কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল পরাবাস্তবতা ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রয়োগমূলক অভিজ্ঞতা (Test Case) হিসাবে "দলিত আকাশ" কবিতাটি রচনা করেছেন l


পরাবাস্তবতার সঙ্গে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত l মানুষের রয়েছে চিন্তা ও কল্পনা করার ক্ষমতা l  বস্তুজগতের অন্য কিছুর কিন্তু তা নাই। এই কল্পনা দিয়ে আমরা একেকটা জগত সৃষ্টি করতে পারি l বস্তুজগতের অনেক কিছু বা আমাদের পরিচিত ব্যক্তিদের আমরা স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নে দেখা বস্তুগুলো বা ব্যক্তিগুলো বাস্তব থেকে উঠে আসা l কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে সেই চরিত্রগুলির যে আচরণ, তাদের নিয়ে যে ঘটনাক্রম তা অবচেতন মনের পরিচালনাধীন l সেখানে না থাকে সময়ের বাঁধন, না যুক্তির শাসন, না চরিত্র ও সময়ের সঙ্গে সমন্বয়কারী স্থান l অর্থাৎ স্বপ্নে এক পরিচিত ব্যক্তিকে আমরা এমন একটি স্থানে দেখছি, যেখানে তার থাকার কথা নয়, এমন সময়ে দেখছি যে সময়ে তার অস্তিত্ব হয়তো নেই, অর্থাৎ কোনো মৃত ব্যক্তিকে হয়তো জীবন্ত অবস্থায় দেখছি l এই যে অসঙ্গতি, জাগ্রত অবস্থায় এই অসঙ্গতি আমাদের যুক্তিবোধের কাছে ধরা পড়ে l কিন্তু স্বপ্নে অবচেতন মনে যুক্তির শাসন নেই l তাই এই আজগুবি দর্শন অনুমোদন পেয়ে যায় l


এইভাবে স্বপ্নের মধ্যে দেখা চরিত্রগুলো বাস্তবে থাকলেও কল্পনার জগতে তাদের আচরণ ভিন্ন l  তাই এগুলো বাস্তব হলেও প্রকৃতপক্ষে বাস্তব নয় l তাই বলা হচ্ছে পরাবাস্তব। একটা পরাবাস্তব জগৎ সৃষ্টি হয় l বস্তুজগতে অবস্থান করে পরাবাস্তব জগতের কল্পনা করা। এই ক্ষমতা একমাত্র মানুষেরই আছে l  


পরাবাস্তব কবিতার বৈশিষ্ট্য হল এখানে বস্তুজগত থেকে বা মনুষ্যজগত থেকে যে চরিত্রগুলি নেয়া হয়, অবচেতন মনের প্রভাবে তাদের আচরণে কিছু অসঙ্গতি আসে, অবচেতন মনে যেহেতু যুক্তিবোধ কাজ করে না l এই জাতীয় কবিতায় যে রূপকল্প নির্মাণ করা হয়, তা আপাত অবাস্তব মনে হলেও, কবিতায় যে ভাব প্রকাশের প্রয়াস চলে, এই রূপকল্পগুলি সেই ভাব প্রকাশের সহায়ক হয় l আমার প্রবন্ধটিতে পরাবাস্তবতার প্রয়োগের উদাহরণ হিসাবে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার উদ্ধৃতি ছিল,
“আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, সেই পাহাড়ের ঝর্ণা আমি...”


এখানে প্রথম কবিতায় তিনটি চরিত্র - আকাশ, পাহাড়, ঝর্ণা / কবি l আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমাচ্ছে l পাহাড় কি বাস্তবে তা করে ? সেই পাহাড়ের গা বেয়ে কবি ঝর্ণার মতো সুরেলা কাব্য রচনা করে চলেছেন l চরিত্রগুলি আপাত অবাস্তব কাজ করছে l কিন্তু তা কবিতার কাব্যময় ভাব প্রকাশের অনুকূল হয়েছে l


কবিগুরুর "সোনার তরী" কবিতায় পরাবাস্তবতার স্পর্শ আছে l কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই কবিতার  সমালোচনা করে বলেন যে এই কবিতা একেবারে অর্থশূন্য এবং স্ববিরোধী l এটা যে কত অবাস্তব তার প্রমাণ “কৃষক আউস ধান কাটিতেছেন বর্ষাকালে, শ্রাবণ মাসে। বর্ষাকালে ধান কেহই কাটে না, বর্ষাকালে ধান্য রোপণ করে। ... ক্ষেত্রখানি তবে একটি দ্বীপ। তবে এ চর জমি। এ রূপ জমিতে ধান করে না। এ সব জমি শ্রাবণ ভাদ্র মাসে ডুবিয়া থাকে...।"
বলা হয়, এই সমালোচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল নিজেকে একজন কৃষি বিশেষক হিসাবে যতটা মেলে ধরেছেন, কাব্য বোদ্ধা হিসাবে ততটা নয়।


কবি শ্রাবণ মাসে কৃষককে দিয়ে ধান কাটালেন l যা নাকি ভৌগোলিকভাবে অবাস্তব l কিন্তু শ্রাবণ মাসের
"শ্রাবনগগন ঘিরে   ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে     রহিনু পড়ি -
যাহা ছিল নিয়ে গেল  সোনার তরী l"
এই যে আবহ তা কবিতাটির মূল বক্তব্য প্রকাশে এমন সহায়তা দিয়েছে, যে কারনে সমস্ত বিতর্ক অতিক্রম করে "সোনার তরী" আজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতার মর্যাদা লাভ করেছে l কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাস্তবতা ও অবাস্তবতার ধন্দে পড়ে পরাবাস্তবতার ধারণাকে আত্মস্থ করতে পারেন নি l


আলোচ্য "দলিত আকাশ" কবিতাটিতে পরাবাস্তবতার এই ছোঁয়া স্পষ্ট l এই কবিতায় বস্তুজগত ও জীবজগত থেকে বহু চরিত্র নেয়া হয়েছে - আকাশ, কুসুম, পাপড়ি, ননী, রাত, ঈশ্বর, বুক, ত্রাস, বেদনা, অন্ধকার, ইতিহাস, পাষাণ, কলি, অশ্রু, সরোবর, কলি, অহমিকা, তমিশ্রা চাদর, আঁধার বলয়, ধরিত্রী, কৃষ্ণ মহাদেশ ইত্যাদি ইত্যাদি l
এই চরিত্রগুলিকে দিয়ে অস্বাভাবিক অবাস্তব আচরণ করানো হয়েছে l আকাশ যন্ত্রণায় বিদ্ধ l আকাশের কিসের যন্ত্রণা ? এখানেই কবিকল্পনায় পরাবাস্তবতা দেখি l কিন্তু সামগ্রিকভাবে কবিতাটিতে বেদনাময় অনুভবের যে চিত্রটি মেলে দেয়া হয়েছে, যার পরিণতি,
"নিঃশব্দে নীরবে দেয় পাড়ি আঁধার বলয়
ধরিত্রীর মায়া ত্যাজি কৃষ্ণ মহাকাশে।"
কবিতার সর্বাঙ্গে পরাবাস্তবতার ছোঁয়া, কিন্তু প্রতিটি ডীটেল্স কবিতার সামগ্রিক ভাবের অনুসরণ করেছে l
ব্যথাতুর জীবনে কোমলতার পরশ উপশমকারী নয় -
"কুসুমের ছোঁয়া বুকে তবু
পেলব পাপড়ি পারে না দিতে ননীর পরশ"


জীবন সর্বদা এক সুনিশ্চিত আশঙ্কায় আতঙ্কিত l কোনো অভয়বাণী নেই -
"পড়ে না ঝরে রবাহুত ঈশ্বরের কোনও বরাভয়"
বুকে জমে শুধু ত্রাস।"


বেদনার কোনো উপশম নেই l জীবন অন্ধকারময় -
"যে বেদনা জমে রয়, যায় না উড়ে
হয় না বাস্পীভূত, না ঘুচে অন্ধকার"

নৈরাশ্যবোধের চূড়ান্ত l হতাশায় পরিজন পাষাণহৃদয় l তাঁদের কিচ্ছু করণীয় নেই l শুধু শোকের অশ্রু ঝরানো !
"পাষাণেরে বুকে টেনে ছাড়ে সে দীর্ঘশ্বাস।
পাষাণের পলক নেই, তবু ঝরে অশ্রুবারী"


আকাশ কবিতার শুরুতে ছিলো যন্ত্রণাবিদ্ধ l তারপর অন্ধকারের নানা প্রতীক আকাশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে l একবার আকাশকে বলা হচ্ছে বিলাসী l সে আবার কালো কাপড়ে ঢাকা l
"তমিস্রা চাদরে ঢাকা বিলাসী আকাশ"
প্রত্যেকটি বিচ্ছিন্ন চিত্রকল্পের স্পষ্ট অর্থ বোধগম্য না হলেও কবিতার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তার আঁচ পাওয়া যায় l


কিছু টেক্সট আছে যা কিছু পরিস্কার বার্তা  দিয়ে যায়।
সামগ্রিক এক বেদনাবোধ, নৈরাশ্য, শেষে মৃত্যু - এরকম একটি ভাবের আভাস পাওয়া যায় l মনে হয় যেন দীর্ঘদিন দুরারোগ্য অসুখে একজন ভুগছেন l বাঁচার কোনো আশা নেই l যন্ত্রণাময় রোগভোগ l শেষে নিশ্চিত মৃত্যু l
"নিঃশব্দে নীরবে দেয় পাড়ি আঁধার বলয়
ধরিত্রীর মায়া ত্যাজি কৃষ্ণ মহাকাশে।"
করুন কাব্যরস অবচেতন মনকে স্পর্শ করে যায়।


পরাবাস্তবতার প্রয়োগে একটা বিষয় যা হয় কবিতায় দুর্বোধ্যতা চলে আসে l পরস্পর সম্পর্কহীন রূপকল্প গুলির সহযোগে কবিতার ভাব হৃদয়ঙ্গম করতে পাঠক হিমশিম খেয়ে যান l কবিতাটির মন্তব্যে দেখলাম কবি আতাম মিঞা বেশ সরস মন্তব্যে বলেছেন, কবিতাটি আদৌ তাঁর বোধগম্য হয় নি l প্রতি উত্তরে ততোধিক সরস মন্তব্যে অনিরুদ্ধ বুলবুল বলছেন, কবিতাটি পাঠ করেও আতাম মিঞা যে সুস্থ আছেন এটাই অনেক l নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন এরকম ক্ষেত্রে তাঁর মাথা ঘুরে যায় l কবিতাটিকে ঘিরে কবি ও পাঠকের মধ্যে এইরূপ সশ্রদ্ধ সরেস মন্তব্য বিনিময় কবিতা চর্চার পক্ষে স্বাস্থ্যকর l
কবিতার কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক কবিতার জন্মলগ্ন থেকে ছিলো, আজও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে l
এই বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল দুর্বোধ্যতা l বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন হল চর্যাপদ l চর্যাপদকে বলা হয় সন্ধ্যাভাষা l তাতে দিনের আলোর সুস্পষ্টতা নেই। আছে গোধূলির মায়াবী আবছায়া। তাই বলা যায় দুর্বোধ্যতায় বাংলা কবিতার জন্মসিদ্ধ অধিকার।
দুর্বোধ্যতা কবিতার এক অন্যতম অনুসঙ্গ l এ নিয়ে বিতর্ক আছে l এক পক্ষ দুর্বোধ্যতাকে বলছেন কবিতার দুর্বলতা, কবির ব্যর্থতা l আবার, এর বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে, দুর্বোধ্যতা হলো কবিতার শক্তি l কবিতা এক বিশেষ শিল্পশৈলী l গদ্যের মতো সরল, সোজা সাপটা নয় l দুর্বোধ্যতা কবিতার সম্পদ, অলঙ্কার l


ইঙ্গিত এবং সংকেত কবিতাকে রহস্যময় করে। সার্থক কবিতায় তাদের ব্যবহার অপরিহার্য। পাঠক  সেগুলিকে অতিক্রম করে কবিতার বোধ নেন l অপারগ হলে কবিতার ভাব স্পষ্ট হয় না l অন্যদিকে কবির দায়িত্ব সেই সঙ্কেতগুলি কবিতায় এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা যাতে সেগুলি পাঠককে সমাধানের দিকে নিয়ে যায়।
আধুনিক কবিতায় প্রতীক চোখে আঙ্গুল দিয়ে উপমাটি চিনিয়ে দেয় না। বরং যে-দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে তার মধ্যে একটিকে অনুক্ত রাখতেই কবি বেশি আগ্রহী। এই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গন্তব্যর রাস্তাটি খুঁজে নেবার দায়িত্ব কিন্তু সংবেদী পাঠকের।
আবার, অতিরিক্ত মাত্রায় প্রতীকের ব্যবহার কবিতাকে অর্থহীন করে তোলে। সঙ্গতিহীন বিকল্প শব্দের ব্যবহার তাকে ভারাক্রান্ত করে।
কবিতা এক অর্থে সমাজ এবং সভ্যতার দর্পণ। তার ব্যাপ্তি ঐতিহাসিক যুগ পার করে প্রত্নতাত্ত্বিক পৃথিবীতে। মুস্কিল হল এই যে কবিতার শেষে পাদটীকা লাগানোর প্রচলন নেই। সুধী পাঠকের দায়িত্ব সেগুলি খুঁজে নেবার। বিষ্ণু দে’র কবিতার ইতিহাস ও সমাজচেতনার নাগাল পেতে হলে পাঠককে শিক্ষিত হতে হয়। সুধীন্দ্রনাথের ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনার’ কাছাকাছি পৌঁছোতে হলে পাঠককে তৎসম শব্দ ভেদ করার মানসিক পরিশ্রম করতে হবে। আধুনিক কবিতা  পাঠকের মেধা ও মননের কাছে এটা দাবি করে l


এই সব কিছুর মধ্যে না গিয়ে আমি বলব, কবিতা পাঠের পর কবিতার মূল ভাব বুঝলাম বা বুঝলাম না, এ নিয়ে বেশী মাথা ঘামানো উচিত নয় l দেখার বিষয় হলো, কবিতা পাঠের অনুভূতি l কবিতাটি পড়তে কেমন লাগল l যদি কবিতাটি পড়তে, আবৃত্তি করতে ভালো লাগে তাহলে একাধিক পাঠে কবিতাটির ভাব অনেক সময় বোধে চলে আসে l নাও যদি আসে, শুধু ভালবেসেই কবিতাটিকে বার বার পড়া যায় l আর কোনো কবিতার ভাবও বুঝছি না, আবার পড়তেও ভালো লাগছে না, এমন কবিতা সাময়িকভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় l কারণ মাথাকেও তো ঠিক রাখতে হবে l মাথা ঘুরে গেলে পরিবারকে কে দেখবে ? কবিতাটি যে বিষয়ে লেখা হয়েছে বলে মনে হয়, সেই বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করে, পরে সময় করে কবিতাটি পুনরায় পড়ার প্রয়াস করা যেতে পারে l কবিতা শুধু আনন্দপাঠ নয়, মনন চর্চাও বটে l


কবি একটি প্রয়োগ করতে চেয়েছেন l প্রয়োগটি প্রতিশ্রুতিপূর্ণ l


কবিকে জানাই অনেক অনেক ভালবাসা ও শুভেচ্ছা l