এক আছেন মাথার ওপর ঈশ্বর l সকলের পূজ্য l তার পূজায় নিয়োজিত জগতের সকল মানুষ l কিন্তু মানুষও ব্যস্ত l শত সহস্র কাজের ভীড়ে দিশাহারা l সময়ে পূজা করা হয়ে ওঠে না l আর পূজা এমনি হয় না l কিছু আয়োজন প্রয়োজন l সে আয়োজনের যখন সংস্থান থাকে না, তখন কি করা যায় ? দেবতার পুজো তো বাদ দেয়া যায় না l তিনি তো রুষ্টও হতে পারেন l তাই আয়োজনের চেষ্টায় ভিক্ষাবৃত্তি l কিন্তু মানুষ স্বভাব-কৃপণ l কে কাকে দেয় ভিক্ষা ? দাতা তো সেই একজন l জগতের পরমেশ্বর l আমরা মানুষকুল তাঁর কাছ থেকে পেতেই অভ্যস্ত l তাঁর সন্তান বলি নিজেদের, কিন্তু তাঁর গুণের অনুকরণ করি না l বিপদাপন্ন, প্রার্থী মানুষজনদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই l সহমর্মিতার এই অভাব জগতে দুর্ভিক্ষের পরিবেশ রচনা করেছে l মানুষ স্বার্থান্বেষী l নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত l ভ্রাতৃত্ববোধ নেই l অন্যের দুঃখে মন কাঁদে না l অভাব অর্থের, অন্নের, উদার মনের l সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ সমাজটাকে বাসের অযোগ্য করে তুলছে দিনকে দিন l
কবিতাটিতে মানুষের এই আত্মসর্বস্ব মনোবৃত্তির সমালোচনা করা হয়েছে l এই আত্ম-সর্বস্বতা, আর্তের থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া, একটা দুর্ভিক্ষের আবহ তৈরি করেছে আমাদের চারপাশে, যেখানে কেউ কারও কাছ থেকে কিছু পাবার প্রত্যাশা রাখেন না l
সকল ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেই ঈশ্বরকে পরম জ্ঞানী, পরম দাতা বলে মান্যতা দেওয়া হয় l আমরা মানুষজন সেই পরম কল্যাণময় পরমেশ্বরের কাছ থেকেই একমাত্র ভিক্ষা পেয়ে থাকি l সুতরাং ভিক্ষা যদি চাইতেই হয় তাহলে সেই ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থণা বিধেয় l অপর একজন মানুষের কাছে কেন ?


আসরের প্রাজ্ঞ কবি খলিলুর রহমান মহাশয় ঠিক এই অবস্থান থেকে কবির পাতায় কবিতাটিকে ঘিরে মন্তব্য করেছেন l মন্তব্যটি নিম্নরূপ :
"খলিলুর রহমান ২৪/০৫/২০১৭, ১৮:৫৪ মি:
খুব সুন্দর কবিতা। তবে দুই জায়গায় নীতিগত বিরোধ বোধ করলাম। দেবতাকে তুষ্ট করার জন্যে ভিক্ষার প্রয়োজন নেই, অন্তরের ভক্তিই যথেষ্ঠ। আর ভিক্ষে যদি করতেই হয় তবে তা দেবতার কাছেই করা উচিত, যে মানুষ দেবতার ভিক্ষাপ্রার্থী তার কাছে নয়।......."


কবি খলিলুর রহমান প্রকৃত আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, ধর্মবিশ্বাসের বোধ থেকে হয়তো সঠিক কথাই বলেছেন l কবির এই গভীর অর্থবহ মন্তব্যের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও শ্রদ্ধা নিয়েও বলি, এখানে কবিতাটির যে চরিত্র, তিনি অতি সাধারন একজন গৃহবধূ l আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমাদের প্রাত্যহিক ধর্মাচরণে, সর্বদা ধর্মবোধের গভীর আধ্যাত্মিক যে অর্থ বা অনুশাসন, তা মেনে চলতে পারি না নানা কারনে l এটা ধর্মের বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতা থেকে হতে পারে, সরলতা থেকে হতে পারে, লৌকিক বিশ্বাসের কারনে হতে পারে l
অন্য ধর্মের কথা বলতে পারি না, কিন্তু হিন্দুধর্মে বৈদিক যে দেবদেবীগন রয়েছেন, তাদের বিষয়গুলো, যেমন উপাসনা পদ্ধতি, মন্ত্র উচ্চারণ এতো জটিল ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনে বাঁধা, যে অতি সাধারণ মানুষকে ধর্ম আচরণের আস্বাদ দেবার জন্য অনেক লৌকিক দেব দেবীর জন্ম হয়েছে l এই লৌকিক দেবদেবীগনকে একেবারে মানব মানবী রূপে, সাধারণ মানুষের যেন পরিবারের সদস্য, হিতাকাঙ্খী, সব আপদে বিপদে সাহায্যকারী - এই রূপে কল্পনা করা হয় l এঁরা মানবগুণ সম্পন্ন l পরিবারের সদস্যদের মতো খুশি হন, আবার রেগেও যান l তাই তাঁদের খুশি রাখতে সদা তটস্থ  থাকেন মানবকুল l
আর এই দেবদেবীদের অলৌকিক ক্ষমতা যতই থাকুক, এটা বিশ্বাস করা হয় যে, তাঁদের দৈনিক যে ভোজ্যের ব্যবস্থা সেটা তাঁদের ভক্ত এই মর্ত্যবাসীদেরই করতে হয় l প্রসাদ রূপে দেবদেবীর সামনে যে খাদ্যসামগ্রী রাখা হয়, সেটাই তাঁদের উদরপূর্তির একমাত্র সংস্থান l মর্ত্যে যদি এই প্রসাদ নিবেদন না হয়, তাহলে স্বর্গে দেবদেবীরা অভুক্ত থাকেন - এটা মেনে চলা হয় l ঠিক এই বিষয়টি বৈদিক দেবদেবীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য l
সুতরাং বিনা আয়োজনে, শুধু মনের ভক্তি দিয়ে দেবদেবীর পূজা অর্চনা সম্ভব, বৈদিক বা লৌকিক কোনো ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গেই তা মেলে না l সেই আয়োজন অতি ক্ষুদ্র হতে পারে, একটি বাতাসা, একটি চিনির দানা, একটি তুলসি পাতা, একটি ফুল - তাও চলে l কিন্তু আয়োজনশূন্য আরাধনা বিষয়টি সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে l
আর দেবতাকে যেহেতু পরিবারেরই একজন অবিচ্ছেদ্য সদস্য হিসাবে দেখা হয়, সেক্ষেত্রে ঐ  মাত্র একটি বাতাসা, একটি চিনির দানা কি ভোজ্য হিসাবে কোনো পরিবারের সদস্যকে দেয়া সম্ভব ? কোনো মা তাঁর সন্তানকে এইটুকু আহার দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ? মনের দিক থেকে তিনি শান্তি পাবেন ? তাঁর যদি সংস্থান না থাকে, ভিক্ষা করে হলেও, নিজে না খেয়েও, তিনি সন্তানের উদরপূর্তির প্রয়াস করেন l
হিন্দুধর্মে, কি বৈদিক, কি লৌকিক, ধর্মবিশ্বাস এক বৈচিত্র্যপূর্ণ মাধুর্যে পূর্ণ l এখানে যে ঈশ্বরকে আমরা বলছি জগৎপিতা, এই বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের স্রষ্টা, আমাদের রক্ষক, তাঁকেই আবার আমাদের ঘরের মায়েরা সন্তানস্নেহে দেখেন l জগতের পালক বিষ্ণুর অবতার দেবকীপুত্র কৃষ্ণ যিনি যশোদা মায়ের কাছে প্রতিপালিত, বাংলা তথা বিশ্বের সকল হিন্দু মায়ের কাছে তিনি আদরের সন্তানসম কৃষ্ণগোপাল l
তাই জগৎপিতাই বলি, আর সন্তানই বলি - তাঁর  আহারের ব্যবস্থা করা প্রতিটি মায়ের কাছে একটি অবশ্য কর্তব্য l লৌকিক এই তাগিদ থেকেই আলোচ্য কবিতার সেই দরিদ্র গৃহবধূ অনন্যোপায় হয়ে তাই ভিক্ষাকে আশ্রয় করেছেন l
কিন্তু মানুষ এত কৃপণ, তিনি জাত ভিক্ষুক, ভিক্ষা নিতে জানেন, ভিক্ষা দেয়া বিষয়টি তাঁর অভিধানের বাইরে l ঠিক এরকম একটি বিষয় আমরা পাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় l বাংলায় "খেয়া" কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি আছে "কৃপণ" শিরোনামে l আর ইংরাজি GITANJALI (Song Offerings) কাব্যগ্রন্থ যার জন্য কবিগুরু সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে, সেখানে 50 (L) নম্বরে কবিতাটি আছে l
আসরে খুঁজে পেলাম না l তাই এখানে দিলাম l


কৃপণ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (খেয়া কাব্যগ্রন্থ)


আমি   ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম গ্রামের পথে পথে,
তুমি তখন চলেছিলে তোমার স্বর্ণরথে।
অপূর্ব এক স্বপ্ন-সম লাগতেছিল চক্ষে মম–
কী বিচিত্র শোভা তোমার, কী বিচিত্র সাজ।
আমি মনে ভাবেতেছিলেম, এ কোন্‌ মহারাজ।l


আজি   শুভক্ষণে রাত পোহালো ভেবেছিলেম তবে,
আজ আমারে দ্বারে দ্বারে ফিরতে নাহি হবে।
বাহির হতে নাহি হতে কাহার দেখা পেলেম পথে,
চলিতে রথ ধনধান্য ছড়াবে দুই ধারে–
মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব, নেব ভারে ভারে।l


দেখি   সহসা রথ থেমে গেল আমার কাছে এসে,
আমার মুখপানে চেয়ে নামলে তুমি হেসে।
দেখে মুখের প্রসন্নতা জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা,
হেনকালে কিসের লাগি তুমি অকস্মাৎ
“আমায় কিছু দাও গো’ বলে বাড়িয়ে দিলে হাত।l


মরি,   এ কী কথা রাজাধিরাজ, “আমায় দাও গো কিছু’-
শুনে ক্ষণকালের তরে রইনু মাথা-নিচু।
তোমার কী-বা অভাব আছে ভিখারী ভিক্ষুকের কাছে।
এ কেবল কৌতুকের বশে আমায় প্রবঞ্চনা।
ঝুলি হতে দিলেম তুলে একটি ছোটো কণা।l


যবে     পাত্রখানি ঘরে এনে উজাড় করি– এ কী,
ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো সোনার কণা দেখি !
দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে -
তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভরে,
তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে ? l


কবিতাটি প্রতীকধর্মী l অর্থ স্পষ্ট l কবিগুরু বলতে চেয়েছেন, ঈশ্বর শুধু দাতা নন l তিনি গ্রহীতাও l তিনি কি আশা করেন ? তিনি মানুষের কাছে আশা করেন সম্পূর্ণ আত্ম নিবেদন l ভক্ত সত্যিই ভগবানকে কতখানি ভালোবাসেন তা পরখ করে দেখার জন্য ভগবান মাঝে মাঝে এই মর্ত্যধামে নেমে আসেন l দেবতাকে দেওয়ার প্রশ্নে কোনো হিসাব চলে না l ভগবান ভক্তের কাছ থেকে যা পান, ফিরিয়ে দেন তার অনেক অনেক গুণ বেশী l কিন্তু মানুষ স্বভাব-কৃপণ l ঈশ্বর যখন স্বয়ং ভিক্ষুবেশে হাত পেতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে, কৃপণতার খোলসে আবদ্ধ অন্ধ মানুষ তার জগৎপিতাকে চিনতে পারেন না l ব্যাগ হাতড়ে সব থেকে ছোট শস্যদানাটি তিনি ঈশ্বরকে নিবেদন করেন l দিনের শেষে তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারেন l দিনের শেষকে এখানে জীবনের শেষ পর্যায় ধরতে হবে যখন সারা জীবনের কৃতকর্মের হিসাব মিলাতে গিয়ে এরকম বহুবিধ ভুলভ্রান্তি আমাদের বোধে আসে l তখন শুধু অনুতাপ করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না l


মানবধর্মে দরিদ্র নরনারায়নকে ঈশ্বরের প্রতিরূপ মনে করা হয় l মানবসেবাই ঈশ্বরসেবা l বিবেকানন্দ যেমন বলেছেন,
"বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ?
জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর l"


সুতরাং, এই অর্থে, সেই গৃহবধূ, যিনি ভিক্ষার সন্ধানে বেড়িয়েছেন, তিনি সাধারণ মানবী নন l তিনি ঈশ্বরের প্রতিরূপ l রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই রাজাধিরাজ l মানুষকে পরখ করছেন, ঈশ্বরের প্রতি তার ভক্তি কতটা অবিচল l তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে কৃপণ মানুষ ঈশ্বরকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন l


যে পরম কল্যাণময় ঈশ্বরের সন্তান বলে আমরা নিজেদের দাবী করি, তাঁর কল্যাণকামী গুণটিও আমাদের অনুসরণ করা বিধেয়, এই বার্তা দেওয়া হয়েছে সঞ্চয়িতা রায় রচিত "দুর্ভিক্ষ" কবিতাটির মধ্যে দিয়ে l
সুন্দর মানবতাবাদী কবিতাটির জন্য কবি মহাশয়াকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন !