হ্যাঁ, দুরকম বৃক্ষরাজি প্রকৃতিতে বিরাজমান l
এক, সভ্য মানুষের পরিকল্পিত রোপণ যা পায় যথেষ্ট পরিচর্যা।
দুই, স্বাভাবিক বনাঞ্চল। প্রকৃতির সাহচর্যে নিজের মতো বেড়ে ওঠে।
এ তো গেল ভূগোলের কথা।
এই ভৌগোলিক তথ্য কবিতা হল তখন, যখন কবি স্বাভাবিক বনাঞ্চলের মাটিকে বলছেন "আস্তাকুঁড়ের মাটি", 'উচ্ছিষ্ট'। সেখানেই গড়ে ওঠে "আগাছার জঙ্গল"। রূপকের এই ব্যবহারে ভূগোল কবিতার রূপ নেয় এবং কবি রূপকের আড়ালে কি বলতে চাইছেন তার মোটামুটি একটা আভাস পাওয়া যায়।


মানবশিশু তার ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। কারও জন্ম হয় সোনার চামচ, রুপার বাটি হাতে নিয়ে, সমৃদ্ধ পিতামাতা, অন্য ভালোবাসার আত্মীয়জনের একান্ত কামনা ও প্রার্থনার ফলে। পরিকল্পিত এই সন্তান জন্ম থেকেই পায় সব রকমের পরিচর্যা ও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সংস্থান।

আবার কিছু সন্তান জন্মায় দুর্ভাগ্য সঙ্গে নিয়ে। আঁস্তাকুড়ের মাটিতে। অবাঞ্ছিত সন্তান তারা। দুর্ভাগ্য নানা কারনে হতে পারে। তাদের বাবা মা হতে পারেন হতদরিদ্র। সন্তানকে দু মুঠো খেতে দেবার সামর্থ্যও তাঁদের থাকে না। ঈশ্বরের কি পরিহাস, এমন সামর্থ্যহীন পিতামাতার ঘরে সন্তান দিতে তিনি কার্পণ্য করেন না। বছর বছর কাঙালি মায়ের কোল আলোকিত হয় বুভুক্ষু, হাড় জিরজিরে সন্তানের আগমনে। বড়লোকের বেঁচে যাওয়া খাবার যা রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়, সেই উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করে, তাই খেয়ে এদের অবমাননাপূর্ণ জীবন যাপন চলে।


তবু তো এই সন্তানেরা মা বাবার সান্নিধ্য পায়। দুর্ভাগ্যের অন্য রূপও আছে। কুন্তী মাতার সন্তান যারা, তাদের দুঃখ কষ্টের কোনো তুলনা হয় না। অধিরথের মতো স্নেহবৎসল পিতা সকলের ভাগ্যে জোটে না। যুগের অবক্ষয়ে বহু তরুণ তরুণী বিবাহপূর্ব অসাবধানী যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়। প্রকৃতির নিয়মেই সেই তরুণীর গর্ভসঞ্চার হয়। নিজের সম্মান বাঁচাতে, পরিবারের সম্মান বাঁচাতে  সেই অবিবাহিতা মা সন্তানকে ঈশ্বরের ভরসায় রাতের অন্ধকারে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে। মানবজাতির এই চরম অবনমন, মাতৃত্বের এই অবমাননা সভ্যতার কলঙ্ক। রাতের অন্ধকারে, আস্তাকুঁড়ে  মশা মাছি আর ইঁদুরের সঙ্গে সেই নবজাত পরিত্যক্ত শিশুর সহাবস্থান। সদা আশঙ্কা – উৎপাটনের, জীবনহানির। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে  বাঁচার শেষ অবলম্বনটিকে।


একটা জিনিস এখানে লক্ষ্যনীয় l কবি সচেতনভাবে কবিতার শিরোনামে স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ চয়ন করেছেন - "অবাঞ্ছিতা" l এখানে এক অন্য দ্যোতনার আভাস পাই l
নারী ভ্রূণ হত্যা ! এক মারাত্মক ব্যাধি হিসাবে সমাজকে গ্রাস করেছে l শিশুর জন্মের আগেই তার লিঙ্গ নির্ণয় করে, কন্যা সন্তান হলে, তার গর্ভপাত করে দেয়া হচ্ছে l জন্মগ্রহণের আগেই মাতৃগর্ভে কন্যা শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে l তার অপরাধ কি ? কারণ, সে 'অবাঞ্ছিতা' l যদি advance stage এ তা ধরা পড়ছে, গর্ভপাত সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে, জন্মগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই কন্যা শিশুকে  রাতের অন্ধকারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে কোনো আস্তাকুঁড়ে l এটা করছেন সেই কন্যা সন্তানের নিজের মা ! নিজের বাবা ! কারণ, সেই কন্যা অবাঞ্ছিতা !
মানুষের এই অপকর্ম সমাজকে, মানবজাতিকে যে কোন্  ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয় l এর ফলে পুরুষ ও নারীর সংখ্যার অনুপাতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে l ভারতে নারী-পুরুষের অনুপাত ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত দশ বছরের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ভারতে পুত্র সন্তানের চেয়ে কন্যা সন্তান কম জন্ম নিচ্ছে অথবা কম বেঁচে থাকছে। ২০০১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী প্রতি ১০০০ পুত্র সন্তানের বিপরীতে ৯২৭টি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলেও ২০১১ সালের শুমারিতে দেখা যাচ্ছে কন্যা সন্তানের জন্মহার ৯১৪তে নেমে এসেছে। কিছু রাজ্যে এই হার আরো মারাত্মক l যেমন হরিয়ানায় এক হাজার পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা ৮৭৭ জন l
সাম্প্রতিক সময়ে কন্যা ভ্রুণ হত্যার প্রবণতা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। যদিও আইনে নিষেধ আছে, তবু আইনকে ফাঁকি দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যানে জন্মের আগেই শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা হচ্ছে এবং সন্তানটি কন্যা হলে তাকে মাতৃগর্ভেই হত্যা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, জন্মগ্রহণের পরও মধ্যযুগীয় কায়দায় কন্যা সন্তান হত্যা করা হয় বলে বিভিন্ন বার্তা সংস্থা সূত্রে খবর পাওয়া যায়।


নিঃশব্দে ক্ষমাহীন এই অপরাধ হয়ে চলেছে সমাজের একটা অংশের মধ্যে, আইন করেও যার কোনও সমাধান করা সম্ভব হয়ে উঠছে না৷ ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল ল্যান্সেট ২০১১ সালে এক গবেষণা শেষে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, গত তিন দশকে ভারতে অন্তত ১২ মিলিয়ন মেয়ে ভ্রূণ নষ্ট করা হয়েছে। ভারতের অনেক অংশে ৪০ ঊর্ধ্ব অবিবাহিত পুরুষের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। স্ত্রী পেতে সমস্যা হচ্ছে । ভারতের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গান্ধী স্বীকার করে নিয়েছেন, গর্ভপাত একটি মারাত্মক সমস্যা। আরও বহু সমস্যার উৎস এটি।


পরিকল্পিত ও স্বাভাবিক বৃক্ষরাজির রূপক ব্যবহার  করে মানবজাতির সভ্যতার মুখোশ উৎপাটন করেছেন সংবেদনশীল কবি সমীর প্রামাণিক।
প্রিয় কবিকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা ।