http://www.bangla-kobita.com/sanhita/oparibartito/


কবির পাতায় পাঠকের মন্তব্য -
"কবি সংহিতা রচিত "অপরিবর্তিত" কবিতাটিতে একটি ভ্রম সৃষ্টি করা হয়েছে l কোনো গভীরতর অর্থ  সৃষ্টি করবার জন্য এটি করা হয়ে থাকতে পারে, যার কিছুটা ইঙ্গিত কবিতাটির শিরোনামে আছে বলে মনে হচ্ছে l কিন্তু বিষয়টি পরিষ্কার হয় নি আমার কাছে l আপাতত কবিতাটির প্রথম পাঠে ভ্রম যা দেখা যাচ্ছে তা নিম্নরূপ l
প্রথম অংশে বলা হচ্ছে দিন শুরু হয়েছে l এবং এর সমর্থনে কিছু চিত্রকল্প কবিতায় এসেছে, যেমন, প্রেমিক ঘুম থেকে উঠে সুদূর অতীত থেকে প্রিয়ার কাছে এসেছে, সূর্যোদয় হয়েছে, কপোত কপোতী তাদের বাসায় জেগে উঠেছে, বনে কতো ফুল ফুটেছে, মৌমাছিরা গুঞ্জন করছে l বেশ, বোঝা গেল, এবং ভালো করেই বোঝা গেল, নিশি-অবসানে দিন শুরু হল l
এবার কবিতাটির পরের অংশে বিভ্রান্তি শুরু হলো, যার একটি লক্ষণ প্রথম অংশেও ছিলো l প্রিয়া কিন্তু এখনও ঘুম থেকে ওঠে নি l তাহলে কি রাত শেষ হয় নি ? রাত যে শেষ হয় নি তার সমর্থনে কবিতাটির পরের অংশে আবার কিছু তথ্য দেয়া হলো, যেমন, দূর আকাশে তারাগুলি এখনও দেখা যাচ্ছে, নদীর জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি l চাঁদ, তারা এগুলি তো রাতের অনুসঙ্গ, যেমন সূর্যোদয়, মানুষের ঘুম থেকে জেগে ওঠা, পাখি-পতঙ্গের যাবতীয় সক্রিয়তা - এগুলি দিনের অনুসঙ্গ l
বিভ্রান্ত হচ্ছি একই সঙ্গে দিন ও রাত সহাবস্থান করে কি করে, এই ভাবনায় l নিশাবসানে দিনের শুরু এবং দিনাবসানে রাতের শুরু - এই তো প্রকৃতির নিয়ম l এরা একই সঙ্গে বর্তমান থাকে কি করে ? এই বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খাওয়ার অর্থ কি ?
বহিরঙ্গের এই অসঙ্গতি লক্ষ্য করবার পর কবিতাটির দ্বিতীয় পাঠে এই প্রয়োগের অন্তর্নিহিত কোনো তাত্পর্য থাকতে পারে কি না তা বুঝতে চাইলাম l কবিতাটির শিরোনামে একটু ইঙ্গিত ছিলো, শুরুতেই উল্লেখ করেছি, এবার মনোনিবেশ করলাম কবিতাটির শেষ অংশে ১০, ১১, ১২, ১৩,  ১৪, ১৫, ১৬ নং চরণগুলিতে যেখানে দিন কিংবা রাত বোঝানোর অতিরিক্ত কিছু বলা হয়েছে, যা এই বিভ্রান্তির উত্তর হতে পারে l
শুরুতে দেখেছি সুদূর অতীত থেকে এসে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ডেকে সাড়া পান নি l ১০, ১১, ১২ চরণে এসে সেই একই ঘটনা l বিরহী তার প্রেমের অপেক্ষায় চুপি চুপি কাঁদছে l এখানেও প্রেমের ডাকে সাড়া নেই l এবার কবিতার শেষ তিনটি চরণে এসে প্রাকৃতিক কিছু চিত্রকল্প,যা দিয়ে বোঝানো হলো, প্রেম একতরফা হলেও, সাড়া না পেলেও, একপক্ষ অতীত প্রেমকে ভুলে গিয়ে তাকে অস্বীকার করলেও - প্রেমিকের মনে প্রেমের উদ্ভব ও তার প্রবাহ রুদ্ধ হবে না l প্রেম, প্রেমের ভাব চিরন্তন l এখনও বাতাসে ঝড় আসবে l ঝড় এখানে প্রেমভাবের অনুসঙ্গ রূপে ব্যবহৃত l এখনো মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে, যতই না কেন অন্য পক্ষ অতীত প্রেমকে ভুলে যাক, প্রেমকে অস্বীকার করুক, সাড়া না দিক, প্রকৃত প্রেমিক তার প্রেমিকার ঘুম ভাঙ্গাতে, তার মান ভাঙ্গাতে যুগ যুগ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাবে, অতীত থেকে বর্তমানে l
কবিতাটির এই বোধ থেকেই দিন ও রাতের সহাবস্থান নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করলাম l
প্রেম, তার অনুভব, তার নিবেদন, হারানো প্রেমের দরজায় নাড়া দেওয়া,  যুগে যুগে - এটা দিন l আর প্রেমকে অস্বীকার করা, অতীত প্রেমকে ভুলে যাওয়া, সাড়া না দেওয়া, প্রেমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা - এগুলি রাতের চিত্রকল্প l এই দুয়ের সহাবস্থান তো আছে, সর্বযুগে l
জানি না কবিতাটির মধ্যে আসল কবিতাটি খুঁজে পেতে কতটা সফল হয়েছি l একটা প্রয়াস করলাম কেবল l"


কবির পাতায় উপরের আলোচনামূলক মন্তব্যের উত্তরে কবি নিজে কবিতার বিষয়টিকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন l


"কবিতায় “আমি” হচ্ছে আমার বা আমাদের অনুভূতি প্রবন প্রকৃত মন । আর “তুমি” হচ্ছে আমার বা আমাদের বহমান জীবন।এই জীবন অতি ব্যাস্ততার চাপে এবং যুগের অতি যান্ত্রিকতায় এক ভার্চুয়াল জীবন কাটাচ্ছে। যেন এক অদ্ভুত ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন ।তাই জীবনের প্রকৃত আনুভব গুলো যেন সুদূর আতীত কালে চলে গেছে ।সেই মন মাঝে মাঝে আমাদের জাগিয়ে তুলতে চায়।তাই সে জীবন কে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতে চাইছে সূর্য ওঠা ,তার পাখিদের ঘুম ভাঙা , রাতের তারাদের আকাশে মিলিয়ে যাওয়া , ফুল ফোটা , মৌমাছির গুঞ্জন , নদীর জলে চাঁদের ছায়া , এমনকি মানুষের মনের ভালবাসা আজও আছে ।প্রেম ,বিরহ ,নদী,ঝড় ,বাতাস ,চাঁদ ,তারা ,সূর্য সমস্ত কিছুই অপরিবর্তিত আছে ....শুধু জীবনের হাতে সময় নেই এগুলো দেখবার ও অনুভব করার । অথবা সমস্ত কিছু যন্ত্রের(laptop ,smart phone ,T.V etc) মধ্যে জীবন ঘুমিয়ে আছে।তাই এক “মন” অভিমানে বলছে “তুমি কি ভুলেছ সব সময়ের ব্যাবধানে” । ... এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম ...আমি দুঃখিত ...কবিতায় বোঝাতে পারলাম না ।"


এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্যনীয় এবং সাহিত্য প্রেমীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়, তা হলো একটি কবিতায় কবি কি বলতে চেয়েছেন তার সঙ্গে পাঠক কবিতাটি পড়ে যা বুঝেছেন তার মধ্যে তারতম্য হলো l কবি যে তাঁর বক্তব্যটা তাঁর কবিতায় পাঠককে বোঝাতে পারেন নি, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন l এখানেই কিছু বলার আছে l কবির পাতায় বিষয়টি সংক্ষেপে বলেওছি l কিন্তু এরকম একটি বিষয় কবিতা চর্চাকারী এবং সাহিত্যপ্রেমী প্রত্যেকের সামনে নিয়ে আসা উচিত বলে  মনে হয়েছে l তাই বিশদে বিষয়টি এখানে রাখব l


কবির পাতায় কবির মন্তব্যের উত্তরে পাঠকের উত্তর l


"প্রিয় কবি, আপনি যে বিষয়টা মনের মধ্যে নিয়ে কবিতাটি লিখেছেন, মন্তব্যের উত্তরে যা আপনি স্পষ্ট করেছেন, সেই বিষয়টি ঠিক সেইভাবে কবিতাটি পাঠ করার পর আমরা কিছু পাঠক অনুধাবন করতে পারি নি, এর জন্য আপনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এ সম্বন্ধে বলার শুধু এইটুকু যে এখানে আপনার দিক থেকে এমন কিছু ঘটে নি, যার জন্য ব্যর্থতার দায় নিয়ে আপনাকে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে l গদ্যে বক্তব্য সরাসরি রাখা হয় l অর্থের আড়াল থাকে না l সেখানে লেখক ও পাঠকের মধ্যে বোধের অনৈক্য হবার সম্ভাবনা কম l কিন্তু কবিতা ব্যঞ্জনাময় l অল্প কথায় অনেক কথা বলা হয় l অর্থের আড়াল থাকে l সীমার মধ্যে অসীমকে ধরা হয় l কবি যে অভিজ্ঞতা, অনুভব ও প্রেক্ষাপট থেকে কবিতাটি লিখছেন, পাঠক একটি ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে সেই কবিতাটি যখন পাঠ করছেন, তখন তাঁর ঐ কবিতাটি সম্বন্ধে যে বোধ আসবে, সেটা কবির বোধের সঙ্গে হুবহু নাও মিলতে পারে l এটাই কবিতার বিশেষত্ব l এর জন্য কবিরও দুঃখ পাবার কিছু নেই, পাঠকেরও না এবং কবিতার তো নয়ই l বরং এটাই কবিতার শক্তি এবং এজন্যই কবিতা কালজয়ী l একই কবিতা ভিন্ন ভিন্ন যুগে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন অর্থ নিয়ে প্রাসঙ্গিক থাকে l এজন্যই কবিদের দ্রষ্টা বলা হয় l এজন্যই কবিতা চিরায়ত, চিরন্তন l
এই বিষয়টি নিয়ে আগামীকাল আলোচনা বিভাগে একটি লেখা প্রকাশ করব যেখানে এই অভিজ্ঞতাটিকে সকল সদস্যের সঙ্গে ভাগ করে নিবো l লেখাটি পড়ার অনুরোধ রাখলাম l"


তাহলে বোঝা গেল, এটা কোনো কাল্পনিক কাহিনী নয় l বাস্তবেই এটা হয়েছে এবং অতি সম্প্রতি হয়েছে l এবং মনে হয় এই ঘটনাটির মধ্যে শিক্ষণীয় উপাদান আছে l কবিতাটি গতকাল (১৯.০৪.২০১৭) কবিতার আসরে প্রকাশিত হয়েছে l কবিতার নাম "অপরিবর্তীত", কবি - সংহিতা l ঘটনাটি আমাদের মতো করে হাতে কলমে সাহিত্যকে বুঝে নেবার, কবিতাকে বুঝে নেবার একটা বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে l যেটা বুঝে নেব,
১) একটি কবিতার অর্থ কবির কাছে একরকম এবং পাঠকের কাছে ভিন্ন রকম হতে পারে l বুঝে নেব,
২) কেন এরকমটা হতে পারে l এবং এটাও বুঝে নেব,
৩) এর জন্য কবির দুঃখ পাবার কোনো কারণ নেই l
৪) পাঠকেরও দুঃখ পাবার কোনো কারণ নেই l
এটা কবির ব্যর্থতা নয়, কবিতার ব্যর্থতা নয়, পাঠকের ব্যর্থতা নয় l কবিতার রসায়নেই বোধের এই অনৈক্যের অনুমোদন আছে l এটাই কবিতার জয় l গদ্য ও কবিতার মধ্যে এটাই বৈশিষ্টগত পার্থক্য l বিষয়টা তাহলে বিশদে  বুঝতে চেষ্টা করি l


কবির মনে একটা ভাব এল l সেই ভাবকে আশ্রয় করে তিনি কবিতা লিখলেন l সেই কবিতা পড়ে কবির মনোভাব পাঠক কি পুরোটা বুঝতে পারেন ? কবিতাটির উৎসমুহূর্ত, তার প্রেক্ষাপট কবি যদি বলে দেন, সেক্ষেত্রে কবিতার ভাব, কবির মনোভাব বুঝতে পাঠকের একটু সুবিধা হবার কথা l কিন্তু কবিতা বিষয়টি এমনই ব্যঞ্জনাপূর্ণ, এখানে ভাবের এত গভীরতা, অর্থের এত আড়াল থাকে যে, কোনো কবিতার ক্ষেত্রে বোধের ঐক্য গড়ে তোলা অর্থাৎ কবি যা বলতে চেয়েছেন, পাঠক সেটাই বুঝবেন - এমনটা নিশ্চিত করে হয় না l কবি তার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা বোধ থেকে কবিতা লিখলেন l তাঁর বোধের খন্ডচিত্র ঐ কবিতাটি l কবির জ্ঞান ও বোধের যে অংশটি কবিতায় সরাসরি এলো না, তা কিন্তু কবির স্মরণে ও মননে আছে l ফলে তিনি যখন কবিতাটির বোধ নিচ্ছেন তখন কবিতাটিতে সরাসরি যা বলা আছে এবং কবিতার বাইরে ঐ কবিতাকেন্দ্রিক আনুষঙ্গিক যা তাঁর স্মরণে ও মননে আছে - এই দুয়ের সংমিশ্রণে তিনি তা করছেন l
এখানে সময় নিজেও এক ঘটক l কবি একটি কবিতা যখন লিখছেন, তখন কবিতাটি নিয়ে যা ভাবছেন, পরবর্তী কোনো সময়ে ভিন্ন মানসিক অবস্থায় ঐ কবিতা সম্বন্ধে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হতে পারে l ভাবের ভিন্নার্থ করতে পারেন তিনি l
আর পাঠকের দিক থেকে বলতে গেলে, তাঁর পরিবেশ, পটভূমি ভিন্ন l তিনি তাঁর নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিন্ন এক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কবিতাটি পড়ছেন এবং তার পাঠোদ্ধার করছেন l তার সামনে কবিতাটির উৎস, তার প্রেক্ষাপট নেই,  আছে কেবল কবিতাটি l  কবিতার মধ্যে যা বলা আছে তার মধ্যেই তাঁর বোধ তৈরি হয় l ফলে এখানে কবি ও পাঠকের বোধের অনৈক্য হতেই পারে l ব্যাপারটি
স্বাভাবিক l
সবশেষে বলব, কবি সংহিতা, তাঁর কবিতার যে অর্থ পাঠক করেছিল, তার জবাবে, তিনি যে অর্থে কবিতাটি লিখেছিলেন, তা প্রকাশ করে এই আলোচনার ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছেন এবং কবিতার গঠনমূলক সমালোচনার পরিসর সৃষ্টি করে কবিতা চর্চা ও অনুশীলন কর্মটিকে  সঠিক দিশা দিয়েছেন l