৩১-০৩-২০১৭ তারিখ আসরে প্রকাশিত 'চিরায়ত' প্রবন্ধে লিখেছিলাম :
"সাধারণত তিন ধরনের কবিতা আমরা প্রত্যক্ষ করি l ভাবনাভিত্তিক, কাহিনীভিত্তিক ও ব্যক্তি ও নির্দিষ্ট ঘটনাভিত্তিক l ভাবনাভিত্তিক কবিতাগুলি অত্যন্ত উন্নতমানের হয়, আকারে সাধারণত ছোট হয়, খুব বড়ো মাপের প্রতিষ্ঠিত কবিরাই এই ধরনের কবিতা লিখে সফলতা ও সুনাম পেয়ে থাকেন l এই জাতীয় কবিতাগুলি উপভোগ করা একটু কঠিন হয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই এই ধরনের কবিতার স্বতস্ফুর্ত পাঠক কম হয় l বর্ননাধর্মী কবিতাগুলিকেও এই শ্রেণীভুক্ত ভাবা যেতে পারে l বর্ননাধর্মী কবিতায় প্রকৃতির বা অন্য কোন বিষয়ের বর্ণনার অতিরিক্ত কোনো গূঢ় ভাবনা অন্তর্নিহিত থাকে l প্রকৃতির কবি যারা, যেমন ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - তাদের কবিতায় এই বিষয়টা লক্ষ্য করা যায় l
ঘটনা ও কাহিনীভিত্তিক কবিতাগুলি সব ধরনের কবিরাই লিখে থাকেন এবং যেহেতু এই জাতীয় কবিতায় গল্পের ছোঁয়া থাকে, এগুলি পাঠকের খুব প্রিয় হয় l যদিও কবিতায় গল্পের স্পর্শটুকুই থাকে, প্রকৃত গল্পকারের মতো এই গল্পের যুক্তিসঙ্গত পরিণতি দেবার দায় কবির থাকে না l গল্পের পরশটুকুকে আশ্রয় করে তিনি কবিতার জগতে বিচরণ করেন, সীমার মধ্যে অসীম, রূপের মধ্যে অরূপের অন্বেষণ চলে l"
আজ এরকম একটি কাহিনীমূলক কবিতাকে চয়ন করেছি আলোচনার জন্য l কবিতার নাম "আমার দুর্গা অন্নপূর্ণা" l কবি : রক্তিম l
এক জীবনযুদ্ধের কাহিনী। পরিবেশন এত মমত্ববোধে পূর্ণ যে পড়তে শুরু করলে থামা  যায় না। তিন স্তবকে কবিতায় তিন প্রজন্মের গল্প।  Forward and Backward Movement of Action আছে একেবারে ছোটগল্প বা উপন্যাসের ধাঁচে l প্রথম স্তবকে বর্তমান থেকে দ্বিতীয় স্তবকে চলে যাই অতীতে l আর তৃতীয় স্তবকে অনেকটা সময় এগিয়ে আবার বর্তমানে l স্বামীহারা একলা মহিলা কলকাতার শহরতলিতে পরের বাড়িতে কাজ করে নিজের পরিবার প্রতিপালন করছেন l
"কিন্তু সে তার স্বামী নয়, গোটা একটা জলজ্যান্ত লাশ।
পকেটের চিরকুটে লেখা আত্মহত্যার কারণ-"
কিন্তু পরিস্থিতির কাছে হার স্বীকার করেন না দুর্গা l অন্তর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে জীবনের সঙ্গে লড়ে যান l দুই মেয়েকে বড়ো করে পাত্রস্থ করেছেন :
"আমার দুর্গা ভেসে যায়নি মেরুদণ্ড সটানে উঠে দাঁড়ায়
পায়ে পায়ে আশ্রয় নেয় কোলকাতা'র শহরতলিতে;
নিরক্ষর মা মেয়েদের মানুষ করে এবং পাত্রস্থ করে"
দায়িত্ব পরের প্রজন্ম পর্যন্ত গড়ায় l এখন দুই নাতি তাঁর কাছেই থাকে l তাঁর সঙ্গেই স্কুলে যায় l সেখানে রান্নার কাজ করেন আমাদের এই কাহিনীকবিতার protagonist দুর্গা l যে আত্মশক্তি নিয়ে জীবনযুদ্ধের এতটা পথ তিনি পেরিয়ে এসেছেন, সেই শক্তিরুপীনী দুর্গা এখন মা অন্নপূর্ণা হয়ে ওঠেন l স্কুলে স্কুলে তো এখন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যাহ্নকালীন আহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে l সেখানে রান্নার পাট শেষ হলে ছাত্রছাত্রীদের খাবার পরিবেশন করেন মাতৃরুপীনি দুর্গা l
"ওরা ওখানে লেখাপড়া করে ।
         ওদের দিদিমা ওই স্কুলেই রান্নার কাজ  করে ।
একটু পরে দিদিমাই অন্নপূর্ণা হয়ে উঠবে  
         আর পাত্রে পাত্রে খাবার বেড়ে দেবে ।"
যাঁকে নিজের জীবনে দুবেলা দু-মুঠো অন্ন সংগ্রহের জন্য শহর কলকাতার বাড়িতে বাড়িতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে, নিজের জন্য এবং নাবালিকা দুটি মেয়ের জন্য, সেই মহিলা এখন বিদ্যালয়ের শত শত পুত্রকন্যা সম, নাতিনাতনি সম, যার মধ্যে তাঁর নিজের নাতি দুটিও আছে, বাচ্চাদের নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে খাওয়াচ্ছেন - এটা তাঁর কাছে এক পরম প্রাপ্তি l দুর্গা থেকে এভাবেই তিনি অন্নপূর্ণা হয়ে ওঠেন l
উনবিংশ শতাব্দীতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ কোলরিজ-এর হাত ধরে ইংরাজী সাহিত্যে যখন রোমান্টিসিজম এল, রাজা মহারাজা নয়, একেবারে সাধারণ ঘরের খেটে খাওয়া মানুষজন কবিতা গল্প উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হতে শুরু করলেন l কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখলেন লুসি কবিতাগুচ্ছ l আর লিখলেন "The Solitary Reaper", "The Reverie of Poor Susan".
আজকের আলোচ্য কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র এরকমই একজন অতি সাধারণ রমণী, যিনি পরের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে অতি কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করেন l কিন্তু তাঁর জীবনসংগ্রাম, এই সংগ্রামে বিজয়, শক্তিরুপীনি থেকে অন্নপূর্ণায় রূপান্তর - তাঁকে এক মহিমায় উত্তীর্ণ করেছে, যেখানে অপরের চোখে তিনি হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার এক উৎস l


কবি রক্তিমকে এরকম একটি বিষয় নির্বাচন করে কবিতাটির সুন্দর পরিবেশনার জন্য জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন !