মানুষ নিরাপদ জীবনের লক্ষ্যে সমাজ গড়েছে l সেই সমাজে হয়ে চলেছে নানা অপরাধ l ধর্ষণ জঘন্যতম এক সামাজিক অপরাধ l অথচ ধর্ষণ শব্দটিকে জড়িয়ে সমাজে একটা ট্যাবু আছে l এর সম্বন্ধে খোলা আলোচনা করতে কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে l ধর্ষণ বলতে সাধারণত নারী ধর্ষণকেই বোঝা হয় l কিন্তু এর ব্যাপ্তি অনেক বড়ো l এর কারণও অনেক l শুধু কামলিপ্সা চরিতার্থ করাই ধর্ষণের একমাত্র কারণ নয় l


সমাজে যখন ক্রমাগত কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে চলে, কবিরা তার প্রতিবাদ করেন l যুগে যুগে এজাতীয় প্রতিবাদ হতে দেখি l প্রতিবাদের ধরন বহু রকমের হয় l আর প্রতিবাদ করাটাও সবক্ষেত্রে খুব সহজ হয় না l প্রতিবাদীদের ওপর নেমে আসে আক্রমণ l কিন্তু সেই আক্রমণ প্রতিহত করে যুগে যুগে অন্যায়, অপরাধ, শোষণ, নিপীড়ন এর বিরুদ্ধে লড়াই, সংগ্রাম ও প্রতিবাদের ইতিহাস ধারাবাহিক l


"আর্তনাদ" কবিতাটিতে কবি অনন্ত গোস্বামীর লেখনীতে এরকম এক প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে দেখি l কবি সঠিকভাবেই বলেন, যে কোনো বয়সের নারী, ২৮ দিনের শিশু থেকে ৮২ বছরের বৃদ্ধা, সকলেই ধর্ষণের শিকার l সংবাদপত্রে, অন্য সংবাদ মাধ্যমে, যে খবরগুলি দেখি সেখানে কবির এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে l কবি আরও বলেন, নিকট সম্পর্কীয়দের থেকেও এই আক্রমণ আসে l এটিও প্রমাণিত সত্য l প্রায়ই এজাতীয় খবর শিরোনামে আসে l আমার একটি কবিতা, "কন্যা" শিরোনাম, সম্প্রতি আসরে প্রকাশিত, তার মধ্যে বিষয়টি  এভাবে এসেছে,


"কত নাজুক বদন তোমার
ঘরে বাইরে বিপদ ঘোরে
পরশ খোঁজে বয়স্কেরা
কামুক আদম ঝাপট মারে l"


একটি ব্লগে জনৈক রাজীব নুর খান বলছেন, "
একটা মেয়ের জন্যে কেউ নিরাপদ না। শিক্ষক, সহপাঠী, বন্ধু, বয়-ফ্রেন্ড, এলাকার ছেলে, আত্মীয়- পুরুষ, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই কেউ না। কর্মক্ষেত্রে কলিগ, অফিসের বস- সুযোগ পেলেই মিষ্টি হাসি ঝেড়ে ধর্ষকের রূপ ধরতে মুহূর্ত দেরি করেন না। বাসের হেল্পার, ক্যান্টিনবয়, হাসপাতালের ঝাড়ুদার, বাসার দারোয়ান কিংবা অফিসের পিয়ন- ওটার ব্যবহারে কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকতে রাজী নয়।.......
মেয়েরা কার কাছে বিচার চাইবে? শিক্ষকের কাছে? তারাই তো রুমে ডেকে নিয়ে ছাত্রী ধর্ষণে লিপ্ত। মন্ত্রীদের কাছে? এই দেশের কলেজের মেয়েদের তো তাদের কাছে উপঢৌকন হিসেবেই পাঠানো হয়। শরীরের বিনিময়ে মিলে পার্টিতে পদ কিংবা হলে সিট।"


Wikipedia তে পাচ্ছি, "মহিলাদের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, যাঁরা তাঁদের উপর যৌন অত্যাচারের কথা স্বীকার করেন, তাঁদের মাত্র দুই শতাংশ বলেন যে তাঁরা কোনো অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন।"


"আর্তনাদ" কবিতায় কবি বলছেন, মানসিক ভাবে অসুস্থ মহিলারাও এই অত্যাচারের শিকার l কর্মস্থলেও এই ভয় থাকে l
প্রশ্ন জাগে, শুধু কি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতেই এই সমস্যা ? নাকি উন্নত দেশগুলিও এই পরিস্থিতির শিকার ?  
Wikipedia তে পাচ্ছি, "ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশ, বিচার ও অভিযুক্তের শাস্তিপ্রদানের হার বিভিন্ন বিচার ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচার পরিসংখ্যান ব্যুরো-র (১৯৯৯) হিসেব অনুসারে সেদেশের ধর্ষিতদের মধ্যে ৯১% মহিলা ও ৯% পুরুষ এবং ৯৯% ক্ষেত্রেই অপরাধী পুরুষ।"
তাহলে দেখছি, উন্নত দেশেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে l কিন্তু পার্থক্যটা হলো, সেখানে অপরাধীদের বিচার হয় ও শাস্তিবিধানের হার টিও বেশী l আর আমাদের দেশে কি হয় ? ধর্ষণের যে ঘটনাগুলি ঘটে, তার একটা অংশ রিপোর্ট হয় না l কেও বা সাহস করে থানায় অভিযোগ করতে গেলে, এরকম শোনা যায়, প্রশাসন থেকে, বা অপরাধীপক্ষ থেকে ভয় দেখিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে তাদের নিরস্ত করার প্রচেষ্টা হয় l একটা অংশ এই চাপ নিতে না পেরে পিছিয়ে আসেন l শেষ পর্যন্ত এই চাপ অতিক্রম করে যারা প্রশাসন, বিচারব্যবস্থার শরণাপন্ন হন, তাদের একটা অংশ পান বিচারের নামে প্রহসন l অপরাধী বেকসুর খালাস হয়ে যায় l বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে লোকালয়ে ঘুরে বেড়ান l আর নিপীড়িতাকে মুখ লুকাতে হয় ঘরের কোণে l পরিবারের সম্মানহানি হয় l বহু মেয়ে এই অপমানের জ্বালা সহ্য না করতে পেরে আত্মঘাতী হয় l
খুব সামান্য কিছু ঘটনায় অপরাধীর শাস্তি হয় l কবি যেমন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের উল্লেখ করেছেন, ধর্ষণ ও খুনের অপরাধে যার ফাঁসি হয়েছিল l
বিচার প্রক্রিয়ার এই দীর্ঘসূত্রতা, শাস্তি বিধানের এই স্বল্পতার কারনে অপরাধ প্রবণতা উৎসাহিত হয় l


ধর্ষণ একপ্রকার যৌন অত্যাচার। সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অনুমতি ব্যতিরেকে যৌন সংগমে লিপ্ত হওয়াকে ধর্ষণ বলা হয় l শুধু কামতারণার কারণেই এই অপরাধ হয় না l আছে সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্বিক, আরও বহু কারণ l এই আদিম প্রবৃত্তির অত্যাচারে বহু মেয়ের জীবন নষ্ট হয় l বুদ্ধিজীবিরা চিন্তায় পড়েন l নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ করেন l নীরব মোমবাতি মিছিল হয় l কিন্তু ধর্ষণের সংখ্যা কমে না l
প্রশাসন সক্রিয় না হলে, বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতা ত্যাগ না করলে, অপরাধীর শাস্তিবিধান সুনিশ্চিত না হলে এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয় l
সংবেদনশীল কবি বিষয়টি নিয়ে ব্যথিত l তিনি এই নৃশংসতম অপরাধের বিরূদ্ধে আরও জোরদার প্রতিবাদের প্রয়োজন অনুভব করেন l


আলোচনার শুরুতে যে ট্যাবুর কথা বলেছিলাম, সেই ট্যাবু অতিক্রম করে, সমাজের একটি জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে মমত্বপূর্ণ কবিতায় প্রতিবাদ ধ্বনিত করে অনন্ত গোস্বামী কবি হিসাবে তাঁর সামাজিক দায় পালন করেছেন l কবিকে অশেষ ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা l