পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, একটা যুক্তি, একটা নিয়ম মেনেই ঘটে থাকে l কার্যকারণ সূত্রে বাঁধা আছে এই জগতের বুকে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ছোট-বড়ো ঘটনা l জগতের বৃহত্তর মঙ্গল সাধন এর উদ্দেশ্য l কিন্তু মানুষের চর্ম চক্ষু অনেকক্ষেত্রেই এই সূত্র বুঝে উঠতে পারে না l যখন বিধির অমোঘ বিধানে সে তার অতি প্রিয়জনকে হারায়, অতি নির্ভর কেউ তাকে ছেড়ে যায় চিরতরে, ঘটনার আকস্মিকতায়, তার আঘাতে মানুষ বুঝে উঠতে পারে না তার সঙ্গে এমনটা কেন হল, কেন বিধাতা এত অকরুণ l সে বুঝে উঠতে পারে না তার প্রিয়তম অবলম্বনকে কেড়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে জগতের কোন মহা কল্যাণ সংঘটিত হল l আঘাতে, বেদনায় জীর্ণ মানব  হৃদয় বিধাতার ন্যায়বোধের প্রতি অনুযোগ করে l তারপর সময় অতিবাহিত হয়ে চলে l দুঃখ বেদনার বোধ  স্তিমিত হয়ে আসে l সময় মানুষকে সর্বংসহা করে l বিধাতার ন্যায়বোধের প্রতি তার আস্থা পুনঃ স্থাপিত হয় l সে অনুভব করে এর মধ্যে তার জন্য রয়েছে শিক্ষার উপাদান l জগতের বুকে ঘটে চলা প্রতিটি ঘটনা শুধু যে একটা নিয়ম মেনে, কার্যকারনসূত্র মেনে হয়, তাই নয়, প্রতিটি ঘটনা আমাদের জন্য রেখে যায় জীবনের এক অমোঘ শিক্ষা l এই শিক্ষা জীবনবোধকে সমৃদ্ধ করে l নিজেদের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সাহায্য করে এবং  আমাদের পরম স্রষ্টার কাছাকাছি নিয়ে যায় l
মিলন এবং বিরহ জগতের অমোঘ বিধান l এর গল্প, তার রস, তার বার্তা, ছন্দ, সুর, তাল যেন সঙ্গীতের নিয়ম মেনে চলে l জীবন নিজেই সুর, তাল, ছন্দে গাঁথা এক সঙ্গীত l সেই সঙ্গীতের অনুভব জীবনবোধের অনুভব l পার্থিব চামড়ার চোখে জগতকে দেখতে গিয়ে আমরা অনেক সময় জীবনের এই গভীর অনুভব পাই না l
জগতের বুকে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাকে পার্থিব চোখ দিয়ে, অবিশ্বাসী মন নিয়ে যখন বিশ্লেষণ করি, তার আভাস তো পাই, কিন্তু নাগাল পাই না l স্বার্থবোধ ঘটনার প্রকৃত চরিত্র নির্ণয়ে বাধা হয় l ধীরে ধীরে তার অনুভব জাগে যে,
""এর বাইরেও ঘটনা আছে
চোখের বাইরেও অন্য রকম জগত আছে
ঘটনার ভিতরে ভিন্ন ঘটনা অন্য রকম সূত্রপাতে
হয়তো বড় কোনো"
এইভাবে মানুষ জীবনের গভীর অনুভব পায় l চোখের বাইরের জগতকে উপলব্ধি করে l ঘটনার ভিতরে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে আবিষ্কার করে, তাকে বিশ্লেষণ করে এবং এই বিশ্লেষণ তাকে পরিশুদ্ধ করে l


মানুষ মননশীল l প্রতিনিয়ত তার মনের মধ্যে চিন্তার ঝড় ওঠে, যুগপৎ বিশ্বাস এবার অবিশ্বাসের বিপরীতমুখী আবহে তার জীবন যাপন l বিশ্বাসবোধে পূর্ণ তার হৃদয় কখনও অনুভব করে,
"গভীর থেকে কেউ আমাকে ডাকে" ......কখনো মনে হয় উজ্জ্বলতা"
আবার একই সঙ্গে অবিশ্বাসের আবহ দোলা দিয়ে যায়,
"কিংবা পুরোটাই ব্যর্থতা....
কিছু
আঁধারের নিচে ঘাপটি মেরে থাকা পার্থিব ফাঁদ।"


নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে, তার মহিমা সম্বন্ধে সন্দিহান হয় সে l কখনো মনে হয় সে অন্যের ইচ্ছার সৃষ্টি, এর মধ্যে তার নিজের কোনো সক্রিয়তা নেই l তার জীবনটাও অন্যের ইচ্ছাপূরণের মাধ্যম মনে হয়, কর্মকারক l নিজের জীবনের কর্তা সে নিজে নয় l বিচিত্রগামী চিন্তার স্রোত বয়ে যায় মননের মধ্যে l বহু বহু প্রশ্ন ওঠে নিজের অস্তিত্ব ঘিরে l কেন সে অন্য কারও মতো নয় ? নিজের প্রকৃত সত্তা আবিষ্কারে সে ব্যাকুল হয় l আত্ম উপলব্ধি প্রচেষ্টার এই মানব ব্যাকুলতা চিরন্তন l যুগে যুগে মানুষ মানবজীবনের তাৎপর্য সন্ধানে ব্যাকুল l এর জন্য কোনো সময় নির্দিষ্ট নেই l আত্ম উপলব্ধির প্রচেষ্টার জন্য যে কোনো সময়ই উৎকৃষ্ট l কবিতার শেষ পর্যায়ে এই আত্ম উপলব্ধির জন্য ব্যাকুল এক মানবসত্তাকে পাই l সে আশাবাদী, সময়কালে সে নিজেকে খুঁজে পাবে, নিজের প্রকৃত পরিচয় সে জানবে l তখন জগতের সব কার্যকারণসূত্র সে সহজেই বুঝতে পারবে l জীবনের অর্থ সে খুঁজে পাবে l অবিশ্বাসের স্তর পেরিয়ে পরম বিশ্বাসের জগতে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের সঙ্গে তার মহামিলন হবে l "মনের মানুষ" বাংলা চলচিত্রের একটি গানের কলি এখানে মনে আসে,
"মিলন হবে কত দিনে ......
  আমার মনের মানুষের সনে......"


গভীর আধ্যাত্মিক অর্থবাহী "আমার আমি (পার্থিব)" কবিতাটির রচয়িতা কবি আহমাদ সা-জিদ(উদাসকবি) কে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা l