"কবিতায় প্রেম নাই" কবিতায় কবি খসা হক সঠিকভাবেই বলেছেন কবিতায় প্রেম ভালোবাসার পরশ খুব প্রয়োজন l কবিতা পড়তে যদি ভালো না লাগে, সেখান থেকেই কবিতার সঙ্গে পাঠকের দূরত্ব শুরু হয় l এই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে পাঠককে কবিতাবিমুখও করে তুলতে পারে l কবিতার আকর্ষণশক্তি থাকা প্রয়োজন, যে আকর্ষণে পাঠক কবিতাটি পড়বেন এবং একবার পড়ার পর বারবার কবিতাটি পড়তে চাইবেন l এভাবেই এক একটি কবিতা যুগ থেকে যুগান্তরে গিয়েও পাঠকের কাছে আবেদন হারায় না l
কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে কবিতাটির পাঠোদ্ধার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় l একজন সাধারণ পাঠক কবিতাটি যখন পাঠ করছেন, তখন সেই কবিতাটির মধ্যে যে শব্দগুলি আছে, যে উপমা, রূপক, চিত্রকল্প, অলঙ্কার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে তার সম্মুখীন হন l এগুলিকে ভেদ করে তাঁকে কবিতাটির রসাস্বাদন করতে হয় l যদি তিনি এই কাজটি করতে সমর্থ হন তাহলে তাঁর কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতাটি মধুর হয় l তিনি কবিতাটি আবারও পাঠ করতে চাইবেন l কিন্তু যদি সেই কবিতাটির শব্দাবলী, রূপক ইত্যাদি তাঁর বোধের বাইরে চলে যায়, তাহলে সেই কবিতাটি পাঠ করা তাঁর পক্ষে কষ্টকর হয় এবং কবিতাটি পাঠক হারায় l


কবি খসা হক কবিতায় বলছেন, কবিতায় ভালো লাগার উপাদান না থাকলে পাঠক আশাহত হন l তাঁরা কবিতার মধ্যে ভালো লাগার উপাদান আশা করেন l নাহলে তাঁদের কবিতা পড়তে ইচ্ছা করে না l
কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে এমন মোহময় আকর্ষণীয় কথার রাশি থাকবে যাতে করে পাঠক আবিষ্ট হয়ে তা পাঠ করবেন এবং তাঁর মন খুশিতে ভরে উঠবে l প্রবন্ধ, আলোচনায় তত্ত্ব যেভাবে থাকে, কবিতায় সেইভাবে তত্ত্বকথা আউরালে পাঠক সেই কবিতা পাঠে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে, ঝিমিয়ে পড়ে l প্রেমহীন জীবনের প্রকাশ যে প্রেমহীন কবিতা তা পাঠককে মুগ্ধ করে না l


মানুষের ভালবাসা এখন কবিতা ছেড়ে অন্যদিকে ধাবমান l কবিতার কবি প্রেমের কাঙাল l সারা জীবন ধরে মানুষ প্রেম খুঁজে বেড়ায় নারীর দেহে l কেউ জ্ঞানের প্রেমে মত্ত l কেউ অর্থের প্রেমে আসক্ত l বিশুদ্ধ প্রেম যা কাব্য কবিতায় ঢেউ তোলে তা অনুপস্থিত l কবিতা আজ তাই প্রেমভাব বর্জিত l
কিন্তু পাঠক আশাবাদী l কবিতায় প্রেমের সন্ধান তাঁর অনন্ত l জৈবিক প্রেম যেমন তাঁর আকাঙ্খিত, তেমনই কবিতায় কাব্যিক প্রেমও তাঁর কামনা l এজাতীয় কবিতা পেলে তিনি খুশিমনে তা পাঠ করেন l আর তা না পেলে তিনি কবিতা পাঠ থেকে বিরত থাকেন l
কবিতার আলোচনায় দুর্বোধ্যতার প্রশ্নে কবি এবং পাঠক উভয়েরই দায় থাকে l কবিকে দায়িত্বের সঙ্গে শব্দ, উপমা, অলংকার ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয় l কবিতাটির মধ্যে সেগুলিকে এমন করে ছড়িয়ে দিতে হয়, যাতে সমগ্র কবিতার নিরিখে পাঠক সেগুলিকে পাঠোদ্ধার করতে পারেন l আবার কবিতা পাঠের সময় পাঠককেও একটু প্রশিক্ষিত হতে হয়, যাতে করে কবিতায় ব্যবহৃত রূপক, যার ইঙ্গিত কবিতাটিতে আছে, তা যেন তিনি ভেদ করতে পারেন l  
এই প্রসঙ্গে কবি খলিলুর রহমান বলছেন,
"সাধারণভাবে আমার কাছে মনে হয় কবিতার দুর্বোধ্যতা বিভিন্ন প্রকারেরঃ ভাবগত দুর্বোধ্যতা, শব্দগত দুর্বোধ্যতা, প্রতীকগত দুর্বোধ্যতা এবং বিন্যাসগত দুর্বোধ্যতা ...। শব্দগত দুর্বোধ্যতা ও প্রতীকগত দুর্বোধ্যতা কাটিয়ে উঠার কিছুটা দায় দায়িত্ব অবশ্যই পাঠকের। পাঠক যত শব্দসমৃদ্ধ হবে, কল্পনাপ্রশস্ত হবে, অভিজ্ঞ হবে ততই তার কেছে এ দুর্বোধ্যতা কেটে যাবে। তবে ভাবগত দুর্বোধ্যতা ও বিন্যাসগত দুর্বোধ্যতার প্রায় পুরো দায়িত্বটাই কিন্তু কবির নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। "
অন্য একটি আলোচনার মন্তব্যে কবি খসা হক শ্রদ্ধেয় কবি খলিলুর রহমানের সঙ্গে একমত হয়ে বলছেন,
"কবিতার পাঠোদ্ধারে পাঠকের কিছু দায়দায়িত্ব থাকে, তবে কবির দায়দায়িত্বের অস্বীকার করার উপায় নেই। কবির অন্তরের ভাব সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে যদি কবি অপ্রাসঙ্গিক শব্দ প্রয়োগ করে থাকেন, বা এমনকি আকারে ইঙ্গিতে ও পরোক্ষভাবে হলেও ভাবের সাথে সম্পর্কযুক্ত কোন শব্দ প্রয়োগে কবি ব্যর্থ হন, তাহলে পাঠকের পক্ষে সেই কবিতার মর্মার্থ উদ্ঘাটন করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।"


কবিকুলের কাছে সাধারণ পাঠকের পক্ষ থেকে অনুরোধ এসেছে কবিতাকে সহজবোধ্য করার l প্রতীক  যত বিমুর্তই হোক না কেন প্রথম লাইনটি থেকে দ্বিতীয় লাইনে গমনের যেন একটি যৌক্তিক সুত্র থাকে। পাঠক কবিতা পাঠ করে তার মর্ম বুঝে কবিতার স্বাদ অনুভব করতে চায় ।


কাব্যের প্রকাশ আসলে ভাবের প্রকাশ এবং ভাব আমাদের গভীর সচেতনতার মধ্যে থেকে  তিলে তিলে ফুটে উঠে। ইঙ্গিত এবং সংকেত কবিতাকে রহস্যময় করে। সার্থক কবিতায় তাদের ব্যবহার অপরিহার্য। পাঠক  সেগুলিকে অতিক্রম করে কবিতার বোধ নেন l অপারগ হলে কবিতার ভাব স্পষ্ট হয় না l অন্যদিকে কবির দায়িত্ব সেই সঙ্কেতগুলি কবিতায় এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা যাতে সেগুলি পাঠককে সমাধানের দিকে নিয়ে যায়।

কাব্যচর্চা ও কবিতা পাঠ সম্বন্ধীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করে কবি কবিতাটিকে অত্যন্ত মনোগ্রাহী করে তুলেছেন l কবিকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন l