলে এই
রাত ও কবির গুপ্ত আসর।"


কবির কবিতাগুলির বৈশিষ্ট্য হলো সেগুলি নিজস্ব কিছু অপূর্ব শব্দাবলী দ্বারা সমৃদ্ধ। ছন্দের ঝলমলে ব্যবহারে কবিতাগুলি ঝরঝরে সুখপাঠ্য এবং শ্রুতিমধুর। গতিময় স্বাভাবিক চিত্রকল্পের সমাবেশে নান্দনিক আবেশ আসে।


কাব্যভাবনাময়, সৃজনশীল কর্ম রচনার ইতিবৃত্ত বর্ণনাকারী মনোরম কবিতাদ্বয়ের  জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা!