জসীমউদ্দীন-এর কবিতাwww.bangla-kobita.com ওয়েবসাইটে জসীমউদ্দীন-এর প্রকাশিত কবিতাসমূহ।uuid:7d185313-565e-4d50-be79-02a6df9502c9;id=1022024-03-29T08:33:24Zhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/didarul-alom-smorane/দিদারুল আলম স্মরণে2022-01-18T07:24:25-05:002023-06-27T13:23:47-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>খেলা না ভাঙিতে খেলা ছেড়ে গেলি কার ডাক শুনে ভাই,<br />এখনো যে তোর পূবালীর ঠোঁটে রঙ লেখা মুছে নাই!<br />আজো এই মাঠে বাঁশের বাঁশীতে বাজে যে মাঠের গান,<br />কালিন্দী-জল আজো দুলে ওঠে শুনিয়া মেয়ের শাড়ী,<br />মেছো বাঁশী শুনে আজো ঢেউ খেলে কাঁখের কলসে তারি।<br />কারে অভিমান করিয়া বন্ধু! ছেড়ে গেলি আমাদেরে,<br />এই ব্রজধামে আজো আসে নাই মথুরার দূত যে-রে।</p>
<br /><p>কাঞ্চা বয়সে কে দিলরে তোরে আঙিয়ার শ্বেতবাস,<br />কোন দরবেশে তোর কানে কানে খুলিল মন্ত্রপাশ।<br />হায় মুসাফির, কে তোরে বাতাল গোরের কুহেলি পথ,<br />সেই একাকিয়া দূরে দেশে তুই ছাড়িলি জীবন-রথ।<br />অভিমানী ছেলে, কার চেয়েছিলি? কারে তুই পাস নাই?<br />কোন নিদাঘের নিঃশ্বাসে তোর ফুল শুকাইল ভাই?</p>
<br /><p>ওরে বুলবুল, যারে শুনাইতে বেঁধেছিলি তুই গান,<br />সে ফুল-বনের কাঁটা দিয়ে কেউ বিঁধেছিল তোর প্রাণ/<br />তাই ছেড়ে গেলি-হায় পলাতক! শূণ্য পথের বাঁকে,<br />তোর গাঁথা গান আমাদের বুকে উভরিয়া আজ ডাকে।<br />আমাদের খেলা জমে না যে ভাই! তোর সে আদর ছাড়া,<br />আজি মনে হয়, কেউ নাহি জানে হেন মমতার ধারা।<br />একদিন মোরা ভুলে যাব তোরে, এ মায়ার দেশপরে,<br />কেউ কারো স্মৃতি চিরদিন ভরি রাখিতে পারে না ধরে।<br />তোর দেশে ভাই! হয়ত এমন মায়ার কুহক নাহি,<br />জীবনের গাঙে ঘটনার তরী যায় না এমন বাহি।<br />সেই দেশে তাই লিখে রাখিলাম আমাদের দিনগুলি,<br />এই খেলা-মাঠ, এই হাসি গান, যেন যাসনাক ভুলি।<br />রোজ কেয়ামতে যাদি দেখা হয়, বিস্ময়ে তব বুকে<br />হেরিব মোদের সকল কাহিনী স্পষ্ট রেখেছ টুকে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : ধান ক্ষেত</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/beder-bohor/বেদের বহর2022-01-18T07:15:43-05:002024-01-16T05:41:30-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>মধুমতী নদী দিয়া,<br />বেদের বহর ভাসিয়া চলেছে কূলে ঢেউ আছাড়িয়া।<br />জলের উপরে ভাসাইয়া তারা ঘরবাড়ি সংসার,<br />নিজেরাও আজ ভাসিয়া চলেছে সঙ্গ লইয়া তার।<br />মাটির ছেলেরা অভিমান করে ছাড়িয়া মায়ের কোল,<br />নাম-হীন কত নদী-তরঙ্গে ফিরিছে খাইয়া দোল।</p>
<br /><p>দুপাশে বাড়ায়ে বাঁকা তট-বাহু সাথে সাথে মাটি ধায়,<br />চঞ্চল ছেলে আজিও তাহারে ধরা নাহি দিল হায়।<br />কত বন পথ সুশীতল ছায়া ফুল-ফল-ভরা গ্রাম,<br />শস্যের খেত আলপনা আঁকি ডাকে তারে অবিরাম!<br />কত ধল-দীঘি গাজনের হাট, রাঙা মাটি পথে ওড়ে,<br />কারো মোহে ওরা ফিরিয়া এলো না আবার মাটির ঘরে।<br />জলের উপরে ভাসায়ে উহারা ডিঙ্গী নায়ের পাড়া,<br />নদীতে নদীতে ঘুরিছে ফিরিছে সীমাহীন গতিধারা।<br />তারি সাথে সাথে ভাসিয়া চলেছে প্রেম ভালবাসা মায়া,<br />চলেছে ভাসিয়া সোহাগ, আদর ধরিয়া ওদের ছায়া।<br />জলের উপরে ভাসাইয়া তারা ঘরবাড়ি সংসার,<br />ত্যাগের মহিমা, পুন্যের জয় সঙ্গে চলেছে তার।</p>
<br /><p>সামনের নায়ে বউটি দাঁড়ায়ে হাল ঘুরাইছে জোরে,<br />রঙিন পালের বাদাম তাহার বাতাসে গিয়াছে ভরে।<br />ছই এর নীচে স্বামী বসে বসে লাঠিতে তুলিছে ফুল,<br />মুখেতে আসিয়া উড়িছে তাহার মাথায় বাবরী চুল।<br />ও নায়ের মাঝে বউটিরে ধরে মারিতেছে তার পতি,<br />পাশের নায়েতে তাস খেলাইতেছে সুখে দুই দম্পতি।<br />এ নায়ে বেঁধেছে কুরুক্ষেত্র বউ-শাশুড়ীর রণে,<br />ও নায়ে স্বামীটি কানে কানে কথা কহিছে জায়ার সনে!<br />ডাক ডাকিতেছে, ঘুঘু ডাকিতেছে, কোড়া করিতেছে রব,<br />হাট যেন জলে ভাসিয়া চলেছে মিলি কোলাহল সব।<br />জলের উপরে কেবা একখানা নতুন জগৎ গড়ে,<br />টানিয়া ফিরিছে যেথায় সেথায় মনের খুশীর ভরে।</p>
<br /><p>কোন কোন নায়ে রোদে শুখাইছে ছেঁড়া কাঁথা কয়খানা,<br />আর কোন নায়ে শাড়ী উড়িতেছে বরণ দোলায়ে নানা।<br />ও নাও হইতে শুটকি মাছের গন্ধ আসিছে ভাসি,<br />এ নায়ের বধূ সুন্দা ও মেথি বাঁটিতেছে হাসি হাসি।<br />কোনখানে ওরা সি’র নাহি রহে জ্বালাতে সন্ধ্যাদীপ,<br />একঘাট হতে আর ঘাটে যেয়ে দোলায় সোনার টীপ।</p>
<br /><p>এদের গাঁয়ের কোন নাম নাই, চারি সীমা নাহি তার,<br />উপরে আকাশ, নীচে জলধারা, শেষ নাহি কোথা কার।<br />পড়শী ওদের সূর্য, তারকা, গ্রহ ও চন্দ্র আদি,<br />তাহাদের সাথে ভাব করে ওরা চলিয়াছে দল বাঁধি,<br />জলের হাঙর-জলের কুমীর- জলের মাছের সনে,<br />রাতের বেলায় ঘুমায় উহারা ডিঙ্গী-নায়ের কোণে।</p>
<br /><p>বেদের বহর ভাসিয়া চলেছে মধুমতী নদী দিয়া,<br />বেলোয়ারী চুড়ি, রঙিন খেলনা, চিনের সিদুর নিয়া।<br />ময়ূরের পাখা, ঝিনুকের মতি, নানান পুতিঁর মালা,<br />তরীতে তরীতে সাজান রয়েছে ভরিয়া বেদের ডালা।<br />নায়ে নায়ে ডাকে মোরগ-মুরগী যত পাখি পোষ-মানা,<br />শিকারী কুকুর রহিয়াছে বাঁধা আর ছাগলের ছানা।<br />এ নায়ে কাঁদিছে শিশু মার কোলে- এ নায়ে চালার তলে,<br />গুটি তিনচার ছেলেমেয়ে মিলি খেলা করে কৌতুহলে।</p>
<br /><p>বেদের বহর ভাসিয়া চলেছে, ছেলেরা দাঁড়ায়ে তীরে,<br />অবাক হইয়া চাহিয়া দেখিছে জলের এ ধরণীরে!<br />হাত বাড়াইয়া কেহ বা ডাকিছে- কেহ বা ছড়ার সুরে,<br />দুইখানি তীর মুখর করিয়া নাচিতেছে ঘুরে ঘুরে।<br />চলিল বেদের নাও,<br />কাজল কুঠির বন্দর ছাড়ি ধরিল উজানী গাঁও।<br />গোদাগাড়ী তারা পারাইয়া গেল, পারাইল বউঘাটা,<br />লোহাজুড়ি গাঁও দক্ষিণে ফেলি আসিল দরমাহাটা।<br />তারপর আসি নাও লাগাইল উড়ানখালির চরে,<br />রাতের আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে তখন মাথার পরে।</p>
<br /><p>ধীরে অতি ধীরে প্রতি নাও হতে নিবিল প্রদীপগুলি,<br />মৃদু হতে আরো মৃদুতর হল কোলাহল ঘুমে ঢুলি!<br />কাঁচা বয়সের বেদে-বেদেনীর ফিস ফিস কথা কওয়া,<br />এ নায়ে ওনায়ে ঘুরিয়া ঘুরিয়া শুনিছে রাতের হাওয়া।<br />তাহাও এখন থামিয়া গিয়াছে, চাঁদের কলসী ভরে,<br />জোছনার জল গড়ায়ে পড়িছে সকল ধরণী পরে।<br />আকাশের পটে এখানে সেখানে আবছা মেঘের রাশি,<br />চাঁদের আলোরে মাজিয়া মাজিয়া চলেছে বাতাসে ভাসি।<br />দূর গাঁও হতে রহিয়া রহিয়া ডাকে পিউ, পিউ কাঁহা,<br />যোজন যোজন আকাশ ধরায় রচিয়া সুরের রাহা।</p>
<br /><p>এমন সময় বেদে-নাও হতে বাজিয়া বাঁশের বাঁশী,<br />সারা বালুচরে গড়াগড়ি দিয়ে বাতাসে চলিল ভাসি,<br />কতক তাহার নদীতে লুটাল, কতক বাতাস বেয়ে,<br />জোছনার রথে সোয়ার হইয়া মেঘেতে লাগিল যেয়ে।<br />সেই সুর যেন সারে জাহানের দুঃসহ ব্যথা-ভার,<br />খোদার আরশ কুরছি ধরিয়া কেঁদে ফেরে বারবার।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : সোজন বাদিয়ার ঘাট</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/beder-besati/বেদের বেসাতি2022-01-18T07:08:13-05:002023-06-27T13:32:19-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>প্রভাত না হতে সারা গাঁওখানি<br />কিল বিল করি ভরিল বেদের দলে,<br />বেলোয়ারী চুড়ি চিনের সিদুর,<br />রঙিন খেলনা হাঁকিয়া হাঁকিয়া চলে।<br />ছোট ছোট ছেলে আর যত মেয়ে<br />আগে পিছে ধায় আড়াআড়ি করি ডাকে,<br />এ বলে এ বাড়ি, সে বলে ও বাড়ি,<br />ঘিরিয়াছে যেন মধুর মাছির চাকে।<br />কেউ কিনিয়াছে নতুন ঝাঁজর,<br />সবারে দেখায়ে গুমরে ফেলায় পা;<br />কাঁচা পিতলের নোলক পরিয়া,<br />ছোট মেয়েটির সোহাগ যে ধরে না।<br />দিদির আঁচল জড়ায়ে ধরিয়া<br />ছোট ভাই তার কাঁদিয়া কাটিয়া কয়,<br />“তুই চুড়ি নিলি আর মোর হাত<br />খালি রবে বুঝি ? কক্ষনো হবে নয়।”<br />“বেটা ছেলে বুঝি চুড়ি পরে কেউ ?<br />তার চেয়ে আয় ডালিমের ফুল ছিঁড়ে.<br />কাঁচা গাব ছেঁচে আঠা জড়াইয়া<br />ঘরে বসে তোর সাজাই কপালটিরে।”<br />দস্যি ছেলে সে মানে না বারণ,<br />বেদেনীরে দিয়ে তিন তিন সের ধান,<br />কি ছাতার এক টিন দিয়ে গড়া<br />বাঁশী কিনে তার রাখিতে যে হয় মান।<br />মেঝো বউ আজ গুমর করেছে,<br />শাশুড়ী কিনেছে ছোট ননদীর চুড়ি,<br />বড় বউ ডালে ফোড়ৎ যে দিতে<br />মিছেমিছি দেয় লঙ্কা-মরিচ ছুঁড়ি।<br />সেজো বউ তার হাতের কাঁকন<br />ভাঙিয়া ফেলেছে ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান,<br />মন কসাকসি, দর কসাকসি<br />করিয়া বৃদ্ধা শাশুড়ী যে লবেজান।</p>
<br /><p>এমনি করিয়া পাড়ায় পাড়ায়<br />মিলন-কলহ জাগাইয়া ঘরে ঘরে,<br />চলে পথে পথে বেদে দলে দলে<br />কোলাহলে গাঁও ওলট পালট করে।<br />ইলি মিলি কিলি কথা কয় তারা<br />রঙ-বেরঙের বসন উড়ায়ে বায়ে,<br />ইন্দ্রজেলের জালখানি যেন<br />বেয়ে যায় তারা গাঁও হতে আর গাঁয়ে।<br />এ বাড়ি-ও বাড়ি-সে বাড়ি ছাড়িতে<br />হেলাভরে তারা ছড়াইয়া যেন চলে,<br />হাতে হাতে চুড়ি, কপালে সিঁদুর,<br />কানে কানে দুল, পুঁতির মালা যে গলে।<br />নাকে নাক-ছাবি, পায়েতে ঝাঁজর-<br />ঘরে ঘরে যেন জাগায়ে মহোৎসব,<br />গ্রাম-পথখানি রঙিন করিয়া<br />চলে হেলে দুলে, বেদে-বেদেনীরা সব।</p>
<br /><p>“দুপুর বেলায় কে এলো বাদিয়া<br />দুপুরের রোদে নাহিয়া ঘামের জলে,<br />ননদীলো, তারে ডেকে নিয়ে আয়,<br />বসিবারে বল কদম গাছের তলে।”<br />“কদমের ডাল ফোটা ফুল-ভারে<br />হেলিয়া পড়েছে সারাটি হালট ভরে।”<br />“ননদীলো, তারে ডেকে নিয়ে আয়,<br />বসিবার বল বড় মন্টব ঘরে।”<br />“মন্টব ঘরে মস্ত যে মেঝে<br />এখানে সেখানে ইঁদুরে তুলেছে মাটি।”<br />“ননদীলো”, তারে বসিবারে বল<br />উঠানের ধারে বিছায়ে শীতলপাটী।”<br />“শোন, শোন ওহে নতুন বাদিয়া,<br />রঙিন ঝাঁপির ঢাকনি খুলিয়া দাও,<br />দেখাও, দেখাও মনের মতন<br />সুতা সিন্দুর তুমি কি আনিয়াছাও।<br />দেশাল সিঁদুর চাইনাক আমি<br />কোটায় ভরা চিনের সিঁদুর চাই,<br />দেশাল সিঁদুর খস্ খস্ করে,<br />সীথায় পরিয়া কোন সুখ নাহি পাই।</p>
<br /><p>দেশাল সোন্দা নাহি চাহি আমি<br />গায়ে মাখিবার দেশাল মেথি না চাহি,<br />দেশাল সোন্দা মেখে মেখে আমি<br />গরম ছুটিয়া ঘামজলে অবগাহি।”<br />“তোমার লাগিয়া এনেছি কন্যা,<br />রাম-লক্ষ্মণ দুগাছি হাতের শাঁখা,<br />চীন দেশ হতে এনেছি সিঁদুর<br />তোমার রঙিন মুখের মমতা মাখা।”<br />“কি দাম তোমার রাম-লক্ষ্মণ<br />শঙ্খের লাগে, সিঁদুরে কি দাম লাগে,<br />বেগানা দেশের নতুন বাদিয়া<br />সত্য করিয়া কহগো আমার আগে।”</p>
<br /><p>“আমার শাঁখার কোন দাম নাই,<br />ওই দুটি হাতে পরাইয়া দিব বলে,<br />বাদিয়ার ঝালি মাথায় লইয়া<br />দেশে দেশে ফিরি কাঁদিয়া নয়ন-জলে।<br />সিঁদুর আমার ধন্য হইবে,<br />ওই ভালে যদি পরাইয়া দিতে পারি,<br />বিগানা দেশের বাদিয়ার লাগি<br />এতটুকু দয়া কর তুমি ভিন-নারী।”<br />“ননদীলো, তুই উঠান হইতে<br />চলে যেতে বল বিদেশী এ বাদিয়ারে।<br />আর বলে দেলো, ওসব দিয়ে সে<br />সাজায় যেন গো আপনার অবলারে।”<br />“কাজল বরণ কন্যালো তুমি,<br />ভিন-দেশী আমি, মোর কথা নাহি ধর,<br />যাহা মনে লয় দিও দাম পরে<br />আগে তুমি মোর শাঁখা-সিঁদুর পর।”</p>
<br /><p>“বিদেশী বাদিয়া নায়ে সাথে থাক,<br />পসরা লইয়া ফের তুমি দেশে দেশে।<br />এ কেমন শাঁখা পরাইছ মোরে,<br />কাদিঁয়া কাঁদিয়া নয়নের জলে ভেসে?<br />সীথায় সিঁদুর পরাইতে তুমি,<br />সিঁদুরের গুঁড়ো ভিজালে চোখের জলে।<br />ননদীলো, তুই একটু ওধারে<br />ঘুরে আয়, আমি শুনে আসি, ও কি বলে।”<br />“কাজল বরণ কণ্যালো তুমি,<br />আর কোন কথা শুধায়ো না আজ মোরে,<br />সোঁতের শেহলা হইয়া যে আমি<br />দেশে দেশে ফিরি, কি হবে খবর করে।<br />নাহি মাতা আর নাহি পিতা মোর<br />আপন বলিতে নাহি বান্ধব জন,<br />চলি দেশে দেশে পসরা বহিয়া<br />সাথে সাথে চলে বুক-ভরা ক্রদন।<br />সুখে থাক তুমি, সুখে থাক মেয়ে-<br />সীথায় তোমার হাসে সিঁদুরের হাসি,<br />পরাণ তোমর ভরুক লইয়া,<br />স্বামীর সোহাগ আর ভালবাসাবাসি।”</p>
<br /><p>“কে তুমি, কে তুমি ? সোজন ! সোজন!<br />যাও-যাও-তুমি। এক্ষুণি চলে যাও।<br />আর কোনদিন ভ্রমেও কখনো<br />উড়ানখালীতে বাড়ায়ো না তব পাও।<br />ভুলে গেছি আমি, সব ভুলে গেছি<br />সোজন বলিয়া কে ছিল কোথায় কবে,<br />ভ্রমেও কখনো মনের কিনারে<br />অনিনাক তারে আজিকার এই ভবে।<br />এই খুলে দিনু শঙ্খ তোমার<br />কৌটায় ভরা সিন্দুর নিয়ে যাও,<br />কালকে সকালে নাহি দেখি যেন<br />কুমার নদীতে তোমার বেদের নাও।”</p>
<br /><p>“দুলী-দুলী-তুমি এও পার আজ !<br />বুক-খুলে দেখ, শুধু ক্ষত আর ক্ষত,<br />এতটুকু ঠাঁই পাবেনাক সেথা<br />একটি নখের আঁচড় দেবার মত।”</p>
<br /><p>“সে-সব জানিয়া মোর কিবা হবে ?<br />এমন আলাপ পর-পুরুষের সনে,<br />যেবা নারী করে, শত বৎসর<br />জ্বলিয়া পুড়িয়া মরে নরকের কোণে।<br />যাও-তুমি যাও এখনি চলিয়া<br />তব সনে মোর আছিল যে পরিচয়,<br />এ খবর যেন জগতের আর<br />কখনো কোথাও কেহ নাহি জানি লয়।”<br />“কেহ জানিবে না, মোর এ হিয়ার<br />চির কুহেলিয়া গহন বনের তলে,<br />সে সব যে আমি লুকায়ে রেখেছি<br />জিয়ায়ে দুখের শাঙনের মেঘ-জলে।<br />তুমি শুধু ওই শাঁখা সিন্দুর<br />হাসিমুখে আজ অঙ্গে পরিয়া যাও।<br />জনমের শেষ চলে যাই আমি<br />গাঙে ভাসাইয়া আমার বেদের নাও।”<br />“এই আশা লয়ে আসিয়াছ তুমি,<br />ভাবিয়াছ, আমি কুলটা নারীর পারা,<br />তোমার হাতের শাঁখা-সিন্দুরে<br />মজাইব মোর স্বাসীর বংশধারা ?”<br />“দুলী ! দুলী ! মোরে আরো ব্যথা দাও-<br />কঠিন আঘাত-দাও-দাও আরো-আরো,<br />ভেঙ্গে যাক বুক-ভেঙে যাক মন,<br />আকাশ হইতে বাজেরে আনিয়া ছাড়।<br />তোমারি লাগিয়া স্বজন ছাড়িয়া<br />ভাই বান্ধব ছাড়ি মাতাপিতা মোর,<br />বনের পশুর সঙ্গে ফিরেছি<br />লুকায়ে রয়েছি খুঁড়িয়া মড়ার গোর।<br />তোমারি লাগিয়া দশের সামনে<br />আপনার ঘাড়ে লয়ে সব অপরাধ,<br />সাতটি বছর কঠিন জেলের<br />ঘানি টানিলাম না করিয়া প্রতিবাদ।”</p>
<br /><p>“যাও-তুমি যাও, ও সব বলিয়া<br />কেন মিছেমিছি চাহ মোরে ভুলাইতে,<br />আসমান-সম পতির গরব,<br />আসিও না তাহে এতটুকু কালি দিতে।<br />সেদিনের কথা ভুলে গেছি আমি,<br />একটু দাঁড়াও ভাল কথা হল মনে-<br />তুমি দিয়েছিলে বাঁক-খাড়ু পার,<br />নথ দিয়েছিলে পরিতে নাকের সনে।<br />এতদিনও তাহা রেখেছিনু আমি<br />কপালের জোরে দেখা যদি হল আজ,<br />ফিরাইয়া তবে নিয়ে যাও তুমি-<br />দিয়েছিলে মোরে অতীতের যত সাজ।</p>
<br /><p>আর এক কথা-তোমার গলায়<br />গামছায় আমি দিয়েছিনু আঁকি ফুল,<br />সে গামছা মোর ফিরাইয়া দিও,<br />লোকে দেখে যদি, করিবারে পারে ভুল।<br />গোড়ায়ের ধারে যেখানে আমরা<br />বাঁধিয়াছিলাম দুইজনে ছোট ঘর,<br />মোদের সে গত জীবনের ছবি,<br />আঁকিয়াছিলাম তাহার বেড়ার পর।<br />সেই সব ছবি আজো যদি থাকে,<br />আর তুমি যদি যাও কভু সেই দেশে ;<br />সব ছবিগুলি মুছিয়া ফেলিবে,<br />মিথ্যা রটাতে পারে কেহ দেখে এসে।<br />সবই যদি আজ ভুলিয়া গিয়াছি,<br />কি হবে রাখিয়া অতীতের সব চিন,<br />স্মরণের পথে এসে মাঝে মাঝে-<br />জীবনেরে এরা করিবারে পারে হীন ।”</p>
<br /><p>“দুলী, দুলী, তুমি ! এমনি নিঠুর !<br />ইহা ছাড়া আর কোন কথা বলে মোরে-<br />জীবনের এই শেষ সীমানায়<br />দিতে পারিতে না আজিকে বিদায় করে?<br />ভুলে যে গিয়েছ, ভালই করেছ, -<br />আমার দুখের এতটুকু ভাগী হয়ে,<br />জনমের শেষ বিদায় করিতে<br />পারিতে না মোরে দুটি ভাল কথা কয়ে ?<br />আমি ত কিছুই চাহিতে আসিনি!<br />আকাশ হইতে যার শিরে বাজ পড়ে,<br />তুমি ত মানুষ, দেবের সাধ্য,<br />আছে কি তাহার এতটুকু কিছু করে ?<br />ললাটের লেখা বহিয়া যে আমি<br />সায়রে ভাসিনু আপন করম লায়ে ;<br />তারে এত ব্যথা দিয়ে আজি তুমি<br />কি সুখ পাইলে, যাও-যাও মোরে কয়ে।<br />কি করেছি আমি, সেই অন্যায়<br />তোমার জীবনে কি এমন ঘোরতর।<br />মরা কাষ্টেতে আগুন ফুঁকিয়া-<br />কি সুখেতে বল হাসে তব অন্তর ?<br />দুলী ! দুলী ! দুলী ! বল তুমি মোরে,<br />কি লইয়া আজ ফিরে যাব শেষদিনে।<br />এমনি নিঠুর স্বার্থ পরের<br />রুপ দিয়ে হায় তোমারে লইয়া চিনে ?<br />এই জীবনেরো আসিবে সেদিন<br />মাটির ধরায় শেষ নিশ্বাস ছাড়ি,<br />চিরবন্দী এ খাঁচার পাখিটি<br />পালাইয়া যাবে শুণ্যে মেলিয়া পাড়ি।<br />সে সময় মোর কি করে কাটিবে,<br />মনে হবে যবে সারটি জনম হায়<br />কঠিন কঠোর মিথ্যার পাছে<br />ঘুরিয়া ঘুরিয়া খোয়ায়েছি আপনায়।<br />হায়, হায়, আমি তোমারে খুঁজিয়া<br />বাদিয়ার বেশে কেন ভাসিলাম জলে,<br />কেন তরী মোর ডুবিয়া গেল না<br />ঝড়িয়া রাতের তরঙ্গ হিল্লোলে ?<br />কেন বা তোমারে খুঁজিয়া পাইনু,<br />এ জীবনে যদি ব্যথার নাহিক শেষ<br />পথ কেন মোর ফুরাইয়া গেল<br />নাহি পৌঁছিতে মরণের কালো দেশ।</p>
<br /><p>পীর-আউলিয়া, কে আছ কোথায়<br />তারে দিব আমি সকল সালাম ভার,<br />যাহার আশীষে ভুলে যেতে পারি<br />সকল ঘটনা আজিকার দিনটার।<br />এ জীবনে কত করিয়াছি ভুল।<br />এমন হয় না ? সে ভুলের পথ পরে,<br />আজিকার দিন তেমনি করিয়া<br />চলে যায় চির ভুল ভরা পথ ধরে।<br />দুলী-দুলী আমি সব ভুলে যাব<br />কোন অপরাধ রাখিব না মনে প্রাণে ;<br />এই বর দাও, ভাবিবারে পারি<br />তব সন্ধান মেলে নাই কোনখানে।<br />ভাটীয়াল সোঁতে পাল তুলে দিয়ে<br />আবার ভাসিবে মোর বাদিয়ার তরী,<br />যাবে দেশে দেশে ঘাট হতে ঘাটে,<br />ফিরিবে সে একা দুলীর তালাশ করি।<br />বনের পাখিরে ডাকি সে শুধাবে,<br />কোন দেশে আছে সোনার দুলীর ঘরম,<br />দুরের আকাশ সুদুরে মিলাবে<br />আয়নার মত সাদা সে জলের পর।<br />চির একাকীয়া সেই নদী পথ,<br />সরু জল রেখা থামে নাই কোনখানে ;<br />তাহারি উপরে ভাসিবে আমার<br />বিরহী বাদিয়া, বন্ধুর সন্ধানে।<br />হায়, হায় আজ কেন দেখা হল<br />কেন হল পুন তব সনে পরিচয় ?<br />একটি ক্ষণের ঘটনা চলিল<br />সারাটি জনম করিবারে বিষময় ।’</p>
<br /><p>“নিজের কথাই ভাবিলে সোজন,<br />মোর কথা আজ ? না-না- কাজ নাই বলে<br />সকলি যখন শেষ করিয়াছি-<br />কি হইবে আর পুরান সে কাদা ডলে।<br />ওই বুঝি মোর স্বামী এলো ঘরে,<br />এক্ষুনি তুমি চলে যাও নিজ পথে,<br />তোমাতে-আমাতে ছিল পরিচয়-<br />ইহা যেন কেহ নাহি জানে কোনমতে।<br />আর যদি পার, আশিস করিও<br />আমার স্বামীর সোহাগ আদর দিয়ে,<br />এমনি করিয়া মুছে ফেলি যেন,<br />যে সব কাহিনী তোমারে আমারে নিয়ে ।”<br />“যেয়ো না-যেয়ো না শুধু একবার<br />আঁখি ফিরাইয়া দেখে যাও মোর পানে,<br />আগুন জ্বেলেছ যে গহন বনে,<br />সে পুড়িছে আজ কি ব্যথা লইয়া প্রাণে?</p>
<br /><p>ধরায় লুটায়ে কাঁদিল সোজন,<br />কেউ ফিরিল না, মুছাতে তাহার দুখ ;<br />কোন সে সুধার সায়রে নাহিয়া<br />জুড়াবে সে তার অনল পোড়া এ বুক ?<br />জ্বলে তার জ্বালা খর দুপুরের<br />রবি-রশ্মির তীব্র নিশাস ছাড়ি,<br />জ্বলে-জ্বলে জ্বালা কারবালা পথে,<br />দমকা বাতাসে তপ্ত বালুকা নাড়ি।<br />জ্বলে-জ্বলে জ্বালা খর অশনীর<br />ঘোর গরজনে পিঙ্গল মেঘে মেঘে,<br />জ্বলে-জ্বলে জ্বালা মহাজলধীর<br />জঠরে জঠরে ক্ষিপ্ত ঊর্মি বেগে।<br />জ্বলে-জ্বলে জ্বালা গিরিকন্দরে<br />শ্মশানে শ্মশানে জ্বলে জ্বালা চিতাভরে ;<br />তার চেয়ে জ্বালা-জ্বলে জ্বলে জ্বলে<br />হতাশ বুকের মথিত নিশাস পরে ।</p>
<br /><p>জ্বালা-জ্বলে জ্বালা শত শিখা মেলি,<br />পোড়ে জলবায়ু-পোড়ে প্রান্তর-বন ;<br />আরো জ্বলে জ্বালা শত রবি সম,<br />দাহ করে শুধু পোড়ায় না তবু মন।<br />পোড়ে ভালবাসা-পোড়ে পরিণয়<br />পোড়ে জাতিকুল-পোড়ে দেহ আশা ভাষা,<br />পুড়িয়া পুড়িয়া বেঁচে থাকে মন,<br />সাক্ষী হইয়া চিতায় বাঁধিয়া বাসা।<br />জ্বলে-জ্বলে জ্বালা-হতাশ বুকের<br />দীর্ঘনিশাস রহিয়া রহিয়া জ্বলে ;<br />জড়ায়ে জড়ায়ে বেঘুম রাতের<br />সীমারেখাহীন আন্ধার অঞ্চলে।<br />হায়-হায়-সে যে কিজ দিয়ে নিবাবে<br />কারে দেখাইবে কাহারে কহিবে ডাকি,<br />বুক ভরি তার কি অনল জ্বালা<br />শত শিখা মেলি জ্বলিতেছে থাকি থাকি।<br />অনেক কষ্টে মাথার পসরা<br />মাথায় লইয়া টলিতে টলিতে হায়,<br />চলিল সোজন সমুখের পানে<br />চরণ ফেলিয়া বাঁকা বন-পথ ছায়।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : সোজন বাদিয়ার ঘাট</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/sarthok-rojoni/সার্থক রজনী2021-12-14T13:20:38-05:002023-06-27T13:24:11-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আজকে রাতরে যাইতে দেব না, শুধু শুধু কথা কয়ে,<br />তারা ফুটাইব, হাসি ছড়াইব আঁধারের লোকালয়ে।<br />গোলাপী ঠোঁটের কৌটায় করে রাখিব রাতেরে ভরি,<br />তোমার দু-খানি রঙিন বাহুর বাঁধনে তাহারে ধরি।<br />আজকের রাত শুধু আজকের-যত ভাল ভাল কথা,<br />কয়ে আর কয়ে ফুটাইব তাতে যত স্বপনের লতা!</p>
<br /><p>আজকের রাত, মেরু কুহেলির এক ফোঁটা সরু চাঁদ,<br />আজের রাত-শত নিরাশার একটি পূরিত সাধ।<br />আজের রাতেরে জড়ায়ে রাখিব তোমার সোনার গায়,<br />আজকের রাতেরে দোলায় দোলাব তবনিশ্বাস বায়।</p>
<br /><p>আজকের রাতে কথা কব আমি-যত ভাল ভাল কথা,<br />কথার ফুলেতে সাজাইয়া দেব তোমার দেহের লতা!<br />কথায় কথায় উড়ে যাব আমি, ছড়াইয়া যাব আর,<br />মরে যাব আমি নিঃশেষ হয়ে বিস্মৃতি পারাবার।</p>
<br /><p>দিবসে যা হয় হইবে তখন, রাতের পেয়ালা ভরি,<br />দেহ-মদিরার সোনালী পানীয় উথলি যাইবে পড়ি।<br />আজকের রাতে বল, ভালবাসি বল বল তুমি মোর,<br />না হয় ভুলিও যখন হইবে তোমার রজনী ভোর-<br />আমার রজনী ভোর হবেনাক, এ রাত জহর-জাম,<br />পান করে আমি শেষ-নাহি-হওয়া নিদ্রা যে লভিলাম।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : রূপবতী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/gauri-giriv-meye/গৌরী গিরির মেয়ে2021-12-14T13:17:38-05:002023-06-27T18:11:52-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>হিমালয় হতে আসিলে নামিয়া তুষার বসন ত্যাজি,<br />হিমের স্বপন অঙ্গে মাখিয়া সাঁঝের বসনে সাজি।<br />হে গিরি দুহিতা তোমার নয়নে অলকার মেঘগুলি,<br />প্রতি সন্ধ্যায় পরাইয়া যেত মায়া-কাজলের তুলি।<br />তুহিন তুষারে অঙ্গ মাজিতে দুগ্ধধবল কায়,<br />রবির কিরণ পিছলি পিছলি লুটাত হিমানী বায়!<br />রাঙা মাটি পথে চলিতে চলিতে পথ যেন মমতায়,<br />আলতা রেকায় রঙিন হইয়া জড়াইত দুটি পায়।<br />অলকে তোমার পাহাড়ী পবন ফুলের দেউল লুটি,<br />গন্ধের বাসা রচনা করিত সারা রাত ছুটি ছুটি।</p>
<br /><p>গহিন গুহার কুহরে কুহরে কলকল্লোলে ঘুরি,<br />ঝরণা তোমার চরণ বিছাত মণি-মানিকের নুড়ি!<br />পাষাণের ভাষা শুনিতে যে তুমি ঝরণায় পাতি কান,<br />শুনিতে শুনিতে কোন অজানায় ভেসে যেত তব প্রাণ!<br />ঝরণার স্রোতে ভাসিয়া আসিত অলস সোনার ঘুম,<br />তোমার মায়াবী নয়নে বিছাত দূর স্বপনের চুম।<br />শিথিল দেহটি এলাইয়া দিয়া ঘন তুষারের গায়,<br />ঘুমায়ে ঘুমায়ে ঘুমেরে যে ঘুম পাড়াইতে নিরালায়।<br />তোমার দেহের বিম্ব আঁকিয়া আপন বুকের পরে,<br />পরতের পর পরত বিছাত তুষার রজনী ভরে।<br />তোমার ছাষায় যত সে লুকাত, চাঁদের কুমার তত<br />তুষার পরত ভেদিয়া সেথায় একেলা উদয় হ।<br />দূর গগনের সাত-ভাই তারা শিয়রে বিছায়ে ছায়া,<br />পারুল বোনের নিশীথ শয়নে জ্বালতে আলোর মায়া।<br />দিন রজনীর মোহনার সোঁতে শুক-তারকার তরী,<br />চলিতে চলিতে পথ ভুলে যেন ঘাটের বাঁধন স্মরি।<br />পূর্ব তোরণে দাঁড়ায়ে প্রভাত ছুঁড়িত আবীর ধূলি,<br />তোমার নয়ন হইতে ফেলিত ঘুমের কাজল তুলি।<br />কিশোর কুমার, প্রথম হেরিয়া তোমার কিশোরী কায়া,<br />মেঘে আর মেঘে বরণে বরণে মাখাত রঙের মায়া।</p>
<br /><p>কি কুহকে ভুলে ওগো গিরিসুতা! এসেছ মরতে নামি,<br />কে তোমার লাগি পূজার দেউল সাজায়েছে দিবা-যামি।<br />হেথয় প্রখর মরীচি-মালীর জ্বলে হুতাশন জ্বালা,<br />দহনে তোমার শুকাবে নিমেষে বুকে মন্দার মালা।<br />মরতের জীব বৈকুন্ঠের নাহি জানে সন্ধান,<br />ফুলের নেশায় ফুলেরে ছিঁড়িয়া ভেঙে করে শতখান।<br />রূপের পূজারী রূপেরে লইয়া জ্বালায় ভোগের চিতা,<br />প্রেমেরে করিয়া সেবাদাসী এরা রচে যে প্রেমের গীতা।<br />হাত বাড়ালেই হেথা পাওয়া যায়, তৃষ্ণারে বড় করি,<br />তপ-কৃষ তনু গৈরিকবাসে জাগেনাক বিভাবরী।<br />হেথা সমতল, জোয়ারের পানি একধার হতে ভাসি,<br />আরধারে এসে গড়াইয়া পড়ে ছল-কল-ধারে হাসি।<br />হেথায় কাম সহজ লভ্য, পরিয়া যোগীর বাস,<br />গহন গুহায় যোগাসনে কেউ করে না কাহারো আশ।<br />হেথাকার লোক খোলা চিঠি পড়ে, বন-রহস্য আঁকি,<br />বন্ধুর পথে চলে না তটিনী কারো নাম ডাকি ডাকি।<br />তুমি ফিরে যাও হে গিরি-দুহিতা, তোমার পাষাণ পুরে,<br />তোমারে খুঁজিয়া কাঁদিছে ঝরণা কুহরে কুহরে ঘুরে।<br />তব মহাদেব যুগ যুগ ধরি ভস্ম লেপিয়া গায়,<br />গহন গুহায় তোমার লাগিয়া রয়েছে তপস্যায়।<br />অলকার মেয়ে! ফিরে যাও তুমি, তোমার ভবন-দ্বারে,<br />চিত্রকূটের লেখন বহিয়া ফেরে মেঘ জলধারে।<br />তোমার লাগিয়া বিরহী যক্ষ গিরি-দরী পথ-কোণে,<br />পাষাণর গায়ে আপন ব্যথারে মদ্দিছে আনমনে;<br />শোকে কৃশতনু, বিহবল মন, মৃণাল বাহুরে ছাড়ি,<br />বার বার করে ভ্রষ্ট হইছে স্বর্ণ-বলয় তারি।<br />বাণীর কুঞ্জে ময়ূর ময়ূরী ভিড়ায়েছে পাখা তরী,<br />দর্ভ-কুমারী, নিবারের বনে তৃণ আছে বিস্মরি।</p>
<br /><p>তুমি ফিরে যাও তব আলকায়, গৌরী গিরির শিরে,<br />চরণে চরণে তুষার ভাঙিও মন্দাকিনীর তীরে।<br />কন্ঠে পরিও কিংশুকমালা, পাটল-পুষ্প কানে,<br />নীপ-কেশরের রচিও কবরী নব আষাঢ়ের গানে।<br />তীর্থ পথিক বহু পথ বাহি শ্রান্ত ক্লান্ত কায়,<br />কোন এক প্রাতে যেয়ে পৌছিব শিঞ্চল গিরি ছায়।<br />দিগ জোড়া ঘন কুয়াশার লোল অঞ্চলখানি,<br />বায়ুরথে বসি কিরণ কুমার ফিরিবে সুদূরে টানি।<br />আমরা হাজার নব নারী হেথা রহিব প্রতীক্ষায়,<br />কোন শুভখনে গিরি-কন্যার ছায়া যদি দেখা যায়।<br />দিবসের পর দিবস কাটিবে, মহাশূন্যের পথে,<br />বরণের পর বরণ ঢালিবে উতল মেঘের রথে।<br />কুহকী প্রকৃতি মেঘের গুচ্ছে বাঁধিয়া বাদল ঝড়,<br />ঘন ঘোর রাতে মহাউল্লাসে নাচিবে মাথার পর।<br />ভয়-বিহবল দিবস লুকাবে কপিল মেঘের বনে,<br />খর বিদ্যুৎ অট্ট হাসিবে গগনের প্রাঙ্গণে।<br />তীর্থ-পথিক তুব ফিরিবে না, কোন শুভদিন ধরি,<br />বহুদূর পথে দাঁড়াবে আসিয়া গৌরী গিরির পরী।<br />সোনার অঙ্গে জড়ায়ে জড়ায়ে বিজলীর লতাগুলি,<br />ফুল ফোটাইবে, হাসি ছড়াইবে অধর দোলায় দুলি।<br />কেউ বা দেখিবে, কেউ দেখিবে না, অনন্ত মেঘ পরে,<br />আলোক প্রদীপ ভাসিয়া যাইবে শুধু ক্ষণিকের তরে।<br />তারপর সেথা ঘন কুয়াশার অনন্ত আঁধিয়ার,<br />আকাশ-ধরনী, বন-প্রান্তর করে দেবে একাকার।</p>
<br /><p>আমরা মানুষ-ধরার মানুষ এই আমাদের মন,<br />যদি কোনদিন পরিতে না চাহে কুটীরের বন্ধন;<br />যদি কোনদিন সুদূর হইতে আলেয়ার আলো-পরী,<br />বেঘুম শয়ন করে চঞ্চল ডাকি মোর নাম ধরি।<br />হয়ত সেদিন বাহির হইব, গৃহের তুলসী তলে,<br />যে প্রদীপ জ্বলে তাহারে সেদিন নিবায়ে যাইব চলে।<br />অঙ্গে পরিব গৈরিক বাস, গলায় অক্ষহার,<br />নয়নে পরিব উদাস চাহনী মায়া মেঘ বলাকার।<br />কাশীশ্বরের চরণ ছুঁইয়া পূতপবিত্র কায়,<br />জীবনের যত পাপ মুছে যাব প্রয়াগের পথ গায়।<br />হরিদ্বারের রঙিন ধূলায় ঘুমায়ে শ্রান্ত কায়,<br />ত্রিগঙ্গা জলে সিনান করিয়া জুড়াইব আপনায়।<br />কমন্ডলুতে ভরিয়া লইব তীর্থ নদীর বারি,<br />লছমন ঝোলা পার হয়ে যাব পূজা-গান উচ্চারি।<br />তাপসীজনের অঙ্গের বায়ে পবিত্র পথ ছায়ে,<br />বিশ্রাম লভি সমুকের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে।<br />বিশ্রাম লভি সমুখের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে।<br />দেউলে দেউলে রাখিব প্রণাম, তীর্থ নদীর জলে<br />পূজার প্রসূন ভাসাইয়া দিব মোর দেবতারে বলে।<br />মাস-বৎসর কাটিয়া যাইবে, কেদার বদরী ছাড়ি,<br />ঘন বন্ধুর পথে চলিয়াছে সন্যাসী সারি সারি,<br />কঠোর তাপেতে ক্ষীন্ন শরীর শ্রান্তক্লান্ত কায়,<br />সমুখের পানে ছুটে চলে কোন দুরন্ত তৃষ্ণায়।</p>
<br /><p>সহসা একদা মানস সরের বেড়িয়া কণক তীর,<br />হোমের আগুন জ্বলিয়া উঠিবে হাজার সন্ন্যাসীর।<br />শিখায় শিখায় লিখন লিখিয়া পাঠাবে শূন্যপানে,<br />মন্ত্রে মন্ত্রে ছড়াবে কামনা মহা-ওঙ্কার গানে।<br />তারি ঝঙ্কারে স্বর্গ হইতে বাহিয়া কণক রথ,<br />হৈমবতীগো, নামিয়া আসিও ধরি মর্ত্ত্যের পথ।<br />নীল কুবলয় হসে- ধরিও দাঁড়ায়ে সরসী নীরে,<br />মরাল মরালী পাখার আড়াল রচিবে তোমার শিরে।<br />প্রথম উদীতা-ঊষসী-জবার কুসুম মূরতি ধরি,<br />গলিত হিরণ কিরণে নাহিও, হে গিরি দুহিতা পরি।<br />অধর ডলিয়া রক্ত মৃণালে মুছিও বলাকা পাখে,<br />অঙ্গ ঘেরিয়া লাবণ্য যেন লীলাতরঙ্গ আঁকে।<br />চারিধার হতে ভকত কন্ঠে উঠিবে পূজার গান,<br />তার সিঁড়ি বেয়ে স্বরগের পথে করো তুমি অভিযান।</p>
<br /><p>তীর্থ-পথিক, ফিরিয়া আসিব আবার মাটির ঘরে,<br />গিরি গৌরীর বাহিনী আনিব কমন্ডলুতে ভরে।<br />দেউলে দেউলে গড়িব প্রতিমা, পূজার প্রসূন করে,<br />জনমে জনমে দেখা যেন পাই প্রণমিব ইহা স্মরে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : রূপবতী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/kollanye/কল্যাণী2021-12-14T13:13:10-05:002024-03-21T04:02:37-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>শোন, শোন মেয়ে, কার ঘর তুমি জড়ায়েছ জোছনায়,<br />রাঙা অনুরাগ ছড়ায়েছ তুমি কার মেহেদির ছায়!<br />কার আঙিনার ধূলি রাঙা হল চুমি ওই পদতল,<br />কারে দিলে তুমি সুশীতল ছায়া প্রসারিয়া অঞ্চল!</p>
<br /><p>তুমি আকাশের চাঁদ হয়েছিলে, কাহার ফুলের শরে,<br />বিদ্ধ হইয়া হে নভচারিনী নেমেছ মাটির ঘরে!<br />কোন্ সে তমাল মেঘের মায়ায় ওগো বিদ্যুৎলতা!<br />ভুলিলে আজিকে বিরামবিহীন গতির চঞ্চলতা।</p>
<br /><p>চির সুদূরিকা! কহ কহ তুমি, কাহার বাঁশীর সুরে<br />গ্রহতারকার অনাহত বাণী আনিয়াছ দেহপুরে।<br />সে কি জানিয়াছে যুগান্তপারে মহামন্থর শেষে,<br />নীলাম্বুদির তরঙ্গ পরে লক্ষ্মী দাঁড়াল এসে!<br />সে কি জানিয়াছে, মানস-সরের রাঙা মরালীর বায়,<br />সন্ধ্যা-সকাল এক দেহ ধরি দাঁড়ায়েছে নিরালায়!</p>
<br /><p>ওগো কল্যাণী! কহ কহ মোরে, সে কি জানিয়াছে হায়!<br />ও ইন্দ্রধনু তনুখানি তব জড়াতে শ্যামল গায়,<br />তপস্যা-রত জল-ভরা মেঘ গগনে গগনে ঘোরে,<br />কামনা-যজ্ঞে লেলিহা বহ্নি মহাবিদ্যুতে পোড়ে!<br />সে কি জানিয়াছে, বাণীর ভ্রমরী ও অধর ফুল হতে<br />উড়িয়া আসিয়া হিয়ারে যে বেড়ে চিরজনমের ক্ষতে!<br />সে কি শিখিয়াছে, বাসক শয়নে ওই তনুদীপ জ্বালি<br />পতঙ্গ সম প্রতি পলে পলে আপনারে দিতে ঢালি!<br />ও অধর ভরা লাল পেয়ালার দ্রাক্ষারসের তরে,<br />জায়নামাজের বেচিয়াছে পাটি সুরা-বিক্রেতা ঘরে!<br />সে কি জপিয়ায়ে ওই নাম তব তবসী-মালার সনে,<br />সে কি ও নামের কোরান লিখিয়া পড়িয়াছে মনে মনে!</p>
<br /><p>ওগো কল্যাণী! কহ কহ তুমি কেবা দরবেশ,<br />তোমার লাগিয়া মন-মোমবাতি পুড়ায়ে করিল শেষ!<br />কত বড় তার প্রসারিত বুক, আকাশে যে নাহি ধরে,<br />সেই বিদ্যুৎ বিহ্নরে আনি লুকাল বুকের ঘরে!</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : রূপবতী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/aunurodh/অনুরোধ2021-12-14T13:10:34-05:002023-06-27T18:11:58-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>তুমি কি আমার গানের সুরের<br />পূবালী বাতাস হবে,<br />তুমি কি আমার মনের বনের<br />বাঁশীটি হইয়া রবে!<br />রাঙা অধরের রামধনুটিরে,<br />ছড়াবে কি তুমি মোর মেঘ-নীড়ে,<br />আমি কি তোমার কবি হব রাণী,<br />তুমি কি কবিতা হবে;<br />তুমি কি আমার মনের বনের<br />বাঁশীটি হইয়া রবে!</p>
<br /><p>তুমি কি আমার মালার ফুলের<br />ফিরিবে গন্ধ বয়ে,<br />হাসিবে কি তুমি মোর কপালের<br />চন্দন ফোঁটা হয়ে!<br />তুমি কি আমার নীলাকাশ পরে,<br />ফুটাবে কুসুম সারারাত ভরে,<br />সাঁঝ-সকালের রাঙা মেঘ ধরে<br />অঙ্গে জড়ায়ে লবে;<br />তুমি কি আমার মনের বনের<br />বাঁশীটি হইয়া রবে!</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : রূপবতী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/bisorjan/বিসর্জন2021-12-14T12:47:34-05:002023-06-27T15:22:26-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>কি করে আদিল সময় কাটাবে? নানা সন্দেহ ভার,<br />দহন বিষের তীর বিঁধাইয়া হানিতেছে প্রাণে তার।<br />সে যেন দেখিছে আকাশ বাতাস সবাই যুক্তি করি,<br />সকিনারে তার পঙ্কিল পথে নিয়ে যায় হাত ধরি।<br />যারে দেখে তারে সন্দেহ হয়, পাড়া প্রতিবেশী জন,<br />সকিনার সাথে কথা কহিলেই শিহরায় তার মন।<br />ঘরের বাহির হইতে সে নারে; পলকে আড়াল হলে,<br />এই পাপিয়সী আবার ডুবিবে পঙ্কিল হলাহলে।<br />হাতে লয়ে ছোরা চোরের মতন বাড়ির চারিটি ধারে,<br />ঘুরে সে বেড়ায় যদি বা কাহারে ধরিতে কখন পারে।<br />আহার-নিদ্রা ছাড়িল আদিল, ঘুম নাই তার রাতে,<br />কোথাও একটু শব্দ হইলে ছোটে বাতাসের সাথে।</p>
<br /><p>সকিনার সেই সোনা দেহখানি সরষে ক্ষেতের মত,<br />রঙে রঙে লয়ে তাহার পরাণে কাহিনী আনিত কত।<br />সেই দেহে আজ কোন মোহ নাই, বাসর রাতের শেষে<br />নিঃশেষিত যে পানের পাত্র পড়ে আছে দীন বেশে।<br />যে কন্ঠস্বরে বীনাবেনু রব জাগাত তাহার প্রাণে,<br />মাধুরী লুপ্ত সে স্বর এখন তীব্র আঘাত হানে।<br />মোহহীন আর মধুরতাহীন দেহের কাঠাম ভরে,<br />বিগত দিনের কঠোর কাহিনী বাজিয়ে তীব্র স্বরে।<br />কোন মোহে তবে ইহারে লইয়া কাটিবে তাহার দিন,<br />চিরতরে তবে মুছে যাক এই কুলটার সব চিন।</p>
<br /><p>গহন রাত্রে ঘুমায় সকিনা শিয়রের কাছে তার,<br />হাঁটু গাড়া দিয়া বসিল আদিল হাত দুটি করি বার;<br />খোদার নিকটে পঞ্চ রেকাত নামাজ আদায় করি,<br />সাত বার সে যে মনে মনে নিল দরুদ সালাম পড়ি।<br />রুমালে জড়ায়ে কি ওষুধ যেন ধরিল নাকের পরে,<br />বহুখন ভরি নিশ্বাস তার দেখিল পরখ করে।<br />তারপর সে যে অতীব নীরবে হাত দুটি সকিনার,<br />বাঁধিল দড়িতে চরণ দুইটি পরেতে বাঁধিল তার।<br />সন্তর্পণে দেহখানি তার তুলিয়া কাঁধের পরে,<br />চলিল আদিল নীরব নিঝুম গাঁর পথখানি ধরে।</p>
<br /><p>সুদূরে কোথায় ভুতুমের ডাকে কাঁপিয়া উঠিছে রাত,<br />ঘন পাট ক্ষেতে কোঁড়া আর কুঁড়ী করিছে আর্তনাদ।<br />নিজেরি পায়ের শব্দ শুনিয়া প্রাণ তার শিহরায়,<br />নিজ ছায়া যেন ছুল ধরে কার সাথে সাথে তার ধায়।<br />বাঘার ভিটার ডনপাশ দিয়ে, ঘন আমবন শেষে,<br />আঁকাবাঁকা পথ ঘুরিয়া ঘুরিয়া নদীর ঘাটেতে মেশে।<br />সেইখানে বাঁধা ডিঙ্গি তরনী, তার পাটাতন পরে,<br />সকিনারে আনি শোয়াইয়া দিল অতি সযতনে ধরে।</p>
<br /><p>সামনে অথই পদ্মার নদী প্রসারিয়া জলধার,<br />মৃদু ঢেউ সনে ফিসফিস কথা কহিতেছে পারাপার।<br />সকল ধরনী স্তব্ধ নিঝুম জোছনা কাফন পরি,<br />কোন সে করুণ মরণের বেশে সাজিয়াছে বিভাবরী।<br />ধীরে নাও খুলি ভাসিল আদিল অথই নদীর পরে,<br />পশ্চাতে ঢেউ বৈঠার ঘায়ে কাঁদে হায় হায় করে।<br />রহিয়া রহিয়া চরের বিহগ চিৎকারি ওঠে ডেকে,<br />চারি দিগন্ত কেঁপে কেঁপে ওঠে তাহার ধাক্কা লেগে।</p>
<br /><p>সুদূরের চরে ভিড়াল তরনী, ঘন কাশবনে পশি,<br />নল খাগড়ায় আঘাত পাইয়া উঠিতেছে জল স্বসি।<br />মাছগুলি দ্রুত ছুটিয়া পালায় গভীর জলের ছায়।<br />আবার আদিল পঞ্চ রেকাত নফল নামাজ পড়ি,<br />খোদার নিকট করে মোনাজাত দুই হাত জোড় করি।<br />উতল বাতাস কাশবনে পশি আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদে,<br />রাতেরে করিছে খন্ডিত কোন বিরহী পাখির নাদে।<br />ডিঙ্গার তলে পদ্মার পানি দাপায়ে দাপায়ে ধায়,<br />সুদূরের চরে রাতের উক্লা আগুন জ্বালায়ে যায়।</p>
<br /><p>না-না তবু এরে মরিতে হইবে! বাঁধিয়া কলসীখানি,<br />সকিনার গলে, আদিল তাহারে পার্শ্বে আনিল টানি!<br />শব্দ করিয়া হঠাৎ নায়ের বৈঠা পড়িল জলে,<br />জাগিয়া সকিনা চারিদিকে চায় কোথা সে এসেছে চলে!<br />স্বামীরে শুধায়, এ আমি কোথায়, এমন করিয়া চেয়ে<br />কেন আছ তুমি? কন্ঠের স্বরে স্তব্ধতা ওঠে গেয়ে।<br />না! না! এযে মায়া, কভু আদিলেরে ভুলাতে পাবে না আর,<br />কেহ নাই কোথা টলাতে পারে প্রতিজ্ঞা হতে তার্<br />কর্কশ স্বরে কহে সকিারে, অকে চিন্তা করে,<br />স্থির জানিয়াছি, নাহি অধিকার তোমার বাঁচার তরে।</p>
<br /><p>সকিনা কহিল, সোনার পতিরে! এত যদি তব দয়আ,<br />তবে কেন এই অভাগীরে লবে পাতিলে সুখের ময়া।<br />সোঁতের শেহলা ভেসে ফিরিতাম আপন সোঁতের মুখে,<br />কেন তারে তবে কুড়ায়ে আনিয়া আশ্রয় দিলে বুকে!<br />আমি ত তোমারে কত বলেছিনু, এ বুকে আগুন ভরা,<br />যে আসে নিকটে তারে দেহ শুধু ইহারি দারুণ পোড়া।<br />আশ্রয় নিতে গেলাম যে আমি বট বৃক্ষের ছায়ে,<br />পাতা যে তাহার ঝরিয়া পড়িল মোর নিম্বাস ঘায়ে।<br />এ কথা ত পতি, কত বলেছিনু তবে কেন হায় হায়,<br />এ অভাগিনীরে জড়াইলে তব বুক-ভরা মমতায়!<br />আমারে লইয়া বক্ষের মাঝে লিখেছিলে যত কথা,<br />সে কথায় যে গো ফুল ফুটায়েছি রচিয়া সুঠাম লতা;<br />সে লতারে আমি কি করিব আজ! গৃহহীন অভাগীরে,<br />কেন ঘর দিলে স্নেহছায়া ভরা তোমার বুকের নীড়ে?<br />আদিল কহিল, ভুল করেছিনু, ভেবেছিনু এই বুকে<br />এত মায়া আছে তা দিয়ে স্বর্গ গড়িব সোনার সুখে।<br />আজি হেরিলাম, আমার স্বর্গে হাবিয়া দোজখ জ্বলে,<br />তোমার বিগত জীবন বাহিনী তার বহ্নির দোলে।<br />ভাবিয়াছিলাম, এ বাহুতে আছে এত প্রসারিত মায়া,<br />ঢাকিয়া রাখিব তব জীবনের যত কলঙ্ক-ছায়া।<br />আজি হেরিলাম, সে পাপ-বহ্নি বাহুর ছায়ারে ছিঁড়ে,<br />দিকে দিগনে- দাহন ছড়ায় সপ্ত আকাশ ঘিরে।<br />এই বোধ হতে নিস্তার পেতে সাধ্য নাহিক আর,<br />আমার আকাশ বাতাসে আজিকে জ্বলিতেছে হাহাকার।<br />সেই হাহাকারে, তোমার জীবন ইন্ধন দিয়ে আজ,<br />মিটাইব সাধ, দেখি যদি কমে সে কালি-দহের ঝাঁজ।</p>
<br /><p>সকিনা কহিল, পতি গো! তুমি যে আমারে মারিবে হায়,<br />হাসিমুখে আমি সে মরণ নিব জড়ায়ে আঁচল ছায়।<br />আমি যে অভাগী এ বুকে ধরেছি তোমার বংশধর,<br />তার কিবা হবে, একবার তুমি কও মোরে সে খবর?</p>
<br /><p>থাপড়িয়া বুক আদিল কহিল, ওরে পাপীয়সী নারী,<br />আর কি আঘাত আছে তোর তূণে দিবি মো পানে ছাড়ি!<br />আর কি সাপের আছে দংশন, আছে কি অগ্নি জ্বালা,<br />আর কি তীক্ষ্ম কন্টক দিয়ে গড়েছিস তুই মালা!<br />মোর সন্তান আছে তোর বুকে হায়, হায়, ওরে হায়,<br />বড় হলে তারে জানিতে হইবে, কুলটা তাহার মায়।<br />তোর জীবনের যত ইতিহাস দহন সাপের মত,<br />জড়ায়ে জড়ায়ে সেই সন্তানে করিবে নিতুই ক্ষত।<br />পথ দিয়ে যেত কহিবে সকলে আঙুলে দেখায়ে তায়,<br />চেয়ে দেখ তোরা, নষ্টা মায়ের সন্তান ওই যায়!<br />আপন সে ছেলে শত ধিক্কার দিবে নাকি তার বাপে,<br />গলবন্ধনে মরিবে না হায়, সে অপমানের তাপে?<br />তার চেয়ে ভাল, ওরে কলঙ্কী! ভেসে-র সেই ফুল,<br />তোর সনে যেয়ে লভুক আজিকে চির জনমের ভুল।<br />ক্ষণেক থামিয়া রহিল আগিল, সারাটি অঙ্গে তার,<br />কোন অদম্য হিংসা পশু যে নড়িতেছে অনিবার।<br />জাহান্নামের লেলিহা বহ্নি অঙ্গভূষণ করে,<br />উন্মাদিনী কে টানিছে তাহারে, অধরে রুধির ঝরে।<br />না! না! না! সে ফুল চির নিষ্পাপ, হাঁকিয়া সে পুন কয়,<br />ওরে কলঙ্কী!তোর সনে তার এক ঠাই কভু নয়।<br />নল খাগড়ার ওই পথ দিয়ে খানিক এগিয়ে গেলে,<br />ঘন পাট ক্ষেত, ওই ধারে গেলে চরের গেরাম মেলে!<br />সেই পথ দিয়ে যতদূর খুশী হাটিয়া যাইবি পায়,<br />মোর পরিচিত কেউ যেন কভু তোরে না খুঁজিয়া পায়।</p>
<br /><p>নীরবে সকিনা আদিলের পায়ে একটি সালাম রাখি,<br />নল খাগড়ার ঘন জঙ্গলে নিজেরে ফেলিল ঢাকি।<br />আদিলের তরী কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মানদীর গায়,<br />সবল হাতের বৈঠার ঘায়ে কাঁদে ঢেউ হায় হায়।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ্ : সকিনা</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/bidaay/বিদায়2021-12-14T12:39:40-05:002023-06-27T18:25:22-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>কিছুদিন বাদে আদিল কহিল, “গান ত হইল শেষ,<br />সোনার বরণী সকিনা আমার চল আজ নিজ দেশ।<br />তোমার জীবনে আমার জীবনে দুখের কাহিনী যত,<br />শাখায় লতায় বিস্তার লভি এখন হয়েছে গত।<br />চল, ফিরে যাই আপনার ঘরে শূন্য শয্যা তথা,<br />শুষ্ক ফুলেরা ছাড়িছে নিশ্বাস স্মরিয়া তোমার কথা।”</p>
<br /><p>শুনিয়া সকিনা ফ্যাল ফ্যাল করি চাহিল স্বামীর পানে,<br />সে যেন আরেক দেশের মানুষ বোঝে না ইহার মানে।<br />আদিল কহিল-“সেথায় তোমার হলুদের পাটাখানি,<br />সে শুভ দিনের রঙ মেখে গায় ডাকিছে তোমারে রাণী,<br />উদাস বাতাস প্রবেশ করিয়া শূূনো কলসীর বুকে,<br />তোমার জন্যে কাঁদিছে কন্যে শত বিরহের দুখে।<br />মাটির চুলা যে দুরন্ত বায়ে উড়ায়ে ভস্মরাশ,<br />ফাটলে ফাটরে চৌচির হয়ে ছাড়িছে বিরহ শ্বাস।<br />কন্যা-সাজানী সীমলতা সেথা রোপেছিলে নিজ হাতে।<br />রৌদ্রে-দাহনে মলিন আজিকে কেবা জল দিবে তাতে।<br />চল, ফিরে যাই আপনার ঘরে, সেথায় সুখের মায়া।<br />পাখির কুজনে ঝুমিছে সদাই গাছের শীতল ছায়া।"</p>
<br /><p>ক্ষণেক নীরব রহিয়া সকিনা শুধাল স্বামীরে তার,<br />“কোথা সেই ঘর আশ্রয়-ছায়া মিলিবে জীবনে আর ?<br />অভাগিনী আমি প্রতি তিলে তিলে নিজেরে করিয়া দান,<br />কত না দুঃখের দাহনে কিরনু সে ঘরের সন্ধান।<br />সে ঘর আমার জনমের মত পুড়িয়া হয়েছে ছাই,<br />আমার সমুখে শুষ্ক মরু যে ছাড়ে আগুনের হাই।”</p>
<br /><p>আদিল কহিল, “সে মরুতে আজি বহিছে মেঘের ধারা,<br />তুমি সেথা চল নকসা করিয়া রচিবে তৃণের চারা।<br />সেথা অনাগত শিশু কাকলীর ফুটিবে মধুর বোল,<br />নাচিবে দখিন বসন্ত বায় দোলায়ে সুখের দোল।”</p>
<br /><p>“মিথ্যা লইয়া কতকাল পতি প্রবোধিব আপনায় ?”<br />ম্লান হাসি হেসে শুধায় সকিনা, “দুঃখের দাহনায়<br />অনেক সহিয়া শিখেছি বন্ধু, মিছার বেসাতি করি,<br />ভবের নদীতে ফিরিছে কতই ভাগ্যবানের তরী।<br />সেথায় আমার হলনাক ঠাঁই, দুঃখ নাহি যে তায়,<br />সান্ত্বনা রবে, অসত্য লয়ে ঠকাইনি আপনায়।<br />কোন ঘরে মোরে নিয়ে যাবে পতি?যেথায় সমাজনীতি,<br />প্রতি তিলে তিলে শাসনে পিষিয়া মরিছে জীবন নিতি।<br />না ফুটিতে যেথা প্রেমের কুসুম মরিছে নিদাঘ দাহে,<br />না ফুটিতে কথা অধরে শুকায় বিভেদের কাঁটা রাহে।<br />সাদ্দাদ সেথা নকল ভেস্ত গড়িয়া মোহের জালে,<br />দম্ভে ফিরেছে টানিছে ছিঁড়িছে আজিকার এই কালে।<br />সে দেশের মোহ হইতে যে আজি মুক্ত হয়েছি আমি,<br />স্বার্থক যেন লাগিছে যে দুখ সয়েছি জীবনে, স্বামী।<br />কোন ঘরে তুমি নিয়ে যাবে পতি, কুলটার দুর্নাম,<br />যেথায় জ্বলিছে শত শিখা মেলি অফুরান অবিরাম।<br />যেথায় আমার অপাপ-বিদ্ধ শিশু সন্তান তরে,<br />দিনে দিনে শুধু রচে অপমান নানান কাহিনী করে।<br />যেথায় থাপড়ে নিবিছে নিমেষে বাসরের শুভ বাতি.<br />মিলন মালিকা শুকায় যেখানে শেষ না হইতে রাতি।<br />যেথায় মিথ্যা সম্মান অর খ্যাতি আর কুলমান,<br />প্রেম-ভালবাসা স্নেহ-মায়া পরে হানিছে বিষের বাণ।<br />সেথায় আমার ঘর কোথা পতি ? মোরে ছায়া দিতে হায়,<br />নাই হেন ঠাঁই রীতি নীতি ঘেরা তোমাদের দুনিয়ায়।<br />এ জীবনে আমি ঘরই চেয়েছিনু সে ঘরের মোহ দিয়ে,<br />কেউ নিল হাসি, কেউ নিল দেহ কেউ গেল মন নিয়ে।<br />ঘর ত কেহই দিল না আমারে, মিথ্যা ছলনাজাল,<br />পাতিয়া জীবনে নিজেরে ভুলায়ে রাখি আর কতকাল।”</p>
<br /><p>আদিল কহিল, “আমিও জীবনে অনেক দুঃখ সয়ে,<br />নতুন অর্থ খুঁজিয়া পেয়েছি তোমার কাহিনী লয়ে।<br />আর কোন খ্যাতি, কোন গৌরব, কোন যশ কুলমান,<br />আমাদের মাঝে আনিতে নারিবে এতটুকু ব্যবধান।<br />বিরহ দাহনে যশ কুলমান পোড়ায় করেছি ছাই,<br />তোমার জীবন স্বর্ণ হইয়া উজলিছে সেথা তাই।<br />চল ঘরে যাই, নতুন করিয়া গড়িব সমাজনীতি,<br />আমাদের ভালবাসী দিয়ে সেথা রচিব নতুন প্রীতি,</p>
<br /><p>সে ঘর বন্ধু, এখনো রচিত হয় নাই কোনখানে,<br />সে প্রীতি ফুটিবে আমারি মতন কোটি কোটি প্রাণদানে।<br />তুমি ফিরে যাও আপনার ঘরে, রহিও প্রতীক্ষায়.<br />হয়ত জীবনে আবার মিলন হইবে তোমা-আমায়।’</p>
<br /><p>“কারে সাথে করে ফিরে যাব ঘরে ? শূন্য বাতাস তথা,<br />ফুঁদিয়ে এ বুকে আগুন জ্বালাবে ইন্ধনি মোর ব্যথা।”<br />“একা কেন যাবে ?”সকিনা যে কহে, “এই যে তোমার ছেলে,<br />এরে সাথে করে লইও সেথায় নতুন জীবন মেলে।<br />দিনে দিনে তারে ভুলে যেতে দিও জনম দুখিনী মায়,<br />শিখাইও তারে, মরিয়াছে মাতা জীবনের ঝোড়ো বায়।<br />কহিও, দারুণ বনের বাঘে যে খায়নি তাহারে ধরে,<br />মনের বাঘের দংশনে সে যে মরিয়াছে পথে পড়ে।<br />এতদিন পতি, তোমার আশায় ছিনু আমি পথ চেয়ে,<br />আঁচলের ধন সঁপিলাম পায় আজিকে তোমারে পেয়ে।<br />কতেকদিন সে কাঁদিবে হয়ত অভাগী মায়ের তবে,<br />সে কাঁদব তুমি সহ্য করিও আর এক শুভ স্মরে।<br />মোর জীবনের বিগত কাহিনী মোর সাথে সাথে ধায়,<br />তাহারা আঘাত হানিবে না সেই অপাপ জীনটায়।<br />বড় আদরের মোর তোতামণি তারে যাও সাথে নিয়ে,<br />আমারি মতন পালিও তাহারে বুকের আদর দিয়ে।”<br />এই কথা বলি অভাগী সকিনা ছেলেরে স্বামীর হাতে,<br />সঁপিয়া যে দিতে নয়নের জল লুকাইল নিরালাতে।</p>
<br /><p>তোতামণি কয়, “মাগো, মা আমার লক্ষী আমার মা,<br />তোমারে ছাড়িয়া কোথাও যে মোর পরাণ টিকিবে না।<br />কোন বনবাসে আমারে মা তুমি আজিকে সঁপিয়া দিয়া,<br />কি করিয়া তুমি জীবন কাটাবে একেলা পরাণ নিয়া।”<br />“বাছারে! সে সব শুধাসনে মোরে, এটুকু জানিস সার,<br />ছেলের শুভের লাগিয়া সহিতে বহু দুখ হয় মার।<br />রজনী প্রভাতে মা বোল বলিয়া আর না জুড়াবি বুক,<br />শতেক দুখের দাহন জুড়াতে হেরিব না চাঁদ মুখ।<br />তবু বাছা তোরে ছাড়িতে হইবে, জনম দুখিনী মার,<br />সাধ্য হল না বক্ষে রাখিতে আপন ছেলেরে তার।”</p>
<br /><p>ছেলেরে আঁচলে জড়ায়ে সকিনা কাঁদিল অনেকক্ষণ,<br />তারপর কোন দৃঢতায় যেন বাঁধিয়া লইল মন।<br />উসাদ কন্ঠে কহিল স্বামীকে, “ফিরে যাও, নিজ ঘরে,<br />মোদের মিলন বাহিরে হল না রহিল হৃদয় ভরে।<br />আমার লাগিয়া উদাসী হইয়া ফিরিয়াছ গাঁয় গাঁয়,<br />এই সান্ত্বনা রহিল আমার সমুখ জীবনটায়।<br />যাহার লাগিয়া এমন করিয়া অমন পরাণ করে,<br />আজি জানিলাম, তাহারো পরাণ আমারো লাগিয়া ঝরে।<br />এ সুখ আমার দুখ-জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার,<br />সারাটি জনম তপস্যা করি শোধ নাহি হবে তার।<br />এই স্মরণের শক্তি আমারে চালাবে সমুখ পানে,<br />যে অজানা সুর মোহ বিস্তারি নিশিদিন মোর টানে।”</p>
<br /><p>“প্রাণের সকিনা ?” আদিল শুধায়, “সে তব জীবনটায়,<br />আমার তরেতে এতটুকু ঠাই নাহি কোন তরুছায় ?”<br />“আছে, আছে পতি, “সকিনা যে কহে, “হায়রে যাহারে পাই,<br />তাহারে আবার হারাইতে সখা, বড় যে আরাম তাই।<br />ফুলেরে ডাকিয়া পুছিনু সেদিন, “ফুল ! তুমি বল কার ?<br />ফুলে কহে, যারে কিছু না দিলাম আমি যে সবটা তার।<br />শুধালাম পুন; বল বল ফুল ! সব তুমি দিলে যারে,<br />সেকি আজ হাসে বরণে সুবাসে তোমার দানের ভাবে ?<br />“সে আমার কাছে কিছু পায় নাই। ফুল কহে ম্লান হাসি,<br />‘পদ্মের বনে ফিরিছে সারসী কুড়ায়ে শামুক রাশি।<br />পুছিলাম পুন ফুল !তুমি বল কোথায় সবতি তব ?<br />ফুল কহে, যারে কিছু দেই নাই সেথা মোর চিরভব।<br />এ জীবনে মোর এই অভিশাপ যারে কিছু দিতে যাই,<br />কর্পুর সম উবে যায় তাহা, হাতে না লইতে তাই।<br />যে আমারে চাহে যতটা করিয়া আমি হই তত তার,<br />ইচ্ছা করিয়া আমি যে জীবনে কিছু নারি হতে কার।<br />যে আমারে পায় তাহার নিশীথে চির অনিদ্রা জাগে,<br />ফুলশয্যা যে কন্টকক্ষত তাহার জীবনে লাগে।<br />সাপের মাথায় চরণ রাখিয়া চলে সে আঁধার রাতে,<br />দুখের মুকুট মাথায় পরিয়া বিষের ভান্ড হাতে।<br />নিকটে করিয়া যে আমারে চাহে আমি তার বহুদূর,<br />দূরের বাঁশীতে বেজে ওঠে নিতি প্রীতি মিলনের সুর।</p>
<br /><p>ফুলের কাহিনী স্মরিযা পতি গো, অনেক শিখেছি আজ,<br />স্বেচ্ছায় তাই হাসিয়া নিলাম বিরহ মেঘের বাজ।<br />নিকটে তোমারে পেতে চেয়েছিনু, সাধ হল না তাই,<br />দূরের বাঁশীরে দূরে রেখে দেখি বুকে তারে যদি পাই।<br />গলে না লইতে শুকাল মালিকা, মিলন রাতের মোহে,<br />চিরশূণ্যতা ভরেছি এ বুকে দোঁহে আকড়িয়া দোঁহে।<br />আজ তাই পতি, বড় আশা করে তোমারে পাঠাই দূরে,<br />সেই শূন্যতা ভরে যদি ওঠে আমার বুকের সুরে।</p>
<br /><p>আদিল কহিল, প্রাণের সকিনা, সারাটি জনম ভরে,<br />দুখের সাগরে সাঁতার কেটেছ কেবলি আমার তরে।<br />আজকে তোমার কোন সাধ হতে তোমারে না দিব বাধা,<br />স্বেচ্ছায় আমি বরিয়া নিলাম এই বিরহের কাঁদা।<br />বিদায়ের কালে বল অভাগিনী, কোথায় বাঁধিবে ঘর,<br />কোন ছায়াতরু শীতলিত সেই সুদূর তেপান্তর?</p>
<br /><p>ম্লান হাসি হেসে কহিল সকিনা, আমার মতন হায়,<br />অনেক সহিয়া ঘুমায়েছে সারা জীবনে ঝড়িয়ায়;<br />কবর খুঁড়িয়া বাহির করিয়া তাদের কাহিনী মালা,<br />বক্ষে পরিয়া প্রতি পলে পলে বুঝিব তাদের জ্বালা।<br />যত ভাঙা ঘর শুষ্ক কুসুম, দলিত তৃষিত মন,<br />সেথায় আমার যোগ সাধনের রচিব যে ধানাসন।<br />সেইখানে পতি বরষ বরষ রহিব তপস্যায়,<br />খুঁজিব নতুন কথা যা শুনিলে সব দুখ দূরে যায়।<br />জানি না সে কোন কথা-অমৃত, কোন সে মধুর ভাষা,<br />তবু আজ মোর নিশিদিশি ভরি জাগিতেছে মনে আশা;<br />সে কথার আমি পাব সন্ধান, দুঃখ দাহন মাঝে,<br />হয়ত বেদন-নাশন কখন গোপনে সেখা রোজে।<br />একান্ত মনে বসি ধ্যানাসনে একটি একটি ধরি,<br />মোর ব্যথাগুলি সবার ব্যথার সঙ্গে মিশাল করি;<br />পরতে পরতে খুলিয়া খুলিয়া দিনের পরেতে দিন,<br />খুঁজিয়া দেখিব কোথা আছে সেই কথামৃতের চিন।<br />যদি কোন কোন সন্ধান মেলে, সে মধুর সুর নিয়া,<br />নতুন করিয়া গড়িব আবার আমাদের এ দুনিয়া।<br />সেইদিন পতি ফিরিয়া যাইব আবার তোমার ঘরে,<br />অভাগীরে যদি ভালবাস সখা, থেকো প্রতীক্ষা করে।</p>
<br /><p>বিদায়ের আগে ও চরণে শেষ ছালাম জানায়ে যাই,<br />দোয়া করো মোরে, এই সাধনায় সিদ্ধি যেন গো পাই।<br />আর যদি কভু ফিরে নাহি আসি, ব্যথার দাহনানলে,<br />জানিও, অভাগী মরিয়াছে সেথা নিরাশায় জ্বলে জ্বলে।<br />আজি এ জীবন বিষে বিষায়িত, প্রেম, ভালবাসা, মায়া,<br />বেড়িয়া নাচিছে গোর কুজঝট কদাকার প্রেত ছায়া।<br />জ্বলিছে বহ্নি দিকে দিগনে-, তীব্র লেলিহা তার,<br />খোদার আরশ কুরছির পরে মূর্চ্ছিছে বারবার।<br />দিন রজনীর দুইটি ভান্ড পোরা যে তীব্র বিষে,<br />মাটির পেয়ালা পূর্ণ করিয়া উঠেছে গগন দিশে।<br />তারকা-চন্দ্রে জ্বলিছে তাহার তীব্র যে হুতাশন,<br />তারি জ্বালা হতে নিস্তার মোর না হইল কোনক্ষণ।<br />সন্ধ্যা সকাল তারি শিখা লয়ে আকাশের দুই কোলে,<br />মারণ মন্ত্র ফুকারি ফুকারি যুগল চিতা যে জ্বলে।<br />তাই এ জীবন সরায়ে লইনু তোমার জীবন হতে,<br />আমারে ভাসিতে দাও পতি, সেই কালিয়-দহের স্রোতে।</p>
<br /><p>বাপের সঙ্গে চলিয়াছে ছেলে, ফিরে চায় বারে বারে,<br />পারিত সে যদি দুটি চোখ বরি টেনে নিয়ে যেত মারে।<br />পাথরের মত দাঁড়ায়ে সকিনা, স্তব্ধ যে মহাকাল,<br />খুঁজিয়া না পায় অভাগিনী তরে সান্ত্বনা ভাষাজাল।<br />চরণ হইতে চলার চক্র খসিয়া খসিয়া পড়ে,<br />নয়ন হইতে অশ্রুর ধারা নিশির শিশিরে ঝরে।<br />তিনু ফকিরের সারিন্দা বাজে, আয়রে দুষ্কু আয়,<br />পাতাল ফুঁড়িয়া দুনিয়া ঘুরিয়া আকাশের নিরালায়।<br />আয়রে দুস্কু, কবরের ঘরে হাজার বছর ঘুরে,<br />ছিলি অচেতন আজকে আয়রে আমার গানের সুরে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : সকিনা</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/sukher-basor/সুখের বাসর2021-12-14T12:15:05-05:002023-06-27T18:13:06-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>নয়া জমিদার আদিলদ্দীন ধরি সকিনারে হাত,<br />কহিল, চল গো সোনার বরণী, মোর ঘরে মোর সাথ!<br />মালার মতন করিয়া তোমারে পরিয়া রাখিব গলে,<br />পঙ্খী করিয়া পুষিব তোমারে উড়াব আকাশ ভরি,<br />আমার দুনিয়া রঙিন করিব তোমারে মেহেদী করি।</p>
<br /><p>সকিনা কহিল, আপনি মহান, হতভাগিনীর তরে,<br />যাহা করেছেন জিন্দেগী যাবে ঋণ পরিশোধ করে।<br />তবুও আমারে ক্ষমা করিবেন, আপনার ঘরে গেলে,<br />বসিতে হইবে হতভাগিনীরে কলঙ্ক কালি মেলে।<br />আসমান সম আপনার কুল, মোর জীবনের মেঘে,<br />যত চান আর সুরুয তারকা সকল ফেলিবে ঢেকে।<br />ধোপ কাপড়েতে দাগ লাগিলে যে সে দাগ মোছেনা আর,<br />অভাগীর তরী ভাসাইতে দিন ভুলের গাঙের পার।</p>
<br /><p>আদিল কহিল, সুন্দর মেয়ে! থাক চাঁদ মেঘে ঢেকে,<br />তুমি যে উদয় হও মোর মনে জোছনা ঝলক এঁকে।<br />মোর ভালবাসা চান্দের সম, তব কলঙ্ক তার,<br />শোভা হয়ে শুধু ছড়ায়ে পড়িবে নানা কাহিনীতে আর।<br />সকিনা কহিল, পাড়ে পড়ি তুমি আমারে বুঝোনা ভুল,<br />কত না বিপদ সায়র হইতে তুমি মোরে দেছ কূল।<br />তোমার নিকটে জমা রাখিলাম ইহ-পরকাল মোর,<br />দন্ডের তরে তোমারে ভুলিলে আমি যেন লই গোর।<br />তোমার লাগিয়া আমি যে বন্ধু তাপসিনী হয়ে রব,<br />গহন বনেতে কুঁড়ে ঘরে বসি তব নাম শুধু লব।<br />ক্ষমা করো মোরে, তোমার জীবনে দোসর হইব বলে,<br />সাধ থাকিলেও সাধ্য নাহিক আমারি ভাগ্য ফলে।</p>
<br /><p>আদিল কহিল, সুন্দর মেয়ে! তুমি কেন ভয় পাও?<br />আমার আকাশে তুমি হবে মোর উদয়-তারার নাও।<br />এই বুক মোর এত প্রসারিত, তাহার আড়াল দিয়া,<br />দুনিয়া ছড়ান তব কলঙ্ক রাখিব যে আবরিয়া।<br />এ বাহুতে আছে এত বিক্রম, তার মহা-মহিমায়,<br />এতটুকু গ্লানি আনিতে পাবে না কেউ এ জীবনটায়।</p>
<br /><p>তবু মোরে ক্ষমা করিও বন্ধু! সকিনা কহিল কাঁদি,<br />যারে ভালবাসি তারে কোন প্রাণে দেব এই দেহ সাধি।<br />একটি বিপদ হতে উদ্ধার পাইবার লাগি তার,<br />আরটি বিপদে পড়িতে হয়েছে বদলে এ দেহটার।<br />পন্যের মত দেহটারে সে যে বিলায়েছে জনে জনে,<br />কোন লালসার লাগি নহে শুধু বাঁচিবার প্রয়োজনে।<br />এই মন লয়ে কতজন সনে করিয়াছে অভিনয়,<br />কত মিথ্যার নকল রচিয়া ফিরেছে ভুবনময়।<br />সে শুধু ক্ষুধার আহারের লাগি কে তাহা বুঝিতে পাবে?<br />সবাই তাহারে চিন্তা করিবে নানা কুৎসিতভাবে!<br />সেই মন আর সেই দেহ যাহা সবখানে কদাকার,<br />কেমন করিয়া দিবে তারে যেবা সব চেয়ে আপনার!<br />পায়ে পড়ি তব, শোন গো বন্ধু! ছাড় অভাগীর আশা,<br />আমারে লইয়া ভাঙিওনা তব আসমান সব বাসা।</p>
<br /><p>আদিল কহিল, বুঝিলাম মেয়ে! রজনী হইলে শেষ,<br />রাতের বাসারে উপহাসি পাখি চলে যায় আর দেশ;<br />সকল বিপদ হইতে তোমারে করিয়াছি উদ্ধার,<br />আমারে লইয়া তোমার জীবনে প্রয়োজন কিবা আর?<br />কি কথা শুনালে পরাণ বন্ধু! সকিনা কাঁদিয়া কয়,<br />তীক্ষ্ম বরশা-শেল যে বিধালে আমার জীবনটায়।<br />এত যদি মনে ছিল গো বন্ধু, এই অভাগিনী তরে,<br />তোমার পরাণ ওমন করিয়া এমনই যদি বা করে;<br />আমারে লইয়া এতই তোমার হয় যদি প্রয়োজন,<br />আজি হতে তবে সঁপিলাম পায়ে এই দেহ আর মন।<br />সাক্ষী থাকিও আল্লা রসুল! আপন অনিচ্ছায়,<br />সব চেয়ে যেবা পবিত্র মম তারে দিনু আমি হায়;<br />এই দেহ মন যাহা জনে জনে কালি যে মাকায়ে গেছে,<br />তাই নিল আজি মোর ফেরেস্তা আপনার হাতে যেচে।<br />বনে থাকো তুমি পউখ পাখালী আমারে করিও দোয়া,<br />আজ হতে আমি বন্দী হইনু লইয়া ইহার ময়া।<br />অনেক ঊর্ধ্বে থাকগো তোমরা চন্দ্র-সূরুয দুটি,<br />মোদের জীবন রহে যেন সদা তোমাদের মত ফুটি।<br />দোয়া কর তুমি সোনার পতিগো, দোয়া কর তুমি মোরে,<br />তোমার জীবনে জড়ালাম আমি লতার মতন করে।<br />এ লতা বাঁধন জনমের মত কখনো যেন না টুটে,<br />যত ভালবাসা ফুলের মতন রহে যেন এতে ফুটে।</p>
<br /><p>সকিনারে লয়ে আদিল এবার পাতিল সুখের ঘর,<br />বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর।<br />সোঁতের শেহলা ভাসিতে ভাসিতে এবার পাইল কূল,<br />আদিলবলিল, গাঙের পানিতে কুড়ায়ে পেঁয়েছি ফুল।<br />এই ফুল আমি মালায় গাঁথিয়া গলায় পরিয়া নেব,<br />এই ফুল আমি আতর করিয়া বাতাসে ছড়ায়ে দেব।<br />এই ফুলে আমি লিখন লিখিব, ভালবাসা দুটি কথা,<br />এই ফুলে আমি হাসিখুশি করে জড়াব জীবন-লতা।</p>
<br /><p>করিলও তাই, সকিনারে দিয়ে রঙের রঙের শাড়ী,<br />আদিল কহিল, সবগুলি মেঘ এসেছে সন্ধ্যা ছাড়ি।<br />সবগুলি পাখি রঙিন পাখায় করেছে হেথায় মেলা,<br />সবগুলি রামধনু এসে দেহে জুড়েছে রঙের খেলা।<br />ঝলমল মল গয়নায় গাও ঝলমল মল করে,<br />ঝিকিমিকি ঝিকি জোনাক মতিরা হাসিছে অঙ্গ ধরে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : সকিনা</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/sokina/সকিনা2021-12-14T12:02:29-05:002023-06-25T13:58:27-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>দুখের সায়রে সাঁতারিয়া আজ সকিনার তরীখানি,<br />ভিড়েছে যেখানে, সেতা নাই কূল, শুধুই অগাধ পানি।<br />গরীবের ঘরে জন্ম তাহার, বয়স বাড়িতে হায়,<br />কিছু বাড়িল না, একরাশ রূপ জড়াইল শুধু গায়।<br />সেই রূপই তার শত্রু হইল, পন্যের মত তারে,<br />বিয়ে দিল বাপ দুই মুঠি ভরি টাকা আধুলির ভারে!</p>
<br /><p>খসম তাহার দাগী-চোর, রাতে রহিত না ঘরে,<br />হেথায় হোথায় ঘুরিয়া ফিরিত সিদকাঠি হাতে করে।<br />সারাটি দিবস পড়িয়া ঘুমাত, সকিনার সনে তার,<br />দেখা যে হইত ক্ষনেকের তরে, মাসে দুই একবার।<br />সেই কোন তার কল্পিত এক এপরাধ ভেবে মনে,<br />মারিবার যবে হত প্রয়োজন অতীব ক্রোধের সনে।<br />এমন স্বামীর বন্ধন ছাড়ি বহু হাত ঘুরি ফিরি,<br />দুঃখের জাল মেলে সে চলিল জীবনের নদী ঘিরি।<br />সে সব কাহিনী বড় নিদারুন, মোড়লের দরবার,<br />উকিলের বাড়ি, থানার হাজত, রাজার কাছারী আর;<br />ঘন পাট ক্ষেত, দূর বেত ঝাড়, গহন বনের ছায়,<br />সাপের খোড়লে, বাঘের গুহায় কাটাতে হয়েছে তায়;<br />দিনেরে লুকায়ে, রাতেরে লুকায়ে সে সব কাহিনী তার,<br />লিখে সে এসেছে, কেউ কোন দিন জানিবে না সমাচার।<br />সে কেচ্ছা কোন কবি গাহিবে না কোন দেশে কোন কালে,<br />সকিনারি শুদা সারাটি জনম দহিবে যে জঞ্জালে।<br />এত যে আঘাত, এত অপমান, এত লাঞ্ছনা তার,<br />সবই তার মনে, এতটুকু দাগ লাগে নাই দেহে তার।<br />দেহ যে তার পদ্মের পাতা, ঘটনার জল-দল,<br />গড়ায়ে পড়িতে রূপেরে করেছে আরো সে সমুজ্জল।</p>
<br /><p>সে রূপ যাদের টানিয়া আনিল তারা দুই হাত দিয়ে,<br />জগতের যত জঞ্জাল আনিল জড়াইল তারে নিয়ে।<br />কেউ দিল তারে বিষের ভান্ড, কেউ বা প্রবঞ্চনা,<br />কেউ দিল ঘৃণা, কলঙ্ক কালি এনে দিল কোন জনা।<br />সে রূপের মোহে পতঙ্গ হয়ে যাহারা ভিড়িল হায়,<br />তারা পুড়িল না অমর করিয়া বিষে বিষাইল তায়।<br />তাদেরি সঙ্গে আসিল যুবক, তরুণ সে জমিদার,<br />হাসিখুশী মুখ, সৌম্য মুরতি দেশ-জোড়া খ্যাতি তার।<br />সে আসি বলিল, সব গ্লানি হতে তোমারে মুক্ত করি,<br />মোর গৃহে নিয়ে রাণীর বেশেতে সাজাইব এই পরী।<br />করিলও তাই, যে জাল পাতিয়া রূপ-পিয়াসীর দল,<br />রেখেছিল তারে বন্দী করিয়া রচিয়া নানান ছল;<br />সে সব হইতে টানিয়া তাহারে নিয়ে এলো করি বার,<br />গত জীবনের মুছিয়া ঘটনা জীবন হইতে তার!<br />মেঘ-মুক্ত সে আকাশের মত দাঁড়াল যখন এসে,<br />রূপ যেন তারে করিতেছে স্তব সারাটি অঙ্গে ভেসে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : সকিনা</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nomuder-kalo-meye/নমুদের কালো মেয়ে2021-06-06T06:31:47-04:002023-08-23T05:40:17-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>ইতল বেতল ফুলের বনে ফুল ঝুর ঝুর করেরে ভাই।<br />ফুল ঝুর ঝুর করে ;<br />দেখে এলাম কালো মেয়ে গদাই নমুর ঘরে।<br />ধানের আগায় ধানের ছড়া, তাহার পরে টিয়া,<br />নমুর মেয়ে গা মাজে রোজ তারির পাখা দিয়া,<br />দুর্বাবনে রাখলে তারে দুর্বাতে যায় মিশে,<br />মেঘের খাটে শুইয়ে দিলে খুঁজে না পাই দিশে।<br />লাউয়ের ডগায় লাউয়ের পাতা, রৌদ্রেতে যায় ঊনে,<br />গা-ভরা তার সোহাগ দোলে তারির লতা বুনে।<br />যে পথ দিয়ে যায় চলে সে, যে পথ দিয়ে আসে,<br />সে পথ দিয়ে মেঘ চলে যায়, বিজলী বরণ হাসে।<br />বনের মাঝে বনের লতা, পাতায় পাতায় ফুল,<br />সেও জানে না নমু মেয়ের শ্যামল শোভার তুল।<br />যে মেঘের জড়িয়ে ধরে হাসে রামের ধনু,<br />রঙিন শাড়ী হাসে যে তার জড়িয়ে সেই তনু।</p>
<br /><p>গায়ে তাহার গয়না নাহি, হাতে কাচের চুড়ি;<br />দুই পায়েতে কাঁসার খাড়ু, বাজছে ঘুরি ঘুরি।<br />এতেই তারে মানিয়েছে যা তুলনা নেই তার;<br />যে দেখে সে অমনি বলে, দেখে লই আরবার।<br />সোনা রুপার গয়না তাহার পরিয়ে দিলে গায়,<br />বাড়ত না রুপ, অপমানই করতে হত তায়।<br />ছিপছিপে তার পাতলা গঠন, হাত চোখ মুখ কান,<br />দুলছে হেলছে মেলছে গায়ে গয়না শতখান ।</p>
<br /><p>হ্যাচড়া পুজোর ছড়ার মত ফুরফুরিয়ে ঘোরে<br />হেথায় হোথায় যথায় তথায় মনের খুশীর ভরে।<br />বেথুল তুলে, ফুল কুড়িয়ে, বেঙ্গে ফলের ডাল,<br />সারাটি গাঁও টহল দিয়ে কাটে তাহার কাল।<br />পুতুল আছে অনেকগুলো, বিয়ের গাহি গান,<br />নিমন্ত্রণে লোক ডাকি সে হয় যে লবেজান।<br />এসব কাজে সোজন তাহার সবার চেয়ে সেরা,<br />ছমির শেখের ভাজন বেটা, বাবরি মাথায় ঘেরা।<br />কোন বনেতে কটার বাসার বাড়ছে ছোট ছানা,<br />ডাহুক কোথায় ডিম পাড়ে তার নখের আগায় জানা।<br />সবার সেরা আমের আঁটির গড়তে জানে বাঁশী,<br />উঁচু ডালে পাকা কুলটি পাড়তে পারে হাসি।<br />বাঁশের পাতায় নথ গড়ায়ে গাবের গাঁথি হার,<br />অনেক কালই জয় করেছে শিশু মনটি তার।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : সোজন বাদিয়ার ঘাট</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/are-akdin-asio-bondhu/আর একদিন আসিও বন্ধু2021-06-06T04:16:18-04:002024-02-10T07:46:23-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আর একদিন আসিও বন্ধু-আসিও এ বালুচরে,<br />বাহুতে বাঁধিয়া বিজলীর লতা রাঙা মুখে চাঁদ ভরে।<br />তটিনী বাজাবে পদ-কিঙ্কিণী, পাখিরা দোলবে ছায়া,<br />সাদা মেঘ তব সোনার অঙ্গে মাখাবে মোমের মায়া।<br />আসিও সজনি, এই বালুচলে, আঁকা-বাঁকা পথখানি;<br />এধারে ওধারে ধান ক্ষেত তারে লয়ে করে টানাটানি।<br />কখনো সে গেছে ওধারে বাঁকিয়া কখনো এধারে আসি,<br />এরে ওরে লয়ে জড়াজড়ি করে ছড়ায় ধুলার হাসি।<br />এহ পথ দিয়ে আসিও সজনি, প্রভাতে ও সন্ধ্যায়,<br />দিগন্ত জোড়া ধানের ক্ষেতের গন্ধ মাখিয়া গায়।<br />চরের বাতাস বাতাস করিয়া শীতল করিছে যারে,<br />সেই পথে তুমি চরণ ফেলিয়া আসিও এ নদী পারে।</p>
<br /><p>আর একদিন আসিও সজনি, এ মোর কামনাখানি,<br />মুখ বালুচরে আখর এঁকেছি নখরে নখর হানি।<br />লিখিয়াছি তাহা পাখির পাখায় মোর নিঃশ্বাস ঘায়ে,<br />আর লিখিয়াছি দুর গগনের কনক মেঘের ছায়ে।<br />সেই সব তুমি পড়িয়া পড়িয়া অলস অবশ কায়,<br />এইখানে এসে থামিও বন্ধু মোর বেনুবন-ছায়া।<br />এই বেনুবন মোর সাথে সাথে কাঁদিয়াছে বহুরাতি,<br />পাতায় পাতায় জড়াজড়ি করি উতল পবনে মাতি।<br />এইখানে সখি। সাক্ষ্য হইয়া রাতের প্রহরগুলি,<br />কত যে কঠোর বেদনা আমার তোমারে বলিবে খুলি।</p>
<br /><p>রাত-জাগা পাখি কহিবে তোমারে, আমার বে-ঘুম রাতি,<br />কাটিতে কাটিতে কি করে নিবেছে একে একে সব বাতি।<br />সেইখানে তুমি বসিও সজনি।মনে না রাখিও ডর,<br />সেদিন আমার যত কথা সখি। এই মুক মাটি তলে,<br />মোর সাথে সাথে ঘুমায়ে রহিবে মহা-মৃত্যুর কোলে।</p>
<br /><p>এই নদী তটে বরষ বরষ ফুলের মহোৎসবে;<br />আসিবে যাহারা তাহাদের মাঝে মোর নাম নাহি রবে।<br />সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে, অভাগা গাঁয়ের কবি,<br />জীবনের কোন কনক বেলায় দেখেছিল কার ছবি।<br />ফুলের মালায় কে লিখিল তারে গোরের নিমন্ত্রণ,<br />কে দিল তাহারে ধুপের ধোঁয়ায় নিদারুণ হুতাশণ।</p>
<br /><p>সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে কথা এই অভাগার,<br />জনিবে না কেউ কত বড় আশা জীবনে আছিল তার।<br />ধরণীর বুকে প্রদীপ রাখি সে, আকাশের ডাক দিত-<br />মাটির কলসে জল ভরে সে যে তটিনীরে বুকে নিত।<br />এত বড় আশা কি করে ভাঙিল, কি করে জীবন ভোরে,<br />রঙ-কুহেলির সোনার স্বপন ভাঙিল সিঁধেল চোরে।<br />এসব সেদিন স্মরিবে না কেহ, দুঃখ নাহিক তায় ;<br />যে গেল তাহারে ফিরায়ে আনিতে পিছু-ডাকে নাহি হায়।<br />যে দুখে আমার জীবন দহিল সে দুখের স্মৃতি রাখি,<br />সবার মাঝারে রহিব যে বেঁচে, এর চেয়ে নাই ফাঁকি।</p>
<br /><p>তুমিও আমারে ভেবো না সেদিন, আমার দুঃখ ভার।<br />এতটুকু ব্যথা নাহি আনে যেন কোনদিন মনে কার।<br />এ মোর জীবনে তোমার হাতের পেয়েছিনু অবহেলা,<br />এই গৌরব রহিল আমার ভরিতে জীবন ভেলা।<br />তুমি দিয়াছিলে আমারে আঘাত, তারি মহা-মহিমায়<br />সবার আঘাত দলিয়া এসেছি এ মোর চরণ ঘায়।<br />তোমারে আমার লেগেছিল ভাল, আর সব ভাল তাই।<br />আমার জীবনে এতটুকু দাগ কেহ কভু আঁকে নাই।<br />তোমার নিকটে পেয়েছিনু ব্যথা তারি গেীরব ভরে,<br />আর সব ব্যথা খড়কুটা সম ছিঁড়িয়াছি নখে ধরে।</p>
<br /><p>তুমি দিয়েছিলে ক্ষুধা,<br />অবহেলে তাই ছাড়িয়া এসেছি জগতের যত সুধা।<br />এ জীবনে মোর এই গৌরব, তোমারে যে পাই নাই,<br />আর কারো কাছে না পাওয়ার ব্যথা সহিতে হয়নি তাই।<br />তোমার নিকটে কণিকা না পেয়ে আমি হয়েছিনু ধনী-<br />আমার কুটীরে ছড়াছড়ি যেত রতন মানিক মণি।</p>
<br /><p>তাই আজ শুভখনে-<br />মোর পরে তব যত অন্যায় আনিও না কভু মনে।<br />আমারে যে ব্যথা দিয়েছিলে তুমি, তাতে নাহি মোর দুখ,<br />তুমি সুখে ছিলে, মোর সাথে রবে সেই স্মরণের সুখ।<br />আর একদিন আসিও সজনি। মোর কন্ঠের ডাক।<br />যতদিন তুমি না আসিবে যেন নাহি হয় নির্ব্বাক।<br />এ মোর কামনা পাখি হয়ে যেন এই বালুচরে ফেরে,<br />যেন বাজ হয়ে গগনে গগনে মেঘের বসন ছেঁড়ে।<br />এই কথা আমি ভরে রেখে যাই খর-তটিনীর জলে,<br />যেন দুই কুল ভাঙিয়া সে চলে আপনার কল্লোলে।<br />আর একদিন আসিও সজনি। এ আমার অভিশাপ।<br />যত দিন যাবে পলে পলে এর বাড়িবে ভীষণ তাপ।<br />এই বাসনার ইন্ধন জ্বালি সাজালেম যেই হোম,<br />কাল-নটেশের চরণের তালে জ্বলে যেন নির্স্মম।<br />যেন তারি দাহ সপ্ত আকাশ ভেদিয়া উপরে ধায়,<br />চন্দ্র-সুর্য মুরছিয়া পড়ে তারি নিশ্বাস ঘায়।<br />যেন সে বহ্নি শত ফণা মেলি করে বিষ উদগার,<br />তারি দাহ হতে তুমি যেন কভু নাহি পাও উদ্ধার।<br />যতদিনে তুমি এই বালুচলে নাহি আস পুন ফিরে,<br />আজি এই কথা লিখে রেখে যাই বালুকার বুকে চিলে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : বালু চর</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/uranir-char/উড়ানীর চর2021-06-06T04:06:11-04:002024-02-04T10:20:37-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>উড়ানীর চর ধূলায় ধূসর<br />যোজন জুড়ি,<br />জলের উপরে ভাসিছে ধবল<br />বালুর পুরী।</p>
<br /><p>ঝাঁকে বসে পাখি ঝাঁকে উড়ে যায়<br />শিথিল শেফালি উড়াইয়া বায়;<br />কিসের মায়ায় বাতাসের গায়<br />পালক পাতি;<br />মহা কলতানে বালুয়ার গানে<br />বেড়ায় মাতি।</p>
<br /><p>উড়ানীর চরে কৃষাণ-বধূর<br />খড়ের ঘর,<br />ঢাকাই সীমের উড়িছে আঁচল<br />মাথার পর।</p>
<br /><p>জাঙলা ভরিয়া লাউ এর লতায়<br />লক্ষ্মী সে যেন দুলিছে দোলায়;<br />ফাল্গুনের হাওয়া কলার পাতায়,<br />নাচিছে ঘুরি;<br />উড়ানী চরের বুকের আঁচল<br />কৃষাণ-পুরি।</p>
<br /><p>উড়ানীর চর উড়ে যেতে চায়<br />হাওয়ার টানে;<br />চারিধারে জল করে ছল ছল<br />কি মায়া জানে।</p>
<br /><p>ফাগুনের রোদ উড়াইয়া ধূলি,<br />বুকের বসন নিতে চায় খুলি;<br />পদ ধরি জল কলগান তুলি,<br />নূপুর নাড়ে;<br />উড়ানীর চর চিক্ চিক্ করে<br />বালুর হারে।</p>
<br /><p>উড়ানীর চরে ছাড়-পাওয়া রোদ<br />সাঁঝের বেলা-<br />বালু লয়ে তার মাখামাখি করি<br />জমায় খেলা।</p>
<br /><p>কৃষানী কি বসি সাঁঝের বেলায়<br />মিহি চাল ঝাড়ে মেঘের কুলায়,<br />ফাগের মতন কুঁড়া উঠে যায়<br />আলোক ধারে;<br />কচি ঘাসে তারা জড়াজড়ি করে<br />গাঙের পারে।</p>
<br /><p>উড়নীর চরে তৃণের অধরে<br />রাতের রানী,<br />আঁধারের ঢেউ ছোঁয়াইয়া যায়<br />কি মায়া টানি।</p>
<br /><p>বিরহী কৃষাণ বাজাইয়া বাঁশী,<br />কাল-রাতে মাখে কাল-ব্যথারাশি;<br />থেকে থেকে চর শিহরিয়া ওঠে,<br />বালুকা উড়ে;<br />উড়ানীর চর ব্যথায় ঘুমায়<br />বাঁশীর সুরে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/kaal-se-asibe/কাল সে আসিবে2021-06-06T04:01:29-04:002023-06-27T19:57:19-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>কালকে সে নাকি আসিবে মোদের ওপারের বালুচরে,<br />এ পারের ঢেউ ওপারে লাগিছে বুঝি তাই মনে করে।<br />বুঝি তাই মনে করে,<br />বাউল বাতাস টানাটানি করে বালুর আঁচল ধরে।<br />কাল সে আসিবে, মুখখানি তার নতুন চরের মত,<br />চখা আর চখী নরম ডানায় মুছায়ে দিয়েছে কত।<br />চরের চাষীর ধানের খেতের মতই তাহার গা,<br />কোথাবা হলুদ, আব্ছা হলুদ, কোথাবা হলুদ না।</p>
<br /><p>কাল সে আসিবে, হাসিয়া হাসিয়া রাঙা মুখখানি ভরি,<br />এপারে আমার পাতার কুটিরে আমি কি বা আজ করি!<br />কাল সে আসিবে, ওই বালুচরে, ওপারে আমার ঘর,<br />তাজ পরে নদী-ঘাটের ডিঙা কাঁপে নদীটির পর।<br />কাল সে আসিবে, নোঙর ছিঁড়িল, দুলিছে নায়ের পাল,<br />কারে হারায়েছি, কারে যেন আমি দেখি নাই কতকাল।<br />ওপারেতে চর বালু লয়ে খেলে, উড়ায় বালুর রথ,<br />ওখানে সে কাল দুটি রাঙা পায়ে ভাঙিয়া যাইবে পথ।<br />কাল সে আসিবে ওই বালুচরে, আমি কি আবার হায়,<br />আসমান-তারা শাড়ীখানি আজ উড়াব সারাটি গায়?<br />রামলক্ষ্মণ শঙ্খ দুগাছি পরিব আবার হাতে,<br />খোঁপায় জড়াব কিংশুক-কলি, কাজল চোখের পাতে;<br />গলায় কি আজ পরিতে হইবে পদ্ম-রাগের মালা,<br />কানাড়া ছান্দে বাঁধিব কি বেনী কপালে সিঁদুর জ্বালা?<br />কাল সে আসিবে, মিছাই ছিঁড়িছি আঁধারের কালো কেশ,<br />আজকের রাত পথ ভুলে বুঝি হারাল ঊষার দেশ।</p>
<br /><p>এই বালুচরে আসিবে সে কাল, তরে রাঙা মুখে ভরি,<br />অফুট ঊষার সোনার কমল আসিবে সোহাগে ধরি।<br />সে আসিবে কাল, গলায় পরিয়া কুসুম ফুলের হার,<br />দুখানি নূপুর মুখর হইবে চরণে জড়ায়ে তার।<br />মাথায় বাঁধিবে দুধালীর লতা কচি সীমপাতা কানে,<br />বেণুর অধর চুমিয়া চুমিয়া মুখর করিবে গানে।<br />কাল সে আসিবে, রাই সরিষাল হলদী কোটার শাড়ী,<br />মটর কনেরে সাথে করে যেন খুলে দেখে নাড়ি নাড়ি।</p>
<br /><p>কাল সে আসিবে ওই বালুচরে, ধারে তার এই নদী,<br />তারি কূলে মোর ভাঙা কুঁড়ে ঘর, বহুদূরে নয় যদি;<br />তবু কি তাহার সময় হইবে হেথায় চরণ ধরি,<br />মোর কুঁড়ে ঘর দিয়ে যাবে হায়, মণি-মানিকেতে ভরি।<br />সে কি ওই চরে দাঁড়ায়ে দেখিবে বরষার তরুগুলি,<br />শীতের তাপসী কারে বা স্মরিছে আভরণ গার খুলি?<br />হয়ত দেখিবে, হয় দেখিবে না;<br />কাল সে আসিবে চরে,<br />এপারে আমার ভাঙা ঘরখানি, আমি থাকি সেই ঘরে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/kaal-se-asiyachilo/কাল সে আসিয়াছিল 2021-06-06T02:43:36-04:002023-06-26T08:11:19-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>কাল সে আসিয়াছিল ওপারের বালুচরে,<br />এতখানি পথ হেঁটে এসেছিল কি জানি কি মনে করে।<br />কাশের পাতায় আঁচড় লেগেছে তাহার কোমল গায়,<br />দুটি রাঙা পায়ে আঘাত লেগেছে কঠিন পথের ঘায়।<br />সারা গাও বেয়ে ঘাম ঝরিতেছে, আলসে অবশ তনু,<br />আমার দুয়ারে দাঁড়াল আসিয়া দেখিয়া অবাক হনু।</p>
<br /><p>দেখিলাম তারে- যার লাগি একা আশা-পথ চেয়ে থাকি,<br />এই বালুচরে মাথা কুটে কুটে ফুকারিয়া যারে ডাকি।<br />দেখিলাম তারে- যার লাগিএই উদাস ঝাউ-এর বন,<br />বরষ বরষ মোর গলা ধরি করিয়াছে ক্রন্দন।<br />দেখিলাম তারে, তবু কেন হায় বলিতে নারিনু ডাকি,<br />কোন অপরাধে আমার ললাটে দিলে এত ব্যথা আঁকি!<br />বলিতে নারিনু, ওগো পরবাসী, দেখিতে এলে কি তাই,<br />আগুন জ্বেলেছ যেই ঘন-বনে সেকি পুড়ে হল ছাই!<br />এলে কি দেখিতে-দূর হতে যারে হেনেছিলে বিষ-বাণ,<br />সে বন বিহগী বেঁচে আছে কিবা জীবনের অবসান!<br />বলিতে নারিনু, নিঠুর পথিক, কেন এলে মিছামিছি<br />অলস চরণ, অবশ দেহটি, সারা গায়ে ঘাম, ছি ছি!<br />এতখানি পথ হাঁটিয়া এসেছে কত না কষ্ট সহি,<br />তারি কাছে মোর দুখের কাহিনী কেমন করিয়া কহি!</p>
<br /><p>নয়নের জল মুছিয়া ফেলিনু, মুখে মাখিলাম হাসি,<br />কহিলাম, বুঝি পূর্বের সুরুয সাঁঝেতে উদিল আসি!<br />আঁচলে তাহারে বাতাস করিণু চরণ দুখানি ধূয়ে,<br />মাথার কেশেতে মুছাইয়া দিয়ে বসিলাম কাছে নুয়ে!<br />কহিলাম-বড় ভাগ্য আমার, আজিকার দিনখানি,<br />এমনি করিয়া রাখাযায় নাকি দুই হাতে যদি টানি!</p>
<br /><p>রবির চলার পথ,<br />আজিকার তরে ভুলিতে পারে না অস্ত পারের পথ?<br />কৌটায় ভরে সিঁদুর ত রাখি, আজিকার দিন হায়,<br />এমনি করিয়া কৌটার মাঝে ভরে কি রাখা না যায়!<br />এই দিনটিরে মাথায় কেশেতে বেঁধে রাখা যায়নাকি!<br />মিছেমিছি কত বকিয়া গেলাম ছাই পাশ থাকি থাকি।<br />শুনে সে কেবল হাসি-মুখে তার আরও মাখাইল হাসি,<br />সেই রাঙা মুখে- যে মুখেরে আমি এত করে ভালবাসি।</p>
<br /><p>মুখেতে মাখিল হাসি,<br />সোনা দেহখানি নাড়া দিয়ে গেল বুঝি হাওয়া ফুল-বাসী!<br />কাল এসেছিল এই বালুচরে আর মোর কুঁড়ে ঘরে-<br />তার পাশে চলে ছোট্ট নদীটি দুইখানি তীর ধরে।<br />সেই দুই তীরে রবি-শস্যেতে দিগন্ত গেছে ভরি-<br />রাই সরিষার জড়াজড়ি করে ফুলের আঁচল ধরি।<br />তারি এক তীরে বাঁকা পথখানি, দীঘল বালুর লেখা,<br />সেই পথ দিয়ে এসেছিল কাল আঁকিয়া পায়ের রেখা।<br />কাল এসেছিল, চখা আর চখী এ ওরে আদর করি,<br />পাখা নেড়েছিল, তারি ঢেউ লাগি নদী উঠেছিল নড়ি।<br />তারি ঢেউ বুঝি ভেসে এসেছিল আমার পাতার ঘরে-<br />বহুদিন পরে পেয়েছিনু তারে শুধু কালিকার তরে।</p>
<br /><p>কালিকার দিন, মেরু- কুহেলির অনন্ত আঁধিয়ারে<br />শুধু একখানা আলোক- কমল ফুটেছিল এক ধারে।<br />মহা-সাগরের দিগন্ত-জোড়া ফেন-লহরীর পরে<br />প্রদীপ-তরনী ভেসে এসেছিল বুঝি এ ব্যথার ঝড়ে!<br />কালকে তাহারে পেয়েছিনু আমি, হায়, হায়, কত-কাল,<br />যারে ভাবি এই শূনো বালুচরে চিতায় দিয়েছি জ্বাল;<br />সেই তারে হায়, দেখিয়া নারিনু খুলিয়া দেখাতে আমি<br />এই জীবনের যত হাহাকার উঠিয়াছে দিন-যামী, -<br />যে আগুনে আমি জ্বলিয়া মরেছি, সে-দাবদাহন আনি<br />কোন্ প্রাণে আমি নারী হয়ে সেই ফুলের তনুতে হানি!</p>
<br /><p>শুধু কহিলাম-পরাণ বন্ধু! তুমি এলে মোর ঘরে,<br />আমি ত জানিনে কি করে যে আজ তোমারে আদর করে!<br />বুকে যে তোমারে রাখিব বন্ধু, বুকেতে শ্মাশান জ্বলে;<br />নয়নে রাখিব! হায়রে অভাগা, ভাসিয়া যাইবে জলে!<br />কপালে রাখিব! এ ধরার গাঁয়ে আমার কপাল পোড়া;<br />মনে যে রাখিব! ভেঙে গেছে সে যে কভু নারে লাগে জোড়া!<br />সে কেবল শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চাহিল আমার পানে;<br />ও যেন আরেক দেশের মানুষ, বোঝে না ইহার মানে।</p>
<br /><p>সামনে বসায়ে দেখিলাম তারে, দেখিলাম সেই মুখ।<br />ভাবিলাম ওই সুমেরু হইতে কি করে যে আসে দুখ।<br />দেখিতে দেখিতে সকাল কাটিল, দুপুরের উঁচু বেলা,<br />পশ্চিম দেশে গড়ায়ে পড়িল মেঘেতে আঁকিয়া খেলা।<br />বালুচর হতে বিদায় মাগিল নতুন বকের সারি,<br />পাখায় পাখায় আকাশের বুকে শেফালীর ফুল নাড়ি।</p>
<br /><p>সে মোরে কহিল“দিন চলে গেল, আমি তবে আজ আসি?<br />-যার রাঙা মুখ ফুলের মতন, তাতে মাখা মিঠে হাসি।<br />সে মোরে কহিল, একটি কথায় ভাঙিল স্বপন মোর,<br />ভাঙিল তাহার সোনার চুড়াটি, ভাঙিল সকল দোর।<br />সে মোরে কহিল, “শোন তাপসিনি। আজকের মত তবে,<br />বিদায় হইনু, আবার আসিব মোর খুশী হবে যবে।”<br />হাসিয়াই তারে কহিলাম, “সখা বিদায় সমস্কার”<br />অভাগিনী আমি রুষিতে নারিনু নয়ন জলের ধার।<br />খানিক যাইয়া ফিরিয়া চাহিল, কহিল আমারে, “নারি।<br />কোন কিছু কয়ে ব্যথা দেছি তোমা, কেন চোখে তব বারি?”<br />আমি কহিলাম, “সুন্দর সখা, আমার নয়ন ধার-<br />পাইয়াও যেগো পাইবে তোমারে ভাষা এই বেদনার।’</p>
<br /><p>“ আমি কি নিঠুর?” সে মোরে শুধাল, আমি কহিলাম, “নয়।<br />ফুলেরো আঘাত গায়ে লাগে যার, কে তারে নিঠুর কয়?<br />গলায় যাহারে মালা দেই নাক হয়ত মালার ভারে,<br />তাহার কোমল ফুলের অঙ্গে কোন ব্যথা দিতে পারে ।</p>
<br /><p>ছুঁইনা যাহারে ভয়ে,<br />ও দেহ-তরুর অফুট কুসুম যদি পড়ে হায় খয়ে।<br />সে মোরে দিয়েছে এই এত জ্বালা এ-কথা ভাবিব যবে<br />রোজ-কেয়ামত ভেঙে পড়ে যেন আমার মাথায় তবে।”<br />“তবে কেন কাঁদ? হায় তাপসিনি।জীবনের ভোরখানি,<br />কার হেলা পেয়ে আজিকে এনেছ মরণের দেশে টানি।”<br />আমি কহিলাম-“সোনার বন্ধু এ-মোর ললট-লেখা<br />কেউ পারিবে না মুছাইয়া দিতে ইহার গভীর রেখা।</p>
<br /><p>মাথার পসরাখানি,<br />মাথায় লইয়া চলিতে হইবে সমুখে চরণ টানি।<br />এ-জীবনে কেউ দোসর হবে না, নিবে না করিয়া ভাগ,<br />এই বুক ভরি জমায়েছি যত তীব্র বিষের দাগ।</p>
<br /><p>তবু বলি সখা। কেন কাঁদি আমি, তোমারে দেখিয়া মোর,<br />কেন বয়ে যায় শাওনের ধারা ভাঙিয়া নয়ন দোর।<br />আমি কাঁদি সখা, তুমি কেন হেথা মানুষ হইয়া এলে-<br />বিধির গড়া ত সবই পাওয়া যায়, মানুষের নাহি মেলে।<br />আকাশ গড়েছে শ্যাম-ঘন-নীল, দুধের নবনী মেঘে-<br />সন্ধ্যা সকাল প্রতিদিন যায় নব নব রুপ মেখে;<br />যত দুরে যাই তত দুরে পাই, কেউ নাহি করে মানা,<br />কেউ নাহি পারে কাড়িয়া লইতে মাথার আকাশখানা।<br />বিধাতা গড়েছে সুন্দর ধরা, কাননে কুসুম-কলি,<br />কোলে কোলে তার পাখি গাহে গান, গুঞ্জরে মধু অলি।<br />বাতাস চলেছে ফুল কুড়াইয়া পাখায় জড়ায়ে ঘ্রাণ-<br />যারে পায় তারে বিলাইয়া যায় ফুল-সখীদের দান।</p>
<br /><p>তটিনী চলেছে গাহি-<br />তার জলে আজ সম-অধিকার, কারো কোন ব্যধা নাহি।<br />শুধু মানুষের পায়না মানুষ, নাহি কারো অধিকার,<br />মানুষ সবারে পাইল এভাবে। মানুষ হল না কার।<br />কেন তুমি সখা। মানুষ হইলে, অতটুকু দেহ ভরি,<br />বিশ্ব-জোড়া এ রুপ-পিপাসারে কেন রাখিয়াছ ধরি।<br />আমি কাঁদি সখা। কেন তুমি নাহি আকাশের মত হলে-<br />যেখানে যেতাম তোমারে পেতাম.দেখিতাম নানা ছলে।</p>
<br /><p>আকাশের তলে ঘর<br />যারা বাঁধিয়াছে তাদের তৃষ্ণা অমনি বিপুলতর।<br />তুমি কেন সখা। কানন হলে না, ফুলের সোহাগ পরি-<br />রঙিন তোমার দেহ-নীপখানি পুলকে উঠিত ভরি।<br />বাউল বাতাসে ভাসিয়া যেতাম তোমার ফুলের বনে,<br />অনন্ত-তুষ্ণা মিটায়ে দিতাম অনন্ত-পাওয়া সনে।<br />কেন তুমি সখা। মানুষ হইলে। সীমারে বরণ করি-<br />অসীম ক্ষুধারে সীমার বেড়ার বাহিরে রেখেছ ধরি।<br />তুমি কেন সখা! এমন হলে না-যত দুরে যাইতাম<br />আকাশের মত যত দুরে চাহি তোমারেই পাইতাম।</p>
<br /><p>আমি অনন্ত, আমি যে অসীম, অনন্ত মোর ক্ষুধা-<br />বিপুল এ-দেশে ভাসিয়েছ তুমি একটু সীমার সুধা।</p>
<br /><p>হায় রে মানুষ হায়।<br />কেমন করিয়া পাব তারে, যারে ধরা ছোঁয়া নাহি যায়।<br />আমি কাঁদি কেন সুন্দর সখা।তোমারে বলিব খুলি।<br />এই বেদনায়, কেন তুমি এলে মানুষ হইয়া ভুলি?<br />যে মানুষ এই ধরারে দেখিছে নীতির চশমা পরি,<br />যার যাহা পায় তাই লয় সে যে পালায় ওজন করি।<br />জগৎ জুড়িয়া পাতিয়াছে যারা মনুসংসিতা বই-<br />আমি কাঁদি সখা! আর কিছু নও তুমি সে মানুষ বই।</p>
<br /><p>জগতের মজা ভারি-<br />চোখ বেঁধে যারা ধরারে দেখিল তাহাদেরি নাম জারি।<br />বাহিরে হাসিছে নীতির জগৎ, তাহার আড়ালে বসি,<br />কাঁদে উভরায় উলঙ্গ নর পরি শাসনের রসি।<br />সে বলে যে আমি না ভাল মন্দ, আমি নর-নারায়ণ,<br />মহা-শক্তিরে বাঁধিয়া রেখেছে সংস্কার বন্ধন।<br />আমি কাঁদি সখা। আমার মাঝারে আছে সে আমার আমি,<br />মোর সুখে-দুখে মন্দ-ভালোয় সুনাম-কুনামে নামী ;<br />এ-জগতে কেউ চাহিল না তারে ; এ-মোর পসরাখানি,<br />যারে দিতে যাই, সেই ফিরে চায় হেলায় নয়ন টানি।</p>
<br /><p>জগতের হাটে তাই<br />সে মোর আমারে খন্ড করিয়া দোকানে বিকায়ে যাই।<br />কেউ হাসি চায়, কেউ ভালবাসা, কেউ চায় মিঠে-কথা,<br />কেউ নিতে চায় নয়নের জল কেউ চায় এর ব্যথা।<br />শস্যের ক্ষেতে একেলা কৃষাণ বীজ ছড়াইয়া যাই-<br />কোথা পাপ কোথা পুণ্য ছড়ানু, কোন কিছু মনে নাই।<br />আমি কাঁদি সখা। হাটে-বেচা সেই খন্ড আমারে লয়ে,<br />যারে ভালবাসি-তাহার পূজায় কেমনে আনিব বয়ে।<br />হায় হায় সখা। তুমি কেন হলে হাটের দোকানদার-<br />খন্ড করিয়া চাহ যারে তুমি পূর্ণ চাহনা তার?</p>
<br /><p>সব কথা মোর শুনে সে কেবল কহিল একটু হাসি-<br />“মোর যত কথা কব একদিন, আজকের মত আসি?”<br />পায়ে পায়ে পায়ে যতদুর গেল, নিমেষ রহিনু চেয়ে ;<br />সন্ধ্যা-তিমিরে কলস ডুবাল সাঁঝের রঙিন মেয়ে।<br />শূন্য চরের মাতাল বাতাস রাতের কুহেলি-কেশ<br />নাড়িয়া নাড়িয়া হয়রাণ হয়ে ফিরিল ঊষার দেশ।</p>
<br /><p>কত দিন গেল, কত রাত এলো ঋতুর বসন পরি,<br />চলে কাল-নটী বরণে বরণে বরষের পথ ধরি।<br />আজো বসে আছি এই বালুচরে, দুহাত বাড়ায়ে ডাকি<br />কাল যে আসিল এই বালুচরে, আর সে আসিবে নাকি?</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/kobita/কবিতা2021-06-06T02:35:32-04:002024-01-15T17:44:24-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>তাহারে কহিনু, সুন্দর মেয়ে! তোমারে কবিতা করি,<br />যদি কিছু লিখি ভুরু বাঁকাইয়া রবে না ত দোষ ধরি।”<br />সে কহিল মোরে, “কবিতা লিখিয়া তোমার হইবে নাম,<br />দেশে দেশে তব হবে সুখ্যাতি, আমি কিবা পাইলাম ?”<br />স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিনু কি দিব জবাব আর,<br />সুখ্যাতি তরে যে লেখে কবিতা, কবিতা হয় না তার।<br />হৃদয়ের ফুল আপনি যে ফোটে কথার কলিকা ভরি,<br />ইচ্ছা করিলে পারিনে ফোটাতে অনেক চেষ্টা করি।<br />অনেক ব্যথার অনেক সহার, অতল গভীর হতে,<br />কবিতার ফুল ভাসিয়া যে ওঠে হৃদয় সাগর স্রোতে।</p>
<br /><p>তারে কহিলাম, তোমার মাঝারে এমন কিছু বা আছে,<br />যাহার ঝলকে আমার হিয়ার অনাহত সুর বাজে।<br />তুমিই হয়ত পশিয়া আমার গোপন গহন বনে,<br />হৃদয়-বীণায় বাজাইয়া সুর কথার কুসুম সনে।<br />আমি করি শুধু লেখকের কাজ, যে দেয় হৃদয়ে নাড়া,<br />কবিতা ত তার ; আর যেবা শোনে-কারো নয় এরা ছাড়া।<br />মানব জীবনে সবচেয়ে যত সুন্দরতম কথা,<br />কবিকার তারই গড়ন গড়িয়া বিলাইছে যথাতথা।<br />সেকথা শুনিয়া লাভ লোকসান কি জানি হয় না হয়,<br />কেহ কেহ করে সমরকন্দ তারি তরে বিনিময়।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/dhamrai-roth/ধামরাই রথ2021-06-06T01:59:07-04:002023-06-27T07:52:30-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সুত্রধর,<br />কতকাল ধরে গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর।<br />সূক্ষ্ম হাতের বাটালি ধরিয়া কঠিন কাঠেরে কাটি,<br />কত পরী আর লতাপাতা ফুল গড়েছিল পরিপাটি।<br />রথের সামনে যুগল অশ্ব, সেই কত কাল হতে,<br />ছুটিয়া চলেছে আজিও তাহারা আসে নাই কোন মতে।</p>
<br /><p>তারপর এলো নিপুণ পটুয়া, সূক্ষ্ম তুলির ঘায়,<br />স্বর্গ হতে কত দেবদেবী আনিয়া রথের গায়।<br />রঙের রেখার মায়ায় বাঁধিয়া চির জনমের তরে,<br />মহা সান্ত্বনা গড়িয়া রেখেছে ভঙ্গুর ধরা পরে।</p>
<br /><p>কৃষ্ণ চলেছে মথুরার পথে, গোপীরা রথের তলে,<br />পড়িয়া কহিছে, যেওনা বন্ধু মোদের ছাড়িয়া চলে।<br />অভাগিনী রাধা, আহা তার ব্যথা যুগ যুগ পার হয়ে,<br />অঝোরে ঝরিছে গ্রাম্য পোটোর কয়েকটি রেখা লয়ে।</p>
<br /><p>সীতারে হরিয়া নেছে দশানন, নারীর নির্যাতন<br />সারা দেশ ভরি হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বালায়েছে হুতাশন।<br />রাম-লক্ষ্মণ সুগ্রীব আর নর বানরের দল,<br />দশমুন্ড সে রাবণে বধিয়া বহালো লহুর ঢল।<br />বস্ত্র হরণে দ্রৌপদী কাঁদে, এ অপমানের দাদ,<br />লইবারে সাজে দেশে দেশে বীর করিয়া ভীষণ নাদ।<br />কত বীর দিল আত্ম-আহুতী, ভগ্ন শঙ্খ শাঁখা।<br />বোঝায় বোঝায় পড়িয়া কত যে নারীর বিলাপ মাথা।<br />শ্মশান ঘাটা যে রহিয়া রহিয়া মায়েদের ক্রদনে,<br />শিখায় শিখায় জ্বলিছে নির্বিছে নব নব ইন্ধনে।</p>
<br /><p>একদল মরে, আর দল পড়ে ঝাপায়ে শক্র মাঝে,<br />আকাশ ধরণী সাজিল সে-দিন রক্তাশ্বর সাজে।<br />তারপর সেই দুর্যধনের সবংশ নিধনিয়া,<br />ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত যে হলো সারা দেশ নিয়া।<br />এই ছবিগুলি রথের কাঠের লিলায়িত রেখা হতে,<br />কালে কালে তাহা রুপায়িত হতো জীবন দানের ব্রতে।<br />নারীরা জানিত, এমনি ছেলেরা সাজিবে যুদ্ধ সাজে,<br />নারী-নির্যাতন-কারীদের মহানিধনের কাজে।</p>
<br /><p>বছরে দু-বার বসিত হেথায় রথ-যাত্রার মেলা,<br />কত যে দোকান পসারী আসিত কত সার্কাস খেলা।<br />কোথাও গাজীর গানের আসরে খোলের মধুর সুরে।<br />কত যে বাদশা বাদশাজাদীরা হেথায় যাইত ঘুরে।<br />শ্রোতাদের মনে জাগায়ে তুলিত কত মহিমার কথা,<br />কত আদর্শ নীতির ন্যায়ের গাঁথিয়া সুরের লতা।<br />পুতুলের মত ছেলেরা মেয়েরা পুতুল লইয়া হাতে।<br />খুশীর কুসুম ছড়ায়ে চলিত বাপ ভাইদের সাথে।<br />কোন যাদুকর গড়েছিল রথ তুচ্ছ কি কাঠ নিয়া,<br />কি মায়া তাহাতে মেখে দিয়েছিল নিজ হৃদি নিঙাড়িয়া।<br />তাহারি মায়ায় বছর বছর কোটী কোটী লোক আসি,<br />রথের সামনে দোলায়ে যাইত প্রীতির প্রদীপ হাসি।</p>
<br /><p>পাকিস্তানের রক্ষাকারীরা পরিয়া নীতির বেশ,<br />এই রথখানি আগুনে পোড়ায়ে করিল ভস্মশেষ।<br />শিল্পী হাতের মহা সান্ত্বনা যুগের যুগের তরে,<br />একটি নিমেষে শেষ করে গেল এসে কোন বর্বরে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/ma-o-khokon/মা ও খোকন2018-02-18T11:51:49-05:002023-06-27T18:05:38-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>মা বলিছে, খোকন আমার! যাদু আমার মানিক আমার!<br />উদয়তারা খোকন আমার! ঝিলিক মিলিক সাগর-ফেনার!<br />ফিনকি হাসি ক্ষণিকজ্বলা বিজলী-মালার খোকন আমার!<br />খোকন আমার দুলকি হাসি, ফুলকি হাসি জোছনা ধারার।<br />তোমায় আমি দোলার উপর দুলিয়ে দিয়ে যাই যে দুলে, –<br />যাই যে দুলে, সকল ভুলে, রাঙা মেঘের পালটি তুলে,<br />দেই তোমারে দোলায় দুলে।<br />খোকন তখন লাফিয়ে উঠে<br />সাইকেলেতে যায় যে ছুটে,<br />বল খেলিয়ে খেলার মাঠে সবার তারিফ লয় যে লুটে।</p>
<br /><p>মা বলিছে, খোকন আমার! মানিক আমার!<br />এতটুকুন দস্যি আমার! লক্ষ্মী আমার!<br />হলদে রঙের পক্ষী আমার!<br />তোমায় আমি পোষ মানাব বুকের খাঁচায় ভরে<br />তোমায় আমি মিষ্টি দেব, তোমায় আমি লজেন্স দেব,<br />তোমায় আমি দুধ খাওয়াব সোনার ঝিনুক ভরে!<br />খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, রান্না ঘরে যায় যে ছুটে,<br />কলাই ভাজা চিবোয় সে যে পূর্ন দুটি মুঠো।</p>
<br /><p>মা বলিছে, খোকন আমার! যাদু আমার! মানিক আমার!<br />ঈদের চাঁদের হাসি আমার! কেমন করে রাখি তোরে<br />বুকের মাঝে ধরে?<br />এতটুকুন আদর আমার! দূর্বা শিষের শিশির আমার!<br />মেঘের বুকের বিজলী আমার!<br />সকল সময় পরাণ যে মোর হারাই হারাই করে;<br />এত করে আদর করি ভরসা না পাই<br />তোরে আমার বুকের মাঝে ধরে।<br />পাল-পাড়াতে কলেরাতে, মরছে লোকে দিনে রাতে,<br />বোস পাড়াতে বসন্ত আজ দিচ্ছে বড়ই হানা,<br />আমরা মাথার দিব্যি লাগে ঘরটি ছেড়ে-<br />যাসনে কোথাও ভুলি মায়ের মানা।</p>
<br /><p>খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, ওষুধ লয়ে যায় যে ছুটে,<br />পাল-পাড়াতে দিনে রাতে রোগীর সেবা করে;<br />মরণ-মুখো রোগী তখন অবাক হয়ে চেয়ে দেখে<br />ফেরেস্তা কে বসে আছে তার শিয়রের পরে।<br />মুখের পানে চাইলে, তাহার রোগের জ্বালা।<br />যায় যে দূরে সরে।</p>
<br /><p>মা বলিছে, খোকন আমার! সোনা আমার!<br />হীরে-মতির টুকরো আমার! টিয়ে পাখির বাচ্চা আমার!<br />তোরে লয়ে মন যে আমার এমন ওমন কেমন যেন করে।<br />পুতুল খেলার পুতুল আমার! বকুল ফুলের মালা আমার!<br />তোরে আদর করে আমার পরাণ নাহি ভরে।<br />ও পাড়াতে ওই যে ওধার, ঘরে আগুন লাগছে কাহার,<br />আজকে ঘরের হোসনেরে বার,<br />আমার মাথায় হাত দিয়ে আজ বল ত শপথ করে।</p>
<br /><p>খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, ক্ষিপ্ত হয়ে যায় যে ছুটে,<br />জ্বলন্ত সেই আগুন পানে সবার সাথে জুটে।<br />দাউ দাউ দাউ আগুন ছোটে, কুন্ডলী যে পাকিয়ে ওঠে;<br />ওই যে কুঁড়ে, ঘরের তলে, শিশু মুখের কাঁদন ঝলে,<br />চীৎকারিয়ে উঠছে মাতা আঁকড়িয়ে তায় ধরে।<br />জ্বলছে আগুন মাথার পরে কে তাহাদের রক্ষা করে।<br />মুহূর্তে যে সকল কাঁদন যাবে নীরব হয়ে;<br />সেই লেলিহা আগুন পরে খোকা মোদের লাফিয়ে পড়ে,<br />একটু পরে বাইরে আসে তাদের বুকে করে।</p>
<br /><p>মা যে তখন খোকারে তার বুকের মাঝে ধরে,<br />বলে আমার সোনা মানিক! লক্ষ্মী মানিক!<br />ঘুমো দেখি আমার বুকের ঘরে।<br />খোকা বলে, মাগো আমার সোনা মানিক।<br />সকল শ্রানি- জুড়াব আজ তোমার কোলের পরে।</p>
<br /><p> (এক পয়সার বাঁশী কাব্যগ্রন্থ)</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/golpoburo/গল্পবুড়ো2018-02-18T11:49:00-05:002023-06-26T19:41:29-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>গল্পবুড়ো, তোমার যদি পেটটি ভরে<br />রূপকথা সব গিজ গিজ গিজ করে,<br />আর যদি না চলতে পার, শোলক এবং<br />হাসির, ছড়ার, পড়ার কথার ভরে;<br />যদি তোমার ইলি মিলি কিলি কথা<br />খালি খালি ছড়িয়ে যেতে চায় সে পথের ধারে,<br />তবে তুমি এখানটিতে দাঁড়িয়ে গিয়ে<br />ডাক দিও ভাই- ডাক দিও ভাই! মোদের পূর্নিমারে।</p>
<br /><p>যদি তোমার মিষ্টি মুখের মিষ্টি কথা<br />আদর হয়ে ছড়িয়ে যেতে চায় যে পথের কোণে,<br />কথা যদি চুমোর মত-ফুলের মত,<br />রঙিন হয়ে চায় হাসিতে ফোটে ফুলের সনে;<br />যতি তোমার রাঙা কথা রামধনুকের রঙের মত,<br />ছড়িয়ে পড়ে কালো মেঘের গায়ে,<br />যদি তোমার হলদে কথা<br />হলদে পাখির পাখার পরে সোয়ার হয়ে,<br />ছড়িয়ে পড়ে সরষে ফুলের হলদে হাওয়ার বায়ে;<br />যদি তোমার সবুজ কথা শস্যক্ষেতের দিগন্তরে,<br />ছড়িয়ে যেতে চায় যে বারে বারে;<br />তবে তুমি এখানটিতে দাঁড়িয়ে গিয়ে,<br />ডাক দিও ভাই! ডাক দিও ভাই! মোদের পূর্ণিমারে!<br />গল্পবুড়ো! আবার যদি গাজীর গানের দলটি নিয়ে,<br />নাচের নূপুর জড়িয়ে পায়ে, গাজীর আশা ঘুরিয়ে বায়ে,<br />খঞ্জনীতে সুরটি দিয়ে, রূপকথারি আসর গড় সুদূর কোন গাঁয়ে;<br />চন্দ্রভান রাজার মেয়ে আবার যদি নেমে আসে,<br />ঘুমলি চোখের পাতার পরে তোমার গানের বায়ে;<br />আবার যদি মদন কুমার সপ্ত-ডিঙা সাজিয়ে নিয়ে,<br />দেয় গো পাড়ি কালাপানি-পূবান পানি পেরিয়ে গিয়ে,<br />ক্ষীর-সাগরের অপর পারে মধুমালার দেশেঃ-<br />দুধে ধবল আলতা বরণ রাজার কনে ঘুমায় হেসে হেসে,<br />পাঁচ মানিকের পঞ্চ প্রদীপ পাহারা দেয়<br />হাতের পায়ের আর শিয়রের দেশে-<br />আবার যদি গাঁয়ের যত ছেলের মেয়ের,<br />বোনের ভায়ের মায়ের ঝিয়ের সবার বুকের<br />সে রূপকথার সে রূপ-সাগর<br />আনতে টেনে পরাণ তোমার কান্দে বারে বারে;<br />তবে তুমি ডাক দিও ভাই! ডাক দিও ভাই!<br />ডাক দিও ভাই! মোদের পূর্নিমারে!</p>
<br /><p> (এক পয়সার বাঁশী কাব্যগ্রন্থ)</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/kosmani/খোসমানী2018-02-18T11:48:08-05:002023-06-27T12:44:30-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>তেপান্তরের মাঠেরে ভাই, রোদ ঝিম-ঝিম করে<br />রে ভাই, রোদ ঝিম-ঝিম করে ;<br />দুলছে সদাই ধুলার দোলায় ঘূর্ণি হাওয়ার ভরে।<br />মাঝখানে তার বট-বিরিক্ষি ঠান্ডা পাতার বায়ে,<br />বাতাসেরে শীতল করে ছড়ায় মাটির গায়ে।<br />সেথায় আছে খোসমানী সে সোনার বরণ গা,<br />বিজলী-বরণ হাত দুখানি আলতা-পরা পা।<br />সন্ধ্যাবেলা যখন এসে দাঁড়ায় প্রদীপ করে,<br />হাজার তারা ফুঠে ওঠে নীল আকাশের পরে।<br />পাকা তেলাকুচের ফলে রাঙাতে ঠোঁট দুটি,<br />সন্ধ্যা-সকাল রাঙা হয়ে হাসে কুটিকুটি।<br />রামধনু, তার শাড়ীর পাড়ে দোল খাইবে বলে,<br />সাতটি রঙের সাতটি হাসি ছড়ায় মেঘের দলে।<br />সাদা সাদা বকের ছানা নরম পাখা মেলে,<br />বলে, কন্যা, তোমার শাড়ীর পাড়ে ফিরব খেলে।<br />মেঘের গায়ে বিজলী মেখে বলে, কন্যা, আয়।<br />তোরে আজি জড়িয়ে নেব নীলাম্বরীর ছায়।<br />সে যখনে হাসে তখন হাসে যে ফুলগুলি,<br />গান গাহিলে বেড়ে তারে নাচে যে বুলবুলি।<br />সকাল হলে দুর্বাশীষের নীহার-জলে নেয়ে,<br />আকাশ দিয়ে নেচে বেড়ায় ফুলের রেণু খেয়ে।<br />এই খুকীটির সঙ্গে তোমার আলাপ যদি থাকে,<br />ব’লো যেন আসমানীরে বারেক কাছে ডাকে।</p>
<br /><p> (এক পয়সার বাঁশী কাব্যগ্রন্থ)</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/holud-batichhe-meye/হলুদ বাঁটিছে মেয়ে2016-10-24T14:03:46-04:002023-06-27T07:02:19-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>হলুদ বাঁটিছে হলুদ বরণী মেয়ে,<br />হলুদের পাটা হাসিয়া গড়ায় রাঙা অনুরাগে নেয়ে।<br />দুই হাতে ধরি কঠিন পুতারে ঘসিছে পাটার পরে,<br />কাঁচের চুড়ী যে রিনিক ঝিনিকি নাচিছে খুশীর ভরে।<br />দুইটি জঙ্ঘা দুইধারে মেলা কাঠ-গড়া কামনার,<br />তাহার উপর উঠিতে নামিতে সোনার দেহটি তার;<br />মর্দ্দিত দুটি যুগল সারসী শাড়ী সরসীর নীরে,<br />ডুবিতে ভাসিতে পুষ্প ধনুরে স্মরিতেছে ঘুরে ফিরে।</p>
<br /><p>হলুদ বাঁটিছে হলুদ বরণী মেয়ে,<br />রঙিন ঊষার আবছা হাসিতে আকাশ ফেলিল ছেয়ে।<br />মিহি-সুরী গান গুন গুন করে ঘুরিছে হাসিল ঠোঁটে,<br />খুশীর ভোমরী উড়িয়া শ্রীমুখ-পদ্মের দল লোটে।<br />বিগত রাতের বভস-সুখের মদিরা জড়িত স্মৃতি,<br />সারাটি পাটারে হলুদে জড়ায়ে গড়ায়ে রঙিছে ক্ষিতি।<br />গাছের ডালে যে বুলবুলী বসি ভরিয়া দুখানা পাখ,<br />লিখিয়া হইতে তারি একটুকু মেলিছে সুরেলা ডাক।</p>
<br /><p>হলুদ বাঁটিছে হলুদ বরণী মেয়ে,<br />হলুদে লিখিত রঙিন কাহিনী গড়াইছে পাটা বেয়ে।<br />ডোল-ভরা ধান, কোল ভরা শিশু, বুক-ভরা মিঠে গান,<br />কোকিল ডাকান আম্র ছায়ায় পাতার কুটীর খান;<br />চাঁদিনী রাতের জোছনা আসিয়া গড়ায় বেড়ার ফাঁকে<br />কৃষাণ কন্ঠে বাঁশীটি বাজিয়া আকাশেতে প্রীতি আঁকে।<br />অর্দ্ধেক রাত নক্সী-কাঁথাটি মেলন করিয়া ধরি,<br />অতি সযতনে আঁকে ফুল-লতা মনের মমতা ভরি।<br />সুখ যেন আসি গড়াইয়া পড়ে, সূতার লতালী ফাঁদে,<br />মাটির ধরায় টেনে নিয়ে আসে গগন বিহারী চাঁদে।</p>
<br /><p>কাব্য গ্রন্থঃ- হলুদ বরণী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/shibon-rota/সীবন-রতা2016-10-24T14:01:40-04:002023-06-25T06:25:03-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>সেলাই করিছে মেয়ে<br />জাম-দানী শাড়ী রেখায় হাসিছে সোনার অঙ্গ ছেয়ে।<br />এক পাশ হইতে দেখিতেছি তারে, বাঁকাধনু নাসিকায়<br />ভূরু-তীর দুটি সদা উদ্যত বধিতে কে অজানায়।<br />আঁখি সরোবর স্তব্ধ নিঝুম, মৃদু পলকের ঘায়ে,<br />ঢেউ-হংসীরা বিরাম লভিছে কাজল রেখায় গাঁয়ে।<br />অধরখানিতে যুগল ঠোঁটের রঙিন বাঁধন খুলি,<br />মাঝে মাঝে মৃদু হাসিটে ফুটিছে সুমধুর সুখে দুলি।</p>
<br /><p>খোঁপার ফিতার কুসুম বাঁধনে গোলাপ মেলিছে দল,<br />বেনীর ভ্রমর সেথা জড় হয়ে রয়েছে অচঞ্চল।<br />এক হাতে ধরি সরু সুইটিরে সেলাই করিছে বসে,<br />আকাশ হইতে তারা-ফুলগুলি পড়িছে সেথায় খসে।<br />রঙের রঙের আলপনা যত তার ভালবাসা হয়ে,<br />জনমের মতো বন্দী হইছে কাঁথায় কুহকালয়ে।</p>
<br /><p>কে মাখিয়া দেছে হলুদের গুড়ো তাহার সারাটি গায়,<br />রঙিন শাড়ীর ফাঁকে ফাঁকে তাহা আকাশ ধরনী বায়।<br />অনাহত কোন গান বাজে তার দেহের বীনার তারে,<br />কালের সারথি থামায়েছে চলা সেই সুর শনিবারে।<br />সে সুর শুধুই হৃদয় গহনে কিছু অনুভব হয়,<br />কাহারো নিকট ভাষার বসন কভু সে পরিল নয়।<br />তাহারই একটু রেশ মেখে বুকে বাঁশী যে আত্মহারা,<br />শূণ্য বুকের শূন্য ভরিতে কাঁদে তার সুর-ধারা।<br />মোহের মতন স্বপনের মতো আবছা রঙিন মেঘে,<br />যেমনি ছড়ায় মধুর সুষমা সিদুরিয়া রোদ লেগে;<br />কোনসে মহান ভাস্কর যেন তাজমহলের থেকে,<br />পাথর কাটিয়া অতি ধীরে ধীরে লইতেছে তারে এঁকে।</p>
<br /><p>বারবার করে ভেঙে যায় ছবি, হয় না মনের মত,<br />আবার তাহারে গড়িবার লাগি হয় তপস্যা-রত।<br />ওই বাহু দুটি মমতা হইয়া মেলিবে শাড়ীর মেঘে,<br />ও অধরখানি ভালবাসা করে পাষাণে লইবে এঁকে।<br />নাসিকার ওই স্বর্ণ দেউলে স্থাপি মন্মথ-ছবি।<br />যুব-যুগান্ত রূপ-হোমানলে ঢলিবে জীবন-হবি।</p>
<br /><p>বসিয়া রয়েছে সীবন-রতা সে মেয়ে,<br />রঙিন ফুলটি ভাসিয়া এসেছে রামধনু নদী বেয়ে।<br />চরণ দুখানি যুগল হংসী শাড়ীর সাগর পাটে,<br />সাঁতারি এখন আসিয়া বসেছে পাড়ের রঙিন ঘাটে,<br />রাঙা টুকটুকে আলতা রেখার রঙিন তটের পানি,<br />ভালবাসা-ফুল ফুটিছে টুটিছে ভরিয়া ধরণীখানি।<br />সাবধান হাতে সরু সুই লয়ে নক্সা আঁকে সে ধরে,<br />কাঁথা উপরে আরেক ধরণী হাসিতেছে খুশী ভরে।<br />আরেক শিল্পী তাহারে লইয়া কালের খাতার পরে,<br />আর এক কাঁথা বুনট করিছে সে রূপ মাধুরী ধরে।</p>
<br /><p>কাব্য গ্রন্থঃ--হলুদ বরণী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/koishor-joubon-duhu-meli-gelo/কৈশর যৌবন দুহু মেলি গেল2016-10-24T13:57:02-04:002023-06-27T10:35:29-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>এখনো গন্ধ বন্ধ কোরকে, দুএকটি রাঙা দল,<br />উকি ঝুঁকি দিয়ে পান করিতেছে ভোরের শিশির জল।<br />রঙিন অধরে সরল হাসিটি, বিহান বেলার আগে,<br />মেঘগুলি যেন রঙে ডুগুডুগু ঊষসীর অনুরাগে।<br />এ হাসি এখনি কৌতুক হয়ে নাচিবে নানান ঢঙে,<br />মেঘের আড়ালে কভু লুকোচুরি খেলিবে কতা রঙে।</p>
<br /><p>আঁখি দুটি আজো স্বচ্ছ-সরল কাজল দীঘির মত,<br />কারো কলসীর আঘাতে এখনো হয় নাই ঢেউ-ক্ষত।<br />সব কিছু এর মুকুরে এখনো উজ্জ্বল হয়ে ভাসে,<br />যে আসে নিকটে তাহারেই সে যে আদরিয়া ভালবাসে।</p>
<br /><p>আরো কিছুদিন পরে এই আঁখি বিদ্যুদ্দাম হয়ে,<br />নৃত্য চপল খেলিয়া বেড়াবে মেঘ হতে মেঘে বয়ে।<br />ওই ভুরু-ধনু আরো বাঁকাইয়া চাহনীর তীরগুলি,<br />কত হতভাগা মৃগেরে বধিবে কাজলের বিষগুলি।</p>
<br /><p>ওই বাহু দুটি যুগল মমতা, যে হয় নিকটতর,<br />তাহারি গলায় পরাইয়া দেয় জানে না আপন পর।<br />কিছুদিন পরে ও বাহু লতায় ফুটিবে মোহের ফুল,<br />আকর্ষণের মন্ত্র পড়িয়া ছড়াবে রঙের ভুল।<br />তাহারি বাঁধনে বন্দী হইতে চির জনমের তরে,<br />আসিবে কুমার রূপ-গানে তার অধর বাঁশরী ভরে।</p>
<br /><p>বক্ষের পরে আধ-মুকুলিত যুগল কমল দুটি,<br />এখনো সুবাসে ভরে নাই দিক পল্লব দলে ফুটি।<br />কিছুদিন পরে ওই মন্দিরে অনঙ্গ নিজে পশি,<br />ভালবাসিবার মন্ত্র রচিবে ধ্যানের আসনে বসি।<br />মন্ত্র-সিদ্ধ একদন তার ফুল ধনু করি থির,<br />ফিরাবে ঘুরাবে স্বেচ্চায় সেথা স্থাপি এ যুগল তীর।</p>
<br /><p>এখনো অফুট কুসুমিত দেহ, জবা কুসুমের দ্যুতি,<br />আনত ঊষার নব-মেঘদলে রাঙিছে রূপের সত্ততি।<br />নিহারে ভূসিথ কুসুম কমল আধেক মুদিত আঁখি,<br />সরসী নাচিছে হরষিত দোলে আরশীতে তারে রাখি।<br />বিহান বেলার আধ ঘুমে পাওয়া আধ স্বপনের স্মৃতি,<br />দূরাগত কোন সুখদ বাঁশীর আবছা মধুর গীতি।<br />সে যেন ঊষার হসিত কপোলে শ্বেত চন্দন ফোঁটা,<br />সে যেন পূজার নিবেদিত ফুল দেবতা চরণে লোটা।</p>
<br /><p>আরো ক্ষণকাল দাঁড়াও গো মেয়ে! তোমার সোনার হাসি,<br />আরো ক্ষণকাল দেখে চলে যাই আমি কবি পরবাসী।<br />আরো ক্ষণকাল করগো বেলম, ভোরের শিশির কণা,<br />তাই দিয়ে যদি হয় কভু কোন অমরতা-গীতি বোনা।<br />আমি ক্ষণিকের অতিথি তোমার, তব অনাগত দিনে,<br />জানি জানি এই পথিক সখারে লইতে পাবে না চিনে।<br />ওই দেহ বীণা বাজিবে সেদিন, হাত চোখ মুখ কান,<br />শত তার হয়ে আকাশে বাতাসে ছড়াবে কুহক গান।<br />তারি ঝঙ্কারে রণিবে ধরণী, ফুলের স্তবক হয়ে,<br />আসিবে পূজারী স্তব-গান গেয়ে ওদেহের দেবালয়ে।<br />তাহাদের তরে রাখিয়া গেলাম আমার আশীর্বাদ,<br />যেন তারা পায় তোমার মাঝারে মোর অপূরিত সাধ।</p>
<br /><p>কাব্য গ্রন্থঃ- হলুদ বরণী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/phul-neya-bhalo-noy/ফুল নেয়া ভাল নয়2016-10-24T13:54:32-04:002023-06-27T18:04:00-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>ফুল নেয়া ভাল নয় মেয়ে।<br />ফুল নিলে ফুল দিতে হয়, <br />ফুলের মতন প্রাণ দিতে হয়।<br />যারা ফুল নিয়ে যায়,<br />যারা ফুল দিয়ে যায়,<br />তারা ভুল দিয়ে যায়,<br />তারা কুল নিয়ে যায়।<br />তুমি ফুল, মেয়ে! বাতাসে ভাঙিয়া পড়<br />বাতাসের ভরে দলগুলি নড়নড়।<br />ফুলের ভার যে পাহাড় বহিতে নারে<br />দখিনা বাতাস নড়ে উঠে বারে বারে।<br />ফুলের ভারে যে ধরণী দুলিয়া ওঠে,<br />ভোমর পাখার আঘাতে মাটিতে লোটে।<br />সেই ফুল তুমি কেমনে বহিবে তারে,<br />ফুল তো কখনো ফুলেরে বহিতে নারে।</p>
<br /><p>কাব্য গ্রন্থঃ-হলুদ বরণী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/purborag/পুর্ব্বরাগ2016-07-30T18:05:06-04:002023-06-26T15:40:40-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>দীঘিতে তখনো শাপলা ফুলেরা হাসছিলো আনমনে,<br />টের পায়নিক পান্ডুর চাঁদ ঝুমিছে গগন কোণে ।<br />উদয় তারার আকাশ-প্রদীপ দুলিছে পুবের পথে,<br />ভোরের সারথী এখনো আসেনি রক্ত-ঘোড়ার রথে।<br />গোরস্থানের কবর খুঁড়িয়া মৃতেরা বাহির হয়ে,<br />সাবধান পদে ঘুরিছে ফিরিছে ঘুমন্ত লোকালয়ে।<br />মৃত জননীরা ছেলে মেয়েদের ঘরের দুয়ার ধরি,<br />দেখিছে তাদের জোনাকি আলোয় ক্ষুধাতুর আঁখি ভরি।<br />মরা শিশু তার ঘু্মন্ত মার অধরেতে দিয়ে চুমো,<br />কাঁদিয়া কহিছে, “জনম দুখিনী মারে, তুই ঘুমো ঘুমো।”<br />ছোট ভাইটিরে কোলেতে তুলিয়া মৃত বোন কেঁদে হারা,<br />ধরার আঙনে সাজাবে না আর খেলাঘরটিরে তারা।</p>
<br /><p>দুর মেঠো পথে প্রেতেরা চলেছে আলেয়ার আলো বলে,<br />বিলাপ করিছে শ্মশানের শব ডাকিনী যোগীনি লয়ে।<br />রহিয়া রহিয়া মড়ার খুলিতে বাতাস দিতেছে শীস,<br />সুরে সুরে তার শিহরি উঠিছে আঁধিয়ারা দশধিশ।<br />আকাশের নাটমঞ্চে নাচিছে অন্সরী তারাদল,<br />দুগ্ধ ধবল ছায়াপথ দিয়ে উড়াইয়ে অঞ্চল।<br />কাল পরী আর নিদ্রা পরীরা পালঙ্ক লয়ে শিরে,<br />উড়িয়া চলেছে স্বপনপুরীর মধুবালা-মন্দিরে।</p>
<br /><p>হেনকালে দুর গ্রামপথ হতে উঠিল আজান-গান ।<br />তালে তালে তার দুলিয়া উঠিল স্তব্ধএ ধরাখান।<br />কঠিন কঠোর আজানের ধবনি উঠিল গগন জুড়ে।<br />সুরেরে কে যেন উঁচু হতে আরো উঁচুতে দিতেছে ছুঁড়ে।<br />পু্র্ব গগনে রক্ত বরণ দাঁড়াল পিশাচী এসে,<br />ধরণী ভরিয়া লহু উগারিয়া বিকট দশনে হেসে।<br />ডাক শুনি তার কবরে কবরে পালাল মৃতের দল,<br />শ্মাশানঘাটায় দৈত্য দানার থেমে গেল কোলাহল।<br />গগনের পথে সহসা নিবিল তারার প্রদীপ মালা<br />চাঁদ জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে গেল ভরি আকাশের থালা।</p>
<br /><p>তখনো কঠোর আজান ধ্বনিছে, সাবধান সাবধান!<br />ভয়াল বিশাল প্রলয় বুঝিবা নিকটেতে আগুয়ান।<br />ওরে ঘুমন্ত-ওরে নিদ্রিত-ঘুমের বসন খোল,<br />ডাকাত আসিয়া ঘিরিয়াছে তোর বসত-বাড়ির টোল।<br />শয়ন-ঘরেতে বাসা বাঁধিয়াছে যত না সিঁধেল চোরে,<br />কন্ঠ হইতে গজমতি হার নিয়ে যাবে চুরি করে।</p>
<br /><p>শয়ন হইতে জাগিল সোজন, মনে হইতেছে তার<br />কোন অপরাধ করিয়াছে যেন জানে না সে সমাচার।<br />চাহিয়া দেখিল, চালের বাতায় ফেটেছে বাঁশের বাঁশী,<br />ইঁদুর আসিয়া থলি কেটে তার ছড়ায়েছে কড়িরাশি।<br />বার বার করে বাঁশীরে বকিল, ইদুরের দিল গালি,<br />বাঁশী ও ইঁদুর বুঝিল না মানে সেই তা শুনিল খালি।</p>
<br /><p>তাড়াতাড়ি উঠি বাঁশীটি লইয়া দুলীদের বাড়ি বলি,<br />চলিল সে একা রাঙা প্রভাতের আঁকা-বাঁকা পথ দলি।<br />খেজুরের গাছে পেকেছে খেজুর, ঘনবন-ছায়া-তলে,<br />বেথুল ঝুলিছে বার বার করে দেখিল সে কুতুহলে।<br />ও-ই আগডালে পাকিয়াছে আম, ইসরে রঙের ছিরি,<br />এক্কে ঢিলেতে এখনি সে তাহা আনিবারে পারে ছিঁড়ি।<br />দুলীরে ডাকিয়া দেখাবে এসব, তারপর দুইজনে,<br />পাড়িয়া পাড়িয়া ভাগ বসাইবে ভুল করে গণে গণে।<br />এমনি করিয়া এটা ওটা দেখি বহুখানে দেরি করি,<br />দুলীদের বাড়ি এসে-পৌঁছিল খুশীতে পরাণ ভরি।<br />দুলী শোন্ এসে- একিরে এখনো ঘুমিয়ে যে রয়েছিস্?<br />ও পাড়ার লালু খেজুর পাড়িয়া নিয়ে গেলে দেখে নিস্!<br />সিঁদুরিয়া গাছে পাকিয়াছে আম, শীগগীর চলে আয়,<br />আর কেউ এসে পেড়ে যে নেবে না, কি করে বা বলা যায়।</p>
<br /><p>এ খবর শুনে হুড়মুড় করে দুলী আসছিল ধেয়ে,<br />মা বলিল, এই ভর সক্কালে কোথা যাস্ ধাড়ী মেয়ে?<br />সাতটা শকুনে খেয়ে না কুলোয় আধেক বয়সী মাগী,<br />পাড়ার ধাঙড় ছেলেদের সনে আছেন খেলায় লাগি।<br />পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেতে পাড়ায় যে টেকা ভার,<br />চুন নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!<br />এ সব গালির কি বুঝিবে দুলী, বলিল একটু হেসে,<br />কোথায় আমার বসয় হয়েছে, দেখই না কাছে এসে।<br />কালকে ত আমি সোজনের সাথে খেলাতে গেলাম বনে,<br />বয়স হয়েছে এ কথা ত তুমি বল নাই তক্ষণে।<br />এক রাতে বুঝি বয়স বাড়িল? মা তোমার আমি আর<br />মাথার উকুন বাছিয়া দিব না, বলে দিনু এইবার।<br />ইহা শুনি মার রাগের আগুন জ্বলিল যে গিঠে গিঠে,<br />গুড়ুম গুড়ুম তিন চার কিল মারিল দুলীর পিঠে।</p>
<br /><p>ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চাহিয়া সোজন দেখিল এ অবিচার,<br />কোন হাত নাই করিতে তাহার আজি এর প্রতিকার।<br />পায়ের উপরে পা ফেলিয়া পরে চলিল সমুখ পানে,<br />কোথায় চলেছে কোন পথ দিয়ে, এ খবর নাহি জানে।<br />দুই ধারে বন, লতায়-পাতায় পথেরে জড়াতে চায়,<br />গাছেরা উপরে ঝলর ধরেছে শাখা বাড়াইয়া বায়।<br />সম্মুখ দিয়া শুয়োর পালাল, ঘোড়েল ছুটিল দূরে,<br />শেয়ালের ছাও কাঁদন জুড়িল সারাটি বনানী জুড়ে।<br />একেলা সোজন কেবলি চলেছে কালো কুজঝটি পথ,<br />ভর-দুপুরেও নামে না সেথায় রবির চলার রথ।<br />সাপের ছেলম পায়ে জড়ায়েছে, মাকড়ের জাল শিরে,<br />রক্ত ঝরিছে বেতসের শীষে শরীরের চাম ছিঁড়ে।<br />কোন দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নাই রায়ের দীঘির পাড়ে,<br />দাঁড়াল আসিয়া ঘন বেতঘেরা একটি ঝোপের ধারে।<br />এই রায়-দীঘি, ধাপ-দামে এর ঘিরিয়াছে কালো জল,<br />কলমি লতায় বাঁধিয়া রেখেছে কল-ঢেউ চঞ্চল।<br />চারধারে এর কর্দম মথি বুনো শুকরের রাশি,<br />শালুকের লোভে পদ্মের বন লুন্ঠন করে আসি।<br />জল খেতে এসে গোখুরা সপেরা চিহ্ন এঁকেছে তীরে,<br />কোথাও গাছের শাখায় তাদের ছেলম রয়েছে ছিঁড়ে।<br />রাত্রে হেথায় আগুন জ্বালায় নর-পিশাচের দল,<br />মড়ার মাথায় শিস দিয়ে দিয়ে করে বন চঞ্চল।<br />রায়েদের বউ গলবন্ধনে মরেছিল যার শাখে,<br />সেই নিমগাছ ঝুলিয়া পড়িয়া আজো যেন কারে ডাকে!</p>
<br /><p>এইখানে এসে মিছে ঢিল ছুঁড়ে নাড়িল দীঘির জল,<br />গাছেরে ধরিয়া ঝাঁকিল খানিক, ছিঁড়িল পদ্মদল।<br />তারপর শেষে বসিল আসিয়া নিমগাছটির ধারে,<br />বসে বসে কি যে ভাবিতে লাগিল, সেই তা বলিতে পারে।</p>
<br /><p>পিছন হইতে হঠাৎ আসিয়া কে তাহার চোখ ধরি,<br />চুড়ি বাজাইয়া কহিল, কে আমি বল দেখি ঠিক করি?<br />ও পাড়ার সেই হারানের পোলা। ইস শোন বলি তবে<br />নবীনের বোন বাতাসী কিম্বা উল্লাসী তুমি হবেই হবে!<br />পোড়ামুখীরা এমনি মরুক- আহা, আহা বড় লাগে,<br />কোথাকার এই ব্রক্ষদৈত্য কপালে চিমটি দাগে।<br />হয়েছে হয়েছে, বিপিনের খুড়ো মরিল যে গত মাসে,<br />সেই আসিয়াছে, দোহাই! দোহাই! বাঁচি না যে খুড়ো ত্রাসে!</p>
<br /><p>‘‘ভারি ত সাহস!’’ এই বলে দুলী খিল্ খিল্ করে হাসি,<br />হাত খুলে নিয়ে সোজনের কাছে ঘেঁষিয়া বসিল আসি।<br />একি তুই দুলী! বুঝিবা সোজন পড়িল আকাশ হতে,<br />চাপা হাসি তার ঠোঁটের বাঁধন মানে না যে কোনমতে।<br />দুলী কহে, দেখ! তুই ত আসিলি, মা তখন মোরে কয়,<br />বয়স বুঝিয়া লোকের সঙ্গে আলাপ করিতে হয়।<br />ও পাড়ার খেঁদি পাড়ারমুখীরে ঝেঁটিয়ে করিতে হয়।<br />আর জগাপিসী, মায়ের নিকটে যা তা বলিয়াছে তারা।<br />বয়স হয়েছে আমাদের থেকে ওরাই জানিল আগে,<br />ইচ্ছে যে করে উহাদের মুখে হাতা পুড়াইয়া দাগে।<br />আচ্ছা সোজন! সত্যি করেই বয়স যদিবা হত,<br />আর কেউ তাহা জানিতে পারিত এই আমাদের মত?<br />ঘাড় ঘুরাইয়া কহিল সোজন, আমি ত ভেবে না পাই,<br />আজকে হঠাৎ বয়স আসিল? আসিলই যদি শেষে,<br />কথা কহিল না, অবাক কান্ড, দেখি নাই কোনো দেশে।</p>
<br /><p>দুলালী কহিল, আচ্ছা সোজন, বল দেখি তুই মোরে,<br />বয়স কেমন! কোথায় সে থাকে! আসে বা কেমন করে!<br />তাও না জানিস! সোজন কহিল, পাকা চুল ফুরফুরে,<br />লাঠি ভর দিয়ে চলে পথে পথে বুড়ো সে যে থুরথুরে।<br />দেখ দেখি ভাই, মিছে বলিসনে, আমার মাথার চুলে,<br />সেই বুড়ো আজ পাকাচুল লয়ে আসে নাইতরে ভুলে?<br />দুলীর মাথার বেণীটি খুলিয়া সবগুলো চুল ঝেড়ে,<br />অনেক করিয়া খুঁজিল সোজন, বুড়োনি সেথায় ফেরে!<br />দুলীর মুখ ত সাদা হয়ে গেছে, যদি বা সোজন বলে,<br />বয়স আজিকে এসেছে তাহার মাথার কেশেতে চলে!<br />বহুখন খুঁজি কহিল সোজন-নারে না, কোথাও নাই,<br />তোর চুলে সেই বয়স-বুড়োর চিহ্ন না খুঁজে পাই!<br />দুলালী কহিল, এক্ষুণি আমি জেনে আসি মার কাছে<br />আমার চুলেতে বয়সের দাগ কোথা আজি লাগিয়াছে।<br />দুলী যেন চলে যায়ই আর কি, সোজন কহিল তারে,<br />এক্ষুণি যাবি? আয় না একটু খেলিগে বনের ধারে।</p>
<br /><p>বউ-কথা কও গাছের উপরে ডাকছিল বৌ-পাখি,<br />সোজন তাহারে রাগাইয়া দিল তার মত ডাকি ডাকি।<br />দুলীর তেমনি ডাকিতে বাসনা, মুখে না বাহির হয়,<br />সোজনেরে বলে, শেখা না কি করে বউ কথা কও কয়?<br />দুলীর দুখানা ঠোঁটেরে বাঁকায়ে খুব গোল করে ধরে,<br />বলে, এইবার শিস দে ত দেখি পাখির মতন স্বরে।<br />দুলীর যতই ভুল হয়ে যায় সোজন ততই রাগে,<br />হাসিয়া তখনদুলীর দুঠোট ভেঙে যায় হেন লাগে।</p>
<br /><p>ধ্যেৎ বোকা মেয়ে, এই পারলি নে, জীভটা এমনি করে,<br />ঠোটের নীচেতে বাঁকালেই তুই ডাকিবি পাখির স্বরে।<br />এক একবার দুলালী যখন পাখির মতই ডাকে,<br />সোজনের সেকি খুশী, মোরা কেউ হেন দেখি নাই তাকে।<br />দেখ, তুই যদি আর একটুকু ডাকিতে পারিস ভালো,<br />কাল তোর ভাগে যত পাকা জাম হবে সব চেয়ে কালো।<br />বাঁশের পাতার সাতখানা নথ গড়াইয়া দেব তোরে,<br />লাল কুঁচ দেব খুব বড় মালা গাঁথিস যতন করে!<br />দুলী কয়, তোর মুখ ভরা গান, দে না মোর মুখে ভরে,<br />এই আমি ঠোঁট খুলে ধরিলাম দম যে বন্ধ করে।<br />দাঁড়া তবে তুই, বলিয়া সোজন মুখ বাড়ায়েছে যবে,<br />দুলীর মাতা যে সামনে আসিয়া দাঁড়াইল কলরবে।<br />ওরে ধাড়ী মেয়ে, সাপে বাঘে কেন খায় না ধরিয়া তোরে?<br />এতকাল আমি ডাইনি পুষেছি আপন জঠরে ধরে!<br />দাঁড়াও সোজন! আজকেই আমি তোমার বাপেরে ডাকি,<br />শুধাইব, এই বেহায়া ছেলের শাসি- সে দেবে নাকি?</p>
<br /><p>এই কথা বলে দুলালীরে সে যে কিল থাপ্পড় মারি,<br />টানিতে টানিতে বুনো পথ বেয়ে ছুটিল আপন বাড়ি।<br />একলা সোজন বসিয়া রহিল পাথরের মত হায়,<br />ভাবিবারও আজ মনের মতন ভাষা সে খুঁজে না পায়?</p>
<br /><p>('সোজন বাদিয়ার ঘাট' কাব্য গ্রন্থ থেকে সংকলিত)</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/polayon/পলায়ন2016-06-05T06:52:49-04:002023-09-19T21:20:40-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>নমুর পাড়ায় বিবাহের গানে আকাশ বাতাস<br />উঠিয়াছে আজি ভরি,<br />থাকিয়া থাকিয়া হইতেছে উলু, ঢোল ও সানাই<br />বাজিতেছে গলা ধরি।<br />রামের আজিকে বিবাহ হইবে, রামের মায়ের<br />নাহি অবসর মোটে;<br />সোনার বরণ সীতারে বরিতে কোনখানে আজ<br />দূর্বা ত নাহি জোটে।<br />কোথায় রহিল সোনার ময়ূর, গগনের পথে<br />যাওরে উড়াল দিয়া,<br />মালঞ্চঘেরা মালিনীর বাগ হইতে গো তুমি<br />দূর্বা যে আনো গিয়া।</p>
<br /><p>এমনি করিয়া গেঁয়ো মেয়েদের করুণ সুরের<br />গানের লহরী পরে,<br />কত সীতা আর রাম লক্ষণ বিবাহ করিল<br />দূর অতীতের ঘরে।<br />কেউ বা সাজায় বিয়েরে কনেরে, কেউ রাঁধে রাড়ে<br />ব্যস্ত হইয়া বড়,<br />গদাই নমুর বাড়িখানি যেন ছেলেমেয়েদের<br />কলরবে নড় নড়।<br />দূর গাঁর পাশে বনের কিনারে দুজন কাহারা<br />ফিস্ ফিস্ কথা কয়!<br />বিবাহ বাড়ির এত সমারোহ সেদিকে কাহারো<br />ভ্রক্ষেপ নাহি হায়!</p>
<br /><p>সোজন, আমার বিবাহ আজিকে, এই দেখ আমি<br />হলুদে করিয়া স্নান,<br />লাল-চেলী আর শাঁখা সিন্দুর আলতার রাগে<br />সাজিয়েছি দেহখান।<br />তোমারে আজিকে ডাকিয়াছি কেন, নিকটে আসিয়া<br />শুন তবে কান পাতি,<br />এই সাজে আজ বাহির যেথা যায় আঁখি,<br />তুমি হবে মোর সাথী।</p>
<br /><p>কি কথা শুনালে অবুঝ! এখনো ভাল ও মন্দ<br />বুঝিতে পারনি হায়,<br />কাঞ্চাবাঁশের কঞ্চিরে আজি যেদিকে বাঁকাও<br />সেদিকে বাঁকিয়ে যায়।</p>
<br /><p>আমার জীবনে শিশুকাল হতে তোমারে ছাড়িয়া<br />বুঝি নাই আর কারে,<br />আমরা দুজনে একসাথে রব, এই কথা তুমি<br />বলিয়াছ বারে বারে।<br />এক বোঁটে মোরা দুটি ফুল ছিনু একটিরে তার<br />ছিঁড়ে নেয় আর জনে;<br />সে ফুলেরে তুমি কাড়িয়া লবে না? কোন কথা আজ<br />কহে না তোমার মনে?<br />ভাবিবার আর অবসর নাহি, বনের আঁধারে<br />মিশিয়াছে পথখানি,<br />দুটি হাত ধরে সেই পথে আজ, যত জোরে পার<br />মোরে নিয়ে চল টানি।<br />এখনি আমারে খুঁজিতে বাহির হইবে ক্ষিপ্ত<br />যত না নমুর পাল,<br />তার আগে মোরা বন ছাড়াইয়া পার হয়ে যাব<br />কুমার নদীর খাল।<br />সেথা আছে ঘোর অতসীর বন, পাতায় পাতায়<br />ঢাকা তার পথগুলি,<br />তারি মাঝ দিয়া চলে যাব মোরা, সাধ্য কাহার<br />সে পথের দেখে ধুলি।</p>
<br /><p>হায় দুলী! তুমি এখনো অবুঝ, বুদ্ধি-সুদ্ধি<br />কখন বা হবে হায়,<br />এ পথের কিবা পরিণাম তুমি ভাবিয়া আজিকে<br />দেখিয়াছ কভু তায়?<br />আজ হোক কিবা কাল হোক, মোরা ধরা পড়ে যাব<br />যে কোন অশুভক্ষণে,<br />তখন মোদের কি হবে উপায়, এই সব তুমি<br />ভেবে কি দেখেছ মনে?<br />তোমারে লইয়া উধাও হইব, তারপর যবে<br />ক্ষিপ্ত নমুর দল,<br />মোর গাঁয়ে যেয়ে লাফায়ে পড়িবে দাদ নিতে এর<br />লইয়া পশুর বল;<br />তখন তাদের কি হবে উপায়? অসহায় তারা<br />না না, তুমি ফিরে যাও!<br />যদি ভালবাস, লক্ষ্মী মেয়েটি, মোর কথা রাখ,<br />নয় মোর মাথা খাও।</p>
<br /><p>নিজেরি স্বার্থ দেখিলে সোজন, তোমার গেরামে<br />ভাইবন্ধুরা আছে,<br />তাদের কি হবে! তোমার কি হবে! মোর কথা তুমি<br />ভেবে না দেখিলে পাছে?<br />এই ছিল মনে, তবে কেন মোর শিশুকালখানি<br />তোমার কাহিনী দিয়া,<br />এমন করিয়া জড়াইয়াছিলে ঘটনার পর<br />ঘটনারে উলটিয়া?<br />আমার জীবনে তোমারে ছাড়িয়া কিছু ভাবিবারে<br />অবসর জুটে নাই,<br />আজকে তোমারে জনমের মত ছাড়িয়া হেথায়<br />কি করে যে আমি যাই!<br />তোমার তরুতে আমি ছিনু লতা, শাখা দোলাইয়া<br />বাতাস করেছ যারে,<br />আজি কোন প্রাণে বিগানার দেশে, বিগানার হাতে<br />বনবাস দিবে তারে?<br />শিশুকাল হতে যত কথা তুমি সন্ধ্যা সকালে<br />শুনায়েছ মোর কানে,<br />তারা ফুল হয়ে, তারা ফল হয়ে পরাণ লতারে<br />জড়ায়েছে তোমা পানে।<br />আজি সে কথারে কি করিয়া ভুলি? সোজন! সোজন!<br />মানুষ পাষাণ নয়!<br />পাষাণ হইলে আঘাতে ফাটিয়া চৌচির হত<br />পরাণ কি তাহা হয়?<br />ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে, তখনি তা মোছে<br />ঠোঁটেরি হাসির ঘায়,<br />কথার লেখা যে মেহেদির দাগ-যত মুছি তাহা<br />তত ভাল পড়া যায়।<br />নিজেরি স্বার্থ দেখিলে আজিকে, বুঝিলে না এই<br />অসহায় বালিকার,<br />দীর্ঘজীবন কি করে কাটিবে তাহারি সঙ্গে,<br />কিছু নাহি জানি যার।<br />মন সে ত নহে কুমড়ার ফালি, যাহারে তাহারে<br />কাটিয়া বিলান যায়,<br />তোমারে যা দেছি, অপরে ত যবে জোর করে চাবে<br />কি হবে উপায় হায়!<br />জানি, আজি জানি আমারে ছাড়িতে তোমার মনেতে<br />জাগিবে কতেক ব্যথা,<br />তবু সে ব্যথারে সহিওগো তুমি, শেষ এ মিনতি,<br />করিও না অন্যথা।<br />আমার মনেতে আশ্বাস রবে, একদিন তুমি<br />ভুলিতে পারিবে মোরে,<br />সেই দিন যেন দূরে নাহি রয়, এ আশিস আমি,<br />করে যাই বুক ভরে।<br />এইখানে মোরা দুইজনে মিলি গাড়িয়াছিলাম<br />বটপাকুড়ের চারা,<br />নতুন পাতার লহর মেলিয়া, এ ওরে ধরিয়া<br />বাতাসে দুলিছে তারা!<br />সরু ঘট ভরি জল এনে মোরা প্রতি সন্ধ্যায়<br />ঢালিয়া এদের গোড়ে<br />আমাদের ভালবাসারে আমরা দেখিতে পেতাম<br />ইহাদের শাখা পরে।<br />সামনে দাঁড়ায়ে মাগিতাম বর-এদেরি মতন<br />যেন এ জীবন দুটি,<br />শাখায় জড়ায়ে, পাতায় জড়ায়ে এ ওরে লইয়া<br />সামনেতে যায় ছুটি।<br />এ গাছের আর কোন প্রয়োজন? এসো দুইজনে<br />ফেলে যাই উপাড়িয়া,<br />নতুবা ইহারা আর কোনো দিনে এই সব কথা<br />দিবে মনে করাইয়া।<br />ওইখানে মোরা কদমের ডাল টানিয়া বাঁধিয়া<br />আম্রশাখার সনে,<br />দুইজনে বসি ঠিক করিতাম, কেবা হবে রব,<br />কেবা হবে তার কনে।<br />আম্রশাখার মুকুল হইলে, কদম গাছেরে<br />করিয়া তাহার বর,<br />মহাসমারোহে বিবাহ দিতাম মোরা দুইজনে<br />সারাটি দিবসভর।<br />আবার যখন মেঘলার দিনে কদম্ব শাখা<br />হাসিত ফুলের ভারে,<br />কত গান গেয়ে বিবাহ দিতাম আমের গাছের<br />নববধূ করি তারে।<br />বরণের ডালা মাথায় করিয়া পথে পথে ঘুরে<br />মিহি সুরে গান গেয়ে<br />তুমি যেতে যবে তাহাদের কাছে, আঁচল তোমার<br />লুটাত জমিন ছেয়ে।</p>
<br /><p>দুইজনে মিলে কহিতাম, যদি মোদের জীবন<br />দুই দিকে যেতে চায়,<br />বাহুর বাঁধন বাঁধিয়া রাখিব, যেমনি আমরা<br />বেঁধেছি এ দুজনায়।<br />আজিকে দুলালী, বাহুর বাঁধন হইল যদিবা<br />স্বেচ্ছায় খুলে দিতে,<br />এদেরো বাঁধন খুলে দেই, যেন এই সব কথা<br />কভু নাহি আনে চিতে।<br />সোজন! সোজন! তার আগে তুমি, যে লতার বাঁধ<br />ছিঁড়িলে আজিকে হাসি,<br />এই তরুতলে, সেই লতা দিয়ে আমারো গলায়<br />পরাইয়ে যাও ফাঁসি।<br />কালকে যখন আমার খবর শুধাবে সবারে<br />হতভাগা বাপ-মায়,<br />কহিও তাদের, গহন বনের নিদারুণ বাঘে<br />ধরিয়া খেয়েছে তায়।<br />যেই হাতে তুমি উপাড়ি ফেলিবে শিশু বয়সের<br />বট-পাকুড়ের চারা,<br />সেই হাতে এসো ছুরি দিয়ে তুমি আমারো গলায়<br />ছুটাও লহুর ধারা।<br />কালকে যখন গাঁয়ের লোকেরা হতভাগিনীর<br />পুছিবে খবর এসে,<br />কহিও, দারুণ সাপের কামড়ে মরিয়াছে সে যে<br />গভীর বনের দেশে।<br />কহিও অভাগী ঝালী না বিষের লাড়ু বানাইয়া<br />খাইয়াছে নিজ হাতে;<br />আপনার ভরা ডুবায়েছে সে যে অথই গভীর<br />কূলহীন দরিয়াতে।</p>
<br /><p>ছোট বয়সের সেই দুলী তুমি এত কথা আজ<br />শিখিয়াছ বলিবারে,<br />হায় আমি কেন সায়রে ভাসানু দেবতার ফুল-<br />সরলা এ বালিকারে!<br />আমি জানিতাম, তোমার লাগিয়া তুষের অনলে<br />দহিবে আমারি হিয়া,<br />এ পোড়া প্রেমের সকল যাতনা নিয়ে যাব আমি<br />মোর বুকে জ্বালাইয়া।<br />এ মোর কপাল শুধু ত পোড়েনি তোমারো আঁচলে<br />লেগেছে আগুন তার;<br />হায় অভাগিনী, এর হাত হতে এ জনমে তব<br />নাহি আর নিস্তার!<br />তবু যদি পার মোরে ক্ষমা কোরো, তোমার ব্যথার<br />আমি একা অপরাধী;<br />সব তার আমি পূরণ করিব, রোজ কেয়ামতে<br />দাঁড়াইও হয়ে বাদী।<br />আজকে আমারে ক্ষমা করে যাও, সুদীর্ঘ এই<br />জীবনের পরপারে-<br />সুদীর্ঘ পথে বয়ে নিয়ে যেয়ো আপন বুকের<br />বেবুঝ এ বেদনাবে।</p>
<br /><p>সেদিন দেখিবে হাসিয়া সোজন খর দোজখের<br />আতসের বাসখানি,<br />গায়ে জড়াইয়া অগ্নির যত তীব্র দাহন<br />বক্ষে লইবে টানি।<br />আজিকে আমরে ক্ষমা করে যাও, আগে বুঝি নাই<br />নিজেরে বাঁধিতে হায়,<br />তোমার লতারে জড়ায়েছি আমি, শাখা বাহুহীন<br />শুকনো তরুন গায়।<br />কে আমারে আজ বলে দিবে দুলী, কি করিলে আমি<br />আপনারে সাথে নিয়ে,<br />এ পরিণামের সকল বেদনা নিয়ে যেতে পারি<br />কারে নাহি ভাগ দিয়ে।<br />ওই শুন, দূরে ওঠে কোলাহল, নমুরা সকলে<br />আসিছে এদিন পানে,<br />হয়ত এখনি আমাদের তারা দেখিতে পাইবে<br />এইভাবে এইখানে।</p>
<br /><p>সোজন! সোজন! তোমরা পুরুষ, তোমারে দেখিয়া<br />কেউ নাহি কিছু কবে,<br />ভাবিয়া দেখেছ, এইভাবে যদি তারা মোরে পায়,<br />কিবা পরিণাম হবে?<br />তোমরা পুরুষ-সমুখে পিছনে যে দিকেই যাও,<br />চারিদেকে খোলা পথ,<br />আমরা যে নারী, সমুখ ছাড়িয়া যেদিকেতে যাব,<br />বাধাঘেরা পর্ব্বত।<br />তুমি যাবে যাও, বারণ করিতে আজিকার দিনে<br />সাধ্য আমার নাই,<br />মোরে দিয়ে গেলে কলঙ্কভার, মোর পথে যেন<br />আমি তা বহিয়া যাই,<br />তুমি যাবে যাও, আজিকার দিনে এই কথাগুলি<br />শুনে যাও শুধু কানে,<br />জীবনের যত ফুল নিয়ে গেলে, কন্টক তরু<br />বাড়ায়ে আমার পানে।<br />বিবাহের বধূ পালায়ে এসেছি, নমুরা আসিয়া<br />এখনি খুঁজিয়া পাবে,<br />তারপর তারা আমারে ঘিরিয়া অনেক কাহিনী<br />রটাবে নানানভাবে।<br />মোর জীবনের সুদীর্ঘ দিনে সেই সব কথা<br />চোরকাঁটা হয়ে হায়,<br />উঠিতে বসিতে পলে পলে আসি নব নবরূপে<br />জড়াবে সারাটি গায়।<br />তবু তুমি যাও, আমি নিয়ে গেনু এ পরিনামের<br />যত গাঁথা ফুল-মালা।<br />ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর মোরে, আকাশ সায়রে<br />তোমার চাঁদের গায়,<br />আমি এসেছিনু, মোর জীবনের যত কলঙ্ক<br />মাখাইয়া দিতে হায়!<br />সে পাপের যত শাসি-রে আমি আপনার হাতে<br />নীরবে বহিয়া যাই,<br />আজ হতে তুমি মনেতে ভাবিও, দুলী বলে পথে<br />কারে কভু দেখ নাই।</p>
<br /><p>সোঁতের শেহলা, ভেসে চলে যাই, দেখা হয়েছিল<br />তোমার নদীর কূলে,<br />জীবনেতে আছে বহুসুখ হাসি, তার মাঝে তুমি<br />সে কথা যাইও ভুলে।<br />যাইবার কালে জনমের মত শেষ পদধূলি<br />লয়ে যাই তবে শিরে,<br />আশিস্ করিও, সেই ধূলি যেন শত ব্যথা মাঝে<br />রহে অভাগীরে ঘিরে।<br />সাক্ষী থাকিও দরদের মাতা, সাক্ষী থাকিও<br />হে বনের গাছপালা-<br />সোজন আমার প্রাণের সোয়ামী, সোজন আমার<br />গলার ফুলের মালা।<br />সাক্ষী থাকিও চন্দ্র-সূর্য, সাক্ষী থাকিও-<br />আকাশের যত তারা,<br />ইহকালে আর পরকালে মোর কেহ কোথা নাই,<br />কেবল সোজন ছাড়া।<br />সাক্ষী থাকিও গলার এ হার, সাক্ষী থাকিও<br />বাপ-ভাই যতজন<br />সোজন আমার পরাণের পতি, সোজন আমার<br />মনের অধিক মন।<br />সাক্ষী থাকিও সীথার সিদুর, সাক্ষী থাকিও<br />হাতের দুগাছি শাঁখা,<br />সোজনের কাছ হইতে পেলাম এ জনমে আমি<br />সব চেয়ে বড় দাগা।</p>
<br /><p>দুলী! দুলী! তবে ফিরে এসো তুমি, চল দুইজনে<br />যেদিকে চরণ যায়,<br />আপন কপাল আপনার হাতে যে ভাঙিতে চাহে,<br />কে পারে ফিরাতে তায়।<br />ভেবে না দেখিলে, মোর সাথে গেলে কত দুখ তুমি<br />পাইবে জনম ভরি,<br />পথে পথে আছে কত কন্টক, পায়েতে বিঁধিবে<br />তোমারে আঘাত করি।<br />দুপুরে জ্বলিবে ভানুর কিরণ, উনিয়া যাইবে<br />তোমার সোনার লতা,<br />ক্ষুধার সময়ে অন্ন অভাবে কমল বরণ<br />মুখে সরিবে না কথা।<br />রাতের বেলায় গহন বনেতে পাতার শয়নে<br />যখন ঘুমায়ে রবে,<br />শিয়রে শোসাবে কাল অজগর, ব্যাঘ্র ডাকিবে<br />পাশেতে ভীষণ রবে।<br />পথেতে চলিতে বেতের শীষায় আঁচল জড়াবে,<br />ছিঁড়িবে গায়ের চাম,<br />সোনার অঙ্গ কাটিয়া কাটিয়া ঝরিয়া পড়িবে<br />লহুধারা অবিরাম।</p>
<br /><p>সেদিন তোমার এই পথ হতে ফিরিয়া আসিতে<br />সাধ হবে না আর,<br />এই পথে যার এক পাও চলে, তারা চলে যায়<br />লক্ষ যোজন পার।<br />এত আদরের বাপ-মা সেদিন বেগানা হইবে<br />মহা-শত্রুর চেয়ে,<br />আপনার জন তোমারে বধিতে যেখানে সেখানে<br />ফিরিবে সদাই ধেয়ে।<br />সাপের বাঘের তরেতে এ পথে রহিবে সদাই<br />যত না শঙ্কাভরে,<br />তার চেয়ে শত শঙ্কা আকুলহইবে যে তুমি,<br />বাপ-ভাইদের ডরে।<br />লোকালয়ে আর ফিরিতে পাবে না, বনের যত না<br />হিংস্র পশুর সনে,<br />দিনেরে ছাপায়ে, রাতের ছাপায়ে রহিতে হইবে<br />অতীব সঙ্গোপনে।<br />খুব ভাল করে ভেবে দেখ তুমি, এখনো রয়েছে<br />ফিরিবার বসর,<br />শুধু নিমিষের ভুলের লাগিয়া কাঁদিবে যে তুমি,<br />সারাটি জনমভর।</p>
<br /><p>অনেক ভাবিয়া দেখেছি সোজন, তুমি যেথা রবে,<br />সকল জগতখানি<br />শত্রু হইয়া দাঁড়ায় যদিবা, আমি ত তাদেরে<br />তৃণসম নাহি মানি।<br />গহন বনেতে রাতের বেলায় যখন ডাকিবে<br />হিংস্র পশুর পাল,<br />তোমার অঙ্গে অঙ্গ জড়ায়ে রহিব যে আমি,<br />নীরবে সারাটি কাল।<br />পথে যেতে যেতে ক্লান্ত হইয়া এলায়ে পড়িবে<br />অলস এ দেহখানি,<br />ওই চাঁদমুখ হেরিয়া তখন শত উৎসাহ<br />বুকেতে আনিব টানি।<br />বৃষ্টির দিনে পথের কিনারে মাথার কেশেতে<br />রচিয়া কুটির খানি,<br />তোমারে তাহার মাঝেতে শোয়ারে সাজাব যে আমি<br />বনের কুসুম আনি।<br />ক্ষুধা পেলে তুমি উচু ডালে উঠি থোপায় থোপায়<br />পাড়িয়া আনিও ফল,<br />নল ভেঙে আমি জল খাওয়াইব, বন-পথে যেতে<br />যদি পায়ে লাগে ব্যথা,<br />গানের সুরেতে শুনাইবে আমি শ্রানি- নাশিতে<br />সে শিশুকালের কথা।<br />তুমি যেথা যাবে সেখানে বন্ধু! শিশু বয়সের<br />দিয়ে যত ভালবাসা,<br />বাবুই পাখির মত উচু ডালে অতি সযতনে<br />রচিব সুখের বাসা।<br />দূরের শব্দ নিকটে আসিছে, কথা কহিবার<br />আর অবসর নাই,<br />রাতের আঁধারে চল এই পথে, আমরা দুজনে<br />বন-ছায়ে মিশে যাই।</p>
<br /><p>সাক্ষী থাকিও আল্লা-রসুল, সাক্ষী থাকিও<br />যত পীর আউলিয়া<br />এই হতভাগী বালিকারে আমি বিপদের পথে<br />চলিলাম আজি নিয়া।<br />সাক্ষী থাকিও চন্দ্র-সূর্য! সাক্ষী থাকিও<br />আকাশের যত তারা,<br />আজিকার এই গহন রাতের অন্ধকারেতে<br />হইলাম ঘরছাড়া।<br />সাক্ষী থাকিও খোদার আরশ, সাক্ষী থাকিও<br />নবীর কোরানখানি,<br />ঘর ছাড়াইয়া, বাড়ি ছাড়াইয়া কে আজ আমারে<br />কোথা লয়ে যায় টানি।<br />সাক্ষী থাকিও শিমূলতলীর যত লোকজন<br />যত ভাই-বোন সবে,<br />এ জনমে আর সোজনের সনে কভু কোনখানে<br />কারো নাহি দেখা হবে।<br />জনমের মত ছেড়ে চলে যাই শিশু বয়সের<br />শিমূলতলীর গ্রাম,<br />এখানেতে আর কোনদিন যেন নাহি কহে কহে<br />সোজন-দুলীর নাম।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: সোজন বাদিয়ার ঘাট</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/jele-gange-machh-dhorite-jay/জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়2016-06-05T06:40:58-04:002023-06-27T18:26:09-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়,<br />পদ্মা নদীর উজান বাঁকে ছোট্ট ডিঙি নায়।<br />পদ্মা নদী কাটাল ভারী, চাক্কুতে যায় কাটা,<br />তারির পরে জেলের তরী করে উজান-ভাঁটা।<br />জলের উপর শ্যাওলা ভাসে, স্রোতের ফুলও ভাসে,<br />তারির পরে জেলের তরী ফুলেল পালে হাসে;<br />তারি সাথে ভাসায় জেলে ভাটীর সুরে গান,<br />জেলেনী তার হয়ত তাহার সাথেই ভেসে যান।</p>
<br /><p>জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়,<br />জেলেনী বউ জাল যে বুনায় বসে ঘরের ছায়।<br />সূতোর পরে সুতো দিয়ে বুনোয় দীঘল জাল,<br />তারির সাথে বুনিয়ে চলে দীঘল মনের হাল।<br />জেলে তাহার নেই যে ঘরে, ভোরের কোকিল ডাকে<br />জেলেনী বউ আপন মনে জাল বুনাতেই থাকে।</p>
<br /><p>জেলে গেছে মাছ ধরিতে হায়,<br />পূব কোণেতে মেঘের গায়ে চক্কর দিয়ে যায়।<br />বাও ডাকিল, ঢেউঁ হাঁকিল তল তলা নাওখানি,<br />জেলেনী বউ ঘরের থেকে সেঁচছে তাহার পানি।<br />বৈষম শাপট! জেলের কুঁড়ে ভাঙবে যে এই বেলা<br />গাঙের থেকে দিচ্ছে জেলে বৈঠাতে তার পেলা।</p>
<br /><p>গাঙে কাঁপে জেলের তরী, ঘরে জেলের প্রিয়া,<br />মধ্যে তারি আসন-যাওন করছে জেলের হিয়া।<br />জেলে ভাবে ঘরের কথা, বউ যে জেলের তরী,<br />এরি মধ্যে ঝড় পাগেলা কোথায় যে যায় সরি।<br />লাভের মাঝে হাজরা তলা দুগ্ধেতে যায় ভাসি,<br />গঙ্গা দেবীর কপাল ভালো পূজায় উঠেন হাসি!</p>
<br /><p>জেলে গেছে মাছ ধরিতে বাঁকে,<br />জেলেনী বোর মন ভালো না বলতে নারে কাকে!<br />জাল বুনিতে ভুল হয়ে যায়, সূতো কেবল ছেঁড়ে<br />জেলে বাঁকের বগীলা তার মন নিয়েছে কেড়ে।<br />জলের ঘাটে কলস তাহার ভরেও নাহি ভরে,<br />ইচ্ছা করে কলসীটিরে বাঁধি মাথার কেশে,<br />ভাসিয়ে দেয় জেলে তাহার রয় যে বে গান দেশে।</p>
<br /><p>জেলে বাঁকে মাছ ধরিতে যায়,<br />কূল হারা সেই গাঙে কাহার কুল লইয়া হায়!<br />অথই নদীর অথই পানি জালে না পায় তাল<br />অথই মনের ব্যথা জেলের তার চেয়ে জঞ্জাল।<br />কত নদী পেরিয়ে এলো ততই নদী ছাড়ি,<br />ব্যথার নদী উথল পাথল জমছেনাক পাড়ি।<br />মাটির মায়া কাটালো যে ভাটীর সুরে হায়,<br />কেন তাহার পরাণ টানে সুদূর ভাটী গাঁয়!</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রাখালী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/mena-sheikh/মেনা শেখ2016-06-05T06:38:01-04:002023-06-27T06:15:23-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>মেনা শেখের খবর জান?-সাত গাঁয়ে তার নাম,<br />ছেলে বুড়ো যাকেই শুধাও, কোন খানে তার ধাম?<br />আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, আলীপুরের মোড়ে,<br />আকাশ ছোঁয়া খড়ের পালা চোখের পাতা পড়ে।<br />দুপুর রোদে ধাঁধিয়ে দেওয়া টিনের ঘরের চাল,<br />গগন-গাঙে উড়ছে যেন সাদা পাখির পাল।<br />সাত গাঁর লোক গর্ব করে ফুলিয়ে বুকের ছাতা,<br />মেনা শেখের গাঁয়ের মানুষ নইক মোরা যাতা।</p>
<br /><p>জানিসনে ভাই! সেবার যে ওই দিগ-নগরের হাট।<br />দবির ছেলে শোকের মামুদ কিনতে গিয়ে পাট।<br />বরই ডাঙার সাদের সাথে লাগল মারামারি,<br />মেনা শেখের নাম শুনে সব তুলেই পালা দাড়ি,<br />-দে ছুট সেই বন-বাদাড়ে যেথায় চলে পাও,<br />একলা মেনা হারিয়ে দিল একশ জনা সাও।<br />কথা যাদের টাকায় বিকায় সেই যে উকিল বাবু।<br />মেনা শেখের রাখতে খাতির সে-ও হয়ে যায় কাবু,<br />সদর থানার বড় বাবু-যম কাঁপে যার ডরে,<br />শালার চেয়ে ইতরামি গাল মুখে সদাই ঝরে।<br />তারেও মেনা-কান-কথাতে করতে পারে গুণ।<br />মনে নেই সেই দবির জোলার পুতের বৌ-এর খুন?</p>
<br /><p>লেখা পড়া জানে না সে? সিটকিও না দাঁত ;<br />না পড়েছে আজি ক খ দুখান কলার পাত।<br />পড়েছে ত সাতটি গাঁয়ের সাতশ বাড়ির লোক,<br />কেমন করে ব্যথায়-গানে লয়ে হাজার শোক।<br />মেঠো মায়ের অবোধ ছেলে মাটির সাথে মিশে,<br />কোলখানি তার সোনায় সাজায় সোনা ধানের শীষে।<br />সে ত জানে সাত ঋতুতে সাতটি রঙের আলা,<br />ছবির পরে ছবি এঁকে সাজায় মাঠের থালা।<br />তারি সাথে হাজার চাষীর কি কাজ হবে রোজ,<br />কোন মাঠে কে করবে বা কি-জানে সে তার খোঁজ।<br />বানে ফসল ডোবার আগে ডোবে তাহার চোখ,<br />মায়ের ছেলে মরার আগে তাহার বুকে শোক।<br />বিয়ের বেলায় কলমা পড়ায়, মরলে সে দ্যা্য় গোর<br />সুখের বেলা সাথের সাথী, দুখীর দুখে ভোর।<br />কেতাব পড়ে পায়নি খেতাব ? পেয়েছে এক ডাকে,<br />হাজার চাষীর হাজার লাঠি উঠবস তার হাঁকে।</p>
<br /><p>তোমরা বল অত্যাচারী ?-জিভ কাটিব চুপ করে থাক,<br />শেখের পোরে ডাক দিয়ে তোর পিঠেতে নয় পিটাব ঢাক।<br />দোষে গুণে পয়দা মানুষ চাঁদের বুকে রয়েছে দাগ,<br />যেই মেঘেতে বর্ষে বাদল সেই মেঘেতেই ঝড়েরি রাগ।<br />মানি আমি, আছে তাহার অনেক রকম অত্যাচারও,<br />তবু সে কেন মোড়ল মোদের ভেবেছ কি কেউ একবারও?<br />খুন করিলে বুক দিয়ে সে আগে দাঁড়ায় খুনীর হয়ে,<br />চোর-ধরিবাজ সবার কুনাম লয় সে আপন মাথায় বয়ে।</p>
<br /><p>একটি ভিটেয় চরছে ঘুঘু তাহার নাকি অত্যাচারে।<br />জানি আমি কলম-পেষা। এই নিয়ে আজ দুষছ তারে।<br />হাজার ভিটের চরত ঘুঘু সে না থাকলে মোদের গাঁয়ে,<br />হাজার চালের খসত ছানি তোমাদের ওই কলম ঘায়ে।<br />লাঠি তাহার মারে যদি মাথায় তাহা বইতে পারি।<br />কলম দিয়ে যে মার মারো ব্যথা তাহার বুঝতে নারি।<br />লাঠির আঘাত সারবে জানি দুদিন কিবা ছদিন পরে,<br />কলম দিয়ে কর আঘাত সারবে না সে গেলেও গোরে।<br />জানিনে ওই ছাতার কলম কি দিয়ে বা লও গড়িয়ে,<br />খোদার কলম রদ করেছো ওরই একটা আঁচড় দিয়ে।<br />মাঠে মাঠে জমি মোদের খোদ জমিদার খোদার লেখায়,<br />আলের পরে আল গাঁথিয়া সীমানা তার যায় দেখা যায়।<br />তোমরা লেখ কাগজে আল, সীমানা তার বুঝতে নারি।<br />খোদার দেওয়া খাস মহালের তারি মায়ায় দখল ছাড়ি।<br />সেই কলমের খোরাক দিতে মাঠে মাঠে লাঙল ঠেলি,<br />মাটি খুঁড়ে যে সোনা পাই চরণতলে দেই যে মেলি।<br />তবু তাহার মেটে না ভুখ ইচ্ছে করে দনে- পিষে<br />কলমগুলো দিই জ্বালিয়ে জাহান্নামের আগুন শীষে।</p>
<br /><p>আমরা মাঠের মুক্ত শিশু ভয় করি না ঝঞঝা বাদল,<br />জাহান্নামের মতন জ্বালা চৈত্র রোদে বাজাই লাঙল।<br />শুনো মাঠও মন্ত্র শুনে দোলায় তরুণ তৃণের আঁচল,<br />কচি গায়ে পুলক দিতে কাজলী মেঘও হয়রে সজল।<br />বর্ষা বুকে ভাসাই মোরা সবুজ ধানের মাদুরখানি,<br />ছল ছল জলের উপর অন্ন মায়ের আসন টানি।</p>
<br /><p>বাঁশীর সুরে শরৎ-চাঁদের কুচি কুচি সোনার হাসি,<br />কাঁচা ধানের পাতায় পাতায় মেলতে পারি রাশি রাশি।<br />মাঠে যে ধান ধরেই নাক, পারি সে ধান ভরতে ডোলে,<br />এটা কেবল জানিনে ওই কলম ধরে সে কোন কলে।<br />ঝড় এসে ঘর উড়িয়ে নিলে ঝড়েই ঘরে দেই যে ছানি,<br />ভয় করিনে বৃষ্টি শীলা- শীরালীদের মন্ত্র জানি।<br />ভয় করিনে হাঙর কুমীর- দেবতা আছেন খোয়াজ খিজির,<br />বনের বাঘে ভয় করিনে গাজী মাদার হাঁকছে জিকির।<br />ভয় শুধু ওই কলমটারে, আঘাত তাহার গায় না লাগে,<br />শেলের মত বক্ষখানির ব্যথার জাগায় ভীষণ দাগে।<br />মেনা শেখের হাতের লাঠি ভাঙতে পারে সবার মাথা,<br />কি দিয়ে ওই গড়ছ কলম, হাজার মারে ভাঙে না তা।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রাখালী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/rakhali/রাখালী2016-06-05T06:33:11-04:002023-06-27T13:54:05-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কালো কালো,<br />মাঝে সোনার মুখটি হাসে আঁধারেতে চাঁদের আলো।<br />রানতে বসে জল আনতে সকল কাজেই হাসি যে তার,<br />এই নিয়ে সে অনেক বারই মায়ের কাছে খেয়েছে মার।<br />সান করিয়া ভিজে চুলে কাঁখে ভরা ঘড়ার ভারে<br />মুখের হাসি দ্বিগুণ ছোটে কোনমতেই থামতে নারে।</p>
<br /><p>এই মেয়েটি এমনি ছিল, যাহার সাথেই হত দেখা,<br />তাহার মুখেই এক নিমেষে ছড়িয়ে যেত হাসির রেখা<br />মা বলিত, বড়ুরে তুই, মিছেমিছি হাসিস্ বড়,<br />এ শুনেও সারা গা তার হাসির চোটে নড় নড়!<br />মুখখানি তার কাঁচা কাঁচা, না সে সোনার, না সে আবীর,<br />না সে ঈষৎ ঊষার ঠোঁটে আধ-আলো রঙিন রবির!<br />কেমন যেন গাল দুখানি মাঝে রাঙা ঠোঁটটি তাহার,<br />মাঠে ফোটা কলমি ফুলে কতকটা তার খেলে বাহার।</p>
<br /><p>গালটি তাহার এমন পাতল ফুঁয়েই যেন যাবে উড়ে<br />দু একটি চুল এলিয়ে পড়ে মাথার সাথে রাখছে ধরে।<br />সাঁঝ-সকালে এ ঘর ও ঘর ফিরত যখন হেসে-খেলে;<br />মনে হত ঢেউয়ের জ্বলে ফুলটিরে কে গেছে ফেলে!</p>
<br /><p>এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে ও পথ দিয়ে চলতে ধীরে<br />ওই মেয়েটির রূপের গাঙে হারিয়ে গেল কলসটিরে।<br />দোষ কি তাহার? ওই মেয়েটি মিছেমিছি এমনি হাসে,<br />গাঁয়ের রাখাল! অমন রূপে কেমনে রাকে পরাণটা সে!<br />এ পথ দিয়ে চলতে তাহার কোঁচার হুড়ুম যায় যে পড়ে,<br />ওই মেয়েটি কাছে এলে আচঁলে তার দে সে ভরে।<br />মাঠের হেলের নাস্তা নিতে হুকোর আগুন নিবে যে যায়,<br />পথ ভুলে কি যায় সে নিতে, ওই মেয়েটি রানছে যেথায়?<br />নিড়ের ক্ষেতে বারে বারে তেষ্টাতে প্রাণ যায় যে ছাড়ি,<br />ভর-দুপুরে আসে কেবল জল খেতে তাই ওদের বাড়ি!<br />ফেরার পথে ভুলেই সে যে আমের আঁটির বাশীটিরে,<br />ওদের গরের দাওয়ায় ফেলে মাঠের পানে যায় সে ফিরে।<br />ওই মেয়েটি বাজিয়ে তারে ফুটিয়ে তোলে গানের ব্যাথা,<br />রাঙা মুখের চুমোয় চুমোয় বাজে সুখের মুখর কথা!</p>
<br /><p>এমনি করে দিনে দিনে লোক- লোচনের আড়াল দিয়া,<br />গেঁয়ো স্নেহের নানান ছলে পড়ল বাঁধা দুইটি হিয়া!<br />সাঁঝের বেলা ওই মেয়েটি চলত যখন গাঙের ঘাটে<br />ওই ছেলেটির ঘাসের বোঝা লাগত ভারি ওদের বাটে।<br />মাথার বোঝা নামিয়ে ফেলে গামছা দিয়ে লইত বাতাস,<br />ওই মেয়েটির জল-ভরনে ভাসতে ঢেউয়ে রূপের উছাস।<br />চেয়ে চেয়ে তাহার পানে বলত যেন মনে মনে,<br />জল ভর লো সোনার মেয়ে! হবে আমার বিয়ের কনে?<br />কলমী ফুলের নোলক দেব, হিজল ফুলের দেব মালা,<br />মেঠো বাঁশী বাজিয়ে তোমায় ঘুম পাড়াব, গাঁয়ের বালা!</p>
<br /><p>বাঁশের কচি পাতা দিয়ে গড়িয়ে দেব নথটি নাকের,<br />সোনা লতায় গড়ব বালা তোমার দুখান সোনা হাতের।<br />ওই না গাঁয়ের একটি পাশে ছোট্র বেঁধে কুটিরখানি,<br />মেঝের তাহার ছড়িয়ে দেব সরষে ফুলের পাঁপড়ি আনি।<br />কাজলতলার হাটে গিয়ে আনব কিনে পাটের শাড়ী,<br />ওগো বালা! গাঁয়ের বালা! যাবে তুমি আমার বাড়ি?”</p>
<br /><p>এই রুপেতে কত কথাই আসত তাহার ছোট্র মনে,<br />ওই মেয়েটি কলসী ভরে ফিরত ঘরে ততক্ষণে।<br />রুপের ভার আর বইতে নারে কাঁখখানি তার এলিয়ে পড়ে,<br />কোনোরুপে চলছে ধীরে মাটির ঘড়া জড়িয়ে ধরে।<br />রাখাল ভাবে, কলসখানি না থাকলে তার সরু কাঁখে,<br />রুপের ভারেই হয়ত বালা পড়ত ভেঙে পথের বাঁকে।<br />গাঙোন জল ছল-ছল বাহুর বাঁধন সে কি মানে,<br />কলস ঘিরি উঠছে দুলি’ গেঁয়ো-বালার রুপের টানে।</p>
<br /><p>মনে মনে রাখাল ভাবে, “গাঁয়ের মেয়ে! সোনার মেয়ে।<br />তোমার কালো কেশের মত রাতের আঁধার এল ছেয়ে।<br />তুমি যদি বল আমায়, এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি<br />কলাপাতার আঁধার-ঘেরা ওই যে ছোট তোমার বাড়ি।<br />রাঙা দু’খান পা ফেলে যাও এই যে তুমি কঠিন পথে,<br />পথের কাঁটা কত কিছু ফুটতে পারে কোনমতে।<br />এই যে বাতাস-উতল বাতাস, উড়িয়ে নিলে বুকের বসন,<br />কতখন আর রুপের লহর তোমার মাঝে রইবে গোপন।<br />যদি তোমার পায়ের খাডু যায় বা খুলে পথের মাঝে,<br />অমর রুপের মোহন গানে সাঁঝের আকাশ সাজবে না যে।</p>
<br /><p>আহা ! আহা ! সোনার মেয়ে ! একা একা পথে চল,<br />ব্যথায় ব্যথায় আমার চোখে জল যে ঝরে ছল ছল।”<br />এমনিতর কত কথায় সাঁঝের আকাশ হত রাঙা,<br />কখন হলুদ, আধ-হলুদ, আধ-আবীর মেঘ ভাঙা।<br />তার পরেতে আসত আঁধার ধানের ক্ষেতে, বনের বুকে,<br />ঘাসের বোঝা মাথায় লয়ে ফিরত রাখাল ঘরের মুখে।</p>
<br /><p>সেদিন রাখাল শুনল, পথে সেই মেয়েটির হবে বিয়ে,<br />আসবে কালি ‘নওশা’তাহার ফুল-পাগড়ী মাথায় দিয়ে।<br />আজকে তাহার ‘হলদি-ফোটা’ বিয়ের গানে ভরা বাড়ি,<br />মেয়ে-গলার করুণ গানে কে দেয় তাহার পরাণ ফাড়ি’।<br />সারা গায়ে হলুদ মেখে সেই মেয়েটি করছিল সান,<br />কাঁচা সোনা ঢেলে যেন রাঙিয়ে দেছে তাহার গা’খানা।<br />চেয়ে তাহার মুখের পানে রাখাল ছেলের বুক ভেঙে যায়।<br />আহা ! আহা ! সোনার মেয়ে ! কেমন করে ভুললে আমায় ?</p>
<br /><p>সারা বাড়ি খুশীর তুফান-কেউ ভাবে না তাহার লাগি,<br />মুখটি তাহার সাদা যেন খুনী মকর্দ্দমার দাগী।<br />অপরাধীর মতন সে যে পালিয়ে এল আপন ঘরে,<br />সারাটা রাত মরল ঝুরে কি ব্যথা সে বক্ষে ধরে।</p>
<br /><p>বিয়ের ক’নে ছলছে আজি শ্বশুর-বাড়ি পালকী চড়ে<br />চলছে সাথে গাঁয়ের মোড়ল বন্ধু ভাই-এর কাঁধটি ধ’রে ।<br />সারাটা দিন বিয়ে বাড়ির ছিল যত কল-কোলাহল<br />গাঁয়ের পথে মূর্ত্তি ধরে তারাই যেন চলছে সকল।</p>
<br /><p>কেউ বলিছে, মেয়ের বাপে খাওয়াল আজ কেমন কেমন,<br />ছেলের বাপের বিত্তি বেসাৎ আছে কি ভাই তেমন তেমন?<br />মেয়ে-জামাই মিলছে যেন চাঁদে চাঁদে মেলা,<br />সুর্য যেমন বইছে পাটে ফাগ-ছড়ান সাঁঝের বেলা!<br />এমনি করে কত কথাই কত জনের মনে আসে,<br />আশ্বিনেতে যেমনি তর পানার বহর গাঙে ভাসে।<br />হায়রে আজি এই আনন্দ, যাবে লয়ে এই যে হাসি,<br />দেখল না কেউ সেই মেয়েটির চোখদুটি যায় ব্যথায় ভাসি।<br />খুঁজল না কেউ গাঁয়ের রাখাল একলা কাঁদে কাহার লাগি<br />বিজন রাতের প্রহর থাকে তাহার সাথে ব্যথায় জাগি।</p>
<br /><p>সেই মেয়েটির চলা-পথে সেই মেয়েটির গাঙের ঘাটে<br />একলা রাখাল বাজায় বাঁশী ব্যথার ভরা গাঁয়ের বাটে।<br />গভীর রাতে ভাটীর সুরে বাঁশী তাহার ফেরে উদাস<br />তারি সাথে কেঁপে কেঁপে কাঁদে রাতের কালো বাতাস।<br />করুণ করুণ-অতি করুণ বুকখানি তার উতল করে,<br />ফেরে বাঁশীর সুরটি ধীরে ধীরে ঘুমো গাঁয়ের ঘরে ঘরে।</p>
<br /><p>“কোথায় জাগো বিরহিণী ! ত্যজি বিরল কুটিরখানি,<br />বাঁশীর ভরে এস এস ব্যথায় ব্যথায় পরাণ হানি।<br />শোন শোন দশা আমার, গহন রাতের গলা ধরি’<br />তোমার তরে ও নিদয়া, একা একা কেঁদে মরি।<br />এই যে জমাট রাতের আঁধার, আমার বাঁশী কাটি তারে,<br />কোথায় তুমি, কোথায় তুমি, কেঁদে মরে বারে বারে।”<br />ডাকছাড়া তার কান্না শুনি একলা নিশা সইতে নারে,<br />আঁধার দিয়ে জড়ায় তারে, হাওয়ায় দোলায় ব্যথার ভারে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রাখালী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/neer/নীড়2016-05-17T22:39:40-04:002023-06-27T14:00:53-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>গড়াই নদীর তীরে,<br />কুটিরখানিরে লতা-পাতা-ফুল মায়ায় রয়েছে ঘিরে।<br />বাতাসে হেলিয়া, আলোতে খেলিয়া সন্ধ্যা সকালে ফুটি,<br />উঠানের কোণে বুনো ফুলগুলি হেসে হয় কুটি কুটি।<br />মাচানের পরে সীম-লতা আর লাউ কুমড়ার ঝাড়,<br />আড়া-আড়ি করি দোলায় দোলায় ফুল ফল যত যার।<br />তল দিয়ে তার লাল নটেশাক মেলিছে রঙের ঢেউ,<br />লাল শাড়ীখানি রোদ দিয়ে গেছে এ বাড়ির বধূ কেউ।<br />মাঝে মাঝে সেথা এঁদো ডোবা হতে ছোট ছোট ছানা লয়ে,<br />ডাহুক মেয়েরা বেড়াইতে আসে গানে গানে কথা কয়ে!<br />গাছের শাখায় বনের পাখিরা নির্ভয়ে গান ধরে,<br />এখনো তাহারা বোঝেনি হেথায় মানুষ বসত করে।</p>
<br /><p>মটরের ডাল, মসুরের ডাল, কালিজিড়া আর ধনে,<br />লঙ্কা-মরিচ রোদে শুখাইছে উঠানেতে সযতনে।<br />লঙ্কার রঙ মসুরের রঙ, মটরের রঙ আর,<br />জিড়া ও ধনের রঙের পাশেতে আলপনা আঁকা কার।<br />যেন একখানি সুখের কাহিনী নানান আখরে ভরি,<br />এ বাড়ির যত আনন্দ হাসি আঁকা জীবন- করি।<br />সাঁঝ সকালের রঙিন মেঘেরা এখানে বেড়াতে এসে,<br />কিছুখন যেন থামিয়া রয়েছে এ বাড়িরে ভালবেসে।<br />সামনে তাহার ছোট ঘরখানি ময়ূর পাখির মত,<br />চালার দুখানা পাখনা মেলিয়া তারি ধ্যানে আছে রত।<br />কুটিরখানির একধারে বন, শ্যাম-ঘন ছায়াতলে,<br />মহা-রহস্য লুকাইয়া বুকে সাজিছে নানান ছলে।<br />বনের দেবতা মানুষের ভয়ে ছাড়ি ভূমি সমতল,<br />সেথায় মেলিছে অতি চুপি চুটি সৃষ্টির কৌশল;<br />লতা-পাতা ফুল ফলের ভাষায় পাখিদের বুনো সুরে।<br />তারি বুকখানি সারা বন বেড়ি ফিরিতেছে সদা ঘুরে।<br />ইহার পাশেতে ছোট গেহ-খনি, এ বনের বন-রাণী,<br />বনের খেলায় হয়রান হয়ে শিথিল বসনখানি;<br />ইহার ছায়ায় মেলিয়া ধরিয়া শুয়ে ঘুম যাবে বলে,<br />মনের মতন করিয়া ইহারে গড়িয়াছে নানা ছলে।</p>
<br /><p>সে ঘরের মাঝে দুটি পা মেলিয়া বসিয়া একটি মেয়ে ,<br />পিছনে তাহার কালো চুলগুলি মাটিতে পড়েছে বেয়ে।<br />দুটি হাতে ধরি রঙিন শিকায় রচনা করিছে ফুল,<br />বাতাসে সরিয়া মুখে উড়িতেছে কভু দু একটি চুল।<br />কুপিত হইয়া চুলেরে সরাতে ছিড়িছে হাতের সূতো,<br />চোখ ঘুরাইয়া সুতোরে শাসায় করিয়া রাগের ছুতো।<br />তারপর শেষে আপনার মনে আপনি উঠিছে হাসি,<br />আরো সরু সরু ফুল ফুটিতেছে শিকার জালেতে আসি।<br />কালো মুখখানি, বন-লতা পাতা আদর করিয়া তায়,<br />তাহাদের গার যত রঙ যেন মেখেছে তাহার গায়।<br />বনের দুলালী ভাবিয়া ভাবিয়া বনের শ্যামল কায়া;<br />জানে না, কখন ছড়ায়েছে তার অঙ্গে বনের ছায়া।<br />আপনার মনে শিকা বুনাইছে, ঘরের দুখানা চাল,<br />দুখানা রঙিন ডানায় তাহারে করিয়াছে আবডাল।<br />আটনের গায়ে সুন্দীবেতের হইয়াছে কারুকাজ<br />বাজারের সাথে পরদা বাঁধন মেলে প্রজাপতি সাজ।<br />ফুস্যির সাথে রাঙতা জড়ায়ে গোখুরা বাঁধনে আঁটি,<br />উলু ছোন দিয়ে ছাইয়াছে ঘর বিছায়ে শীতল পাটি।<br />মাঝে মাঝে আছে তারকা বাঁধন, তারার মতন জ্বলে,<br />রুয়ার গোড়ায় খুব ধরে ধরে ফুলকাটা শতদলে।<br />তারি গায় গায় সিদুরের গুড়ো, হলুদের গুড়ো দিয়ে,<br />এমনি করিয়া রাঙায়েছে যেন ফুলেরা উঠেছে জিয়ে।<br />একপাশে আশে ফুলচাং ভাল বলা যায়নাক ত্বরা।<br />তার সাথে বাঁধা কেলী কদম্ব ফুল-ঝুরি শিকা আর,<br />আসমান-তারা শিকার রঙেতে সব রঙ মানে হার।<br />শিকায় ঝুলানো চিনের বাসন, নানান রঙের শিশি,<br />বাতাসের সাথে হেলিছে দুলিছে রঙে রঙে দিবানিশি।<br />তাহার নীচেতে মাদুর বিছায়ে মেয়েটি বসিয়া একা,<br />রঙিন শিকার বাঁধনে বাঁধনে রচিছে ফুলের লেখা।</p>
<br /><p>মাথার উপরে আটনে ছাটনে বেতের নানান কাজ,<br />ফুলচাং আর শিকাগুলি ভরি দুলিতেছে নানা সাজ।<br />বনের শাখায় পাখিদের গান, উঠানে লতার ঝাড়<br />সবগুলো মিলে নির্জ্জনে যেন মহিমা রচিছে তার।<br />মেয়েটি কিন্তু জানে না এ সব, শিকায় তুলিছে ফুল,<br />অতি মিহি সুরে গান সে গাহিছে মাঝে মাঝে করি ভুল।<br />বিদেশী তাহার স্বামীর সহিত গভীর রাতের কালে,<br />পাশা খেলাইতে ভানুর নয়ন জড়াল ঘুমের জালে।</p>
<br /><p>ঘুমের ঢুলুনী, ঘুমের ভুলুনী-সকালে ধরিয়া তায়,<br />পাল্কীর মাঝে বসাইয়া দিয়া পাঠাল স্বামীর গাঁয়।<br />ঘুমে ঢুলু আঁখি, পাল্কী দোলায় চৈতন হল তার,<br />চৈতন হয়ে দেখে সে ত আজ নহে কাছে বাপ-মার।<br />এত দরদের মা-ধন ভানুর কোথায় রহিল হায়,<br />মহিষ মানত করিত তাহার কাঁটা যে ফুটিলে পায়।<br />হাতের কাঁকনে আঁচড় লাগিলে যেত যে সোনারু বাড়ি,<br />এমন বাপেরে কোন দেশে ভানু আসিয়াছে আজ ছাড়ি।<br />কোথা সোহাগের ভাই-বউ তার মেহেদী মুছিলে হায়,<br />সাপন সীথার সিদুর লইত ঘষিতে ভানুর পায়।<br />কোথা আদরের মৈফল-ভাই ভানুর আঁচল ছাড়ি,<br />কি করে আজিকে দিবস কাটিছে একা খেলাঘরে তারি।</p>
<br /><p>এমনি করিয়া বিনায়ে বিনায়ে মেয়েটি করিছে গান,<br />দূরে বন পথে বউ কথা কও পাখি ডেকে হয়রান।<br />সেই ডাক আরো নিকটে আসিল, পাশের ধঞ্চে-খেতে<br />তারপর এলো তেঁতুলতলায় কুটিরের কিনারেতে<br />মেয়েটি খানিক শিকা তোলা রাখি অধরেতে হাসি আঁকি,<br />পাখিটিরে সে যে রাগাইয়া দিল বউ কথা কও ডাকি।<br />তারপর শেষে আগের মতই শিকায় বসাল মন,<br />ঘরের বেড়ার অতি কাছাকাছি পাখি ডাকে ঘন ঘন।<br />এবার সে হল আরও মনোযোগী, শিকা তোলা ছাড়া আর,<br />তার কাছে আজ লোপ পেয়ে গেছে সব কিছু দুনিয়ার।<br />দোরের নিকট ডাকিল এবার বউ কথা কও পাখি,<br />বউ কথা কও, বউ কথা কও, বারেক ফিরাও আঁখি।<br />বউ মিটি মিটি হাসে আর তার শিকায় যে ফুল তোলে,<br />মুখপোড়া পাখি এবার তাহার কানে কানে কথা বলে।<br />যাও ছাড়-লাগে, এবার বুঝিনু বউ তবে কথা কয়,<br />আমি ভেবেছিনু সব বউ বুঝি পাখির মতন হয়।<br />হয়ত এমনি পাখির মতন এ ডাল ও ডাল করি,<br />বই কথা কও ডাকিয়া ডাকিয়া জনম যাইবে হরি,<br />হতভাগা পাখি! সাধিয়া সাধিয়া কাঁদিয়া পাবে না কূল,<br />মুখপোড়া বউ সারাদিন বসি শিকায় তুলিবে ফুল।<br />ইস্যিরে মোর কথার নাগর! বলি ও কি করা হয়,<br />এখনি আবার কুঠার নিলে যে, বসিতে মন না লয়?<br />তুমি এইবার ভাত বাড় মোর, একটু খানিক পরে,<br />চেলা কাঠগুলো ফাঁড়িয়া এখনি আসিতেছি ঝট করে।</p>
<br /><p>কখনো হবে না, আগে তুমি বস, বউটি তখন উঠি,<br />ডালায় করিয়া হুড়ুমের মোয়া লইয়া আসিল ছুটি।<br />একপাশে দিল তিলের পাটালী নারিকেল লাড়ু আর<br />ফুল লতা আঁকা ক্ষীরের তক্তি দিল তারে খাইবার।<br />কাঁসার গেলাসে ভরে দিল জল, মাজা ঘষা ফুরফুরে<br />ঘরের যা কিছু মুখ দেখে বুঝি তার মাঝে ছায়া পূরে।<br />হাতেতে লইয়া ময়ূরের পাখা বউটি বসিল পাশে,<br />বলিল, এসব সাজায়ে রাখিনু কোন দেবতার আশে?<br />তুমিও এসো না! হিন্দুর মেয়ে মুসলমানের সনে<br />খাইতে বসিয়া জাত খোয়াইব তাই ভাবিয়াছ মনে?<br />নিজেরই জাতিটা খোয়াই তাহলেবড় গম্ভীর হয়ে,<br />টপটপ করে যা ছিল সোজন পুরিল অধরালয়ে।</p>
<br /><p>বউ ততখনে কলিকার পরে ঘন ঘন ফুঁক পাড়ি,<br />ফুলকি আগুন ছড়াইতেছিল দুটি ঠোট গোলকরি।<br />দুএক টুকরো ওড়া ছাই এসে লাগছিল চোখে মুখে,<br />ঘটছিল সেথা রূপান্তর যে বুঝি না দুখে কি সুখে।<br />ফুঁক দিতে দিতে দুটি গাল তার উঠছিল ফুলে ফুলে,<br />ছেলেটি সেদিকে চেয়ে চেয়ে তার হাত ধোয়া গেল ভুলে।<br />মেয়ে এবার টের পেয়ে গেছে, কলকে মাটিতে রাখি,<br />ফিরিয়া বসিল ছেলেটির পানে ঘুরায়ে দুইটি আঁখি।</p>
<br /><p>তারপর শেষে শিকা হাতে লয়ে বুনাতে বসিল ত্বরা,<br />মেলি বাম পাশে দুটি পাও তাতে মেহেদীর রঙ ভরা।<br />নীলাম্বরীর নীল সায়রেতে রক্ত কমল দুটি,<br />প্রথমভোরের বাতাস পাইয়া এখনি উঠিছে ফুটি।<br />ছেলেটি সেদিক অনিমেষ চেয়ে, মেয়েটি পাইয়া টের,<br />শাড়ীর আঁচলে চরণ দুইটি ঢাকিয়া লইল ফের।</p>
<br /><p>ছেলেটি এবার ব্যস্ত হইয়া কুঠার লইল করে,<br />এখনি সে যেন ছুটিয়া যাইবে চেলা ফাড়িবার তরে।<br />বউটি তখন পার আবরণ একটু লইল খুলি,<br />কি যেন খুঁজিতে ছেলেটি আসিয়া বসিল আবার ভুলি।<br />এবার বউটি ঢাকিল দুপাও শাড়ীর আঁচল দিয়ে,<br />ছেলেটি সজোরে কলকে রাখিয়া টানিল হুকোটি নিয়ে।<br />খালি দিনরাত শিকা ভাঙাইবে? হুকোয় ভরেছ জল?<br />কটার মতন গন্ধ ইহার একেবারে অবিকল।<br />এক্ষুণি জল ভরিণু হুকায়। দেখ! রাগায়ো না মোরে,<br />নৈচা আজিকে শিক পুড়াইয়া দিয়েছিলে সাফ করে?<br />কটর কটর শব্দ না যেন মুন্ড হতেছে মোর,<br />রান্নাঘরেতে কেন এ দুপুরে দিয়ে দাও নাই দোর?<br />এখনি খুলিলে? কথায় কথায় কথা কর কাটাকাটি,<br />রাগি যদি তবে টের পেয়ে যাবে বলিয়া দিলাম খাঁটি!</p>
<br /><p>মিছেমিছি যদি রাগিতেই সখ, বেশ রাগ কর তবে,<br />আমার কি তাতে, তোমারি চক্ষু রক্ত বরণ হবে।<br />রাগিবই তবে? আচ্ছা দাঁড়াও মজাটা দেখিয়া লও,<br />যখন তখন ইচ্ছা মাফিক যা খুশী আমারে কও!<br />এইবার দেখ! না! না! তবে আর রাগিয়া কি মোর হবে,<br />আমি ত তোমার কেউ কেটা নই খবর টবার লবে?</p>
<br /><p>বউটি বসিয়াশিকা ভাঙাইতেছে, আর হাসিতেছে খালি,<br />প্রতিদিন সে ত বহুবার শোনে এমনি মিষ্ট গালি।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/roop/রূপ2016-05-12T16:32:25-04:002023-06-25T04:53:05-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>রূপেরে কহিনু ডাকি<br />হায় রূপ! তুমি কেন চলে যাও,<br />তুমি কেন একখানে<br />স্থির হয়ে রহিতে না পাও!<br />তুমি কি জান না রূপ,<br />আঁখিতে কাজল-লতা একেঁ,<br />তরুণীরা তোমারে ধরিতে পাতে ফাঁদ-<br />দশন মুকুতা মালা দিয়ে<br />জড়ায়ে হাসির রাঙা চাঁদ<br />তুমি কি জান না রূপ, বাহুর বিজলী লতা দুটি,<br />বাহুরে ছাড়িয়া যদি যায়;<br />লহর পহর জাগে বসি<br />শাড়ীর সুনীল দরিয়ায়।</p>
<br /><p>তুমি কি জান না রূপ,<br />দেহের ধূপের পাত্র ভরি,<br />তোমা লাগি হোম-মন্ত্র<br />ধ্বনিছে দিবস বিভাবরী;<br />কত যে হইল প্রাণবলি<br />কত যে হইল তনুক্ষয়,<br />হায় রূপ! চিরচঞ্চল রূপ!….<br />তবু তুমি কাহারো ত হলে নয়।<br />তোমার তনুর হাওয়া লাগি<br />প্রেম-ফুল ফুটিয়া টুটিয়া মরে যায়,<br />কথার কাকলি ওড়ে পথে<br />সোহাগে আগরে মূরছায়।<br />রূপ! তুমি রূপ! কারো লাগি থামিলে না কোন পথ বাঁকে<br />একটি আশিষ-কণা, একটু করুণা-বারি,<br />দয়া করে নাহি দিলে কাকে।</p>
<br /><p>রূপেরে কহিনু ডাকি,<br />শোন রূপ, আমাদের কলূষ অন্তর,<br />তোমারে ছুঁইতে যেয়ে হায়<br />আমাদের ধরণীর ধূলিরে মাখাই তব গায়;<br />শিশুরা সরল মন,<br />চোখে মুখে স্বরগের চুমু লেগে আছে,<br />তুমি কি পার না রূপ! কিছুদিন রহিবারে<br />খেলাঘরে তাহাদের কাছে?<br />ফুলেরা তাদেরও চেয়ে ভাল,<br />হাসিমুখে চেয়ে থাকে খালি, কথা নাহি জানে,<br />পাখিরা বনের পাখি<br />ডালে ডালে মধুর কাকলি করে ফেরে;<br />তুমি কি তাদের মাঝে<br />কিছুদিন রহিতে পার না রূপ!<br />তোমার চলার পথ ছেড়ে?<br />রূপেরে কহিনু ডেকে আরো,<br />হায় রূপ! চিরচঞ্চল রূপ,<br />দেহ হতে দেহ পানে ধাও,<br />তোমা হেরি এত কথা জাগে মোর মনে;<br />তোমার কি কোন কথা নাই?<br />আমরা তোমারে চাহি, তুমি কি কারেও নাহি চাও!<br />আরো কহিলাম তারে, রূপ! তুমি<br />তনুতে তনুতে বাসা বাঁধি,<br />রজনী প্রভাতে চলে যাও;<br />তোমার নাহিক তৃপ্তি-<br />কি চেয়ে কি যেন নাহি পাও।<br />তোমার হাতের বর-মালা<br />নিশীথে পরায়ে কারো গলে<br />প্রভাতে খুলিয়া লয়ে যাও;<br />কারে যে বেসেছ ভাল<br />তুমি তা জান না বলে রূপ,<br />কেবলি সমুখ পানে ধাও।<br />বড় যে অভাগা রূপ,<br />বড় যে অবলা রূপ,<br />জানে না কি করে কথা বলে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ- রূপবতী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/torun-kishor/তরুণ কিশোর2016-05-12T15:34:56-04:002023-06-26T13:18:34-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>তরুণ কিশোর ! তোমার জীবনে সবে এ ভোরের বেলা,<br />ভোরের বাতাস ভোরের কুসুমে জুড়েছে রঙের খেলা।<br />রঙের কুহেলী তলে,<br />তোমার জীবন ঊষার আকাশে শিশু রবি সম জ্বলে।<br />এখনো পাখিরা উঠেনি জাগিয়া, শিশির রয়েছে ঘুমে,<br />কলঙ্কী চাঁদ পশ্চিমে হেলি কৌমুদী-লতা চুমে।<br />বঁধুর কোলেতে বধুয়া ঘুমায়, খোলেনি বাহুর বাঁধ,<br />দীঘির জলেতে নাহিয়া নাহিয়া মেটেনি তারার সাধ।<br />এখনো আসেনি অলি,<br />মধুর লোভেতে কোমল কুসুম দুপায়েতে দলি দলি।<br />এখনো গোপন আঁধারের তলে আলোকের শতদল,<br />মেঘে মেঘে লেগে বরণে বরণে করিতেছে টলমল।<br />এখনো বসিয়া সেঁউতীর মালা গাঁথিছে ভোরের তারা,<br />ঊষার রঙিন শাড়ীখানি তার বুনান হয়নি সারা।<br />হায়রে করুণ হায়,<br />এখনি যে সবে জাগিয়া উঠিবে প্রভাতের কিনারায়।<br />এখন হইবে লোক জানাজানি, মুখ চেনাচেনি আর,<br />হিসাব নিকাশ হইবে এখন কতটুকু আছে কার।<br />বিহগ ছাড়িয়া ভোরের ভজন আহারের সন্ধ্যানে,<br />বাতাসে বাঁধিয়া পাখা-সেতু-বাঁধ ছুটিবে সুদুর-পানে।<br />শূন্য হাওয়ার শূন্য ভরিতে বুকখানি করি শুনো,<br />ফুলের দেউল হবে না উজাড় আজিকে প্রভাতে পুন।</p>
<br /><p>তরুণ কিশোর ছেলে,<br />আমরা আজিকে ভাবিয়া না পাই তুমি হেথা কেন এলে?<br />তুমি ভাই সেই ব্রজের রাখাল, পাতার মুকুট পরি,<br />তোমাদের রাজা আজো নাকি খেলে গেঁয়ো মাঠখানি ভরি।<br />আজো নাকি সেই বাঁশীর রাজাটি তমাল-লতার ফাঁদে,<br />চরণ জড়ায়ে নূপুর হারায়ে পথের ধূলায় কাঁদে<br />কে এলে তবে ভাই,<br />সোনার গোকুল আঁধার করিয়া এই মথুরার ঠাই।</p>
<br /><p>হেথা যৌবন মেলিয়া ধরিয়া জমা-খরচের খাতা,<br />লাভ লেকাসান নিতেছে বুঝিয়া খুলিয়া পাতায় পাতা।<br />ওপারে কিশোর, এপারে যুবক, রাজার দেউল বাড়ি,<br />পাষাণের দেশে কেন এলে ভাই। রাখালের দেশ ছাড়ি?<br />তুমি যে কিশোর তোমার দেশেতে হিসাব নিকাশ নাই,<br />যে আসে নিকটে তাহারেই লও আপন বলিয়া তাই।<br />আজিও নিজেরে বিকাইতে পার ফুলের মালার দামে,<br />রূপকথা শুনি তোমাদের দেশে রূপকথা-দেয়া নামে।<br />আজো কানে গোঁজ শিরীষ কুসুম কিংশুক-মঞ্জরী,<br />অলকে বাঁধিয়া পাটল ফুলেতে ভরে লও উত্তরী!<br />আজিও চেননি সোনার আদর, চেননি মুক্তাহার,<br />হাসি মুখে তাই সোনা ঝরে পড়ে তোমাদের যারতার।<br />সখালী পাতাও সখাদের সাথে, বিনামূলে দাও প্রাণ,<br />এপারে মোদের মথুরার মত নাই দান-প্রতিদান।<br />হেথা যৌবন যত কিছু এর খাতায় লিখিয়া লয়,<br />পান হতে চুন খসেনাক-এমনি হিসাবময়।<br />হাসিটি হেথায় বাজারে বিকায় গানের বেসাত করি,<br />হেথাকার লোক সুরের পরাণ ধরে মানে লয় ভরি।<br />হায়রে কিশোর হায়!<br />ফুলের পরাণ বিকাতে এসেছ এই পাপ-মথুরায়</p>
<br /><p>কালিন্দী লতা গলায় জড়ায়ে সোনার গোকুল কাঁদে<br />ব্রজের দুলাল বাঁধা নাহি পড়ে যেন মথুরার ফাঁদে।<br />মাধবীলতার দোলনা বাঁধিয়া কদম্ব-শাখে শাখে,<br />কিশোর! তোমার কিশোর সখারা তোমারে যে ওই ডাকে।<br />ডাকে কেয়াবনে ফুল-মঞ্জরি ঘন-দেয়া সম্পাতে,<br />মাটির বুকেতে তমাল তাহার ফুল-বাহুখানি পাতে।</p>
<br /><p>ঘরে ফিরে যাও সোনার কিশোর! এ পাপমথুরাপুরী,<br />তোমার সোনার অঙ্গেতে দেবে বিষবান ছুঁড়ি ছুঁড়ি।<br />তোমার গোকুল আজো শেখে নাই ভালবাসা বলে কারে,<br />ভালবেসে তাই বুকে বেঁধে লয় আদরিয়া যারে তারে।<br />সেথায় তোমার কিশোরী বধূটি মাটির প্রদীপ ধরি,<br />তুলসীর মূলে প্রণাম যে আঁকে হয়ত তোমারে স্মরি।<br />হয়ত তাহাও জানে না সে মেয়ে জানে না কুসুম-হার,<br />এত যে আদরে গাঁথিছে সে তাহা গলায় দোলাবে কার?<br />তুমিও হয়ত জান না কিশোর, সেই কিশোরীর লাগি,<br />মনে মনে কত দেউল গেঁথেছে কত না রজনী জাগি।<br />হয়ত তাহারি অলকে বাঁধিতে মাঠের কুসুম ফুল,<br />কতদূর পথ ঘুরিয়া মরিছ কত পথ করি ভুল।<br />কারে ভালবাস, কারে যে বাস না তোমরা শেখনি তাহা,<br />আমাদের মত কামনার ফাঁদে চেননি উহু ও আহা!<br />মোদের মথুরা টরমল করে পাপ-লালসার ভারে,<br />ভোগের সমিধ জ্বালিয়া আমরা পুড়িতেছি বারে বারে।<br />তোমাদের প্রেম নিকষিত হেম কামনা নাহিক তায়<br />যুগে যুগে কবি গড়িয়াছে ছবি কত ব্রজের গাঁয়!<br />তোমাদের সেই ব্রজের ধূলায় প্রেমের বেলাতি হয়,<br />সেথা কেউ তার মূল্য জানে না, এই বড় বিস্ময়।<br />সেই ব্রজধূলি আজো ত মুছেনি তোমার সোনার গায়,<br />কেন তবে ভাই, চরণ বাড়ালে যৌবন মথুরায়!</p>
<br /><p>হায়রে প্রলাপী কবি!<br />কেউ কভু পারে মুছিয়া লইতে ললাটেরলেখা সবি।<br />মথুরার রাজা টানিছে যে ভাই! কালের রজ্জু ধরে,<br />তরুণ কিশোর! কেউ পারিবে না ধরিয়া রাখিতে তোরে।<br />ওপারে গোকুল এপারে মথুরা মাঝে যমুনার জল,<br />নীল নয়নেতে তোর ব্যথা বুঝি বয়ে যায় অবিরল।<br />তবু যে তোমারে যেতে হবে ভাই, সে পাষাণ মথুরায়,<br />ফুলের বসতি ভাঙিয়া এখন যাইবি ফলের গাঁয়।<br />এমনি করিয়া ভাঙা বরষায় ফুলের ভূষণ খুলি,<br />কদম্ব-বধূ শিহরীয়া উঠে শরৎ হাওয়ায় দুলি।<br />এমনি করিয়া ভোরের শিশির ফুরায় ভোরের ঘাসে,<br />মাধবী হারায় বুকের সুরভি নিদাঘের নিম্বাস।<br />তোরে যেতে হবে চলে<br />এই গোকুলের ফুলের বাঁধন দুপায়েতে দলে দলে।<br />তবু ফিরে চাও সোনার কিশোর বিদায় পথের ধার,<br />কি ভূষণ তুমি ফেলে গেলে ব্রজে দেখে লই একবার।<br />ওই সোনামুখে আজো লেগে আছে জননীর শত চুমো,<br />দুটি কালো আঁখি আজো হতে পারে ঘুম-গানে ঘুম্ ঘুমো।<br />বরণ তাদের আর পেলবতা লিখে গেছে নির্ভূল।<br />কচি শিশু লয়ে ধরার মায়েরা যে আদর করিয়াছে,<br />সোনা ভাইদের সোনা মুখে বোন যত চুমা রাখিয়াছে;<br />সে সব আজিকে তোর ওই দেহে করিতেছে টলমল,<br />নিখিল নারীর স্নেহের সলিলে তুই শিশু শতদল।<br />রে কিশোর! এই মথুরার পথে সহসা দেখিয়া তোরে,<br />মনে হয় যেন ওমনি কাহারে দেখেছিনু এক ভোরে।<br />সে আমার এই কৈশোর-হিয়া, জীবনের একতীরে,<br />কোথা হতে যেন সোনার পাখিটি উড়ে এসেছিল ধীরে।<br />পাখায় তাহার বেঁধে এনেছিল দূর গগনের লেখা,<br />আর এনেছিল রঙিন ঊষার একটু সিঁদুর-রেখা।<br />সে পাখি কখন উড়িয়া গিয়াছে মোর বালুচর ছাড়ি,<br />আজিও তাহারে ডাকিয়া ডাকিয়া শূন্যে দুহাত নাড়ি।</p>
<br /><p>সোনার কিশোর ভাই,<br />তোর মুখ হেরী মনে হয় যেন কোথায় ভাসিয়া যাই।<br />এত কাছে তুই, তবু মনে হয় আমাদের গেঁয়ো নদী,<br />রোদ-মাখা সাদা বালু-চরখানি শুকাইছে নিরবধি;<br />সেইখানে তুই দুটি রাঙা পায়ে আঁকিয়া পায়ের রেখা,<br />চলেছিস একা বালুকার বুকে পড়িয়া টেউএর লেখা।<br />সে চরে এখনো মাঠের কৃষাণ বাঁধে নাই ছোট ঘর,<br />কৃষাণের বউ জাঙলা বাঁধেনি তাহার বুকের পর।<br />লাঙল সেথায় মাটিরে ফুঁড়িয়া গাহেনি ধানের গান,<br />জলের উপর ভাসিতেছে যেন মাটির ও মেটো-থান।<br />বর্ষার নদী এঁকেছিল বুকে ঢেউ দিয়ে আলপনা,<br />বর্ষা গিয়াছে, ওই বালুচর আজো তাহা মুছিল না।<br />সেইখান দিয়ে চলেজ উধাও, চখা-চখি উড়ে আগ,<br />কোমল পাখার বাতাস তোমার কমল মুখেতে লাগে।</p>
<br /><p>এপারে মোদের ভরের‘গেরাম’আমরা দোকানদার,<br />বাটখারা লয়ে মাপিতে শিখেছি কতটা ওজন কার।<br />তবুরে কিশোর, ওই পারে যবে ফিরাই নয়নখানি,<br />এই কালো চোখে আজো এঁকে যায় অমরার হাতছানি।<br />ওপারেতে চর এ পারেতে ভর মাঝে বহে গেঁয়ো নদী।<br />কিশোর কুমার, দেখিতাম তোরে ফিরিয়া দাঁড়াতি যদি।<br />তোর সোনা মুখে উড়িতেছে আজো নতুন চরের বালি,<br />রাঙা দুটি পাও চলিয়া চলিয়া রাঙা ছবি আঁকে খালি।<br />তুই আমাদের নদীটির মত দুপারে দুইটি তট,<br />দুই মেয়ে যেন দুইধারে টানে বুড়াতে কাঁখের ঘট।<br />ওপারে ডাকিছে নয়া বালুচর কিশোর কালের সাথী,<br />এপারেতে ভর ভরা যৌবন কামনা-ব্যথায় ব্যথী।<br />তুই হেথা ভাই ঘুমাইয়া থাক গেঁয়ো নদীটির মত,<br />এপার ওপার দুটি পাও ধরে কাঁদুক বাসনা যত।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রাখালী</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/krishani-dui-meye/কৃষাণী দুই মেয়ে2016-05-12T15:15:12-04:002023-06-25T16:56:29-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>কৃষাণী দুই মেয়ে<br />পথের কোণে দাঁড়িয়ে হাসে আমার পানে চেয়ে।<br />ওরা যেন হাসি খুশীর দুইটি রাঙা বোন,<br />হাসি-খুশীর বেসাত ওরা করছে সারাখন।<br />ঝাকড়া মাথায় কোঁকড়া চুলে, লেগেছে খড়কুটো,<br />তাহার নীচে মুখ দুখানি যেন তরমুজফালি দুটো।<br />সেই মুখেতে কে দুখানি তরমুজেরি ফালি,<br />একটি মেয়ে লাজুক বড়, মুখর আরেক জন,<br />লজ্জাবতীর লতা যেন জড়িয়ে গোলাপ বন।</p>
<br /><p>একটি হাসে, আর সে হাসি লুকায় আঁচল কোণে,<br />রাঙা মুখের খুশী মিলায় রাঙা শাড়ীর সনে।<br />পউষ-রবির হাসির মত আরেক জনের হাসি,<br />কুয়াশাহীন আকাশ ভরে টুকরো-মেঘে ভাসি।<br />চাষীদের ওই দুইটি মেয়ে ঈদের দুটি চাঁদ,<br />যেই দেখেছি, পেরিয়ে গেল নয়নপুরীর ফাঁদ।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: ধান ক্ষেত</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/choudhurider-roth/চৌধুরীদের রথ2016-05-12T15:11:57-04:002023-06-27T07:28:37-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>চৌধুরীদের রথ<br />ডান ধারে তার ধূলায় ধূসর তালমা হাটের পথ।<br />চামচিকে আর আরসূলারা নির্ভাবনায় বসি,<br />করছে নানান কল-কোলাহল রথের মাঝে পশি!<br />বাদুর সেথা ঝুলছে সুখে, বাহির জগৎখানি,<br />অনেক দিনই ত্যাগ করেছে তাদের জানাজানি।<br />গরুর বীরের মাথায় বসি পাঁকুড় গাছের চারা,<br />মেলছে শিকড়, তবু ঠাকুর দেয়নি কোন সাড়া।<br />কাঠের ঘোড়ার ঠ্যাং ভেঙেছে, খসছে রথের ছাদ,<br />আজো তবু কেউ করেনি ইহার প্রতিবাদ।</p>
<br /><p>রাস্তা দিয়ে নানান রকম লোকের চলাচল;<br />নানান রকম আলাপ বিলাপ, নানান কোলাহল।<br />কেউ বা চাষী, কেউ বা ধনী, পরদেশী, কেউ দেশী,<br />ভাবে তারা সবার চেয়ে কাজের কথাই বেশী।<br />কেউ বা ভাবে, মোকদমায় হারিয়ে দিয়ে কার<br />বসত-বাড়ি করবে নিলাম বাঁশ-গাড়ীতে তার।<br />কেউ বা ভাবে, কি কৌশলে মেলি কথার জাল,<br />এক আনিতে আনবে টেনে ছয়পয়সার মাল।<br />যতই কেন ব্যস্ত থাকুক, যতই কাজের তাড়া;<br />হেথায় এলে সব ভুলে চায় রথের পানে তারা।<br />চাক ভাঙা আর বয়স মলিন চৌধুরীদের রথ,<br />তাদের পানে করুন চেয়ে শুধায় যেন পথ;-<br />শুধায় যেন, সেই অতীতের চৌধুরীদের কে,<br />ছুতোর ডেকে রঙিন এ রথ গড়লপুলকে!<br />আসল গাঁয়ের বৃদ্ধ পোটো, রঙিন তুলির সনে,<br />রেখায় রেখায় বাঁধল সে কোন সোনার স্বপনে।<br />রথের চূড়ায় উড়ল ধ্বজা, গাঁয়ের ছেলে-মেয়ে,<br />চলতে পথে থাকত খানিক রথের পানে চেয়ে।</p>
<br /><p>তারপরে সে রথের দিনে হাজার লোকের মেলা,<br />দোকান পসার, ভোজবাজী আর ভানুমতীর খেলা,<br />আসত গাঁয়ের বৌ ঝিরা সব, আসত ছেলে-মেয়ে,<br />রঙিন হাসির দুলত লহর রঙিন কাপড় ছেয়ে।<br />বুড়ো মাসীর স্কন্ধে উঠে ছোট্ট শিশু ছেলে;<br />এই রথেরি ঠাকুরটিরে দেখত আঁখি মেলে।<br />গাঁর বধূরা ভালের সিদুর মেলে পথের পরে<br />সরল বুকের আঁকত পূজা এই ঠাকুরের তরে।<br />আঁচল তাদের জড়িয়ে ধরে ছোট্ট শিশুর দল,<br />তালের পাতার বাজিয়ে বাঁশী করত কোলাহল।<br />দৌড়ের নাও ভাসত গাঙে, রঙিন নিশান লয়ে,<br />গলুই ভরি জ্বলত পিতল নব-রতন হয়ে।<br />তাহার গলে পরিয়ে দিত রঙিন সোলার মালা,<br />এমনি মত হাজার নায়ে গাঙটি হত আলা।<br />সেই নায়েতে বাছ খেলাত গাঁয়ের যত চাষী;<br />বৈঠা পরে বৈঠা হাঁকি চলত তারা ভাসি।<br />তারি তালে গাইত তারা ভাটির সুরে গান,<br />শুনে নদী উথল পাথাল, ঢেউ ভেঙে খান খান।<br />কৌতুহলী দাঁড়িয়ে তীরে হাজার নয়-নারী,<br />হাতে তাদের দুলত মালা গলায় দিতে তারি,<br />যাহার তরী সব তরীরে পেরিয়ে যাবে আগে,<br />তারে তারা করবে বরণ মনের অনুরাগে।</p>
<br /><p>সে সব আজি কোথায় গেল, চৌধুরীদের রথ,<br />আজো যেন শুধায় সবে তাদের চলা-পথ।<br />চাকাগুলো ভেঙেছে তার উই ধরেছে কাঠে,<br />কোন অভিযোগ বক্ষে লয়ে সময় তাদের কাটে!<br />ছবিগুলো যাচ্ছে মুছে, ভাঙা কদম ডাল,<br />ত্যাগ করিয়া পালিয়ে গেছে নিঠুর বংশীয়াল।<br />তলায় বসে একলা রাধা কাঁপছে পুলকে,<br />জানতে আজো পায়নি তাহার বন্ধু নিল কে।<br />মাঠের পথে চলছে ধেনু বিরাম নাহি হ্যয়,<br />রাখাল কবে ঠ্যাং ভেঙেছে, কেউ না ফিরে চায়।<br />দল বাঁধিয়া চলছে কোথায় গাঁয়ের ছেলে-মেয়ে,<br />মৃদঙ্গ আর ঢোল বাঁজায়ে বাঁশীতে গান গেয়ে।<br />হয়ত কোন পরব গাঁয়ের করবে সমাপন,<br />হাজার বরষ আগেই তাহার করছে আয়োজন।<br />কারো কাঁধের ঢোল ভেঙেছে কাহারো একতারা,<br />দলপতি যে নেইক সাথে, টের পায়নি তারা।<br />এমনি কালের কঠোর ঘায়ে দিনের পরে দিন,<br />এ সব ছবির একখানিকরও থাকবেনাক চিন।<br />এর সাথে সেই গাঁয়ের পোটো, -তাহার কথাও সবে,<br />ভুলে যাবে অজানা কোন দিনের মহোৎসবে।<br />কোন সে অতীত আঁধার সাগর, তাহারপারে বসি,<br />এঁকেছিল সোনার স্বপন বরণ ঘষি ঘষি।<br />হয়ত তারি গাঁয়ের যত নর-নারীর দল,<br />মনে তাহার ফুটিয়েছিল স্বপন শতদল;<br />তারি একটি সোনার কলি আলোক- তরীর প্রায়,<br />সপ্ত সাগর পার হইয়া ভিড়ছে রথের গায়!<br />আজ হয়ত অনাদরেই অনেক অভিমানে,<br />চলছে ফিরে প্রদীপ তরী সেই অতীতের পানে;<br />সেখানে সেই বৃদ্ধ পোটো বনস্পতির প্রায়,<br />হাজার শাখা এলিয়ে বায়ে ঢুলছে নিরালায়।<br />চাক ভাঙা আর বয়স মিলন চৌধুরীদের রথ,<br />আজো যেন চক্ষু মুদে খুঁজছে তাদের পথ।<br />বনের লতায় গা ছেয়েছে, গাছের শাখা তারে,<br />জড়িয়ে ধরে এ সব কথা শুনছে বারে বারে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: ধান ক্ষেত</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/puran-pukur/পুরান পুকুর2016-05-10T13:42:28-04:002023-06-27T14:03:09-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>পুরান পুকুর, তব তীরে বসি ভাবিয়া উদাস হই,<br />খেজুরের গোড়ে বাঁধা ছোট ঘাট, করে জল থই থই;<br />রাত না পোহাতে গাঁয়ের বধুরা কলসীর কলরবে,<br />ঘুম হতে তোমা জাগাইয়া দিত প্রভাতের উৎসবে।<br />সারাদিন ধরি ঘড়ায় ঘড়ায় তব অমৃতরাশি,<br />বধুদের কাঁখে ঢলিয়া ঢলিয়া ঘরে ঘরে যেত হাসি।<br />‘বদনায়’ভরা একটুকু, তারি ভরসায় গেঁয়ো-চাষী,<br />চৈত্র-রোদের করুণ করিয়া বাজাত গানের বাঁশী।<br />মাঠ হতে তারা জ্বলিয়া পুড়িয়া আসিত তোমার তীরে,<br />খেজুর পাতায় সোনালী চামর দোলাতে তাদের শিরে।<br />শান্ত হইয়া গামছা ভিজায়ে তোমার কাজল-জলে,<br />নাহিয়া নাহিয়া সাধ মিটিত না-আবার নাহিবে বলে।</p>
<br /><p>এইখানে বসি পল্লী-বধূরা আধেক ঘোমটা খুলি,<br />তোমার মুকুরে মুখখানি হেরে জল-ভরা যেত ভুলি।<br />সখিতে সখিতে কাঁধে কাঁধ ধরি খেলিত যে জল-খেলা,<br />সারাটি গাঁয়ের যত রূপ আছে তব বুকে হত মেলা,<br />পুকুরের জল উথলি পাথালি ভাসিত তাদের হাসি, -<br />ফুলে ফুল লাগি ফুলেরা যেমন ভেঙে হয় রাশি রাশি।<br />আজি মনে পড়ে, পুরান পুকুর, মায়ের আঁচল ধরে,<br />একটি ছেলের ঝাঁপাঝাঁপি খেলা তোমার বুকের পরে।<br />ওই এত জলে সাঁপলার ফুল, -তারি ছিল এত লোভ,<br />তাই তুলিবারে জলে ডুবিলেও মনে নাহি ছিল ক্ষোভ।<br />আজিকে তোমার কোথায় সে জল? কোথা সেই বাঁধা ঘাট,<br />গেঁয়ো বধূদের খাড়ুতে মুখর কোথা সে পুকুর বাট?</p>
<br /><p>চারিধারে তব বন-জঙ্গল পাতায় পাতায় ঢাকা,<br />নিকষ-রাতের আঁধার যেন গো তুলিতে রয়েছে আঁকা।<br />ডুকরিয়া কাঁদে ডাহুক ডাহুকী তরু-মর্ম্মর স্বনে,<br />তারি সাথে বুঝি উঠিছে শিহরি যত ব্যথা তব মনে!<br />হিজল গাছের মালা হতে আজি খসিয়া রঙিন ফুল,<br />সাঁঝের মতন দিতেছে ব্যথিয়া তোমার চরণমূল।<br />সন্ধ্যা-সকালে আসিত যাহারা কলসী লইয়া ঘাটে,<br />তারা সবে আজি বিদায় নিয়েছে মরণ পারের হাটে।<br />বক্ষ-মুকুরে সোনা মুখখানি দেখিবারে কেহ নাই,<br />কুচুরী পানায় আধ বুকখানি ঢাকিয়া রেখেছ তাই!</p>
<br /><p>ঘুচাও ঘুচাও মৌন তড়াগ, বুকের আরসীখানি,<br />মোর বাল্যের যত ভুলো-কথা সারা গায়ে দাও টানি।<br />সেই ছেলেবেলা স্বপ্নের মত কত স্নেহ ভরা মুখ,<br />এনে দাও, শুধু বারেক দেখিয়া ভরে লই সারা বুক।<br />এনে দাও সেই তব তীরে বসি মেঠো রাখালের বাঁশী<br />স্বপনের ভেলা দুলায়ে দুলায়ে আকাশেতে যাক্ ভাসি।<br />হায়রে, সেদিন আসে না ফিরিয়া! শুধু ভিজে আঁখি পাতা,<br />পুরানো স্বপন কুড়ায়ে কুড়ায়ে আকাশেতে জাল পাতা!<br />তুমিও সজনি, আমারি মতন না জানি কাঁদিছ কত,<br />ছোট ঢেউগুলি নাড়িয়া নাড়িয়া পাড়েরে করিছ ক্ষত।<br />বনদেবী আজ সমবেদনায় আঁচল বিছায়ে জলে,<br />ব্যথাতুরা তব সারা বুকখানি ঢেকেছে কলমী দলে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/bongo-bondhu/বঙ্গ-বন্ধু2016-05-10T13:38:52-04:002023-06-27T20:08:29-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>মুজিবর রহমান।<br />ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।<br />বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,<br />জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞঝা-অশনি বেয়ে ।<br />বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা-মার।<br />হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যে অঙ্গার ;<br />দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে,<br />দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে ;<br />তাহাই যেন বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি<br />ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।</p>
<br /><p>মুজিবর রহমান।<br />তব অশ্বেরে মোদের রক্তে করায়েছি পূত-স্নান।<br />পীড়িত-জনের নিশ্বাস তারে দিয়েছে চলার গতি,<br />বুলেটে নিহত শহীদেরা তার অঙ্গে দিয়েছে জ্যেতি।<br />দুর্ভিক্ষের দানব তাহারে অদম্য বল,<br />জঠরে জঠরে অনাহার-জ্বালা করে তারে চঞ্চল।<br />শত ক্ষতে লেখা অমর কাব্য হাসপাতালের ঘরে,<br />মুর্হুমুহু যে ধবনিত হইছে তোমার পথের পরে।<br />মায়ের বুকের ভায়ের বুকের বোনের বুকের জ্বালা,<br />তব সম্মুখ পথে পথে আজ দেখায়ে চলিছে আলা।<br />জীবন দানের প্রতিজ্ঞা লয়ে লক্ষ সেনানী পাছে,<br />তোমার হুকুম তামিলের লাগি সাথে তব চলিয়াছে।<br />রাজভয় আর কারাশৃঙ্কল হেলায় করেছ জয়।<br />ফাঁসির মঞ্চে-মহত্ব তব কখনো হয়নি ক্ষয়।<br />বাঙলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমুর্ত রাজ,<br />প্রতি বাঙালীর হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।<br />তোমার একটি আঙ্গুল হেলনে অচল যে সরকার।<br />অফিসে অফিসে তালা লেগে গেছে-স্তব্ধ হুকুমদার।</p>
<br /><p>এই বাঙলায় শুনেছি আমরা সকল করিয়া ত্যাগ,<br />সন্ন্যাসী বেশে দেশ-বন্ধুর শান্ত-মধুর ডাক।<br />শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী-জীবন করিয়া দান,<br />মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান।<br />তারা যা পারেনি তুমি তা করেছ, ধর্মে ধর্মে আর,<br />জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সন্তান বাঙলার।</p>
<br /><p>সেনাবাহিনীর অশ্বে চড়িয়া দম্ভ-স্ফীত ত্রাস,<br />কামান গোলার বুলেটের জোরে হানে বিষাক্ত শ্বাস।<br />তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়,<br />আমরা বাঙালীর মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।</p>
<br /><p>ধন্য এ কবি ধন্য এ যুগে রয়েছে জীবন লয়ে,<br />সম্মুখে তার মহাগৌরবে ইতিহাস চলে বয়ে।<br />ভুলিব না সেই মহিমার দিন, ভাষার আন্দোলনে ।<br />বুরেটের ভয় তুচ্ছ করিয়া ছেলেরা দাঁড়াল রণে ।<br />বরকত আর জব্বার আর সালাম পথের মাঝে,<br />পড়ে বলে গেলো, “আমরা চলিনু ভাইরা আসিও পাছে।”<br />উত্তর তার দিয়েছে বাঙালী, জানুয়ারী সত্তরে,<br />ঘরের বাহির হইল ছেলেরা বুলেটের মহা-ঝড়ে।<br />পথে পথে তারা লিখিল লেখন বুকের রক্ত দিয়ে,<br />লক্ষ লক্ষ ছুটিল বাঙালী সেই বাণী ফুকারিয়ে।<br />মরিবার সে কি উন্মাদনা যে, ভয় পালাইল ভয়ে,<br />পাগলের মত ছোট নর-নারী মৃত্যুরে হাতে লয়ে।<br />আরো একদিন ধন্য হইনু সে মহাদৃশ্য হেরি,<br />দিকে দিগনে- বাজিল যেদিন বাঙালীর জয়ভেরী।<br />মহাহুঙ্কারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার,<br />বঙ্গ-বন্ধু শেখ মুজিবেরে করিয়া আনিল বার।<br />আরো একদিন ধন্য হইব, ধন-ধান্যেতে ভরা,<br />জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এদেশ সীমিত-বসুন্ধরা।<br />মাঠের পাত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি,<br />বরণে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকসী-কাঁথার ছবি।<br />মানুষ মানুষ রহিবে না ভেদ, সকলে সকলকার,<br />এক সাথে ভাগ করিয়া খাইবে সম্পদ যত মার।<br />পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর রূপালীর তার পরে,<br />পরাণ ভুলানো ভাটিয়ালী সুর বাজিবে বিশ্বভরে।<br />আম-কাঁঠালের ছায়ায় শীতল কুটিরগুলির তলে,<br />সুখ যে আসিয়া গড়াগড়ি করি খেলাইবে কৌতুহলে।</p>
<br /><p>আরো একদিন ধন্য হইব চির-নির্ভীকভাবে,<br />আমাদের জাতি নেতার পাগড়ি ধরিয়া জবাব চাবে,<br />“কোন অধিকারে জাতির স্বার্থ করিয়াছ বিক্রয়?”<br />আমার এদেশ হয় যেন সদা সেইরূপ নির্ভয়।</p>
<br /><p>সূত্র: ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/bamun-barir-meye/বামুন বাড়ির মেয়ে2016-05-10T13:30:06-04:002023-06-25T04:53:03-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>বামুন বাড়ির মেয়ে,<br />কাঁচা রোদের বরণ ঝরে গা-খানি তার বেয়ে-<br />সে রোদ দেখা যায়, যেমনি বনের পাতার ফাঁকে,<br />শিশু-রবির টুকরো আলো ছড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকো;<br />তেমনি তাহার বসন বেয়ে, আঁচলখানি বেয়ে,<br />যে পথ দিয়ে চলে সে পথ রূপে যে যায় নেয়ে।</p>
<br /><p>এই গাঁয়েতে আধলা পুকুর, পচা কাজল জল;<br />বেঙের ছাতি তাহার বুকে ভাসছে অবিরল।<br />সেখানেতে পানার বহর মশার দলের সনে,<br />চিরস্থায়ী ঘর বাঁধিয়া বাস করে নির্জনে।<br />তারির ফাঁকে বরষ বরষ জল-সাপলার পরী,<br />চাঁদের আলো মাখায় তাহার ফুলেল কুটীর ভরি।<br />সেই জলেরি ঢেউ বাঁধিয়া সূক্ষ্ম লতার সনে<br />কলমী-কুসুম নিতুই সাজে নতুন বিয়ের কনে।<br />সেখানেতে পদ্মপাতায় মেলি পূজার ফুল,<br />কলমিনী পুকুর জলে ভাসায় জাতি-কুল।<br />তেমনি এই সুদূর গাঁয়ে ম্যালেরিয়ার বাস,<br />ঝগড়া ফেসাদ-কুসংস্কার ঘুরছে চারি পাশ।<br />এরির মধ্যে বাস করে এই বামুন বাড়ির মেয়ে,<br />সবার সনে থেকেও সে যে একলা সবার চেয়ে।<br />ও যেন ঠিক কুমুদ-কুসুম দীঘির পচা জল,<br />আজও তাহার পায়নি ছুঁতে পরাগ শতদল।<br />ও যেন ঠিক ঝুমকো লতা জড়িয়ে গাঁয়ের সব,<br />হাসছে উহার পাতায় পাতায় ফুলের মহোৎসব।</p>
<br /><p>এই গাঁয়েতে বরষ বরষ আসছে মহামারী,<br />হাজার পরাণ ধূলায় লোটে চরণ ঘায়ে তারি।<br />আসে হেথায় বসন্ত আর কলেরা প্লেগ আদি,<br />ওই মেয়েটির প্রতি এদের কেউ নাহি হয় বাদী।<br />সে যেন গাঁর পূজার কুসুম, সকল অত্যাচার,<br />সাহস নাহি পায় ছুঁইতে চরণ দুটি তার।</p>
<br /><p>আছে গাঁয়ের নারদ-পিসী ক্ষান্ত মাসীর মাতা,<br />যাহার যত পোপন কিছু লিখছে ভরি খাতা।<br />আছে গাঁয়ে মোক্ষদা সে খ্যাংরামুখী বুড়ী;<br />মুখে কথার বজ্রশিলা ফিরছে ছুঁড়ি ছুঁড়ি।<br />ওই মেয়েটির জগৎ যেন তাদের হতে আর;<br />কিংবা তারা বুঝছে যে ও, নাগাল পাওয়ার বার।<br />ওই মেয়েটির চলন-চালন আর যে হাসি-খুশী,<br />কারো হাসি-খুশীর সনে হয়নি আজো দুষী।<br />এ গাঁয় প্রথম চাঁদ আসিয়া বসে শিমূল ডালে,<br />সোনা হাসির মুঠি মুঠি ছড়ায় উহার গালে।<br />সন্ধ্যা বেলায় যে রঙ ঝরে গাঁয়ের পুকুর জলে;<br />সেও হয়ত ওরির পায়ে আলতা মাখার ছলে।<br />গাঁয়ের মাঝে বামুন বাড়ি সকল বাড়ির সেরা;<br />চার ধারে তার নানান বরণ ফুল-বাগিচার বেড়া।<br />পাতায় পাতায় ফলের বাসা, ফুলের স্বপন মাঝে,<br />ফুলের চেয়েও ফুলেল সাজে বামুন বড়ি রাজে।</p>
<br /><p>তাদের ঘরে ঠাকুর আছে মন্ত্র পড়ি রোজ<br />তুলসী তামা গঙ্গাজলে দেয় যে পূজার ভোজ।<br />সেথায় জ্বলে হোমের আগুন, ঘন্টা কাঁসর বাজে,<br />তাহার মাঝে বামুন বাড়ির পূজার ঠাকুর রাজে।<br />বামুন পাড়ার স্বপন যেন ধূপের ধোঁয়ায় হেসে,<br />পূজারতির মন্ত্র সনে বেড়ায ভেসে বেসে।<br />হোমাগুনের গন্ধ ঝরে সারাটি গাও বেয়ে<br />তারি মতন দাঁড়িয়ে হাসে বামুন বাড়ির মেয়ে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/rakhaler-rajogi/রাখালের রাজগী2016-05-10T13:21:59-04:002023-06-26T16:24:17-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>রাখালের রাজা! আমাদের ফেলি কোথা গেলে ভাই চলে,<br />বুক হতে খুলি সোনা লতাগুলি কেন পায়ে দলে?<br />জানিতেই যদি পথের কুসুম পথেই হইবে বাসি,<br />কেন তারে ভাই! গলে পরেছিলে এতখানি ভালবাসি?<br />আমাদের দিন কেটে যাবে যদি গলেতে কাজের ফাঁসি<br />কেন শিখাইলে ধেনু চরাইতে বাজায়ে বাঁশের বাঁশী?<br />খেলিবার মাঠ লাঙল বাজায়ে চষিতেই যদি হবে,<br />গাঁয়ের রাখাল ডাকিয়া সেথায় রাজা হলে কেন তবে?</p>
<br /><p>তুমি চলে গেছ, শুধু কি আমরা তোমারি কাঙাল ভাই!<br />হারায়েছি গান, গোচরণ মাঠ, বাঁশের বাঁশরী তাই।<br />সোজাসুজি আজ উধাও চলিতে কোথা সে উধাও মাঠ,<br />গোখুর ধূলোয় চাঁদোয়া-টাঙানো কোথা সে গাঁয়ের বাট?<br />চরণ ফেলিতে চরণ চলে না শস্য-খেতের মানা,<br />খেলিবার মাঠে বড় জমকালো মিলেছে পাটের থানা।<br />গেঁয়ো শাখী আজ লুটায়ে পড়িছে কাঁচা পাকা ফল-ভারে,<br />তলে তলে তার মাঠের রাখাল হাট মিলাইতে নারে।<br />চষা মাঠে আজ লাঙল চলিতে জাগে না ভাটীর গান<br />সারা দিন খেটে অন্ন কুড়াই, তবু তাতে অকুলান।<br />ধানের গোলার গর্বেতে আজি ভরে না চাষীর বুক,<br />টিনের ঘরের আট-চালা বেঁধে রোদে জ্বলে পায় সুখ।<br />বাছের নায়েতে ছই দিয়ে চাষী পাটের বেপার করে,<br />দাবাড়ের গরু হালের খেতে যে জোয়াল বহিয়া মরে।<br />হেমন্ত নদী ঢেউ খেলেনাক সারীর গানের সুরে,<br />গরু-দৌড়ের মাঠখানি চাষী লাঙলেতে দেছে ফুঁড়ে।</p>
<br /><p>মনে পড়ে ঘর ছোনের ছাউনি, বেড়িয়া চালের বাতা,<br />কৃষাণ বধূর বুকখানি যেন লাউ এর লতায় পাতা।<br />তারি পাশে পাশে প্রতি সন্ধ্যায় মাটির প্রদীপ ধরি<br />কুমারী মেয়েরা আশিস মাগিত গ্রাম-দেবতারে স্মরি।</p>
<br /><p>আজকে সেখানে জ্বলে না প্রদীপ, বাজে না মাঠের গান,<br />ঘুমলী রাতের প্রহর গণিয়া জাগে না বিরহী প্রাণ।<br />শূনো বাড়িগুলো রয়েছে দাঁড়ায়ে, ফাটলে ফাটলে তার,<br />বুনো লতাগুলো জড়ায়ে জড়ায়ে গেঁথেছে বিরহ-হার।<br />উকুন যাহার গায়ে মারা যায়- থন থন করে তাজা,<br />এমন গরুরে পালিয়া কৃষাণ নিজেরে বনে না রাজা!<br />ধানের গোলার গর্ব ভুলেছে, ভুলেছে গায়ের বল,<br />চক্ষু বুজিয়া খুঁজিছে কোথায় টাকা বানানোর কল।</p>
<br /><p>সারাদিন ভরি শুধু কাজ কাজ আরও চাই আরও-আরও-<br />ক্ষুধিত মানুষ ছুটিছে উধাও, তৃষ্ণা মেটে না কারও।<br />পেটে নাই ভাত, মুখে নাই হাসি, রোগে হাড়খানা সার,<br />প্রেত-পুরি যেন নামিয়া এসেছে বাহিয়া নরক-দ্বার।<br />হাজার কৃষাণ কাঁদিছে অঝোরে কোথা তুমি মহারাজ?<br />ব্রজের আকাশ ফাড়িয়া ফাড়িয়া হাঁকিছে বিরহ-বাজ।<br />আমরা তোমারে রাজা করেছিনু পাতার মুকুট গড়ে,<br />ছিঁড়ে ফেলে তাহা মণির মুকুট পরিলে কেমন করে?<br />বাঁশরী বাজায়ে শাসন করেছ মানুষ-পশুর দল,<br />সুর শুনে তার উজান বহিত কালো যমুনার জল।<br />কোন প্রাণে সেই বাঁশের বাঁশরী ভেঙে এলি গেঁয়ো বাটে?<br />কার লোভে তুই রাজা হলি ভাই! মথুরার রাজপাটে?<br />বাঁশীর শাসন হেলায় সয়েছি, বুনো ফলে দিছি কর,<br />অসির শাসন কি দিয়ে সহিব, বেচিয়াছি বাড়ি ঘর;<br />হালের গরুরে নিলামে দিয়েও মিটাতে পারিনি ভুখ,<br />আধখানা ফলে পেট ভরে যেত- ভেবে ভেবে হয় দুখ;<br />এত পেয়ে তোর সাধমেটেনাক, দুনিয়া জুড়িয়া ক্ষুধা,<br />আমরা রাখাল মাঠের কাঙাল যোগাইব তারি সুধা!</p>
<br /><p>শোনরে কানাই! পষ্ট কহিছি, সহিব না মোরা আর,<br />সীমার বাহিরে সীমা আছে যদি, ধৈর্যেরো আছে বার।<br />ভাবিয়াছ ওই অসির শাসনে মোরা হয়ে জড়সড়,<br />নিজের ক্ষুধার অন্ন আনিয়া চরণে করিব জড়?</p>
<br /><p>বাঁশীর শাসন মেনেছি বলিয়া অসিও মানিতে হবে!<br />শুরু দেয়া-ডাকে কাজরী গেয়েছি, ঝড়েও গাহিব তবে?<br />বাঁশীর শাসন বুকে যেয়ে লাগে, নত হয়ে আসে শির,<br />অসির শাসনে মরাদেরো মাঝে জেগে ওঠে শত বীর।<br />ভাবিয়াছ, মোরা গাঁয়ের রাখাল, নাই কোন হাতিয়ার,<br />যে লাঙল পারে মাটিরে ফাড়িতে, ভাঙিতেও পারে ঘাড়।<br />ঝড়ের সঙ্গে লড়িয়াছি মোরা, বাদলের সাথে যুঝি,<br />বর্ষার সাথে মিতালী পাতায়ে সোনা ধান করি পুঁজি।<br />* * *<br />তবুও সেখানে প্রদীপ জ্বালাই ঘন আঁধারের কোলে,<br />আঁকড়িয়া আছি পল্লীর মাটি কোন্ ক্ষমতার বলে!<br />জনমিয়া যারা দুখের নদীতে শিখিয়াছে দিতে পাড়ি,<br />অসির শাসন তরিবে তাহারা যাক না দুদিন চারি।<br />পষ্ট করিয়া কহিছি কানাই, এখন সময় আছে,<br />গাঁয়ে ফিরে চল, নতুবা তোমায় কাঁদিতে হইবে পাছে।<br />জনম-দুখিনী পল্লী-যশোদা আশায় রয়েচে বাঁচি,<br />পাতায় পাতায় লতায় লতায় লতিয়ে স্নেহের সাজি।<br />হিয়াখানি তার হানা-বাড়ি সম ফাটলে ফাটলে কাঁদি<br />বক্ষে লয়েছে তোমারি বিরহ বনের লতায় বাঁধি।</p>
<br /><p>আঁধা পুকুরের পচা কালো জলে মুরছে কমল- রাধা,<br />কৃষাণ বধূরা সিনান করিতে শুনে যায় তারি কাঁদা।<br />বেনুবনে তুমি কবে বেঁধেছিলে তোমার বাঁশের বাঁশী,<br />দখিনা বাতাস আজিও তাহারে বাজাইয়া যায় আসি!<br />কোমল লতায় দোলনা বাঁধিয়া শাখীরা ডাকিছে সুরে,<br />আর কত কাল ভুলে রবি ভাই, পাষাণ মথুরা-পুরে?</p>
<br /><p>আমরা ত ভাই! ভেবে পাইনাক তোরি বা কেমন রীত,<br />একলা বসিয়া কেতাব লিখিস ভুলিয়া মাঠের গীত।<br />পুঁথিগুলো সব পোড়াইয়া ফ্যাল, দেখে গাও করে জ্বালা,<br />কেমনে কাটাস সারাদিন তুই লইয়া ইহার পালা?<br />ওরাই তো তোরে যাদু করিয়াছে, মোরা যদি হইতাম,<br />ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া বানাইয়া ঘুড়ির আকাশে উড়াইতাম!<br />রাজধানী যেরে পরদেশ তোর-ইট কাঠ দিয়ে ঘেরা,<br />ইট-কাঠ তাই আঁটঘাট বেঁধে মনেও কি দিলি বেড়া?</p>
<br /><p>এত ডাক ডাকি শুনে ন শুনিস, এমনি কঠিন হিয়া-<br />আমরা রাখাল ভাবিয়া না পাই- গলাইব কিবা দিয়া?<br />একেলা আমরা মাঠে মাঠে ফিরি, পথে পথে কেঁদে মরি,<br />আমাদের গান শোনে নারে কেউ, লয়নাক হাত ধরি।</p>
<br /><p>চল গাঁয়ে যাই, আঁকাবাঁকা পথ ধূলার দোলায় দোলে,<br />দুধারের খেত কাড়াকাড়ি করে তাহারে লইতে কোলে।<br />কদম্ব রেণু শিহরিয়া উঠে নতুন পাটল মেঘে,<br />তমালের বনে বিরহী রাধার ব্যথা-দেয়া যায় ডেকে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: ধানক্ষেত</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/purnima/পূর্ণিমা2016-05-10T09:34:32-04:002023-06-27T15:20:18-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>পূর্নিমাদের আবাস ছিল টেপাখোলার গাঁয়,<br />একধারে তার পদ্মনদী কলকলিয়ে যায়।<br />তিনধারেতে উধাও হাওয়া দুলতো মাঠের কোলে,<br />তৃণফুলের গন্ধে কভু পড়তো ঢলে ঢলে।<br />সেখান দিয়ে পুর্ণিমারা ফিরতো খেলে নিতি,<br />বাঁকাপথে বাজতো তাদের মুখর পায়ের গীতি।<br />পদ্মানদীর মাঝিরে কেউ ডাকত ছড়ার সুরে,<br />শিশুমুখের কাকলিতে গ্রামটি যেত ভরে।<br />সেদিন হঠাৎ পত্র এলো বাবার থেকে তার,<br />পূর্ণিমারা কলকাত্তা আসবে শনিবার।<br />গীতা কানু সবাই খুশী, ফিসফিসিয়ে কয়,<br />ট্রামের গাড়ী, মোটর গাড়ী কলিকাতাময়।<br />গড়গড়িয়ে গড়ের মাঠে যখন তখন যাব,<br />ইলেকট্রিকের কল টিপিলে যা চাব তা পাব।<br />হাওড়া পুলের উপর দিয়ে আসব হাওয়া খেয়ে,<br />গঙ্গানদী করব উথল মস্ত জাহাজ বেয়ে।<br />এসব কথায় সবাই খুশী, তবু যাবার দিন<br />ঘনিয়ে যত আসছে, কোথায় বাজছে ব্যথার বীণ।<br />বাবলা বনের যেখানটিতে হত পুতুল বিয়ে,<br />পূর্ণিমা যে ঘুরে বেড়ায় সেইখানটি দিয়ে।<br />শিকের উপর দুলছে আজো খেলার হাঁড়িগুলি,<br />দাঁড়কাকটি বসে আছে সেথায় ঠোকর তুলি।<br />চড়ুইভাতির চুলোগুলি তেমনি আছে পড়ে,<br />এখানটিতে খেলবে না আর আগের মতন করে।<br />পোষা বিড়াল কেন যে তার সঙ্গ নাহি ছাড়ে,<br />যদিও বুকে পিষছে তারে স্নেহের অত্যাচারে।<br />পূর্ণিমারা এসেছে আজ শহর কলিকাতা,<br />অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পেলেম তাদের পাতা।<br />শ্যামবাজারের বামধারেতে অন্ধগলির কোণে,<br />একতলা এক বন্ধ ঘরে থাকে অনেক জনে।<br />জানলা দিয়ে বয় না বাতাস, সারাটি ঘর ভরে,<br />ভ্যাঁপসামত গন্ধে সদাই দম আটকে ধরে।<br />ভাই-বোনেতে কদিন আগে জলবসন্ত হতে<br />ভাল হয়ে উঠেছে আজ এই তো কোনো মতে।<br />চোখ দুটি তার কোটরাগত, ফুলের মত মুখে<br />হাসির প্রদীপ জ্বলে না আর শিশুকালের সুখে।<br />কোথায় তাহার খেলাঘরটি, কোথায় খোলা মাঠ!<br />বাবলাশাখায় বাতাস যেথায় করতো ছড়া পাঠ।<br />বন্ধগলির অন্ধ কোণের কয়েদখানার ঘরে,<br />কোন্ দোষের সে বন্ধ হয় কোন্ অপরাদ করে?<br />কোন দস্যু করল হরণ আলো- বাতাস তার,<br />কে হরিল খেলার পুতুল নাচের নূপুর পার<br />কে হরিল ঝুমঝুমি তার শিশুহাতের থেকে,<br />ঊষার গায়ে কে দিলরে মেঘের কালি মেখে?<br />কোথায় আমার রাজার কুমার! শুয়ে মায়ের কোলে,<br />তোমার কি ঘুম ভাঙবে না এই শিশু-চোখের জলে।<br />শান্ত্রী সিপাই লয়ে এসো সপ্তা-ডিঙা করে,<br />আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠুক জয়ডঙ্কার স্বরে।<br />ভাঙতে হবে বন্ধগলি, রুদ্ধ ঘরের দ্বার-<br />ভাঙতে হবে লক্ষযুগের অন্ধ কারাগার।<br />এমন নগর গড়বে তুমি সকল কোণেই তার,<br />সমান হয়ে উদাস বাতাস বইবে অনিবার।<br />চন্দ্র-রবির সোনার প্রদীপ জ্বলবে সবার ঘরে,<br />সকল ঘরের পূর্ণিমাদের হাসিমুখের তরে।<br />সেই আলো কেউ বন্ধ করে রাখতে যদি চায়,<br />তাহার সাথে যুদ্ধ মোদের সকল দুনিয়ায়!</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/a-lady-with-a-lamp/এ লেডী উইথ এ ল্যাম্প2016-05-09T06:08:58-04:002023-06-27T15:52:31-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>গভীর রাতের কালে,<br />কুহেলী আঁধার মূর্ছিত প্রায় জড়ায়ে ঘুমের জালে।<br />হাসপাতালের নিবিয়াছে বাহি; দমকা হাওয়ার ঘায়,<br />শত মুমূর্ষু রোগীর কাঁদন শিহরিছে বেদনায়।<br />কে তুমি চলেছ সাবধান পদে বয়স-বৃদ্ধা-নারী!<br />দুই পাশে তব রুগ্ন-ক্লিন্ন শুয়ে আছে সারি সারি।<br />কাহার পাখাটি জোরে চলিতেছে, বালিশ সরেছে কার,<br />বৃষ্টির হাওয়া লেগেকার গায়ে শিয়রে খুলিয়া দ্বার!<br />ব্যান্ডেজ কার খুলিয়া গিয়াছে, কাহার চাই যে জল,<br />স্বপন দেখিয়া কেঁদে ওঠে কেবা, আঁখি দুটি ছল ছল।<br />এ সব খবর লইতে লইতে চলিয়াছ একাকিনী,<br />দুঃখের কোন সান্ত্বনা তুমি, বেদনায় বিষাদিনী।</p>
<br /><p>গভীর নিশীথে, অনেক ঊর্ধ্বে জ্বলিছে আকাশে তারা,<br />তোমার এ স্নেহ মমতার কাজ দেখিতে পাবে না তারা;<br />রাত-জাগা পাখি উড়িছে আকাশে, জানিবে না সন্ধান,<br />রাত জাগা ফুল ব্যস্ত বড়ই বাতাসে মিশাতে ঘ্রাণ।<br />তারা কেহ আজ জানিতে পাবে না, তাহাদেরি মত কেহ,<br />সারা নিশিজাগি বিলাইছে তার মায়েলী বুকের স্নেহ।<br />এই বিভাবরী বড়ই ক্লান্ত, বড়ই স্তব্ধতম<br />উতলা বাতাস জড়াইয়া কাঁদে আঁধিয়ার নির্মম।<br />মৃত্যু চলেছে এলায়িত কেশে ভয়াল বদন ঢাকি,<br />পরখ করিয়া কারে নিয়ে যাবে, কারে সে যাইবে রাখি।<br />মহামরণের প্রতীক্ষাতুর রোগীদের মাঝখানে,<br />মহীয়সী তুমি জননী মুরতি আসিলে কি সন্ধানে;<br />জীবন মৃত্যু মহা-রহস্য তুমি কি যাইবে খুলি,<br />ধরণীর কোন গোপন কুহেলী আজিকে লইবে তুলি।<br />যে বৃদ্ধ কাল সাক্ষ্য হইয়া আছে মানুষের সাথে,<br />তুমি কি তাহার বৃদ্ধা সাথিনী আসিয়াছ আজ রাতে?<br />নিখিল নরের আদিম জননী আজিকে তোমার বেশে,<br />রুগ্ন তাহার সন্তানদেরে দেখিয়া নিতেছ এসে।<br />নিরালা আমার শয্যার পাশে তোমার আঁচল-ছায়,<br />স্তব হয়ে আজ জড়ায়ে রহিতে বড় মোর সাধ যায়!</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/komola-rani/কমলা রাণী2016-05-09T06:05:31-04:002023-06-27T15:18:42-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>কমলা রাণীর দীঘি ছিল এইখানে,<br />ছোট ঢেউগুলি গলাগলি ধরি ছুটিত তটের পানে।<br />আধেক কলসী জলেতে ডুবায়ে পল্লী-বধূর দল,<br />কমলা রাণীর কাহিনী স্মরিতে আঁখি হত ছল ছল।<br />আজ সেই দীঘি শুকায়েছে, এর কর্দমাক্ত বুকে,<br />কঠিন পায়ের আঘাত হানিয়া গরুগুলি ঘাস টুকে।<br />জলহীন এই শুষ্ক দেশের তৃষিত জনের তরে।<br />কোন সে নৃপের পরাণ উঠিল করুণার জলে ভরে।<br />সে করুণা ধারা মাটির পাত্রে ভরিয়া দেখার তরে,<br />সাগর দীঘির মহা কল্পনা জাগিল মনের ঘরে।</p>
<br /><p>লক্ষ কোদালী হইল পাগল, কঠিন মাটিরে খুঁড়ি,<br />উঠিল না হায় কল-জল-ধারা গহন পাতাল ফুঁড়ি।<br />দাও, জল দাও, কাঁদে শিশু মার শুষ্ক কন্ঠ ধরি,<br />ঘরে ঘরে কাঁদে শূন্য কলসী বাতাসে বক্ষ ভরি।<br />লক্ষ কোদালী আরো জোরে চলে, কঠিন মাটির থেকে,<br />শুষ্ক বালুর ধূলি উড়ে বায় উপহাস যেন হেঁকে।</p>
<br /><p>কোথায় রয়েছে ভাট ব্রাক্ষণ, কোথায় গণক দল,<br />জলদী করিয়া গুনে দেখ কেন দীঘিতে ওঠে না জল?<br />আকাশ হইতে গুণিয়া দেখিও শত-তারা আঁখি দিয়া,<br />পাতালে গুণিও বাসকি-ফণার মণি-দীপ জ্বালাইয়া।<br />ঈশানে গুণিও ঈশানী গলের নর-মুন্ডের সনে,<br />দক্ষিনে গুনো, শাহ মান্দার যেথা সুন্দর বনে।<br />আকাশ গণিল, পাতাল গণিল, গলিল দশটি দিক,<br />দীঘিতে কেন যে জল ওঠেনাক বলিতে নারিল ঠিক।</p>
<br /><p>নিশির শয়নে জোড়মন্দিরে স্বপন দেখিছে রাণী,<br />কে যেন আসিয়া শুনাইল তারে বড় নিদারুণ বানী;<br />সাগর দীঘিতে তুমি যদি রাণী! দিতে পার প্রাণদান,<br />পাতল হইতে শত ধারা-মেলি জাগিবে জলের বান।<br />স্বপন দেখিয়া জাগিল যে রাণী, পূর্বের গগন-গায়,<br />রক্ত লেপিয়া দাঁড়াইল রবি সুদূরের কিনারায়।<br />শোন শোন ওহে পরাণের পতি ছাড় গো আমার মায়া,<br />উড়ে চলে যায় আকাশের পাখি পড়ে রয় শুধু ছায়া।</p>
<br /><p>পেটরা খুলিয়া তুলে নিল রাণী অষ্ট অলঙ্কার,<br />রাসমন্ডল শাড়ীর লহরে দেহটি জড়াল তার।<br />কৌটা খুলিয়া সিঁদুর তুলিয়া পরিল কপাল ভরি,<br />দুর্গা প্রতিমা সাজিল বুঝি বা দশমীর বাঁশী স্মরি।<br />ধীরে ধীরে রাণী দাঁড়াইল আসি সাগর দীঘির মাঝে,<br />লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী শুকনো তটের কাছে।<br />পাতাল হইতে শতধারা মেলি নাচিয়া আসিল জল,<br />রাণীর দুখানা চরণে পড়িয়া হেসে ওঠে খল খল।<br />খাড়ু জলে রাণী খুলিয়া ফেলিল পায়ের নুপূর তার,<br />কোমর জলেতে ছিড়িল যে রাণী কোমরে চন্দ্রহার।<br />বুক-জলে রাণী কন্ঠে হইতে গজমতি হার খুলে,<br />কোরের ছেলেটি জয়ধর কোথা দেখে রাণী আঁখি তুলে।<br />গলাজলে রাণী খোঁপা হতে তার ভাসাল চাঁপার ফুল।<br />চারিধার হতে কল-জলধারা ভরিল দীঘির কূল।<br />সেই ধারা সনে মিশে গেল রাণী আর আসিল না ফিরে,<br />লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী আকাশ বাতাস ঘিরে।<br />***<br />কমলা রানীর এই সেই দীঘি, কার অভিশাপে আজ,<br />খুলিয়া ফেলেছে অঙ্গ হইতে জল-কুমুদীর সাজ।<br />পাড়ে পাড়ে আজ আছাড়ি পড়ে না চঞ্চল ঢেউদল,<br />পল্লী-বধূর কলসীর ঘায়ে দোলে না ইহার জল।<br />কমলা রাণীর কাহিনী এখন নাহিক কাহারো মনে,<br />রাখালের বাঁশী হয় না করুণ নিশীথ উদাস বনে।<br />শুধু এই গাঁর নূতন বধূরে বরিয়া আনিতে ঘরে,<br />পল্লীবাসীরা বরণ কুলাটি রেখে যায় এর পরে।<br />গভীর রাত্রে সেই কুলাখানি মাথায় করিয়া নাকি,<br />আলেয়ার মত কে এক রূপসী হেসে ওঠে থাকি থাকি।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/khandan/খানদান2016-05-09T06:04:08-04:002023-06-26T16:10:04-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>ওধারের বেডে আসিল বালক, মটরের ধাক্কায়,<br />ক্ষতবিক্ষত, রক্তমাখান কচি তার দেহটায়।<br />চিৎকার করি কাঁদিত কেবল, আম্মাগো কোথা গেলে,<br />একেলা যে আমি থাকিতে পারি না তোমারে কাছে না পেলে?<br />কাঁচা মুখখানি মমতা জড়ানো, জননী স্নেহের ভরে,<br />যে-চুমায় তারে জাগায়েছে ভোরে আছে তা অধর ভরে।<br />ঘায়েতে তাহার ওষুধ মাখাতে, চীৎকারি কেঁদে ওঠে,<br />মায়ের আগেতে নালিশ জানায়, বোঝে না কিছুই মোটে।<br />আম্মাগো, তুই কোথা গেলি আজ, ওরা যে আমারে মারে,<br />ক্ষতবিক্ষত অঙ্গে আমার ব্যথা দেয় বারে বারে।<br />আমি বাড়ি যাব- আমি বাড়ি যাব, তোরে শুধু কাছে পেলে,<br />সব যন্ত্রণা জুড়াইবে মাগো তোর বুকে বুকে মেলে।</p>
<br /><p>সারাদিন ভরি কতই সে কাঁদে, বড় ভাই তার আসে,<br />অশ্রুসিক্ত নয়নে বসিয়া রহে বিছানার পাশে।<br />ডাকিয়া সেদিন বলিলাম তারে, মায়েরে সঙ্গে করে,<br />আনেন না কেন? সারাদিন খোকা কাঁদে যে তাহার তরে।<br />ম্লান হাসি হেসে কহিল ভাইটি, আমরা যে খানদান,<br />আমাদের মেয়ে হেথায় আসিলে ভীষণ অসম্মান।<br />রাতের বেলায় সকল বেডের রোগীরা ঘুমায়ে পড়ে,<br />খোকাটি কেবল চীৎকারি কাঁদে মায়েরে তাহার স্মরে।<br />প্রহরের পর প্রহর চলেছে, আম্মাগো কাছে আয়,<br />এত ডাক ডাকি তবু না আসিস আমার যে জান যায়।<br />প্রহরের পর প্রহর চলেছে, আম্মাগো, মোর ঘুড়ি,<br />পূবের ঘরেতে রেখে দিস যেন কেউ নাহি করে চুরি।<br />মারবল আর পেন্সিল দুটো, কখানা টুকরো কাঁচ,<br />সাবধানে তুই রাখিস যেন না কেউ পায় তার আঁচ।<br />প্রহরের পর প্রহর চলেছে, আম্মাগো, কাছে আয়,<br />কে যেন আমারে ধরিতে আসিছে ভীষণ চেহারা হায়,<br />আম্মাগো কারা আমারে মারিছে। প্রহর চলেছে বেয়ে,<br />কাঁদিছে উতল রাতের পবন বড় যেন ব্যথা পেয়ে।</p>
<br /><p>আমি দেখিতেছি বেঘুম শয়নে, সুদূর হেরেম কোণে,<br />জাগিছে জননী, নিশির প্রদীপ জাগিছে তাহার সনে।<br />জাগিছে জননী, রাত-জাগা পাখি, রহিয়া রহিয়া জাগে,<br />রাত কুসুমের উদাস গন্ধ চিরিতেছে বুকটাকে।<br />জাগিছে জননী, দুই হাতে যদি পারিত ছিড়িয়া দিতে,<br />ছেলে হতে তার কোন ব্যবধান রাখিত না ধরনীতে।<br />পরদা প্রথার যে মিথ্যা আজি দুলালের তার হায়,<br />এমনি করিয়া করেছে পৃথক ভাঙিত সে আজি তায়।</p>
<br /><p>আহারে মায়ের দীরঘ নিশাস কোথায় নাহিক লাগে,<br />ঘুরিয়া ঘুরিয়া আপনারি বুকে আরও ব্যথা হয়ে দাগে।<br />ধীরে ধীরে দীপ নিবিয়া আসিল ম্লান হয়ে এল আলো,<br />নিবিড় নীরব নিথর পাথারে জড়ালো রাতের কালো।</p>
<br /><p>সব অভিযোগ ব্যথাতুর সেই বালকের মুখ হতে,<br />ধীরে ধীরে ধীরে ভেসে গেল কোন মহানীরবতা স্রোতে।<br />কোথা সেই স্বর থামিল যাইয়া, বহু বহুযুগ আগে-<br />যারা মরিয়াছে কঠিন পীড়নে সমাজনীতির দাগে;<br />যারা সহিয়াছে সহস্র ব্যথা ভাষাহীন বেদনায়,<br />মূক বালকের বেদনা মিলিল সে মহা নীরবতায়।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/joler-konya/জলের কন্যা2016-05-09T06:02:23-04:002023-06-27T10:42:29-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>জলের উপরে চলেছে জলের মেয়ে,<br />ভাঙিয়া টুটিয়া আছড়িয়া পড়ে ঢেউগুলি তটে যেয়ে।<br />জলের রঙের শাড়ীতে তাহার জড়ায়ে জড়ায়ে ঘুরি,<br />মাতাল বাতাস অঙ্গের ঘ্রাণ ফিরিছে করিয়া চুরি।<br />কাজলে মেখেছে নতুন চরের সবুজ ধানের কায়া,<br />নয়নে ভরেছে ফটিকজলের গহন গভীর মায়া।<br />তাহার উপর ছায়া-চুরি খেলা করিতে তটের বন,<br />সুবাস ফুলের গন্ধ ছড়ায়ে হাসিতেছে সারাখন।</p>
<br /><p>জলের কন্যা চলেছে জলের রথে,<br />খুশীতে ফুটিয়া শাপলা-পদ্ম হাসিতেছে পথে পথে।<br />আগে আগে চলে কলজলধারা ভাসায়ে পানার তরী,<br />চরণে তাহার আলতা পরাতে হিজল পড়িছে ঝরি।<br />ডাহুক ডাহুকী ডাকে বন-পথে নতুন পানির সুরে,<br />কোঁড়া আজ তার কুঁড়ীরে খুঁজিছে ঘন পাট-ক্ষেতে দূরে;<br />পুরাতন জালে তালি দিতে দিতে ঢলিয়া জেলের গায়,<br />জেলে বোর মন মিহিসুরী গানে উজানীর বাঁকে ধায়।<br />পল্লীবধূরা উদাস নয়নে চেয়ে থাকে তটপানে,<br />বাপের বাড়ির মমতায় আজ পরাণ কেন যে টানে।<br />বাঙড়ের খালে সিনান করিতে কলসী ধরিয়া টানি,<br />মায়েরে কহিছে মেয়ের কথাটি নয়া-জোয়ারের পানি!</p>
<br /><p>হোগরার ছই নতুন বাঁধিয়া গাব-জলে মাজা নায়,<br />বাপ চলিয়াছে মেয়েরে আনিতে সুদূরের ভিন গাঁয়।<br />বৈঠার ঘায়ে গলা জলে-ডোবা নাচিছে আমন ধান,<br />কলমির লতা জড়াইয়া তারে ফুলহাসি করে দান!<br />ঢ্যাপের মোয়ার চিত্রিত হাঁড়ি আবার ভরিয়া যায়,<br />পিঠায় আঁকিয়া নতুন নকশা রাত ভোর করে মায়।</p>
<br /><p>জলের কন্যা চলেছে জলের পরে,<br />মাছেরা চলছে দলে দলে আজ পথটি তাহার ধরে।<br />রুহিত লাফায়, চিতল ফালায়, ভাটা মাছ সারি সারি,<br />সাথে সাথে যায় আগে পিছে ধায় খুশী যেন ওরা তারি।<br />শোল মাছ তার শিশুপোনাগুলি ছড়ায়ে লেজের ঘায়,<br />টুবটুব করে আদরিয়া পুন জড়াইছে বুক-ছায়;<br />নকসী কাঁথাটি মেলিয়া ধরিয়া গুমরে চাষার নারী,<br />সযতনে যেন গুটায়ে ধরিছে বুকের নিকটে তারি।<br />জলঘাসগুলি ঈষৎ কাঁপিছে তাদের চলার দোলে,<br />মৃদুল বাতাসে ঝুমিতেছে বন জলের দুনিয়া কোলে।</p>
<br /><p>জলের কন্যা যায়,<br />নতুন পানির লিখন বহিয়া বন্ধ বিলের ছায়।<br />তটের বক্ষে আছাড়িয়া মাথা ক্ষতবিক্ষত করি,<br />বন্দী-মাছেরা কাটাইত দিন জীয়নে- যেন মরি।<br />অঙ্গ ভরিয়া শ্যাওলা জড়ান নির্জীব ঘুম-দোলে,<br />রোগ-পান্ডুর অসাড় দেহ যে পড়িতে চাহিছে ঢলে।<br />আজিকে নতুন জল-কল্লোল শুনিতে পেয়েছে তারা,<br />সহসা অঙ্গে হিল্লোলি ওঠে উধাও গতির ধারা!<br />কে যেন ঘোষিছে তাহাদের কানে সহস্র দিক হতে,<br />ভাঙ্ ভাঙ্ কারা ভাঙ্ ভাঙ্ পাড় উদ্দাম জলস্রোতে।</p>
<br /><p>জলের কন্যা জল-পথ দিয়ে যায়,<br />বকের ছানারা পাখার আড়াল রচিছে তাহার গায়।<br />দুইধারে ঘন কেয়ার কুঞ্জ ছড়ায় সুবাস-রেণু<br />মাতাল বাতাস রহিয়া রহিয়া চুমিছে বনের বেনু।<br />তটে তটে কাঁদে শূন্য কলসী, কুটীরের দীপ ডাকে,<br />আঙিনার বেলী মাটিতে লুটায়, কে কুড়ায়ে লবে তাকে?</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/banor-juth/বানর যুথ2016-05-09T06:00:41-04:002023-06-25T04:53:02-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>গহন বনের মাঝে,<br />বুড়ো বটগাছ শিকড়ে- বাকলে জড়ায়েছে নানা সাজে।<br />জীর্ণ শীর্ণ বুকের পাঁজর গিয়াছে হইয়া ফাঁক,<br />তাহার মধ্যে বাসা বাঁধিয়াছে কোকিল শালিক কাক।<br />সাপের খোলস ঝুলে আছে কোথা, কোথাও শুকনো ডাল,<br />মহাযোগী বট ধ্যানে নিমগ্ন কত যুগ কত কাল।</p>
<br /><p>সেদিন প্রভাতে বেড়াতে বেড়াতে হেরিলাম তার তলে,<br />বানরের দল ঘুমায়ে রয়েছে ধরিয়া এওর গলে।<br />কোন বা জননী, সন্তান মুখে চুমু দিয়ে দিয়ে আর,<br />সাধ মেটেনাক, নানাভাবে তারে আদরিছে বারবার!<br />কোন বা জননী ঘুমায়ে নিঝুম, সন্তানগুলি উঠে,<br />স্বেচ্ছায় দুধ করিতেছে পান মার স্তন হতে লুটে।<br />কোন বা দুষ্ট সন্তান তার চোখে ঘুমন্ত মার,<br />আঙ্গুল মাতা হয়ত এখনো স্বপ্ন জড়িত চোখে,<br />ছেলেদের তরে কোন সুখ-নীড় আঁকিছে বা আশা-লোকে।<br />কোন কোন মাতা ছোট ছেলেটিরে জাগায়ে দিতেছে মাই,<br />আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদে হিংসায় পাশে তার বড় ভাই।<br />মাঘের প্রভাত, কনকনে হাওয়া বহিতেছে শীত করি,<br />শুয়ে আছে ওরা আদরে সোহাগে কাছাকাছি জড়াজড়ি<br />স্নেহ মমতার এমন দৃশ্য নির্জনে আঁকি আর<br />শত ফুল আঁখি মেলিয়া ইহারে দেখিতেছে বারবার।<br />প্রভাতের রবি আসিতে আসিতে থেমে যায় পথ ধারে;<br />কুয়াশা চাদরে রশ্মিরে ঢাকি রাখে যতখন পারে।<br />বন তার শাখা-বাহু বাড়াইয়া দিনেরে আড়াল করে,<br />যিশুর জননী এখানে আসিয়া দাঁড়াক গাছের তলে,<br />বৃন্দাবনের যশোদা আসুক গোপাল লইয়া কোলে;<br />ফাতেমা জননী আসুক বুকেতে হাসান হোসেন টানি;<br />দেখে যাক এই নির্জন বনে মমতার ছবিখানি।</p>
<br /><p>ধীরে ধীরে ধীরে কুয়াশা আঁধার মুছিল রবির গায়,<br />বিহগ কুসুম সহস্রসুরে ফুটিল বনের ছায়।<br />গাছের পাতায় ফাঁকা পথ দিয়ে রবির আলোর ঢেলা;<br />ঘুমন্ত এই স্নেহপুরী মাঝে জুড়িল নিঠুর খেলা।<br />ধীরে ধীরে তারা জাগিয়া উঠিল, ছেলেরে স্কন্ধে করি,<br />আহারের খোঁজে চলিল জননী শাখাপথগুলি ধরি।<br />চলে দম্পতি ডাল হতে ডালে হতে ধরি পাকা ফল,<br />এ ওরে খাওয়ায় গান করে আর নেচে ফেরে চঞ্চল।<br />বৃদ্ধ এ বট, শূণ্য বুকেতে কত কি যে কথা ভরে,<br />উতলা বাতাসে কারে কি কহিছে বুঝি ফিস ফিস করে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/aj-amer-moneta-ta-na-manera/আজ আমার মনে ত না মানেরে2016-05-09T05:57:43-04:002023-06-27T17:14:36-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আজ আমার মনে ত না মানেরে<br />সোনার চান,<br />বাতাসে পাতিয়া বুকরে<br />শুনি আকাশের গান।<br />আজ নদীতে উঠিয়া ঢেউ আমার কূলে আইসা লাগে,<br />রাতের তারার সাথে ঘরের প্রদীপ জাগেরে।<br />চান্দের উপর বসাইয়ারে যেবা গড়ছে চান্দের বাসা,<br />আজ দীঘিতে শাপলা ফুটে তারির লয়ে আশারে।<br />উড়িয়া যায় হংসরে পঙ্খী, যায়রে বহুত দূর,<br />আজ তরলা বাঁশের বাঁশী টানে সেই সুররে।<br />আজ কাঙ্খের কলসী ধইরারে কান্দে যমুনার জল,<br />শিমূলের তুলা লয়ে বাতাস পাগলরে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/are-o-rongila-nayer-majhi/আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি2016-05-09T05:56:11-04:002023-06-27T13:43:15-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি।<br />তুমি এই ঘাটে লাগায়ারে নাও<br />লিগুম কথা কইয়া যাও শুনি।<br />তোমার ভাইটাল সুরের সাথে সাথে কান্দে গাঙের পানি,<br />ও তার ঢেউ লাগিয়া যায় ভাসিয়া কাঙ্খের কলসখানি।<br />পূবালী বাতাসে তোমার নায়ের বাদাম ওড়ে,<br />আমার শাড়ীর অঞ্চল ধৈরয না ধরে।<br />তোমার নি পরাণরে মাঝি হারিয়াছে কেউ;<br />কলসী ভাসায়া জলে গণেছ নি ঢেউ।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/ujan-ganger-naiya/উজান গাঙের নাইয়া2016-05-09T05:54:45-04:002023-06-27T19:40:24-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>উজান গাঙের নাইয়া!<br />কইবার নি পাররে নদী<br />গেছে কতদূর?<br />যে কূল ধইরা চলেরে নদী<br />সে কূল ভাইঙ্গা যায়,<br />আবার আলসে ঘুমায়া পড়ে<br />সেই কূলেরি গায়;<br />আমার ভাঙা কূলে ভাসাই তরীরে<br />যদি পাই দেখা বন্ধুর।<br />নদীর পানি শুনছি নাকি<br />সায়র পানে ধায়,<br />আমার চোখের পানি মিলব যায়া<br />কোন সে দরিয়ায়<br />সেই অজানা পারের লাইগারে<br />আমার কান্দে ভাটির সুর।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/o-amar-gohin-ganger-naya/ও আমার গহিন গাঙের নায়া2016-05-09T05:53:29-04:002023-06-26T13:48:51-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>ও আমার গহিন গাঙের নায়া,<br />ও তুমি অফর বেলায় লাও বায়া যাওরে-<br />কার পানে বা চায়া।<br />ভাটির দ্যাশের কাজল মায়ায়,<br />পরাণডা মোর কাইন্দা বেড়ায়রে-<br />আবছা মেঘে হাতছানি দ্যায়,<br />কে জানি মোর সয়া।</p>
<br /><p>এই না গাঙের আগের বাঁকে<br />আমার বধূর দ্যাশ;<br />কলাবনের বাউরি বাতাস<br />দোলায় মাথার ক্যাশ;<br />কওই খবর তাহার লাইগা,<br />কাইন্দা মরে এক অভাইগারে;<br />ও তার ব্যথার দেয়া থাইকা থাইকা<br />ঝরে নয়ন বায়া।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/o-tui-jare-aghat-hanlire/ও তুই যারে আঘাত হানলিরে মনে সেজন2016-05-09T05:52:08-04:002023-06-27T17:45:53-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>ও তুই যারে আঘাত হানলিরে মনে সেজন কি তোর পর,<br />সে ত তোরি তরে কেন্দে কেন্দে বেড়ায় দেশান্তর;<br />রে বন্ধু!<br />তোরি তরে সাজাইলাম বন-ফুলের ঘর,<br />রে বন্ধু মন-ফুলের ঘর,<br />ও তুই ভোমর হয়া হানলি কাঁটা সেই না ফুলের পর;<br />রে বন্ধু!<br />এক ঘরেতে লাগলে আগুন পোড়ে অনেক ঘর,<br />মনের আগুন মনই পোড়ায়-নাই কোন দোসর;<br />রে বন্ধু!<br />আগে যদি জানতামরে তোর রূপে আগুর জ্বলে,<br />আমি রূপ থুইয়া আগুনের মালা পরতাম নিজ গলে,<br />রে বন্ধু!<br />চিতার অনলে ঝাঁপ দেই যেই জন,<br />ও তার দেহও পোড়ে, মনও পোড়ে, পোড়ে তার ক্রন্দন;<br />রে বন্ধু!<br />রূপের আগুন মনেই লাগে, লাগে না কার গায়,<br />ও সে মনে মনেই মন জ্বালা কেউ না জানে হায়,<br />রে বন্ধু!<br />তীর যদি বেন্ধে গায়ে, তাও তো তোলন যায়,<br />ও তোর কথার আঘাত কোথায় লাগে কেউ নাহি টের পায়;<br />রে বন্ধু!</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/o-mohon-bashi/ও মোহন বাঁশী2016-05-09T05:49:02-04:002023-06-27T05:50:36-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>ও মোহন বাঁশী!<br />বাজাও বাজাওরে কানাই!<br />ধীরে অতি ধীরে;<br />আমি জল আনিতে যমুনাতে,<br />ও বাঁশী শুনব ফিরে ফিরেরে কানাই!<br />ধীরে অতি ধীরে।<br />কলসী ভরার ছলে,<br />তোমার ছায়া দেখব জলেরে কানাই!<br />আমি হারায়ে পায়ের নূপুর,<br />ও ঘরে নাহি যাব ফিরেরে কানাই।<br />ধীরে অতি ধীরে।</p>
<br /><p>তোমার বাঁশীর স্বরে<br />যদি কলসীর জল নড়েরে,<br />তারে ঘুম পাড়াবরে,<br />কাঁকণ বাজাইয়া করেরে কানাই!<br />আমি কেমনে মানাব আমার<br />নয়নের নীরের কানাই!<br />ধীরে অতি ধীরে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/bashori-amar-haraye-giyechhe/বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়েছে2016-05-09T05:47:20-04:002023-06-26T20:30:42-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়েছে<br />বালুর চরে,<br />কেমনে ফিরিব গোধন লইয়া<br />গাঁয়ের ঘরে।</p>
<br /><p>কোমল তৃণের পরশ লাগিয়া,<br />পায়ের নুপুর পড়িয়াছে খসিয়া।<br />চলিতে চরণ ওঠে না বাজিয়া<br />তেমন করে।</p>
<br /><p>কোথায় খেলার সাথীরা আমার<br />কোথায় ধেনু,<br />সাঝেঁর হিয়ায় রাঙিয়া উঠিছে<br />গোখুর-রেণু।</p>
<br /><p>ফোটা সরিষার পাঁপড়ির ভরে<br />চরো মাঠখানি কাঁপে থরে থরে।<br />সাঁঝের শিশির দুচরণ ধরে<br />কাঁদিয়া ঝরে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ:রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/jabo-ami-tomar-deshe/যাব আমি তোমার দেশে2016-05-08T14:23:25-04:002023-11-06T16:29:09-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>পল্লী-দুলাল, যাব আমি-যাব আমি তোমার দেশে,<br />আকাশ যাহার বনের শীষে দিক-হারা মাঠ চরণ ঘেঁষে।<br />দূর দেশীয়া মেঘ-কনেরা মাথায় লয়ে জলের ঝারি,<br />দাঁড়ায় যাহার কোলটি ঘেঁষে বিজলী-পেড়ে আঁচল নাড়ি।<br />বেতস কেয়ার মাথায় যেথায় ডাহুক ডাকে বনের ছায়ায়,<br />পল্লী-দুলাল ভাইগো আমার, যাব আমি যাব সেথায়।</p>
<br /><p>তোমার দেশে যাব আমি, দিঘল বাঁকা পন্থখানি,<br />ধান কাউনের খেতের ভেতর সরু সূতোর আঁচল টানি;<br />গিয়াছে হে হাবা মেয়ের এলোমাথার সিঁথীর মত<br />কোথাও সিধে, কোথায় বাঁকা, গরুর পায়ের রেখায় ক্ষত;<br />গাজনতলির মাঠ পেরিয়ে, শিমূলতলীর বনের বাঁয়ে,<br />কোথাও গায়ে রোদ মাখিয়া, ঘুম-ঘুমায়ে গাছের ছায়ে।<br />তাহার পরে মুঠি মুঠি ছড়িয়ে দিয়ে কদম-কলি,<br />কোথাও মেলে বনের লতা গ্রাম্য মেয়ে যায় যে চলি;<br />সে পথ দিয়ে যাব আমি পল্লী-দুলাল তোমার দেশে,<br />নাম-না জানা ফুলের সুবাস বাতাসেতে আসবে ভেসে।</p>
<br /><p>তোমার দেশে যাব আমি, পাড়ার যত দস্যি ছেলে,<br />তাদের সাথে দল বাঁধিয়া হেথায় সেথায় ফিরব খেলে।<br />থল-দীঘিতে সাঁতার কেটে আনব তুলে রক্ত-কমল,<br />শাপলা লতায় জড়িয়ে চরণ ঢেউ এর সাথে খাব যে দোল।<br />হিজল ঝরা জলের সাথে গায়ের বরণ রঙিন হবে,<br />দীঘির জলে খেলবে লহর মোদের লীলাকালোসবে।</p>
<br /><p>তোমার দেশে যাব আমি পল্লী-দুলাল ভাইগো সোনার,<br />সেথায় পথে ফেলতে চরণ লাগবে পরশ এই মাটি-মার!<br />ডাকব সেথা পাখির ডাকে, ভাব করিব শাখীর সনে,<br />অজান ফুলের রূপ দেখিয়া মানব তারে বিয়ের কনে;<br />চলতে পথে ময়না কাঁটায় উত্তরীয় জড়িয়ে যাবে,<br />অঢেল মাটির হোঁচট লেগে আঁচল হতে ফুল ছড়াবে।</p>
<br /><p>পল্লী-দুলাল, যাব আমি-যাব আমি তোমার দেশে,<br />তোমার কাঁধে হাত রাখিয়া-ফিরবো মোরা উদাস বেশে।<br />বনের পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখব মোরা সাঁঝ বাগানে,<br />ফুল ফুটেছে হাজার রঙের মেঘ তুলিকার নিখুঁত টানে।<br />গাছের শাখা দুলিয়ে আমি পাড়ব সে ফুল মনের আশে,<br />উত্তরীয় ছড়িয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো বনের পাশে।</p>
<br /><p>যে ঘাটেতে ভরবে কলস গাঁয়ের বিভোল পল্লীবালা,<br />সেই ঘাটেরি এক ধারেতে আসবো রেখে ফুলের মালা;<br />দীঘির জলে ঘট বুড়াতে পথে পাওয়া মালাখানি,<br />কুড়িয়ে নিয়ে ভাববে ইহা রাখিয়া গেছে কেউ না জানি।<br />চেনে না তার হাতের মালা হয়তবা সে পরবে গলে,<br />আমরা দুজন থাকব বসে ঢেউ দোলা সেই দীঘির কোলে।<br />চার পাশেতে বনের সারি এলিয়ে শাখার কুন্তল-ভার,<br />দীঘির জলে ঢেউ গণিবে ফুল শুঁকিবে পদ্ম-পাতার।<br />বনের মাঝে ডাকবে ডাহুক, ফিরবে ঘুঘু আপন বাসে,<br />দিনের পিদিম ঢুলবে ঘুমে রাত-জাগা কোন্ ফুলের বাসে।<br />চার ধারেতে বন জুড়িয়া রাতের আঁধার বাঁধবে বেড়া,<br />সেই কুহেলীর কালো কারায় দীঘির জলও পড়বে ঘেরা।<br />সেই আঁধারে পাখায় ধরে চামচিকারা উচ্চে উঠি,<br />দিকে দিকে দিগনে-রে ছড়িয়ে দেবে মুঠি মুঠি।<br />তখন সেথা থাকবে না কেউ, সুদূর বনের গহন কোণে,<br />কানাকুয়া ডাকবে শুধু পহরের পর পহর গণে।<br />সেই নিরালার বুকটি চিরে পল্লী দুলাল আমরা দুজন,<br />পল্লীমায়ের রূপটি যে কি, করব মোরা তার অন্বেষণ।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: ধান ক্ষেত</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/alap/আলাপ2016-05-08T14:19:46-04:002023-06-27T07:33:36-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>ঘুমপাড়ানী ঘুমের দেশে ঘুমিয়ে দুটি আঁখি,<br />মুখেতে তার কে দিয়েছে চাঁদের হাসি মাখি।<br />পা মেজেছে চাঁদের চুমোয়, হাতের ঘুঠোয় চাঁদ,<br />ঠোঁট দুটিতে হাসির নদীর ভাঙবে বুঝি বাঁধ।<br />মাথায় কালো চুলের লহর পড়ছে এসে মুখে,<br />ঝাঁকে ঝাঁকে ভোমর যেন উড়ছে ফুলের বুকে।</p>
<br /><p>এই খুকীটির সঙ্গে আমার আলাপ যদি হয়,<br />সাগর-পারের ঝিনুক হয়ে ভাসব সাগরময় ;<br />রঙিন পাখির পালক হয়ে ঝরব বালুর চরে,<br />শঙ্খমোতির মালা হয়ে দুলব টেউএর পরে।<br />তবে আমি ছড়ার সুরে ছড়িয়ে যাব বায়,<br />তবে আমি মালা হয়ে জড়াব তার গায়।</p>
<br /><p>এই খুকীটি আমায় যদি একটু আদর করে,<br />একটি ছোট কথা শোনায় ভালবাসায় ভরে ;<br />তবে আমি বেগুন গাছে টুনটুনীদের ঘরে,<br />যত নাচন ছড়িয়ে আছে আনব হরণ করে :<br />তবে আমি রুপকথারি রুপের নদী দিয়ে,<br />চলে যাব সাত-সাগরে রতন মানিক নিয়ে ;<br />তবে আমি আদর হয়ে জড়াব্ তার গায়,<br />নুপুর হয়ে ঝুমুর ঝুমুর বাজব দুটি পায়।</p>
<br /><p> কাব্যগ্রন্থ: হাসু</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/polatoka/পলাতকা2016-05-08T14:18:24-04:002023-06-26T05:33:14-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>হাসু বলে একটি খুকু আজ যে কোথা পালিয়ে গেছে-<br />না জানি কোন অজান দেশে কে তাহারে ভুলিয়ে নেছে।<br />বন হতে সে পলিয়ে গেছে, বনে কাঁদে বনের লতা,<br />ফুল ফুটে কয় সোনার খুকু! ছেড়ে গেলি মোদের কোথা?<br />বনের শাখা দুলিয়ে পাতা-করত বাতাস তাহার গায়ে।<br />তাহার শাড়ীর আঁচল লাগি ঝুমকো লতা দুলত বনে,<br />গাছে গাছে ফুল নাচিত তাহার পদধ্বনির সনে।</p>
<br /><p>বনের পথে ডাকত পাখি, তাদের সুরের ভঙ্গী করে-<br />কচি মুখের মিষ্টি ডাকে সারাটি বন ফেলত ভরে।<br />প্রতিধ্বনি তাহার সনে করত খেলা পালিয়ে দূরে,<br />সুরে সুরে খুঁজত সে তার বনের পথে একলা ঘুরে।<br />সেই হাসু আজ পালিয়ে গেছে, পাখির ডাকের দোসর নাহি,<br />প্রতিধ্বনি আর ফেরে না তাহার সুরের নকল গাহি।</p>
<br /><p>হাসু নামের একটি খুকু পালিয়ে গেছে অনেক দূরে,<br />কেউ জানে না কোথায় গেছে কোন্ বা দেশে কোন্ বা পুরে।<br />বাপ জানে না, মায় জানে না কোথায় সে যে পালিয়ে গেছে,<br />সেও জানে না, কোন সুদূরে কে তাহারে সঙ্গে নেছে।<br />কোনোখানে কেউ ভাবে না, কেউ কাঁদে না তাহার তরে,<br />কেউ চাহে না পথের পানে, কখন হাসু ফিরবে ঘরে।<br />মায় কাঁদে না, বাপ কাঁদে না, ভাই-বোনেরা কাঁদছে না তার,<br />খেলার সাথী কেউ জানে না, সে কখনও ফিরবে না আর।<br />ফিরবে না সে, ফিরবে নারে, খেলা ঘরের ছায়ার তলে,<br />মিলবে না সে আর আসিয়া তার বয়সের শিশুর দলে।<br />পেয়ারা-ডালে দোলনা খালি, ইঁদুরে তার কাটছে রশি,<br />চোড়ুই ভাতির হাঁড়ির পরে কাক দুটি আজ ডাকছে রশি,<br />খেলনাগুলি ধূলায় পড়ে, হাত-ভাঙা কার, পা ভাঙা কার,<br />ঝুমঝুমিটি বেহাত হয়ে বাজছে হাতে যাহার তাহার।<br />এসব খবর কেউ জানে না, সে জানে না, কেমন করে<br />কখন যে সে পালিয়ে গেলে তাহার চিরজনম তরে।<br />জানে তাহার পুতলগুলো অনাদরে ধুলায় লুটায়,<br />বুকে করে আর না চুমে, পুতুল-খেলার সেই ছোট মায়।<br />মাতৃ হারা মিনি-বিড়াল কেবা তাহার দুঃখ বুঝে,<br />কেঁদে কেঁদে বেড়ায় সে তার ছোট্ট মায়ের আঁচল খুঁজে।<br />খেলা ঘর আজ পড়ছে ভেঙে, শিশু কল-তানের সনে,<br />পুতুল বধূ আর সাজে না পুতুল-বরের বিয়ের কনে।</p>
<br /><p>হাসু নামের সোনার খুকু আজ যে কোথা পালিয়ে গেছে,<br />সাত-সাগরের অপর পারে কে তাহারে ভুলিয়ে নেছে।<br />পালিয়ে গেছে সোনার হাসুঃ- খেলার সাথী আয়রে ভাই-<br />আজের মত শেষ খেলাটি এইখানেতে খেলে যাই।<br />সেখানটিতে খেলেছিলাম ভাঁড়-কাটি সঙ্গে নিয়ে,<br />সেইখানটি দে রুধে ভাই ময়না কাঁটা পুতে দিয়ে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: হাসু(১৯৩৮)</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/putul/পুতুল2016-05-08T14:13:22-04:002023-06-25T04:52:57-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>পুতুল, তুমি পুতুল ওগো ! কাদের খেলা-ঘরের ছোট খুকু,<br />কাদের ঘরের ময়না পাখি ! সোহাগ-করা কাদের আদরটুকু।<br />কার আঁচলের মানিক তুমি। কার চোখেতে কাজললতা হয়ে,<br />এসেছ এই সোনার দেশে রামধনুকের রঙের হাসি লয়ে।<br />ভোর বেলাকার শিশির তুমি, কে রেখেছে শিউলী ফুলের পরে,<br />খোকা-ভোরের হাসিখানি কে রেকেছে পদ্মপাতায় ধরে।</p>
<br /><p>পুতুল! তুমি মাটির পুতুল! নানাজনের স্নেহের অত্যাচার,<br />হাসিমুখে সইতে পার আপন পরের তাই ধার না ধার।<br />তাই ত তুমি পুতুল লয়ে সারাটা দিন খেলাও খেলাঘরে,<br />তুমি পুতুল, তাই ত পুতুল খেলার সাথী তোমার স্নেহের বরে।</p>
<br /><p>পুতুল! আমার সোনার পুতুল! আমি পুতুল হব তোমার বরে,<br />তুমি হবে আমার পুতুল সারাটা দিন কাটবে আদর করে।<br />তোমায় আমি চাঁদ বলিব, জোছনা দিয়ে মুছিয়ে দিও মুখ,<br />তোমায় আমি বলব মানিক, মালা হয়ে জুড়িয়ে দিও বুক।<br />তুমি আমার উদয়-তারা, হাতে পায়ে জ্বলবে সোনার ফুল,<br />তুমি আমার রূপের সাগর রূপকথা যার খুঁজে না পায় কূল।<br />আমি তোমার কি হব ভাই? পুতুল! আমার রাঙা পুতুল-খুকু,<br />ঘুমপাড়ানী মাসী-পিসীর ঘুমের দেশের ঘুমানীটুকু।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: হাসু (১৯৩৮)</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/bosiruddi-machh-dhorite-jay/বছিরদ্দি মাছ ধরিতে যায়2016-05-08T14:10:01-04:002023-06-25T19:00:07-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>রাত দুপুর মেঘে মেঘে কড়াৎ কড়াৎ শব্দ যখন হয়,<br />দুই নখেতে আঁধার চিরি বিজলী যখন জ্বলে ভুবনময়;<br />তুফান ছোটে জোর দাপটে, বৃষ্টি পড়ে মেঘের ঝাঁজর ঝরে,<br />বছিরদ্দির ঘুম ভেঙে যায়-মুহূর্ত সে রইতে নারে ঘরে।<br />বিলের জলে টাইটুবানি রোহিত কাতল মাছেরা দেয় ফাল,<br />কই মাগুরের দলসাঁতারে আঁকাবাকাঁ ধরি গাঁয়ের খাল,</p>
<br /><p>এমন সময় বছিরদ্দি একহাতেতে তীক্ষ্ম টেটা ধরে,<br />আর এক হাতে মশাল জ্বালি বীর দাপটে ছোটে মাটের পরে।<br />বুড়ীর ভিটায় বেড়াল ডাকে, তাল-তলাতে গলায় দড়ি দিয়ে,<br />মরেছিল তাঁতীর বধূ- এ সবে তার কাঁপায় নাক হিয়ে।<br />শেওড়া বনে পেত্নী নাচে, হাজরাতলায় পিশাচে দেয় শিস,<br />বিলের ধারে আগুন জ্বালি ভূতেরা সব ফিরছে নানান দিশ।<br />ভয় নাহি তার কারও কাছে, রাতের আঁধার মশাল দিয়ে ঠেলে,<br />একলা চলে বছিরদ্দি জোর দাপটে চরণ দুখান ফেলে।<br />হাতে তাহার তীক্ষ্ম টেটা, গায়ে তাহার মোষের মত জোর,<br />চোখ দুটিতে উল্কা জ্বলে যমদূতেরও দেখে লাগে ঘোর।</p>
<br /><p>রাত দুপুরে বিলের পথে বছিরদ্দি মাছ মারিতে যায়-<br />দূর হতে তার মশাল জ্বলে ধকো ধকো রাতের কালো ছায়।<br />বৃষ্টি-শীলা মাথায় পড়ে, তুফান চলে ক্ষিপ্ত ঘোড়ার মত,<br />রয়ে রয়ে বিজলী জ্বলে ইন্দ্র ডাকে আঁধার করি ক্ষত;<br />শ্মাশান-ঘাটায় পেত্নী নাচে, বটের শাখে পিশাচ দোলা খায়,<br />রাত দুপুরে বিলের পথে বছিরদ্দি মাছ ধরিতে যায়।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: হাসু (১৯৩৮)</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nodir-kul-nai-kinar-naire/নদীর কূল নাই-কিনার নাইরে2016-05-08T13:47:45-04:002023-06-26T19:12:35-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>নদীর কূল নাই-কিনার নাইরে;<br />আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাব<br />কাহারে শুধাইরে?<br />ওপারে মেঘের ঘটা, কনক বিজলী ছটা,<br />মাঝে নদী বহে সাঁই সাঁইরে;<br />আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি<br />আবার দেখি নাইরে;<br />আমি দেখিতে দেখিতে সে রূপ<br />আবার দেখি নাইরে।</p>
<br /><p>বেসম নদীর পানি, ঢেউ করে হানাহানি,<br />ভাঙা এ তরনী তবু বাইরে,<br />আমার অকূলের কূল দয়াল বন্ধুর<br />যদি দেখা পাইরে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/amer-bindhu-binodiaria/আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে2016-05-08T13:36:13-04:002023-06-27T15:49:27-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে<br />প্রাণ বিনোদিয়া;<br />আমি আর কতকাল রইব আমার<br />মনেরে বুঝাইয়ারে;<br />প্রাণ বিনোদিয়া।<br />কি ছিলাম, কি হইলাম সইরে, কি রূপ হেরিয়া,<br />আমি নিজেই যাহা বুঝলাম না সই, কি কব বুঝাইয়ারে;<br />প্রাণ বিনোদিয়া।<br />চোখে তারে দেখলাম সইরে! পুড়ল তবু হিয়া,<br />আমার নয়নে লাগিলে আনল নিবাইতাম কাঁদিয়ারে;<br />প্রাণ বিনোদিয়া।<br />মরিব মরিব সইরে যাইব মরিয়া,<br />আমার সোনা বন্ধুর রূপ দিও গরলে গুলিয়ারে;<br />প্রাণ বিনোদিয়া।<br />আগে যদি জানতাম বন্ধু যাইবা ছাড়িয়া,<br />আমি ছাপাইয়া রাখতাম তোমার পাঁজর চিরিয়ারে;<br />প্রাণ বিনোদিয়া।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/bastu-tyegi/বাস্তু ত্যাগী2016-05-08T13:27:47-04:002023-06-25T04:52:57-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>দেউলে দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারীরে খোঁজ করি,<br />মন্দিরে আজ বাজেনাকো শাঁখ সন্ধ্যা-সকাল ভরি।<br />তুলসীতলা সে জঙ্গলে ভরা, সোনার প্রদীপ লয়ে,<br />রচে না প্রণাম গাঁয়ের রূপসী মঙ্গল কথা কয়ে।<br />হাজরাতলায় শেয়ালের বাসা, শেওড়া গাছের গোড়ে,<br />সিঁদুর মাখান, সেই স্থান আজি বুনো শুয়োরেরা কোড়ে।<br />আঙিনার ফুর কুড়াইয়া কেউ যতনে গাঁথে না মালা,<br />ভোরের শিশিরে কাঁদিছে পুজার দুর্বাশীষের থালা।<br />দোল-মঞ্চ যে ফাটিলে ফাটিছে, ঝুলনের দোলাখানি,<br />ইঁদুরে কেটেছে, নাটমঞ্চের উড়েছে চালের ছানি।</p>
<br /><p>কাক-চোখ জল পদ্মদীঘিতে কবে কোন রাঙা মেয়ে,<br />আলতা ছোপান চরণ দুখানি মেলেছিল ঘাটে যেয়ে।<br />সেই রাঙা রঙ ভোলে নাই দীঘি, হিজলের ফুল বুকে,<br />মাখাইয়া সেই রঙিন পায়েরে রাখিয়াছে জলে টুকে।<br />আজি ঢেউহীন অপলক চোখে করিতেছে তাহা ধ্যান,<br />ঘন-বন-তলে বিহগ কন্ঠে জাগে তার স্তব গান।<br />এই দীঘি-জলে সাঁতার খেলিতে ফিরে এসো গাঁর মেয়ে,<br />কলমি-লতা যে ফুটাইবে ফুল তোমারে নিকটে পেয়ে।<br />ঘুঘুরা কাঁদিছে উহু উহু করি, ডাহুকেরা ডাক ছাড়ি,<br />গুমরায় বন সবুজ শাড়ীরে দীঘল নিশাসে ফাড়ি।</p>
<br /><p>ফিরে এসো যারা গাঁও ছেড়ে গেছো, তরুলতিকার বাঁধে,<br />তোমাদের কত অতীত-দিনের মায়া ও মমতা কাঁদে।<br />সুপারির বন শুন্যে ছিঁড়িছে দীঘল মাথার কেশ,<br />নারকেল তরু উর্ধ্বে খুঁজিছে তোমাদের উদ্দেশ।<br />বুনো পাখিগুলি এডালে ওডালে, কইরে কইরে কাঁদে,<br />দীঘল রজনী খন্ডিত হয় পোষা কুকুরের নামে।</p>
<br /><p>কার মায়া পেয়ে ছাড়িলে , এদেশ, শস্যের থালা ভরি,<br />অন্নপূর্ণা আজো যে জাগিছে তোমাদের কথা স্মরি।<br />আঁকাবাঁকা রাকা শত নদীপথে ডিঙি তরীর পাখি,<br />তোমাদের পিতা-পিতামহদের আদরিয়া বুকে রাখি ;<br />কত নমহীন অথই সাগরে যুঝিয়া ঝড়ের সনে,<br />লক্ষীর ঝাঁপি লুটিয়া এনেছে তোমাদের গেহ-কোণে।<br />আজি কি তোমরা শুনিতে পাও না সে নদীর কলগীতি,<br />দেখিতে পাও না ঢেউএর আখরে লিখিত মনের প্রীতি ?</p>
<br /><p>হিন্দু-মুসলমানের এ দেশ, এ দেশের গাঁয়ে কবি,<br />কত কাহিনীর সোনার সুত্রে গেঁথেছে সে রাঙা ছবি।<br />এদেশ কাহারো হবে না একার, যতখানি ভালোবাসা,<br />যতখানি ত্যাগ যে দেবে, হেথায় পাবে ততখানি বাসা।<br />বেহুলার শোকে কাঁদিয়াছি মোরা, গংকিনী নদীসোঁতে,<br />কত কাহিনীর ভেলায় ভাসিয়া গেছি দেশে দেশ হতে।<br />এমাম হোসেন, সকিনার শোকে ভেসেছে হলুদপাটা,<br />রাধিকার পার নুপুরে মুখর আমাদের পার-ঘাটা।</p>
<br /><p>অতীতে হয়ত কিছু ব্যথা দেছি পেয়ে বা কিছুটা ব্যথা,<br />আজকের দিনে ভুলে যাও ভাই, সে সব অতীত কথা।<br />এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, নুতন দৃষ্টি দিয়ে,<br />নুতন রাষ্ট্র গুড়িব আমরা তোমাদের সাথে নিয়ে।<br />ভাঙ্গা ইস্কুল আবার গড়িব, ফিরে এসো মাস্টার।<br />হুঙ্কারে ভাই তাড়াইয়া দিব কালি অজ্ঞানতার।<br />বনের ছায়ায় গাছের তলায় শীতল স্নেহের নীড়ে,<br />খুঁজিয়া পাইব হারাইয়া যাওয়া আদরের ভাইটিরে ।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/rojoni-gondhar-biday/রজনী গন্ধার বিদায়2016-05-08T13:25:35-04:002023-06-25T04:52:56-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>শেষ রাত্রের পান্ডুর চাঁদ নামিছে চক্রবালে,<br />রজনী গন্ধা রূপসীর আঁখি জড়াইছে ঘুম-জালে।<br />অলস চরণে চলিতে চলিতে ঢলিয়া ঢলিয়া পড়ে,<br />শিথিল শ্রানি- চুমিছে তাহার সারাটি অঙ্গ ধরে!<br />উতল কেশেরে খেলা দিতে শেষ উতল রাতের বায়ু:<br />ঘুমাতে ঘুমাতে কাঁপিয়া উঠিছে স্মরিয়া রাতের আয়ু।<br />রজনী- গন্ধা রাতের রূপসী ঝুমিছে শ্রানি-ভরে,<br />অঙ্গ হইতে ঝরিছে কুসুম একটি একটি করে।</p>
<br /><p>শিয়রে চাঁদের দীপটি ঝুমিয়া হইয়া আসিছে ম্লান,<br />রাত-বিহগীর কন্ঠে এখন মৃদু হোয়ে এল গান।<br />পূর্ব তোরণে আসিছে রুপসী রঙিন উষসী-বালা,<br />হসে- লইয়া রাঙা দিবসের অফুট কুসুম-ডালা।<br />রজনী-গন্ধা ঘুমায় আলসে শিথিল দেহটি তার,<br />লুটাইয়া পড়ে বৃন্তশয়নে স্বপন নদীর পার।</p>
<br /><p>ভুবন ভোলানো মরি মরি ঘুম- অপরূপ, অপরূপ!<br />বিধাতা বুঝিবা ধ্যান করিতেছে যুগ যুগ রহি চুপ!<br />এ রূপ মহিমা সহিতে পারে না ভোরের রূপসী ঊষা;<br />রজনী ফুলের অঙ্গ হইতে হরিয়া লইছে ভূষা!</p>
<br /><p>শাড়ীতে তাহার তারা ফুলগুলি দলিয়া পিষিছে পায়ে,<br />ভেঙেছে রাতের পাখির বাঁশরী উদাস বনের বায়ে!<br />শিয়রে চাঁদের মণি দীপ-খানি থাপড়ে নিবায়ে দিল,<br />অঙ্গ হইতে শিশির ফোঁটার গহনা কাড়িয়া নিল।<br />থামিল বনের ঝিঁঝির কন্ঠে ঘুম পাড়ানিয়া সুর,<br />জোনাকী পরীরা দীপগুলি লয়ে চলিল গহনা-পুর।<br />মৃত আত্মারা কবরে লুকাল, মহা রহস্য তার,<br />আঁচলে জড়ায়ে ধীরে ধীরে ধীরে রজনী রুধিল দ্বার।</p>
<br /><p>চারিদিকে নব আলোকের জয় ; চিরপরিচিত সব,<br />মহা-কোলাহলে আরম্ভ হলো দিনের মহোৎসব।<br />এখন শুধুই লোক জানাজানি মুখ চেনাচিনি আর,<br />দেনা-পাওনার হিসাব করিয়া ‘বানিয়া খুলিল দ্বার।</p>
<br /><p>কোথায় ঘুমাল রজনী-গন্ধা কিবা রহস্য-জাল,<br />সারারাতি তারে জড়াইয়াছিল ? কে শোনে সে জঞ্জাল।<br />রাতের রজনী-গন্ধা ঘুমায়, চির বিস্মৃতি-পুরে-<br />তবু রয়ে রয়ে কি করণ বাঁশী বেজে ওঠে বহুদুরে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/raater-pori/রাতের পরী2016-05-08T13:23:41-04:002023-06-27T07:22:40-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>রাতের বেলায় আসে যে রাতের পরী,<br />রজনীগন্ধা ফুলের গন্ধে সকল বাতাস ভরি।<br />চরণের ঘায়ে রাতের প্রদীপ নিভিয়া নিভিয়া যায়,<br />হাসপাতালের ঘর ভরিয়াছে চাঁদিমার জোছনায়।</p>
<br /><p>মানস সরের তীর হতে যেন ধবল বলাকা আসে,<br />ধবল পাখায় ঘুম ভরে আনে ধবল ফুলের বাসে।<br />নয়ন ভরিয়া আনে সে মদিরা, সুদূর সাগর পারে,<br />ধবল দ্বীপের বালু-বেলাতটে শঙ্খ ছড়ায় ভারে।<br />তাহাদেরি সাথে লক্ষ বছর ঘুমাইয়া নিরালায়,<br />ধবল বালুর স্বপন আনিয়া মাখিয়াছে সারা গায়।<br />আজ ঘুম ভেঙে আসিয়াছে হেথা, দেহ লাবনীর পরে,<br />কত না কামনা ডুবিছে ভাসিছে আপন খুশীর ভরে।<br />বসনে তাহার একে একে আসি আকাশের তারাগুলি,<br />জ্বলিছে নিবিছে আপনার মনে রাতের বাতাসে দুলি।</p>
<br /><p>রাতের বেলায় আসে যে রাতের পরী<br />চরণে বাজিছে ঝিঁঝির নূপুর দোলে ধরা মরি মরি!<br />তাহারি দোলায় বনপথে পথে ফুটিছে জোনাকী ফুল,<br />রাত-জাগা পাখি রহিয়া রহিয়া ছড়ায় গানের ভুল!<br />তারি তালে তালে স্বপনের পরী ঘুমের দুয়ার খুলে,<br />রামধনু রাঙা সোনা দেশেতে ডেকে যায় হাত তুলে।<br />হলুদ মেঘের দোলায় দুলিয়া হলদে রাজার মেয়ে,<br />তার পাছে পাছে হলুদ ছড়ায়ে চলে যায় গান গেয়ে।</p>
<br /><p>রাতের বেলায় ঝুমিছে রাতের পরী,<br />মোহ মদিরার জড়াইছে ঘুম সোনার অঙ্গ ভরি।<br />চেয়ারের গায়ে এলাইল দেহ খানিক শ্রানি-ভরে,<br />কেশের ছায়ায় মায়া ঘনায়েছে অধর লাবনী পরে।<br />যেন লুবানের ধূঁয়ার আড়ালে মোমের বাতির রেখা,<br />কবরের পামে জ্বালাইয়া কেবা রচিতেছে কোন লেখা।<br />পাশে মুমূর্ষু রোগীর প্রদীপ নিবু নিবু হয়ে আসে,<br />উতল বাতাস ঘুরিয়া ফিরিয়া কাঁদিছে দ্বারের পাশে।<br />মরণের দূত আসিতে আসিতে থমকিয়া থেমে যায়,<br />শিথিল হস্ত হতে তরবারি লুটায় পথের গায়।<br />যুক্ত করেতে রচি অঞ্জলি বার বার ক্ষমা মাগে,<br />রাত্রের পরী মেলি দেহভার ঝিমায় ঘুমের রাগে।</p>
<br /><p>ভোরের শিশির পদ্ম পাতায় রচিয়া শীতল চুম,<br />তাহার দুইটি নয়ন হইতে মুছাইয়া দিবে ঘুম।<br />রক্তোৎপল হইতে সিদুর মানাইতে তার ঠোঁটে,<br />শুক-তারকার সোনার তরনী দীঘির জলে যে লোটে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/desh/দেশ2016-05-08T13:22:00-04:002023-06-27T19:01:54-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>খেতের পরে খেত চলেছে, খেতের নাহি শেষ<br />সবুজ হাওয়ায় দুলছে ও কার এলো মাথার কেশ।<br />সেই কেশেতে গয়না পরায় প্রজাপতির ঝাঁক,<br />চঞ্চুতে জল ছিটায় সেথা কালো কালো কাক।<br />সাদা সাদা বক-কনেরা রচে সেথায় মালা,<br />শরৎকালের শিশির সেথা জ্বালায় মানিক আলা।<br />তারি মায়ায় থোকা থোকা দোলে ধানের ছড়া;<br />মার আঁচলের পরশ যেন সকল অভাব-হরা।<br />সেই ফসলে আসমানীদের নেইকো অধিকার,<br />জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে হাহাকার।</p>
<br /><p>বনের পরে বন চলেছে বনের নাহি শেষ,<br />ফুলের ফলের সুবাস ভরা এ কোন্ পরীর দেশ?<br />নিবিড় ছায়ায় আঁধার করা পাতার পারাবার,<br />রবির আলো খণ্ড হয়ে নাচছে পায়ে তার।<br />সুবাস ফুলের বুনোট করা বনের লিপিখানি,<br />ডালের থেকে ডালের পরে ফিরছে পাখি টানি।<br />কচি কচি বনের পাতা কাঁপছে তারি সুরে,<br />ছোট ছোট রোদের গুঁড়ো তলায় নাচে ঘুরে,<br />মাথার পরে কালো কালো মেঘরা এসে ভেড়ে<br />বুনো হাতির দল এসেছে আকাশখানি ছেড়ে।<br />এই বনেতে আসমানীদের নেইকো অধিকার,<br />জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে অনাহার।</p>
<br /><p>নদীর পরে নদী গেছে নদীর নাহি শেষ,<br />কত অজান গাঁ পেরিয়ে কত না-জান দেশ।<br />সাত সাগরের পণ্য চলে সওদাগরের নায়,<br />সুধার ধারা গড়িয়ে পড়ে গঞ্জ নগর ছায়।<br />চখায় মুখর বালুর চরা হাসে কতই তীরে,<br />ফুলের বনে রঙিন হয়ে যায় বা কভু ধীরে;<br />কত মিনার-সৌধ চূড়ার কোল ঘেঁষিয়া যায়,<br />কত শহর হাট-বন্দর বাজার ফেলে বায়।<br />কত নায়ের ভাটিয়ালীর গানে উদাস হয়ে,<br />নদীর পরে নদী চলে কোন অজানায় বয়ে।<br />সেই নদীতে আসমানীদের নেইকো অধিকার,<br />জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে হাহাকার।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/tarabi/তারাবি2016-05-08T13:19:16-04:002024-01-28T13:01:59-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ,<br />মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ।<br />চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া,<br />ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া।<br />তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে,<br />চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লুন্ঠন-বাতি জ্বেলে।<br />ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।<br />মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।</p>
<br /><p>গইজদ্দীন গরু ছেড়ে দিয়ে খাওয়ায়েছে মোর ধান,<br />ইচ্ছা করিছে থাপপড় মারি, ধরি তার দুটো কান।<br />তবু তার পাশে বসিয়া নামাজ পড়িতে আজিকে হবে,<br />আল্লার ঘরে ছোটোখাটো কথা কেবা মনে রাখে কবে!<br />মৈজদ্দীন মামলায় মোরে করিয়াছে ছারেখার,<br />টুটি টিপে তারে মারিতাম পেলে পথে কভু দেখা তার।<br />আজকে জামাতে নির্ভয়ে সে যে বসিবে আমার পাশে,<br />তাহারো ভালর তরে মোনাজাত করিব যে উচ্ছাসে।<br />মাহে রমজান আসিয়াছে বাঁকা রোজার চাঁদের ন্যায়,<br />কাইজা ফেসাদ সব ভুলে যাব আজি তার মহিমায়।<br />ভুমুরদি কোথা, কাছা ছাল্লাম আম্বিয়া পুঁথি খুলে,<br />মোর রসুলের কাহিনী তাহার কন্ঠে উঠুক দুলে।<br />মেরহাজে সেই চলেছেন নবী, জুমজুমে করি স্নান,<br />অঙ্গে পরেছে জোছনা নিছনি আদমের পিরহান।<br />নুহু আলায়হুছালামের টুপী পরেছেন নবী শিরে,<br />ইবরাহিমের জরির পাগরী রহিয়াছে তাহা ঘিরে।<br />হাতে বাঁধা তার কোরান-তাবিজ জৈতুন হার গলে,<br />শত রবিশশী একত্র হয়ে উঠিয়াছে যেন জ্বলে।<br />বুরহাকে চড়ে চলেছেন নবী কন্ঠে কলেমা পড়ি,<br />দুগ্ধধবল দূর আকাশের ছায়াপথ রেখা ধরি।<br />আদম ছুরাত বামধারে ফেলি চলে নবী দূরপানে,<br />গ্রহ-তারকার লেখারেখাহীন ছায়া মায়া আসমানে।</p>
<br /><p>তারপর সেই চৌঠা আকাশ, সেইখানে খাড়া হয়ে,<br />মোনাজাত করে আখেরী নবীজী দুহাত উর্ধ্বে লয়ে।<br />এই যে কাহিনী শুনিতে শুনিতে মোল্লা বাড়ির ঘরে,<br />মহিমায় ঘেরা অতীত দিনেরে টানিয়া আনিব ধরে।</p>
<br /><p>বচন মোল্লা কোথায় আজিকে সরু সুরে পুঁথি পড়ি,<br />মোর রসুলের ওফাত কাহিনী দিক সে বয়ান করি।<br />বিমারের ঘোরে অস্থির নবী, তাঁহার বুকের পরে,<br />আজরাল এসে আসন লভিল জান কবজের তরে।<br />আধ অচেতন হজরত কহে, এসেছ দোস্ত মোর,<br />বুঝিলাম আজ মোর জীবনের নিশি হয়ে গেছে ভোর<br />একটুখানিক তবুও বিমল করিবারে হবে ভাই!<br />এ জীবনে কোন ঋণ যদি থাকে শোধ করে তাহা যাই।<br />***<br />***<br />মাটির ধরায় লুটায় নবীজী, ঘিরিয়া তাহার লাশ,<br />মদিনার লোক থাপড়িয়া বুক করে সবে হাহুতাশ।<br />আব্বাগো বলি, কাঁদে মা ফাতিমা লুটায়ে মাটির পরে,<br />আকাশ ধরনী গলাগলি তার সঙ্গে রোদন করে।<br />এক ক্রন্দন দেখেছি আমরা বেহেস্ত হতে হায়,<br />হাওয়া ও আদম নির্বাসিত যে হয়েছিল ধরাছায়;<br />যিশু-জননীর কাঁদন দেখেছি ভেসে-র পায়া ধরে,<br />ক্রুশ বিদ্ধ সে ক্ষতবিক্ষত বেটার বেদন স্মরে।<br />আরেক কাঁদন দেখেছি আমরা নির্বাসী হাজেরার,<br />জমিনের পরে শেওলা জমেছে অশ্রু ধারায় তার;<br />সবার কাঁদন একত্রে কেউ পারে যদি মিশাবার,<br />ফাতিমা মায়ের কাঁদনের সাথে তুলনা মেলে না তার।</p>
<br /><p>আসমান যেন ভাঙ্গিয়া পড়িল তাহার মাথায় হায়,<br />আব্বা বলিতে আদরিয়া কেবা ডাকিয়া লইবে তায়।<br />গলেতে সোনার হারটি দেখিয়া কে বলিবে ডেকে আর,<br />নবীর কনের কন্ঠে মাতাগো এটি নহে শোভাদার।<br />সেই বাপজান জনমের মত গিয়াছে তাহার ছাড়ি।<br />কোন সে সুদূর গহন আঁধার মরণ নদীর পাড়ি।<br />জজিরাতুল সে আরবের রাজা, কিসের অভাব তার,<br />তবু ভুখা আছে চার পাঁচদিন, মুছাফির এলো দ্বার।<br />কি তাহারে দিবে খাইবারে নবী, ফাতেমার দ্বারে এসে;<br />চারিটি খোরমা ধার দিবে মাগো কহে এসে দীন বেশে।<br />সে মাহভিখারী জনমের মত ছাড়িয়া গিয়াছে তায়,<br />আব্বাগো বলি এত ডাক ডাকে উত্তর নাহি হায়।<br />এলাইয়া বেশ লুটাইয়া কেশ মরুর ধূলোর পরে,<br />কাঁদে মা ফাতেমা, কাঁদনে তাহার খোদার আরশ নড়ে।<br />কাঁদনে তাহার ছদন সেখের বয়ান ভিজিয়া যায়,<br />গৈজদ্দীন পিতৃ-বিয়োগ পুন যেন উথলায়!<br />খৈমুদ্দীন মামলায় যারে করে ছিল ছারেখার,<br />সে কাঁদিছে আজ ফাতিমার শোকে গলাটি ধরিয়া তার।<br />মোল্লাবাড়ির দলিজায় আজি সুরা ইয়াসিন পড়ি,<br />কোন দরবেশ সুদূর আরবে এনেছে হেথায় ধরি।<br />হনু তনু ছমু কমুরে আজিকে লাগিছে নূতন হেন,<br />আবুবক্কর ওমর তারেখ ওরাই এসেছে যেন।<br />সকলে আসিয়া জামাতে দাঁড়াল, কন্ঠে কালাম পড়ি,<br />হয়ত নবীজী দাঁড়াল পিছনে ওদেরি কাতার ধরি।<br />ওদের মাথার শত তালী দেওয়া ময়লা টুপীর পরে,<br />দাঁড়াইল খোদা আরশ কুরছি ক্ষনেক ত্যাজ্য করে।</p>
<br /><p>***</p>
<br /><p>মোল্লাবাড়িতে তারাবি নামাজ হয় না এখন আর,<br />বুড়ো মোল্লাজি কবে মারা গেছে, সকলই অন্ধকার।<br />ছেলেরা তাহার সুদূর শহরে বড় বড় কাজ করে,<br />বড় বড় কাজে বড় বড় নাম খেতাবে পকেট ভরে।<br />সুদূর গাঁয়ের কি বা ধারে ধার, তারাবি জামাতে হায়,<br />মোমের বাতিটি জ্বলিত, তাহা যে নিবেছে অবহেলায়।<br />বচন মোল্লা যক্ষ্মা রোগেতে যুঝিয়া বছর চার,<br />বিনা ঔষধে চিকিৎসাহীন নিবেছে জীবন তার।<br />গভীর রাত্রে ঝাউবনে নাকি কন্ঠে রাখিয়া হায়,<br />হোসেন শহিদ পুঁথিখানি সে যে সুর করে গেয়ে যায়।<br />ভুমুরদি সেই অনাহারে থেকে লভিল শূলের ব্যথা,<br />চীৎকার করি আছাড়ি পিছাড়ি ঘুরিতে যে যথা তথা।<br />তারপর সেই অসহ্য জ্বালা সহিতে না পেরে হায়,<br />গলে দড়ি দিয়ে পেয়েছে শানি- আম্রগাছের ছায়।<br />কাছা ছাল্লাম পুঁথিখানি আজো রয়েছে রেহেল পরে,<br />ইদুরে তাহার পাতাগুলি হায় কেটেছে আধেক করে।<br />লঙ্কর আজ বৃদ্ধ হয়েছে, চলে লাঠিভর দিয়ে,<br />হনু তনু তারা ঘুমায়েছে গায়ে গোরের কাফন নিয়ে।</p>
<br /><p>সারা গ্রামখানি থম থম করে স্তব্ধ নিরালা রাতে;<br />বনের পাখিরা আছাড়িয়া কাঁদে উতলা বায়ুর সাথে।<br />কিসে কি হইল, কি পাইয়া হায় কি আমরা হারালাম,<br />তারি আফসোস শিহরি শিহরি কাঁপিতেছে সারা গ্রাম।<br />ঝিঁঝিরা ডাকিছে সহস্র সুরে, এ মূক মাটির ব্যথা,<br />জোনাকী আলোয় ছড়ায়ে চলিছে বন-পথে যথা তথা।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/bostir-meye/বস্তীর মেয়ে2016-05-08T13:14:08-04:002023-06-26T11:22:36-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>বস্তীর বোন, তোমারে আজিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে,<br />যত দূরে যাব তোমাদের কথা চিরদিন মনে রবে।<br />মনে রবে, সেই ভ্যাঁপসা গন্ধ অন্ধ-গলির মাঝে,<br />আমার সে ছোট বোনটির দিন কাটিছে মলিন সাজে।<br />পেটভরা সে যে পায় না আহার, পরনে ছিন্নবাস,<br />দারুণ দৈন্য অভাবের মাঝে কাটে তার বারোমাস।<br />আরো মনে রবে, সুযোগ পাইলে তার সে ফুলের প্রাণ,<br />ফুটিয়া উঠিত নানা রঙ লয়ে আলো করি ধরাখান।<br />পড়িবার তার কত আগ্রহ, একটু আদর দিয়ে,<br />কেউ যদি তারে ভর্তি করিত কোন ইস্কুলে নিয়ে;<br />কত বই সে যে পড়িয়া ফেলিত জানিত সে কত কিছু,<br />পথ দিয়ে যেতে জ্ঞানের আলোক ছড়াইত, পিছু পিছু!<br />নিজে সে পড়িয়া পরেরে পড়াত, তাহার আদর পেয়ে,<br />লেখাপড়া জেনে হাসিত খেলিত ধরনীর ছেলেমেয়ে।</p>
<br /><p>হায়রে দুরাশা, কেউ তারে কোন দেবে না সুযোগ করি,<br />অজ্ঞানতার অন্ধকারায় রবে সে জীবন ভরি।<br />তারপর কোন মূর্খ স্বামীর ঘরের ঘরনী হয়ে,<br />দিনগুলি তার কাটিবে অসহ দৈন্যের বোঝা বয়ে।<br />এ পরিনামের হয় না বদল? এই অন্যায় হতে<br />বস্তীর বোন, তোমারে বাঁচাতে পারিবনা কোনমতে?<br />ফুলের মতন হাসিখুশী মুখে চাঁদ ঝিকি মিকি করে,<br />নিজেরে গলায়ে আদর করিয়া দিতে সাধ দেহ ভরে।<br />তুমি ত কারুর কর নাই দোষ, তবে কেন হায়, হায়,<br />এই ভয়াবহ পরিনাম তব নামিছে জীবনটায়।</p>
<br /><p>এ যে অন্যায়, এ যে অবিচার, কে রুখে দাঁড়াবে আজ,<br />কার হুঙ্কারে আকাশ হইতে নামিয়া আসিবে বাজ।<br />কে পোড়াবে এই অসাম্য-ভরা মিথ্যা সমাজ বাঁধ,<br />তার তরে আজ লিখিয়া গেলাম আমর আর্তনাদ।<br />আকাশে বাতাসে ফিরিবে এ ধ্বনি, দেশ হতে আর দেশে,<br />হৃদয় হইতে হৃদয়ে পশিয়া আঘাত হানিবে এসে।<br />অশনি পাখির পাখায় চড়িয়া আছাড়ি মেঘের গায়,<br />টুটিয়া পড়িবে অগ্নি জ্বালায় অসাম্য ধারাটায়!<br />কেউটে সাপের ফণায় বসিয়া হানিবে বিষের শ্বাস,<br />দগ্ধ করিবে যারা দশ হাতে কাড়িছে পরের গ্রাস।<br />আলো-বাতাসের দেশ হতে কাড়ি, নোংরা বস্তী মাঝে,<br />যারা ইহাদের করেছে ভিখারী অভাবের হীন সাজে;<br />তাহাদের তরে জ্বালায়ে গেলাম শ্মাশানে চিতার কাঠ,<br />গোরস্তানেতে খুঁড়িয়া গেলাম কবরের মহা-পাঠ।<br />কাল হতে কালে যুগ হতে যুগে ভীষণ ভীষণতর,<br />যতদিন যাবে ততজ্বালা ভরা হবে এ কন্ঠস্বর।<br />অনাহারী মার বুভুক্ষা জ্বালা দেবে এরে ইন্ধন,<br />দিনে দিনে এরে বিষায়ে তুলিবে পীড়িতের ক্রন্দন।<br />দুর্ভিক্ষের স্তন পিয়ে পিয়ে লেলিহা জিহ্বা মেলি,<br />আকাশ-বাতাস ধরণী ঘুরিয়া করিবে রক্ত কেলি।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/shinduker-beshati/সিন্দুরের বেসাতি2016-05-08T13:07:43-04:002023-06-25T04:52:55-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(রূপক নাটিকা)</p>
<br /><p>ওলো সোনার বরণী,<br />তোমার সিন্দুর নি নিবারে সজনি!<br />রাঙা তোমার ঠোঁটরে কন্যা, রাঙা তোমার গাল,<br />কপালখানি রাঙা নইলে লোকে পাড়বে গালরে;<br />তোমার সিন্দুর নি নিবারে সজনি!<br />সাঁঝের কোলে মেঘরে-তাতে রঙের চূড়া,<br />সেই মেঘে ঘষিয়া সিন্দুর করছি গুঁড়া গুঁড়ারে,<br />তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!<br />এই না সিন্দুর পরিয়া নামে আহাশেতে আড়া,<br />এই সিন্দুরের বেসাতি করতে হইছি ঘর-ছাড়ারে;<br />তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!<br />কাণা দেয়ায় ঝিলিক মারে কালা মেঘায় ফাঁড়ি,<br />তোমার জন্য আনছি কন্যা মেঘ-ডম্বুর শাড়ীরে;<br />তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!<br />শাড়ীখানি পর কন্যা, সিন্দুর খানি পর,<br />আঙ্খের পলক দেইখা আমি যাই হাপনার ঘররে;<br />তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!</p>
<br /><p>থাক থাক বানিয়ারে নিরালে বসিয়া<br />মা-ধনের আগে আমি আসি জিজ্ঞাসিয়া।<br />শোন শোন ওহে মা-ধন! শুনিয়া ল তোর কানে,<br />আমি তো যাব মা-ধন বানিয়ার দোকানে।<br />এক ধামা দাও ধান আমি কিনিব পুঁতির মালা<br />আরো ধামা দাও ধান আমি কিনিব হাতের বালা।</p>
<br /><p>বিদেশী বানিয়ারে! বোঝা তোমার মাথে,<br />দেখাও দেখি কি কি জিনিস আছে তোমার সাথে?</p>
<br /><p>আমার কাছে সিন্দুর আছে ওই না ভালের শোভা,<br />তোমার রাঙা-ঠোঁটের মত দেখতে মন-লোভা।</p>
<br /><p>আমরা তো জানি না সিন্দুর কেমনে পরে,<br />আমরা তো দেখি নাই সিন্দুর কাহারো ঘরে।</p>
<br /><p>সোনার বরণ কন্যারে! দীঘল মাথার ক্যাশ,<br />সিন্দুর পরাইতে পারি যাও যদি মোর দ্যাশ।<br />ঘরে আছে ভাইয়ের বৌ লক্ষ্মীর সমান,<br />তোমার মাথায় সিন্দুর দিয়া জুড়াইব প্রাণ।</p>
<br /><p>শোন শোন বানিয়ারে কই তোমার আগে,<br />তোমার না সিন্দুর লইতে কত দাম লাগে?</p>
<br /><p>আমার না সিন্দুর লইতে লাগে হাসিমুখ,<br />আমার না সিন্দুর লইতে লাগে খুশীবুক।</p>
<br /><p>নিলাম নিলাম, সিন্দুর নিলাম হাসি-মুখে কিনি,<br />আরো কি ধন আছে তোমার আমরা নি তা চিনি?</p>
<br /><p>আরো আছে হাতের শাঁখা, আছে গলার হার,<br />নাকের বেশর নথও আছে সোনার বাঁধা তার।</p>
<br /><p>আমরা তো নাহি জানি বানিয়া শাঁখা বলে কারে,<br />দেখি নাই তো নথের শোভা সোনাবান্ধা তারে।</p>
<br /><p>সোনার বরণ কন্যা, তোমার সোনার হাত পাও,<br />শাঁখা যদি না পরিলে কিসের সুখ পাও?<br />সাতো ভাইয়ের সাতো বউ সাতো নথ নাকে,<br />পূব-দুয়াইয়া বাড়ি মোদের উজ্জল কইরা থাকে।</p>
<br /><p>শোন শোন বানিয়ারে কই তোমার আগে,<br />তোমার না নথ ও শাঁখায় কত দাম লাগে?</p>
<br /><p>আমার না শাঁখা লইতে লাগে হাসিমুখ,<br />আমার না নথ লইতে লাগে খুশীবুক।<br />নিলাম, নিলাম, নথও নিলাম, নিলাম, তোমার শাঁখা,<br />তোমার কথা বানিয়ারে রিদ্রে রইলো আঁকা।</p>
<br /><p>ওই বিদেশী বানিয়া মোরে<br />পাগল করিয়া গেছে,<br />আমার মন কাড়িয়া নেছেরে সজনি!<br />শাঁখা না কিনিতে আমি হাতে বাঁধলাম ডোর;<br />সিঁথার সিন্দুর কিনে চক্ষে দেখি ঘোর!<br />নথ না কিনিয়া আমি পন্থে করনু বাসা,<br />একেলা কান্দিয়া ফিরি লয়ে তারি আশা।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nishithe-jaiyo-phulobone/নিশিতে যাইও ফুলবনে2016-05-08T13:04:26-04:002023-06-27T12:45:41-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>নিশিতে যাইও ফুলবনে<br />রে ভোমরা<br />নিশিতে যাইও ফুলবনে।<br />জ্বালায়ে চান্দের বাতি<br />আমি জেগে রব সারা রাতি গো;<br />কব কথা শিশিরের সনে<br />রে ভোমরা!<br />নিশিতে যাইও ফুলবনে।</p>
<br /><p>যদিবা ঘুমায়ে পড়ি-<br />স্বপনের পথ ধরি গো,<br />যেও তুমি নীরব চরণে<br />রে ভোমরা!<br />(আমার ডাল যেন ভাঙে না,<br />আমার ফুল যেন ভাঙে না,<br />ফুলের ঘুম যেন ভাঙে না)।<br />যেও তুমি নীরব চরণে<br />রে ভোমরা!<br />নিশিতে যাইও ফুলবনে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/polli-jononi/পল্লী জননী2016-05-08T12:47:52-04:002023-06-27T13:43:54-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার,<br />নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।<br />রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা,<br />করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।<br />শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,<br />তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।</p>
<br /><p>ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান,<br />এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ?<br />ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,<br />শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।</p>
<br /><p>ছেলে কয়, “মারে, কত রাত আছে? কখন সকাল হবে,<br />ভাল যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে?”<br />মা কয়“বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমা ত একটি বার, ”<br />ছেলে রেগে কয় “ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার ?”<br />পান্ডুর গালে চুমো খায় মাতা, সারা গায়ে দেয় হাত,<br />পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ।<br />নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,<br />ছেলেরে তাহার ভাল কোরে দাও, কাঁদে জননীর প্রাণ।<br />ভাল করে দাও আল্লা রছুল। ভাল কোরে দাও পীর।<br />কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর।</p>
<br /><p>বাঁশবনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি,<br />বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারীর বন হেলি।<br />চলে বুনোপথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,<br />দুর ছাই। কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি।<br />যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে,<br />বালাই, বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে।<br />ছেলে কয়, “মাগো! পায়ে পড়ি বলো ভাল যদি হই কাল,<br />করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না ত তুমি গাল?<br />আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া<br />এখনি আমারে এত রোগ হোতে করিতে পারি ত খাড়া ?”<br />মা কেবল বসি রুগ্ন ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,<br />ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে।</p>
<br /><p>“শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,<br />রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি শিকা পরে।<br />খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে,<br />ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।”<br />ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,<br />বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত।</p>
<br /><p>রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে,<br />কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দুর বনে।<br />সাঁঝ হোয়ে গেল আসেনাকো আই-ঢাই মার প্রাণ,<br />হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান।<br />এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে,<br />ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি-সাঁঝে?</p>
<br /><p>কত কথা আজ মনে পড়ে মার, গরীবের ঘর তার,<br />ছোট খাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার।<br />আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই,<br />বলেছে আমরা মুসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই।<br />করিম যে গেল? রহিম চলিল? এমনি প্রশ্ন-মালা;<br />উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা।<br />আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,<br />ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা।</p>
<br /><p>ঘরের চালেতে ভুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,<br />মরণের দুত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দুর-দুর।<br />পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডা’ক ডাকিতেছে ঝুরি ঝুরি,<br />কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি।<br />ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে বুড়ো পাতা ঝরে বনে,<br />ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল গড়াইছে তার সনে।<br />রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা।<br />সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহা-কাল-রাত পাতা।<br />পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেলা,<br />আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/duronto-porobashi/দুরন্ত পরবাসী (গীতকবিতা)2016-05-08T12:40:20-04:002023-06-27T11:26:43-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>ওরে হাইলা লোকের লাঙ্গল বাঁকা,<br />জনম বাঁকা চাঁদ রে ... জনম বাঁকা চাঁদ <br />তার চাইতে অধিক বাঁকা, হায় হায় <br />যারে দিসি প্রাণ রে ... দুরন্ত পরবাসী।<br />আমার হাড় কালা করলাম রে ...<br />আমার দেহ কালার লাইগা রে।<br />ওরে আমার অন্তর কালা করলাম রে ... দুরন্ত পরবাসী।<br />মনু রে ...<br />ওরে কূল বাঁকা, গাঙ বাঁকা,<br />বাঁকা গাঙের পানি রে ... বাঁকা গাঙের পানি <br />সকল বাঁকায় বাইলাম নৌকা, হায় হায় <br />তবু বাঁকারে না জানি রে ... দুরন্ত পরবাসী।<br />আমার হাড় কালা করলাম রে ...<br />আমার দেহ কালার লাইগা রে।<br />ওরে আমার অন্তর কালা করলাম রে ... দুরন্ত পরবাসী।<br />মনু রে ...<br />ওরে হাড় হইল জর জর, <br />অন্তর হইল গুড়া রে ... অন্তর হইল গুড়া<br />পিরিতী ভাঙ্গিয়া গেলে, হায় হায় <br />নাহি লাগে জোড়া রে ... দুরন্ত পরবাসী।<br />আমার হাড় কালা করলাম রে ...<br />আমার দেহ কালার লাইগা রে।<br />ওরে আমার অন্তর কালা করলাম রে ... দুরন্ত পরবাসী।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/polli-borsha/পল্লী বর্ষা2016-05-08T09:16:18-04:002023-06-27T08:14:41-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘেরআড়ে,<br />কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।<br />কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,<br />ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!<br />বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,<br />সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।<br />কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা<br />তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া!<br />হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,<br />নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি!<br />চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে,<br />না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে!<br />কোন্ সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী, –<br />হয়ত আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি!<br />দিকে দিগেনে- যতদূর চাহি, পাংশু মেঘেরজাল<br />পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।<br />গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়, –<br />গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!<br />কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,<br />কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধেকসি কসি।<br />কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল<br />কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।<br />মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীরসুরে,<br />আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।<br />লাঠির উপরে, ফুলের উপরে আঁকা হইতেছে ফুল,<br />কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে বাজিতেছে নির্ভুল।<br />তারি সাথে সাথে গল্প চলেছে- আমীর সাধুর নাও,<br />বহুদেশ ঘুরে আজিকে আবার ফিরিয়াছে নিজগাঁও।<br />ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হতে ওর হাতে,<br />নানান রকম রসি বুনানও হইতেছে তার সাথে।<br />বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে,<br />এ সবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপকথা আঁকে!<br />যেন ও বৃদ্ধ, গাঁয়ের চাষীরা, আর ওই রূপ-কথা,<br />বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে আরেক কল্প-লতা।<br />বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি,<br />সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছেবসি।<br />কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,<br />তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নকসা টানি।<br />বৈদেশী কোন্ বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে,<br />মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে।<br />আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,<br />বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/football-khelowar/ফুটবল খেলোয়াড়2016-05-08T09:13:29-04:002024-02-26T22:40:59-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলোয়াড়,<br />হাতে পায়ে মুখে শত আঘাতের ক্ষতে খ্যাতি লেখা তার।</p>
<br /><p>সন্ধ্যা বেলায় দেখিবে তাহারে পটি বাঁধি পায়ে হাতে,<br />মালিশ মাখিছে প্রতি গিঠে গিঠে কাত হয়ে বিছানাতে।</p>
<br /><p>মেসের চাকর হয় লবেজান সেঁক দিতে ভাঙ্গা হাড়ে,<br />সারা রাত শুধু ছটফট করে কেঁদে কেঁদে ডাক ছাড়ে।</p>
<br /><p>আমরা তো ভাবি ছমাসের তরে পঙ্গু সে হল হায়,<br />ফুটবল-টিমে বল লয়ে কভু দেখিতে পাব না তায়।</p>
<br /><p>প্রভাত বেলায় খবর লইতে ছুটে যাই তার ঘরে,<br />বিছানা তাহার শূন্য পড়িয়া ভাঙা খাটিয়ার পরে।</p>
<br /><p>টেবিলের পরে ছোট বড় যত মালিশের শিশিগুলি,<br />উপহাস যেন করিতেছে মোরে ছিপি- পরা দাঁত তুলি।</p>
<br /><p>সন্ধ্যা বেলায় খেলার মাঠেতে চেয়ে দেখি বিস্ময়ে,<br />মোদের মেসের ইমদাদ হক আগে ছোটে বল লয়ে!</p>
<br /><p>বাপ পায়ে বল ড্রিবলিং করে ডান পায়ে মারে ঠেলা,<br />ভাঙা কয়খানা হাতে পায়ে তার বজ্র করিছে খেলা।</p>
<br /><p>চালাও চালাও আরও আগে যাও বাতাসের মত ধাও,<br />মারো জোরে মারো- গোলের ভেতরে বলেরে ছুঁড়িয়া দাও।</p>
<br /><p>গোল-গোল-গোল, চারিদিক হতে ওঠে কোলাহলকল,<br />জীবনের পণ, মরণের পণ, সব বাঁধা, পায়ে দল।</p>
<br /><p>গোল-গোল-গোল-মোদের মেসের ইমদাদ হক কাজি,<br />ভাঙা দুটি পায়ে জয়ের ভাগ্য লুটিয়া আনিল আজি।</p>
<br /><p>দর্শকদল ফিরিয়া চলেছে মহা-কলবর করে,<br />ইমদাদ হক খোড়াতে খোড়াতে আসে যে মেসের ঘরে।</p>
<br /><p>মেসের চাকর হয়রান হয় পায়েতে মালিশ মাখি,<br />বে-ঘুম রাত্র কেটে যায় তার চীৎকার করিডাকি।</p>
<br /><p>সকালে সকালে দৈনিক খুলি মহা-আনন্দে পড়ে,<br />ইমদাদ হক কাল যা খেলেছে কমই তা নজরে পড়ে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/amar-bari/আমার বাড়ি2016-05-08T09:11:31-04:002024-03-11T16:34:21-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আমার বাড়ি যাইও ভোমর,<br />বসতে দেব পিঁড়ে,<br />জলপান যে করতে দেব<br />শালি ধানের চিঁড়ে।</p>
<br /><p>শালি ধানের চিঁড়ে দেব,<br />বিন্নি ধানের খই,<br />বাড়ির গাছের কবরী কলা<br />গামছা বাঁধা দই।</p>
<br /><p>আম-কাঁঠালের বনের ধারে<br />শুয়ো আঁচল পাতি,<br />গাছের শাখা দুলিয়ে বাতাস<br />করব সারা রাতি।</p>
<br /><p>চাঁদমুখে তোর চাঁদের চুমো<br />মাখিয়ে দেব সুখে,<br />তারা-ফুলের মালা গাঁথি<br />জড়িয়ে দেব বুকে।</p>
<br /><p>গাই দোহনের শব্দ শুনি<br />জেগো সকাল বেলা,<br />সারাটা দিন তোমায় লয়ে<br />করব আমি খেলা।</p>
<br /><p>আমার বাড়ি ডালিম গাছে<br />ডালিম ফুলের হাসি,<br />কাজলা দিঘির কাজল জলে<br />হাঁসগুলি যায় ভাসি।</p>
<br /><p>আমার বাড়ি যাইও ভোমর,<br />এই বরাবর পথ,<br />মৌরী-ফুলের গন্ধ শুঁকে<br />থামিও তব রথ।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/khukir-shompotti/খুকির সম্পত্তি2016-05-08T09:06:59-04:002023-06-27T15:12:35-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>শিউলি নামের খুকির সনে আলাপ আমার অনেকদিনের থেকে<br />হাসিখুশি মিষ্টমিশি অনেক কথা কই যে তারে ডেকে।<br />সেদিন তার কইনু ‘খুকি- কী কী জিনিস কওতো তোমার আছে?<br />সগৌরবে বলর, অনেক-অনেক কিছু আছে তাহারকাছে;<br />সাতটা ভাঙা পেন্সিল আর নীল বরণের ভাঙা দু-খান কাঁচ,<br />মারবেল আছে তিন-চারটে, কড়ি আছে গণ্ডা ছ কি পাঁচ।<br />ডলি পুতুল, মিনি পুতুল, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল আর-<br />পুঁতির মালা, রঙিন ঝিনুক, আরও অনেক খেলনা আছে তার।<br />আছে তাহার পাতার বাঁশি, টিনের উনুন, শোলার পাখির ছা,<br />সাতটা আছে ঝুমঝুমি তার আর আছে তার একটি খেলার মা।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/rakhal-chale/রাখাল ছেলে2016-05-08T09:04:47-04:002023-06-27T19:22:15-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও,<br />বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?’<br />‘ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ<br />কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা;<br />সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,<br />সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা<br />সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না!’<br />রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! আবার কোথায় ধাও,<br />পূব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও।’<br />‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,<br />সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।<br />আমার সাথে করতে খেলা প্রভাত হাওয়া ভাই,<br />সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।<br />চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দু-খান পা,<br />বলছে ডেকে, ‘গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা!’<br />সারা মাঠের ডাক এসেছে, খেলতে হবে ভাই!<br />সাঁঝের বেলা কইব কথা এখন তবে যাই!’<br />‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! সারাটা দিন খেলা,<br />এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা!’<br />‘কাজের কথা জানিনে ভাই, লাঙল দিয়ে খেলি<br />নিড়িয়ে দেই ধানের ক্ষেতের সবিজ রঙের চেলি<br />সরষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হওয়ার সুখে<br />মটর বোনে ঘোমটা খুলে চুম দিয়ে যায় মুখে!<br />ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশি পঊষ-পাগল বুড়ি,<br />আমরা সেথা চষতে লাঙল মুর্শিদা-গান জুড়ি।<br />খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই, খেলা লাঙল-চষা<br />সারাটা দিন খেলতে জানি, জানিই নেকো বসা।’</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/shobar-shukhe/সবার সুখে2016-05-08T09:01:27-04:002023-12-26T04:50:29-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>সবার সুখে হাসব আমি<br />কাঁদব সবার দুখে,<br />নিজের খাবার বিলিয়ে দেব<br />অনাহারীর মুখে।</p>
<br /><p>আমার বাড়ির ফুল-বাগিচা,<br />ফুল সকলের হবে,<br />আমার ঘরে মাটির প্রদীপ<br />আলোক দিবে সবে।</p>
<br /><p>আমার বাড়ি বাজবে বাঁশি,<br />সবার বাড়ির সুর,<br />আমার বাড়ি সবার বাড়ি<br />রইবে না ক দুর।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/mamarbadi/মামার বাড়ি2016-05-08T08:51:11-04:002023-06-27T17:58:28-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা,<br />ফুল তুলিতে যাই<br />ফুলের মালা গলায় দিয়ে<br />মামার বাড়ি যাই।<br />মামার বাড়ি পদ্মপুকুর<br />গলায় গলায় জল,<br />এপার হতে ওপার গিয়ে<br />নাচে ঢেউয়ের দল।<br />দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে<br />লাল শালুকের ফুল,<br />রাতের বেলা চাঁদের সনে<br />হেসে না পায় কূল।<br />আম-কাঁঠালের বনের ধারে<br />মামা-বাড়ির ঘর,<br />আকাশ হতে জোছনা-কুসুম<br />ঝরে মাথার ‘পর।<br />রাতের বেলা জোনাক জ্বলে<br />বাঁশ-বাগানের ছায়,<br />শিমুল গাছের শাখায় বসে<br />ভোরের পাখি গায়।<br />ঝড়ের দিনে মামার দেশে<br />আম কুড়াতে সুখ<br />পাকা জামের শাখায় উঠি<br />রঙিন করি মুখ।<br />কাঁদি-ভরা খেজুর গাছে<br />পাকা খেজুর দোলে<br />ছেলেমেয়ে, আয় ছুটে যাই<br />মামার দেশে চলে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/asmani/আসমানী2016-05-08T08:41:13-04:002024-02-01T06:43:27-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,<br />রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।<br />বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,<br />একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।<br />একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,<br />তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।<br />পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান হাড়,<br />সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার।<br />মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি<br />থাপড়েতে নিবিয়ে দেছে দারুণ অভাব আসি।<br />পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,<br />সোনালি তার গা বরণের করছে উপহাস।<br />ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,<br />সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।<br />বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,<br />হয় নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।<br />আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে<br />ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল্-বিল্-বিল করে।<br />ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,<br />সেই জলেতে রান্না-খাওয়া আসমানীদের চলে।<br />পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,<br />বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।</p>
<br /><p>সূত্র ও কিছু কথা:<br />পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের এই ‘আসমানী’ কবিতাটি ১৯৪৯ সাল তাঁর ‘এক পয়সার বাঁশি’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এই কবিতা মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্য বইয়েও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।কবিতার একটি চরিত্র থেকেই ফরিদপুরের রসুলপুর গ্রামের অতি সাধারণ এই আসমানী বেগম সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন অতি পরিচিত একটি নাম।<br />কবিতার বর্ণনায় পাওয়া হত দরিদ্র আসমানী যে বাস্তবেরই এক চরিত্র তার সন্ধান মেলে কবিতাটি লেখার অনেক বছর পর।<br />আসমানী বেগমের পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে জেষ্ঠ্য কন্যা আলেয়া বেগম বলছিলেন, আমার মা তখন অনেক ছোট, নয় যখন বয়স, তখন জসীমউদ্দীন আমাদের গ্রামে আসেন। তবে অনেক পরে আমরা জানতে পারি, জসীমউদ্দীন আমার মাকে নিয়েই এই কবিতা লিখেছেন।<br />মূলত কবি জসীমউদ্দীনের ভাই সরকারী রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যাপক নুরুদ্দিন আহমেদ এর শ্বশুর বাড়ি ছিল আজকের ফরিদপুর সদরের ইষান গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে। সেখানে একবার বেড়াতে গিয়ে এই আসমানীর দেখা পান জসীমউদ্দীন।</p>
<br /><p>ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের মফিজ ইমাম মিলন জানান, জসীমউদ্দীনের ‘জীবন কথা’ বইয়ের প্রথম সংস্করণে এই তথ্যটি ছিল। তবে ফরিদপুরের একজন জেলাপ্রশাসক জালাল আহমদে উদ্যোগ নিয়ে এই আসমানীকে খুঁজে বের করেন।<br />আসমানী বেগম মারা যান ১৮ আগস্ট ২০১২ সালে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/protidan/প্রতিদান2016-05-08T08:26:03-04:002024-03-20T21:59:10-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,<br />আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।<br />যে মোরে করিল পথের বিবাগী-<br />পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি,<br />দিঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;<br />আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।</p>
<br /><p>আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,<br />যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।<br />যে মোরে দিয়েছে বিষে-ভরা বাণ,<br />আমি দেই তারে বুকভরা গান,<br />কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর, -<br />আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।</p>
<br /><p>মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি<br />রঙিন ফুলের সোহাগ জড়ানো ফুল-মালঞ্চ ধরি।<br />যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী,<br />আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি,<br />কত ঠাঁই হতে কত কী যে আনি, সাজাই নিরন্তর<br />আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/eto-hashi-kothay-pele/এত হাসি কোথায় পেলে2012-11-20T09:24:52-05:002024-03-18T13:10:29-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>এত হাসি কোথায় পেলে<br />এত কথার খলখলানি<br />কে দিয়েছে মুখটি ভরে<br />কোন বা গাঙের কলকলানি।<br />কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে<br />কলমী ফুলের গুলগুলানি।<br />কে দিয়েছে চলন বলন<br />কোন সে লতার দোল দুলানী।</p>
<br /><p>কাদের ঘরে রঙিন পুতুল<br />আদরে যে টইটুবানি।<br />কে এনেছে বরণ ডালায়<br />পাটের বনের বউটুবানী।<br />কাদের পাড়ার ঝামুর ঝুমুর<br />কাদের আদর গড়গড়ানি<br />কাদের দেশের কোন সে চাঁদের<br />জোছনা ফিনিক ফুল ছড়ানি।</p>
<br /><p>তোমায় আদর করতে আমার<br />মন যে হলো উড়উড়ানি<br />উড়ে গেলাম সুরে পেলাম<br />ছড়ার গড়ার গড়গড়ানি।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/paler-nao/পালের নাও2012-10-15T15:50:27-04:002023-06-27T09:01:17-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও -<br />ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও।<br />কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে'<br />কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে'!<br />গুয়ার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘসে' ঘসে',<br />মামা-বাড়ীর বলব কথা শুনো বসে বসে!</p>
<br /><p>কে যাওরে পাল ভরে' কোন্ দেশে ঘর<br />পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর?<br />কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে।<br />কোন্ দেশে হিরামন পাখী বাস করে!<br />কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়,<br />ঘুম যায় আর হাসে হিম্-সিম্ বায়।<br />সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,<br />ছোট মোর বোনটিরে যদি সাথে পাই!</p>
<br /><p>পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,<br />তোমার যে পাল নাচে ফুলঝুরি বাও।<br />তোমার যে না'র ছই আবের ঢাকনী<br />ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধনী।<br />সোনার না বাঁধন্ রে তার গোড়ে গোড়ে<br />হিরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে।<br />তারপর ওড়েরে ঝালরের ছাতি,<br />ঝলমল জলে জ্বলে রতনের বাতি।<br />এই নাও বেয়ে যায় কোন্ সদাগর,<br />কয়ে যাও - কয়ে যাও কোন্ দেশে ঘর?</p>
<br /><p>পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,<br />ঘরে আছে ছোট বোন্ তারে নিয়ে যাও, -<br />চেনা গাঙে সাত ধার করে গলাগলি,<br />সেথা বাস কেহেলার - লোকে গেছে বলি।<br />পারাপার দুই নদী - মাঝে বালুচর<br />সেইখানে বাস করে চাঁদ সওদাগর।</p>
<br /><p>এ পারে ধুতুমের বাসা ও পারেতে টিয়া -<br />সেখানেতে যেও না রে নাও খানি নিয়া।<br />ভাইটাল গাঙ্ দোলে ভাটা গেঁয়ো সোতে,<br />হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোন মতে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nimontron/নিমন্ত্রণ2012-09-24T09:13:25-04:002024-02-10T12:24:46-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,<br />গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;<br /> মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি<br /> মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,<br />মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,<br />তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,</p>
<br /><p>ছোট গাঁওখানি - ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,<br />কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;<br /> ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী<br /> পারের খবর টানাটানি করি;<br />বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;<br />বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।</p>
<br /><p>তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,<br />গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।<br /> সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া<br /> দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,<br />বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,<br />বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!</p>
<br /><p>তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে - নরম ঘাসের পাতে<br />চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।<br /> তেলাকুচা-লতা গলায় পরিয়া<br /> মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,<br />হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,<br />তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।</p>
<br /><p>তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি<br />নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী।<br /> মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া <br /> তোর সনে দেই মিতালী করিয়া<br />ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,<br />সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।</p>
<br /><p>তুমি যদি যাও - দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,<br />সীম আর সীম - হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।<br /> তুমি যদি যাও সে - সব কুড়ায়ে<br /> নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,<br />খাব আর যত গেঁঢো - চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,<br />হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।</p>
<br /><p>তুমি যদি যাও - শালুক কুড়ায়ে, খুব - খুব বড় করে,<br />এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে,<br /> কারেও দেব না, তুমি যদি চাও<br /> আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও,<br />মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,<br />ও পাড়াব সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে;</p>
<br /><p>সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,<br />মতলব কিছু আঁটিব যাহাতে খুশী তারে করা যায়!<br /> লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া<br /> বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া<br />এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,<br />বলিব - কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।</p>
<br /><p>খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে,<br />কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে<br /> রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে <br /> ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;<br />কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে <br />সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।</p>
<br /><p>ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ,<br />কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ।<br /> ওরে মুখ-পোড়া ওরে রে বাঁদর।<br /> গালি-ভরা মার অমনি আদর,<br />কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ;<br />যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।</p>
<br /><p>যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।<br />ঘন কালো বন - মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।<br /> গাছের ছায়ায় বনের লতায়<br /> মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়!<br />আজি সে-সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়,<br />যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়।</p>
<br /><p>তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে<br />লুকায়ে থাকিস্, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে।<br /> মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে,<br /> হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে;<br />অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে,<br />সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/kobor/কবর2012-09-24T08:55:37-04:002024-03-21T11:51:16-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,<br />তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।<br />এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,<br />পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।<br />এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,<br />সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!<br />সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি<br />লাঙল লইয়া খেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।<br />যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত<br />এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।<br />এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে<br />ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।</p>
<br /><p>বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা<br />আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।<br />শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু'পয়সা করি দেড়ী,<br />পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।<br />দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,<br />সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!<br />হেস না- হেস না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,<br />দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!<br />নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,<br />পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।<br />আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,<br />কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!<br />হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,<br />আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।</p>
<br /><p>তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি<br />যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।<br />শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,<br />গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।<br />এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,<br />গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।<br />মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে লাগায়ে বুক,<br />আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।</p>
<br /><p>এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,<br />কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।<br />সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,<br />বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।<br />ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,<br />সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ?<br />গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,<br />তুমি যে কহিলা বা-জানেরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?<br />তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,<br />সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!</p>
<br /><p>তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জড়ায়ে ধরি,<br />তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিনমান ভরি।<br />গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে,<br />ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।<br />পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,<br />চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।<br />আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,<br />হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।<br />গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,<br />চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।</p>
<br /><p>ঊদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি,<br />কবর দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি।<br />তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,<br />হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।<br />মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই,<br />বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;<br />দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে,<br />কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।<br />ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে,<br />কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে।</p>
<br /><p>ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল- আমার কবর গায়<br />স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।<br />সেই সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,<br />পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।<br />জোড়-মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়,<br />গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।<br />জোনাকি-মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,<br />ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।<br />হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়;<br />ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!</p>
<br /><p>এইখানে তোর বু-জীর কবর, পরীর মতন মেয়ে,<br />বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের ঘরে বনিয়াদি ঘর পেয়ে।<br />এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,<br />হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।<br />খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে<br />দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।<br />শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে<br />অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।<br />সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,<br />কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।<br />বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,<br />কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ-বীণ!<br />কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,<br />এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।</p>
<br /><p>ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো,<br />কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।<br />বনের ঘুঘুরা উঁহু উঁহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,<br />পাতায় পাতায় কেঁপে ওঠে যেন তারি বেদনার বীণ।<br />হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়।<br />আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।</p>
<br /><p>হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে,<br />রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।<br />ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,<br />অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!<br />ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,<br />তোমার দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে।<br />বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,<br />রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।</p>
<br /><p>একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,<br />ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।<br />সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে।<br />কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।<br />আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,<br />দাদু! ধর- ধর- বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।<br />এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,<br />কথা কস নাকো, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু।<br />আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,<br />দীন দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে !</p>
<br /><p>ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,<br />অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।<br />মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর,<br />মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর।<br />জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।<br />ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-maath-14/নক্সী কাঁথার মাঠ - চৌদ্দ (শেষ)2012-09-11T15:19:28-04:002024-02-14T18:31:07-05:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(চৌদ্দ)</p>
<br /><p>আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,<br />নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে |<br />মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি,<br />ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি!<br />নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি,<br />কোন্ সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি !</p>
<br /><p>বাতাসের পায়ে বাজেনা আজিকে ঝল মল মল গান,<br />মাঠের ধূলায় পাক খেয়ে পড়ে কত যেন হয় ম্লান!<br />সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ পরে,<br />মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে!<br />মাঠে মাঠে কাঁদে কলমীর লতা, কাঁদে মটরের ফুল,<br />এই একা মাঠে কি করিয়া তারা রাখিবেগো জাতি-কুল |<br />লাঙল আজিকে হয়েছে পাগল, কঠিন মাটিরে চিরে,<br />বুকখানি তার নাড়িয়া নাড়িয়া ঢেলারে ভাঙিবে শিরে |<br />তবু এই-গাঁও রহিয়াছে চেয়ে, ওই-গাঁওটির পানে,<br />কতদিন তারা এমনি কাটাবে কেবা তাহা আজ জানে |<br />মধ্যে লুটায় দিগন্ত-জোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ ;<br />সারা বুক ভরি কি কথা সে লিখি, নীরবে করিছে পাঠ!<br />এমন নাম ত শুনিনি মাঠের? যদি লাগে কারো ধাঁধাঁ,<br />যারে তারে তুমি শুধাইয়া নিও, নাই কোন এর বাঁধা |</p>
<br /><p>সকলেই জানে সেই কোন্ কালে রূপা বলে এক চাষী,<br />ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমেতে গলায় পড়িল ফাঁসি |<br />বিয়েও তাদের হয়েছিল ভাই, কিন্তু কপাল-লেখা,<br />খন্ডাবে কেবা? দারুণ দুঃখ ভালে এঁকে গেল রেখা |<br />রূপা একদিন ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দূর দেশে,<br />তারি আশা-পথে চাহিয়া চাহিয়া বউটি মরিল শেষে |<br />মরিবার কালে বলে গিয়েছিল --- তাহার নক্সী-কাঁথা,<br />কবরের গায়ে মেলে দেয় যেন বিরহিণী তার মাতা!</p>
<br /><p>বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে,<br />শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী বেদনার তালে তালে |<br />প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়,<br />রোগ পাণ্ডডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়!<br />শিয়রের কাছে পড়ে আছে তার কখানা রঙীন শাড়ী,<br />রাঙা মেঘ বেয়ে দিবসের রবি যেন চলে গেছে বাড়ি!</p>
<br /><p>সারা গায় তার জড়ায়ে রয়েছে সেই নক্সী-কাঁথা,---<br />আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা |</p>
<br /><p>কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,---<br />মহা-শূণ্যেতে উড়িয়াছে কেবা নক্সী-কাথাটি ধরে ;<br />হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশীটি বাজায় করুণ সুরে,<br />তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে |<br />সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী-কাঁথার মাঠ,<br />ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ |</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-maath-13/নক্সী কাঁথার মাঠ - তেরো2012-09-11T15:18:06-04:002023-06-27T16:42:26-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(তেরো)</p>
<br /><p>একটি বছর হইয়াছে সেই রূপাই গিয়াছে চলি,<br />দিনে দিনে নব আশা লয়ে সাজুরে গিয়াছে ছলি |<br />কাইজায় যারা গিয়াছিল গাঁয়, তারা ফিরিয়াছে বাড়ী,<br />শহরের জজ, মামলা হইতে সবারে দিয়াছে ছাড়ি |<br />স্বামীর বাড়ীতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে,<br />তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে |<br />একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মত,<br />প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত |</p>
<br /><p>ও-গাঁয়ে রূপার ভাঙা ঘরখানি মেঘ ও বাতাসে হায়,<br />খুঁটি ভেঙে আজ হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছে পথের গায় |<br />প্রতি পলে পলে খসিয়া পড়িছে তাহার চালের ছানি,<br />তারও চেয়ে আজি জীর্ণ শীর্ণ সাজুর হৃদয়খানি |<br />রাত দিন দুটি ভাই বোন যেন দুখেরই বাজায় বীণ |<br />কৃষাণীর মেয়ে, এতটুকু বুক, এতটুকু তার প্রাণ,<br />কি করিয়া সহে দুনিয়া জুড়িয়া অসহ দুখের দান!<br />কেন বিধি তারে এত দুখ দিল, কেন, কেন, হায় কেন,<br />মনের-মতন কাঁদায় তাহারে “পথের কাঙালী” হেন ?</p>
<br /><p>সোঁতের শেহলা ভাসে সোঁতে সোঁতে, সোঁতে সোঁতে ভাসে পানা,<br />দুখের সাগরে ভাসিছে তেমনি সাজুর হৃদয়খানা |<br />কোন্ জালুয়ার মাছ সে খেয়েছে নাহি দিয়ে তায় কড়ি,<br />তারি অভিশাপ ফিরেছে কি তার সকল পরাণ ভরি !<br />কাহার গাছের জালি কুমড়া সে ছিঁড়েছিল নিজ হাতে,<br />তাহারি ছোঁয়া কি লাগিয়াছে আজ তার জীবনের পাতে !<br />তোর দেশে বুঝি দয়া মায়া নাই, হা-রে নিদারুণ বিধি<br />কোন্ প্রাণে তুই কেড়ে নিয়ে গেলি তার আঁচলের নিধি |<br />নয়ন হইতে উড়ে গেছে হায় তার নয়নের তোতা,<br />যে ব্যাথারে সাজু বহিতে পারে না, আজ তা রাখিবে কোথা ?</p>
<br /><p>এমনি করিয়া কাঁদিয়া সাজুর সারাটি দিবস কাটে,<br />আমেনে কভু একা চেয়ে রয় দীঘল গাঁয়ের বাটে |<br />কাঁদিয়া কাঁদিয়া সকাল যে কাটে---দুপুর কাটিয়া যায়,<br />সন্ধ্যার কোলে দীপ নিবু-নিবু সোনালী মেঘের নায়ে |<br />তবু ত আসে না ! বুকখানি সাজু নখে নখে আজ ধরে,<br />পারে যদি তবে ছিঁড়িয়া ফেলায় সন্ধ্যার কাল গোরে |<br />মেয়ের এমন দশা দেখে মার সুখ নাই কোন মনে,<br />রূপারে তোমরা দেখেছ কি কেউ, শুধায় সে জনে জনে |<br />গাঁয়ের সবাই অন্ধ হয়েছে, এত লোক হাটে যায়,<br />কোন দিন কিগো রূপাই তাদের চক্ষে পড়ে নি হায় !<br />খুব ভাল করে খোঁজে যেন তারে, বুড়ী ভাবে মনে মনে,<br />রূপাই কোথাও পলাইয়া আছে হয়ত হাটের কোণে |<br />ভাদ্র মাসেতে পাটের বেপারে কেউ কেউ যায় গাঁরষ<br />নানা দেশে তারা নাও বেয়ে যায় পদ্মানদীর পার |<br />জনে জনে বুড়ী বলে দেয়, “দেখ, যখন যখানে যাও,<br />রূপার তোমরা তালাস লইও, খোদার কছম খাও |”<br />বর্ষার শেষে আনন্দে তারা ফিরে আসে নায়ে নায়ে,<br />বুড়ী ডেকে কয়, “রূপারে তোমরা দেখ নাই কোন গাঁয়ে !”<br />বুড়ীর কথার উত্তর দিতে তারা নাহি পায় ভাষা,<br />কি করিয়া কহে, আর আসিবে না যে পাখি ছেড়েছে বাসা |</p>
<br /><p>চৈত্র মাসেতে পশ্চিম হতে জন খাটিবার তরে,<br />মাথাল মাথায় বিদেশী চাষীরা সারা গাঁও ফেলে ভরে |<br />সাজুর মায়ে যে ডাকিয়া তাদের বসায় বাড়ির কাছে,<br />তামাক খাইতে হুঁকো এনে দ্যায়, জিজ্ঞাসা করে পাছে ;<br />“তোমরা কি কেউ রূপাই বলিয়া দেখেছ কোথাও কারে,<br />নিটল তাহার গঠন গাঠন, কথা কয় ভারে ভারে |”<br />এমনি করিয়া বলে বুড়ী কথা, তাহারা চাহিয়া রয়,---<br />রুপারে যে তারা দেখে নাই কোথা, কেমন করিয়া কয় !<br />যে গাছ ভেঙেছে ঝড়িয়া বাতাসে কেমন করিয়া হায়,<br />তারি ডালগুলো ভেঙে যাবে তারা কঠোর কুঠার-ঘায় ?</p>
<br /><p>কেউ কেউ বলে, “তাহারি মতন দেখেছিন একজনে,<br />আমাদের সেই ছোট গাঁয় পথে চলে যেতে আনমনে |”<br />“আচ্ছা তাহারে সুধাও নি কেহ, কখন আসিবে বাড়ী,<br />পরদেশে সে যে কোম্ প্রাণে রয় আমার সাজুরে ছাড়ি ?”<br />গাঙে-পড়া-লোক যেমন করে তৃণটি আঁকড়ি ধরে,<br />তেমনি করিয়া চেয়ে রয় বুড়ী তাদের মুখের পরে |<br />মিথ্যা করেই তারা বলে, “সে যে আসিবে ভাদ্র মাসে,<br />খবর দিয়েছে, বুড়ী যেন আর কাঁদে না তাহার আশে |”<br />এত যে বেদনা তবু তারি মাঝে একটু আশার কথা,<br />মুহুর্তে যেন মুছাইয়া দেয় কত বরষের ব্যথা |<br />মেয়েরে ডাকিয়া বার বার কহে, “ভাবিস না মাগো আর,<br />বিদেশী চাষীরা কয়ে গেল মোর---খবর পেয়েছে তার |”<br />মেয়ে শুধু দুটি ভাষা-ভরা আঁখি ফিরাল মায়ের পানে ;<br />কত ব্যথা তার কমিল ইহাতে সেই তাহা আজ জানে |<br />গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,<br />বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস |</p>
<br /><p>আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা,<br />ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেড়ে যায় বাসা |<br />আজকে কত না কথা লয়ে যেন বাজিছে বুকের বীনে,<br />সেই যে প্রথম দেখিল রূপারে বদনা-বিয়ের দিনে |<br />তারপর সেই হাট-ফেরা পথে তারে দেখিবার তরে,<br />ছল করে সাজু দাঁড়ায়ে থাকিত গাঁয়ের পথের পরে |<br />নানা ছুতো ধরি কত উপহার তারে যে দিত আনি,<br />সেই সব কথা আজ তার মনে করিতেছে কানাকানি |<br />সারা নদী ভরি জাল ফেলে জেলে যেমনি করিয়া টানে,<br />কখন উঠায়, কখন নামায়, যত লয় তার প্রাণে ;<br />তেমনি সে তার অতীতেরে আজি জালে জালে জড়াইয়া টানে,<br />যদি কোন কথা আজিকার দিনে কয়ে যায় নব-মানে |</p>
<br /><p>আর যেন তার কোন কাজ নাই, অতীত আঁধার গাঙে,<br />ডুবারুর মত ডুবিয়া ডুবিয়া মানক মুকুতা মাঙে |<br />এতটুকু মান, এতটুকু স্নেহ, এতটুকু হাসি খেলা,<br />তারি সাথে সাজু ভাসাইতে চায় কত না সুখের ভেলা !<br />হায় অভাগিনী ! সে ত নাহি জানে আগে যারা ছিল ফুল,<br />তারাই আজিকে ভুজঙ্গ হয়ে দহিছে প্রাণের মূল |<br />যে বাঁশী শুনিয়া ঘুমাইত সাজু, আজি তার কথা স্মরি,<br />দহন নাগের গলা জড়াইয়া একা জাগে বিভাবরী |</p>
<br /><p>মনে পড়ে আজ সেই শেষ দিনে রূপার বিদায় বাণী---<br />“মোর কথা যদি মনে পড়ে তবে পরিও সিঁদুরখানি |”<br />আরও মনে পড়ে, “দীন দুঃখীর যে ছাড়া ভরসা নাই,<br />সেই আল্লার চরণে আজিকে তোমারে সঁপিয়া যাই |”</p>
<br /><p>হায় হায় পতি, তুমি ত জান না কি নিঠুর তার মন ;<br />সাজুর বেদনা সকলেই শোনে, শোনে না সে একজন |<br />গাছের পাতারা ঝড়ে পরে পথে, পশুপাখি কাঁদে বনে,<br />পাড়া প্রতিবেশী নিতি নিতি এসে কেঁদে যায় তারি সনে |<br />হায় রে বধির, তোর কানে আজ যায় না সাজুর কথা ;<br />কোথা গেলে সাজু জুড়াইবে এই বুক ভরা ব্যথা |<br />হায় হায় পতি, তুমি ত ছাড়িয়া রয়েছ দূরের দেশে,<br />আমার জীবন কি করে কাটিবে কয়ে যাও কাছে এসে !<br />দেখে যাও তুমি দেখে যাও পতি তোমার লাই-এর লতা,<br />পাতাগুলি তার উনিয়া পড়েছে লয়ে কি দারুণ ব্যথা |<br />হালের খেতেতে মন টিকিত না আধা কাজ ফেলি বাকি,<br />আমারে দেখিতে বাড়ি যে আসিতে করি কতরূপ ফাঁকি |<br />সেই মোরে ছেড়ে কি করে কাটাও দীর্ঘ বরষ মাস,<br />বলিতে বলিতে ব্যথার দহনে থেমে আসে যেন শ্বাস |</p>
<br /><p>নক্সী-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি,<br />ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি |<br />অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা,<br />তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা |<br />এই কাঁথা যবে আরম্ভ করে তখন সে একদিন,<br />কৃষাণীর ঘরে আদরিনী মেয়ে সারা গায়ে সুখ-চিন |<br />স্বামী বসে তার বাঁশী বাজায়েছে, সিলাই করেছে সেজে ;<br />গুন গুন করে গান কভু রাঙা ঠোঁটেতে উঠেছে বেজে |</p>
<br /><p>সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই,<br />সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই |</p>
<br /><p>খুব ধরে ধরে আঁকিল যে সাজু রূপার বিদায় ছবি,<br />খানিক যাইয়া ফিরে ফিরে আসা, আঁকিল সে তার সবি |<br />আঁকিল কাঁথায়---আলু থালু বেশে চাহিয়া কৃষাণ-নারী,<br />দেখিছে তাহার স্বামী তারে যায় জনমের মত ছাড়ি |<br />আঁকিতে আঁকিতে চোখে জল আসে, চাহনি যে যায় ধুয়ে,<br />বুকে কর হানি, কাঁথার উপরে পড়িল যে সাজু শুয়ে |<br />এমনি করিয়া বহুদিন যায়, মানুষে যত না সহে,<br />তার চেয়ে সাজু অসহ্য ব্যথা আপনার বুকে বহে |<br />তারপর শেষে এমনি হইল, বেদনার ঘায়ে ঘায়ে,<br />এমন সোনার তনুখানি তার ভাঙিল ঝরিয়া-বায়ে |<br />কি যে দারুণ রোগেতে ধরিল, উঠিতে পারে না আর ;<br />শিয়রে বসিয়া দুঃখিনী জননী মুছিল নয়ন-ধার |<br />হায় অভাগীর একটি মানিক ! খোদা তুমি ফিরে চাও,<br />এরে যদি নিবে তার আগে তুমি মায়েরে লইয়া যাও !<br />ফিরে চাও তুমি আল্লা রসুল ! রহমান তব নাম,<br />দুনিয়ায় আর কহিবে না কেহ তারে যদি হও বাম !</p>
<br /><p>মেয়ে কয়, “মাগো ! তোমার বেদনা আমি সব জানি,<br />তার চেয়ে যেগো অসহ্য ব্যথা ভাঙে মোর বুকখানি !<br />সোনা মা আমার ! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন, খাও মাথা,<br />ঘরের মেঝেয় মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা !<br />একটু আমারে ধর দেখি মাগো, সূঁচ সুতা দাও হাতে,<br />শেষ ছবি খানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে |”<br />পাণ্ডুর হাতে সূঁচ লয়ে সাজু আঁকে খুব ধীরে ধীরে,<br />আঁকিয়া আঁকিয়া আঁখিজল মুছে দেখে কত ফিরে ফিরে |</p>
<br /><p>কাঁথার উপরে আঁকিল যে সাজু তাহার কবরখানি,<br />তারি কাছে এক গেঁয়ো রাখালের ছবিখানি দিল টানি ;<br />রাত আন্ধার কবরের পাশে বসি বিরহী বেশে,<br />অঝোরে বাজায় বাঁশের বাঁশীটি বুক যায় জলে ভেসে |<br />মনের মতন আঁকি এই ছবি দেখে বার বার করি,<br />দুটি পোড়া চোখ বারবার শুধু অশ্রুতে উঠে ভরি |<br />দেখিয়া দেখিয়া ক্লান্ত হইয়া কহিল মায়েরে ডাকি,<br />“সোনা মা আমার! সত্যিই যদি তোরে দিয়ে যাই ফাঁকি ;<br />এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর পরে,<br />ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে !<br />সে যদি গো আর ফিরে আসে কভু, তার নয়নের জল,<br />জানি জানি মোর কবরের মাটি ভিজাইবে অবিরল |<br />হয়ত আমার কবরের ঘুম ভেঙে যাবে মাগো তাতে,<br />হয়ত তাহারে কাঁদাইতে আমি জাগিব অনেক রাতে |<br />এ ব্যথা সে মাগো কেমনে সহিবে, বোলো তারে ভালো করে,<br />তার আঁখি জল ফেলে যেন এই নক্সী-কাঁথার পরে |<br />মোর যত ব্যথা, মোর যত কাঁদা এরি বুকে লিখে যাই,<br />আমি গেলে মোর কবরের গায়ে এরে মেলে দিও তাই !<br />মোর ব্যথা সাথে তার ব্যথাখানি দেখে যেন মিল করে,<br />জনমের মত সব কাঁদা আমি লিখে গেনু কাঁথা ভরে |”<br />বলিতে বলিতে আর যে পারে না, জড়াইয়া আসে কথা,<br />অচেতন হয়ে পড়িল যে সাজু লয়ে কি দারুণ ব্যথা |</p>
<br /><p>কানের কাছেতে মুখ লয়ে মাতা ডাক ছাড়ি কেঁদে কয়,<br />“সাজু সাজু ! তুই মোরে ছেড়ে যাবি এই তোর মনে লয় ?”<br />“আল্লা রসুল ! আল্লা রসুল !” বুড়ী বলে হাত তুলে,<br />“দীন দুঃখীর শেষ কান্না এ, আজিকে যেয়ো না ভুলে !”<br />দুই হাতে বুড়ী জড়াইতে চায় আঁধার রাতের কালি,<br />উতলা বাতাস ধীরে ধীরে বয়ে যায়, সব খালি ! সব খালি !!<br />“সোনা সাজুরে, মুখ তুলে চাও, বলে যাও আজ মোরে,<br />তোমারে ছাড়িয়া কি করে যে দিন কাটিবে একেলা ঘরে !”</p>
<br /><p>দুখিনী মায়ের কান্নায় আজি খোদার আরশ কাঁপে,<br />রাতের আঁধার জড়াজড়ি করে উতল হাওয়ার দাপে |</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-maath-12/নক্সী কাঁথার মাঠ - বার2012-09-11T15:17:03-04:002023-06-27T16:50:44-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(বার)</p>
<br /><p>রূপাই গিয়াছে ‘কাইজা’ করিতে সেই ত সকাল বেলা,<br />বউ সারাদিন পথ পানে চেয়ে, দেখেছে লোকার মেলা |<br />কত লোক আসে কত লোক যায়, সে কেন আসে না আজ,<br />তবে কি তাহার নসিব মন্দ, মাথায় ভাঙিবে বাজ!<br />বালাই, বালাই, ওই যে ওখানে কালো গাঁর পথ দিয়া,<br />আসিছে লোকটি, ওই কি রূপাই ? নেচে ওঠে তার হিয়া |<br />এলে পরে তারে খুব বকে দিবে, মাথায় ছোঁয়াবে হাত,<br />কিরা করাইবে লড়ায়ের নামে হবে না সে আর মাৎ |</p>
<br /><p>আঁচলে চোখেরে বার বার মাজে, নারে না সে ত ও নয়,<br />আজকে তাহার কপালে কি আছে, কে তাহা ভাঙিয়া কয় |<br />লোহুর সাগরে সাতার কাটিয়া দিবস শেষের বেলা,<br />রাত্র-রাণীর কালো আঁচলেতে মুছিল দিনের খেলা |<br />পথে যে আঁধার পড়িল সাজুর মনে তার শত গুণ,<br />রাত এসে তা ব্যথার ঘায়েতে ছিটাইল যেন নুন!</p>
<br /><p>ঘরের মেঝেতে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী-কাঁথা,<br />সেলাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা |<br />পাতায় পাতায় খস্ খস্ খস্, শুনে কান খাড়া করে,<br />যারে চায় সে ত আসেনাক শুধু ভুল করে করে মরে |<br />তবু যদি পাতা খানিক না নড়ে, ভাল লাগেনাক তার ;<br />আলো হাতে লয়ে দূর পানে চায়, বার বার খুলে দ্বার |<br />কেন আসে নারে! সাজুর যদি গো পাখা আজ বিধি,<br />উড়িয়া যাইয়া দেখিয়া আসিত তাহার সোনার নিধি |<br />নক্সী-কাঁথায় আঁকিল যে সাজু অনেক নক্সী-ফুল,<br />প্রথমে যেদিন রূপারে সে দেখে, সে খুশির সমতুল |<br />আঁকিল তাদের বিয়ের বাসর, আঁকিল রূপার বাড়ি,<br />এমন সময় বাহিরে কে দেখে আসিতেছে তাড়াতাড়ি |</p>
<br /><p>দুয়ার খুলিয়া দেখিল সে চেয়ে---রূপাই আসিছে বটে,<br />”এতক্ষণে এলে ? ভেবে ভেবে যেগো প্রাণ নাই মোর ঘটে |<br />আর জাইও না কাইজা করিতে, তুমি যাহাদের মারো,<br />তাদের ঘরে ত আছে কাঁচা বউ, ছেলেমেয়ে আছে কারো |”<br />রূপাই কহিল কাঁদিয়া, “বউগো ফুরায়েছে মোর সব,<br />রাতে ঘুম যেতে শুনিবে না আর রূপার বাঁশীর রব |<br />লড়ায়ে আজিকে কত মাথা আমি ভাঙিয়াছি দুই হাতে,<br />আগে বুঝি নাই তোমারো মাথার সিঁদুর ভেঙেছে তাতে |<br />লোহু লয়ে আজ সিনান করেছি, রক্তে ভেসেছে নদী,<br />বুকের মালা যে ভেসে যাবে তাতে আগে জানিতাম যদি!<br />আঁচলের সোনা খসে যাবে পথে আগে যদি জানতাম,<br />হায় হায় সখি, নারিনু বলিতে কি যে তবে করিতাম !”</p>
<br /><p>বউ কেঁদে কয়, “কি হয়েছে বল, লাগিয়াছে বুঝি কোথা,<br />দেখি ! দেখি !! দেখি !!! কোথায় আঘাত, খুব বুঝু তার ব্যথা !”<br />“লাগিয়াছে বউ, খুব লাগিয়াছে, নহে নহে মোর গায়,<br />তোমার শাড়ীর আঁচল ছিঁড়েছে, কাঁকন ভেঙেছে হায়!<br />তোমার পায়ের ভাঙিয়াছে খাড়ু ছিঁড়েছে গলার হার,<br />তোমার আমার এই শেষ দেখা, বাঁশী বাজিবে না আর |<br />আজ ‘কাইজায়’ অপর পক্ষে খুন হইয়াছে বহু |<br />এই দেখ মোর কাপড়ে এখনো লাগিয়া রহিছে লহু |<br />থানার পুলিশ আসিছে হাঁকিয়া পিছে পিছে মোর ছুটি,<br />খোঁজ পেলে পরে এখনি আমার ধরে নিয়ে যাবে টুঁটি |<br />সাথীরা সকলে যে যাহার মত পালায়েছে যথা-তথা,<br />আমি আসিলাম তোমার সঙ্গে সেরে নিতে সব কথা |<br />আমার জন্য ভাবিনাক আমি, কঠিন ঝড়িয়া-বায়,<br />যে গাছ পড়িল, তাহার লতার কি হইবে আজি হায়!<br />হায় বনফুল, যেই ডালে তুই দিয়েছিলি পাতি বুক,<br />সে ডালেরি সাথে ভাঙিয়া পড়িল তোর সে সকল সুখ |<br />ঘরে যদি মোর মা থাকিত আজ তোমারে সঙ্গে করি,<br />বিনিদ্র রাত কাঁদিয়া কাটাত মোর কথা স্মরি স্মরি!</p>
<br /><p>ভাই থাকিলেও ভাইয়ের বউরে রাখিত যতন করি,<br />তোমার ব্যথার আধেকটা তার আপনার বুকে ভরি |<br />আমি যে যাইব ভাবিনাক, সাথে যাইবে কপাল-লেখা,<br />এযে বড় ব্যথা! তোমারো কপালে এঁকে গেনু তারি রেখা!”<br />সাজু কেঁদে কয়, “সোনার পতিরে তুমি যে যাইবে ছাড়ি,<br />হয়ত তাহাতে মোর বুকখানা যাইতে চাহিবে ফাড়ি |<br />সে দুখেরে আমি ঢাকিয়া রাখিব বুকের আঁচল দিয়া,<br />এ পোড়া রূপেরে কি দিয়া ঢাকিব---ভেবে মরে মোর হিয়া |<br />তুমি চলে গেলে পাড়ার লোকে যে চাহিবে ইহার পানে,<br />তোমার গলার মালাখানি আমি লুকাইব কোন্ খানে!”</p>
<br /><p>রূপা কয়, “সখি দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই,<br />সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই |<br />মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে,<br />তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণ তলে |”</p>
<br /><p>এমন সময় ঘরের খোপেতে মোরগ উঠিল ডাকি,<br />রূপা কয়, “সখি! যাই---যাই আমি---রাত বুঝি নাই বাকি!”<br />পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায় ; সাজু কয়, “ ওগো শোন,<br />আর কি গো নাই মোর কাছে তব বলিবার কথা কোন ?<br />দীঘল রজনী---দীঘল বরষ---দীঘল ব্যথার ভার,<br />আজ শেষ দিনে আর কোন কথা নাই তব বলিবার ?”<br />রূপা ফিরে কয়, “না কাঁদিয়া সখি, পারিলামনাক আর,<br />ক্ষমা কর মোর চোখের জলের নিশাল দেয়ার ধার |”</p>
<br /><p>“এই শেষ কথা!” সাজু কহে কেঁদে, “বলিবে না আর কিছু ?”<br />খানিক চলিয়া থামিল রূপাই, কহিল চাহিয়া পিছু,<br />“মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যদি কোন ব্যথা লাগে,<br />দুটি কালো চোখ সাজাইয়া নিও কাল কাজলের রাগে |<br />সিন্দুরখানি পরিও ললাটে---মোরে যদি পড়ে মনে,<br />রাঙা শাড়ীখানি পরিয়া সজনি চাহিও আরশী-কোণে |<br />মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যতনে বাঁধিও চুল,<br />আলসে হেলিয়া খোপায় বাঁধিও মাঠের কলমী ফুল |<br />যদি একা রাতে ঘুম নাহি আসে---না শুনি আমার বাঁশী,<br />বাহুখানি তুমি এলাইও সখি মুখে মেখে রাঙা হাসি |<br />চেয়ো মাঠ পানে---গলায় গলায় দুলিবে নতুন ধান ;<br />কান পেতে থেকো, যদি শোনো কভু সেখায় আমার গান |<br />আর যদি সখি, মোরে ভালবাস মোর তরে লাগে মায়া,<br />মোর তরে কেঁদে ক্ষয় করিও না অমন সোনার কায়া!”</p>
<br /><p>ঘরের খোপেতে মোরগ ডাকিল, কোকিল ডাকিল ডালে,<br />দিনের তরণী পূর্ব-সাগরে দুলে উঠে রাঙা পালে |<br />রূপা কহে, “তবে যাই যাই সখি, যেটুকু আধার বাকি,<br />তারি মাঝে আমি গহন বনেতে নিজেরে ফেলিব ঢাকি |”<br />পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায়, তবু ফিরে ফিরে চায় ;<br />সাজুর ঘরেতে দীপ নিবু নিবু ভোরের উতল বায় |</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-maath-11/নক্সী কাঁথার মাঠ - এগার2012-09-11T15:16:21-04:002023-06-27T16:42:10-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(এগার)</p>
<br /><p>'ও রূপা তুই করিস কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে?<br />বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা-চরের খামার ভূঁয়ে |'<br />'কি বলিলা বছির মামু ?' উঠল রূপাই হাঁক ছাড়িয়া,<br />আগুনভরা দুচোখ হতে গোল্লা-বারুদ যায় উড়িয়া |<br />পাটার মত বুকখানিতে থাপড় মারে শাবল হাতে,<br />বুকের হাড়ে লাগল বাড়ি, আগুন বুঝি জ্বলবে তাতে!<br />লম্ফে রূপা আনলো পেড়ে চাং হতে তার সড়কি খানা,<br />ঢাল ঝুলায়ে মাজার সাথে থালে থালে মারল হানা |<br />কোথায় রল রহম চাচা, কলম শেখ আর ছমির মিঞা,<br />সাউদ পাড়ার খাঁরা কোথায়? কাজীর পোরে আন ডাকিয়া!<br />বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরা গফর-গাঁয়ে,<br />এই কথা আজ শোনার আগে মরিনি ক্যান গোরের ছায়ে?<br />'আলী-আলী' হাঁকল রূপাই হুঙ্কারে তার গগন ফাটে,<br />হুঙ্কারে তার গর্জে বছির আগুন যেন ধরল কাঠে!<br />ঘুম হতে সব গাঁয়ের লোকে শুনল যেন রূপার বাড়ি ;<br />ডাক শুনে তার আসল ছুটে রহম চাচা, ছমির মিঞা,<br />আসল হেঁকে কাজেম খুনী নখে নখে আঁচড় দিয়া |<br />আসল হেঁকে গাঁয়ের মোড়ল মালকোছাতে কাপড় পড়ি,<br />এক নিমেষে গাঁয়ের লোকে রূপার বাড়ি ফেলল ভরি |<br />লম্ফে দাঁড়ায় ছমির লেঠেল, মমিনপুরের চর দখলে,<br />এক লাঠিতে একশ লোকেরমাথা যে জন আস্ ল দলে |<br />দাঁড়ায় গাঁয়ের ছমির বুড়ো, বয়স তাহার যদিও আশী,<br />গায়ে তাহার আজও আছে একশ লড়ার দাগের রাশি |</p>
<br /><p>গর্জি উঠে গদাই ভূঁঞার ; মোহন ভূঁঞার ভাজন বেটা,<br />যার লাঠিতে মামুদপুরের নীল কুঠিতে লাগল লেঠা |<br />সব গাঁর লোক এক হল আজ রূপার ছোট উঠান পরে,<br />নাগ-নাগিনী আসল যেন সাপ-খেলানো বাঁশীর স্বরে!<br />রূপা তখন বেরিয়ে তাদের বলল, 'শোন ভাই সকলে,<br />গাজনা চরের ধানের জমি আর আমাদের নাই দখলে |'<br />বছির মামু বলছে খবর---মোল্লারা সব কাসকে নাকি ;<br />আধেক জমির ধান কেটেছে, কালকে যারা কাঁচির খোঁচায় :<br />আজকে তাদের নাকের ডগা বাঁধতে হবে লাঠির আগায় |'<br />থামল রূপাই---ঠাটা যেমন মেঘের বুকে বাণ হানিয়া,<br />নাগ-নাগিনীর ফণায় যেমন তুবড়ী বাঁশীর সুর হাঁকিয়া |<br />গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাটিম হেন ঘোড়ায় লাঠি,<br />রোহিত মাছের মতন চলে, লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি |</p>
<br /><p>রূপাই তাদের বেড়িয়ে বলে, 'থাল বাজারে থাল বাজারে,<br />থাল বাজায়ে সড়কি ঘুরা হানরে লাঠি এক হাজারে |<br />হানরে লাঠি---হানরে কুঠার, গাছের ছ্যন্ আর রামদা ঘুরা,<br />হাতের মাথায় যা পাস যেথায় তাই লয়ে আজ আয় রে তোরা |'<br />'আলী! আলী! আলী! আলী!!!' রূপার যেন কণ্ঠ ফাটি,<br />ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজে কাঁপছে আকাশ কাঁপছে মাটি |<br />তারি সুরে সব লেঠেল লাঠির, পরে হানল লাঠি,<br />'আলী-আলী' শব্দে তাদের আকাশ যেন ভাঙবে ফাটি |<br />আগে আগে ছুটল রূপা---বৌঁ বৌঁ বৌঁ সড়কি ঘোরে,<br />কাল সাপের ফণার মত বাবরী মাথায় চুল যে ওড়ে |<br />লল পাছে হাজার লেঠেল 'আলী-আলী' শব্দ করি,<br />পায়ের ঘায়ে মাঠের ধূলো আকাশ বুঝি ফেলবে ভরি!<br />চলল তারা মাঠ পেরিয়ে, চলল তারা বিল ডেঙিয়ে,<br />কখন ছুটে কখন হেঁটে বুকে বুকে তাল ঠুকিয়ে |<br />চলল যেমন ঝড়ের দাপে ঘোলাট মেঘের দল ছুটে যায়,<br />বাও কুড়ানীর মতন তারা উড়িয়ে ধূল্ পথ ভরি হায়!<br />দুপুর বেলা এল রূপাই গাজনা চরের মাঠের পরে,<br />সঙ্গে এল হাজার লেঠেল সড়কি লাঠি হস্তে ধরে!<br />লম্ফে রূপা শূণ্যে উঠি পড়ল কুঁদে মাটির পরে,<br />থকল খানিক মাঠের মাটি দন্ত দিয়ে কামড়ে ধরে |<br />মাটির সাথে মুখ লাগায়ে, মাটির সাথে বুক লাগায়ে,<br />'আলী! আলী!' শব্দ করি মাটি বুঝি দ্যায় ফাটায়ে |<br />হাজার লেঠেল হুঙ্কারী কয় 'আলী আলী হজরত আলী,'<br />সুর শুনে তার বন-গেঁয়োদের কর্ণে বুঝি লাগল তালি!<br />তারাও সবে আসল জুটে দলে দলে ভীম পালোয়ান,<br />'আলী আলী' শব্দে যেন পড়ল ভেঙে সকল গাঁখান!<br />সামনে চেয়ে দেখল রূপা সার বেঁধে সব আসছে তারা,<br />ওপার মাঠের কোল ঘেঁষে কে বাঁকা তীরে দিচ্ছে নাড়া |<br />রূপার দলে এগোয় যখন, তারা তখন পিছিয়ে চলে,<br />তারা আবার এগিয়ে এলে এরাও ইটে নানান কলে |<br />এমনি করে সাত আটবারে এগোন পিছন হল যখন<br />রূপা বলে, 'এমন করে 'কাইজা' করা হয় না কখন |'<br />তাল ঠুকিয়ে ছুটল রূপাই, ছুটল পাছে হাজার লাঠি,<br />'আলী-আলী --- হজরত আলী' কণ্ঠ তাদের যয় যে ফাটি |<br />তাল ঠুকিয়া পড়ল তারা বন-গেঁয়োদের দলের মাঝে,<br />লাঠির আগায় লাগল লাঠি, লাঠির আগায় সড়কি বাজে |<br />'মার মার মার' হাঁকল রূপা, --- 'মার মার মার' ঘুরায় লাঠি,<br />ঘুরায় যেন তারি সাথে পায়ের তলে মাঠের মাটি |<br />আজ যেন সে মৃত্যু-জনম ইহার অনেক উপরে উঠে,<br />জীবনের এক সত্য মহান্ লাঠির আগায় নিচ্ছে লুটে!<br />মরণ যেন মুখোমুখি নাচছে তাহার নাচার তালে,<br />মহাকালের বাজছে বিষাণ আজকে ধরার প্রলয় কালে |<br />নাচে রূপা---নাচে রূপা--- লোহুর গাঙে সিনান করি,<br />মরণরে সে ফেলছে ছুড়ে রক্তমাখা হস্তে ধরি |<br />নাচে রূপা---নাচে রুপা---মুখে তাহার অট্টহাসি,<br />বক্ষে তাহার রক্ত নাচে, চক্ষে নাচে অগ্নিরাশি |<br />---হাড়ে হাড়ে নাচন তাহার, রোমে রোমে লাগছে নাচন,<br />কি যেন সে দেখেছে আজ, রুধতে নারে তারি মাতন |<br />বন-গেঁয়োরা পালিয়ে গেল, রূপার লোকও ফিরল বহু,<br />রূপা তবু নাচছে, গায়ে তাজা-খুনের হাসছে লোহু |</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-maath-10/নক্সী কাঁথার মাঠ - দশ2012-09-11T15:15:34-04:002023-06-27T00:59:30-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(দশ)</p>
<br /><p>নতুন চাষা ও নতুন চাষাণী পাতিল নতুন ঘর,<br />বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর |<br />মাঠের কাজেতে ব্যস্ত রূপাই, নয়া বউ গেহ কাজে,<br />দুইখান হতে দুটি সুর যেন এ উহারে ডেকে বাজে |<br />ঘর চেয়ে থাকে কেন মাঠ পানে, মাঠ কেন ঘর পানে,<br />দুইখানে রহি দুইজন আজি বুঝিছে ইহার মানে |</p>
<br /><p>আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান,<br />সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হল্ দি-কোটার গান |<br />ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,<br />কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায় |<br />আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,<br />মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে |</p>
<br /><p>আজকে রূপার বড় কাজ---কাজ---কোন অবসর নাই,<br />মাঠে যেই ধান ধরেনাক আজি ঘরে দেবে তারে ঠাঁই |<br />সারা মাঠে ধান, পথে ঘাটে ধান উঠানেতে ছড়াছড়ি,<br />সারা গাঁও ভরি চলেছে কে কবি ধানের কাব্য পড়ি |</p>
<br /><p>আজকে রূপার মনে পড়েনাক শাপলার লতা দিয়ে,<br />নয়া গৃহিনীর খোঁপা বেঁধে দিত চুলগুলি তার নিয়ে |<br />সিঁদুর লইয়া মান হয়নাক বাজে না বাঁশের বাঁশী,<br />শুধু কাজ---কাজ, কি যাদু-মন্ত্র ধানেরা পড়িছে আসি |</p>
<br /><p>সারাটি বরষা কে কবি বসিয়া বেঁধেছে ধানের গান,<br />কত সুদীর্ঘ দিবস রজনী করিয়া সে অবসান |<br />আজকে তাহার মাঠের কাব্য হইয়াছে বুঝি সারা,<br />ছুটে গেঁয়ো পাখি ফিঙে বুলবুল তারি গানে হয়ে হারা |</p>
<br /><p>কৃষাণীর গায়ে গহনা পরায় নতুন ধানের কুটো ;<br />এত কাজ তবু হাসি ধরেনাক, মুখে ফুল ফুটো ফুটো!<br />আজকে তাহার পাড়া-বেড়ানর অবসর মোটে নাই,<br />পার খাড়ুগাছি কোথা পড়ে আছে, কেবা খোঁজ রাখে ছাই!</p>
<br /><p>অর্ধেক রাত উঠোনেতে হয় ধানের মলন মলা,<br />বনের পশুরা মানুষের কাজে মিশায় গলায় গলা |<br />দাবায় শুইয়া কৃষাণ ঘুমায়, কৃষাণীর কাজ ভারি,<br />ঢেকির পারেতে মুখর করিছে একেলা সারাটি বাড়ি |<br />কোন দিন চাষী শুইয়া শুইয়া গাহে বিরহের গান,<br />কৃষাণের নারী ঘুমাইয়া পড়ে, ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান |<br />হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোত্স্নার জাল পাতি,<br />টেনে টেনে তারে হয়রান হয়ে ডুবে যায় রাতারাতি |</p>
<br /><p>এমনি করিয়া ধানের কাব্য হইয়া আসিল সারা,<br />গানের কাব্য আরম্ভ হল সারাটা কৃষাণ পাড়া!<br />রাতেরে উহারা মানিবে না যেন, নতুন গলার গানে,<br />বাঁশী বাজাইয়া আজকে রাতের করিবে নতুন মানে |</p>
<br /><p>আজিকে রূপার কোন কাজ নাই, ঘুম হতে যেন জাগি,<br />শিয়রে দেখিছে রাজার কুমারী তাহারই ব্যথার ভাগী |</p>
<br /><p>সাজুও দেখিছে কোথাকার যেন রাজার কুমার আজি,<br />ঘুম হতে তারে সবে জাগায়েছে অরুণ-আলোয় সাজি |</p>
<br /><p>নতুন করিয়া আজকে উহারা চাহিছে এ ওর পানে,<br />দীর্ঘ কাজের অবসর যেন কহিছে নতুন মানে!<br />নতুন চাষার নতুন চাষাণী নতুন বেঁধেছে ঘর,<br />সোহাগে আদরে দুটি প্রাণ যেন করিতেছে নড়নড়!<br />বাঁশের বাঁশীতে ঘুণ ধরেছিল, এতদিন পরে আজ,<br />তেলে জলে আর আদরে তাহার হইল নতুন সাজ |<br />সন্ধ্যার পরে দাবায় বসিয়া রূপাই বাজায় বাঁশী,<br />মহাশূণ্যের পথে সে ভাসায় শূণ্যের সুররাশি!<br />ক্রমে রাত বাড়ে, বউ বসে দূরে, দুটি চোখ ঘুমে ভার,<br />'পায়ে পড়ি ওগো চলো শুতে যাই, ভাল লাগে নাক আর |'<br />রূপা ত সে কথা শোনেই নি যেন, বাঁশী বাজে সুরে সুরে,<br />'ঘরে দেখে যারে সেই যেন আজি ফেরে ওই দূরে দূরে |'<br />বউ রাগ করে, 'দেখ, বলে রাখি, ভাল হবেনাক পরে,<br />কালকের মত কর যদি তবে দেখিও মজাটি করে |<br />ওমনি করিয়া সারারাত আজি বাজাইবে যদি বাঁশী,<br />সিঁদুর আজিকে পরিব না ভালে, কাজল হইবে বাসি |<br />দেখ, কথা শোন, নইলে এখনি খুলিব কানের দুল,<br />আজকে ত আমি খোঁপা বাঁধিব না, আলগা রহিবে চুল |'<br />বেচারী রূপাই বাঁশী বাজাইতে এমনি অত্যাচার,<br />কৃষাণের ছেলে! অত কিবা বোঝে, তখনই মানিল হার |</p>
<br /><p>কহে জোড় করে, 'শোন গো হুজুর, অধম বাঁশীর প্রতি,<br />মৌন থাকার কঠোর দণ্ড অন্যায় এ যে অতি |<br />আজকে ও-ভালে সিঁদুর দিবে না, খুলিবে কানের দুল,<br />সন্ধ্যে হবে না সিঁদুরে রঙের---ভোরে হাসিবে না ফুল!<br />এক বড় কথা! আচ্ছা দেখাই, ওরে ও অধম বাঁশী,<br />এই তরুণীর অধরের গানে তোমার হইবে ফাঁসী!'<br />হাতে লয়ে বাঁশী বাজাইল রূপা মাঠের চিকন সুরে,<br />কভু দোলাইয়া বউটির ঠোঁটে কভু তারে ঘুরে ঘুরে |<br />বউটি যেন গো হেসে হয়রান, কহে ঠোঁটে ঠোঁট চাপি,<br />'বাঁশীর দণ্ড হইল, কিন্তু যে বাজাল সে পাপী?'<br />পুনঃ জোর করে রূপা কহে, 'এই অধমের অপরাধ,<br />ভয়ানক যদি, দণ্ড তাহার কিছু কম নিতে সাধ!'<br />রূপার বলার এমনি ভঙ্গী বউ হেসে কুটি কুটি,<br />কখনও পড়িছে মাটিতে ঢলিয়া, কভু গায়ে পড়ে লুটি |<br />পরে কহে, 'দেখো, আরও কাছে এসো, বাঁশীটি লও তো হাতে,<br />এমনি করিয়া দোলাও ত দেখি নোলক দোলার সাথে!'</p>
<br /><p>বাঁশী বাজে আর নোলক যে দোলে, বউ কহে আর বার,<br />'আচ্ছা আমার বাহুটি নাকিগো সোনালী লতার হার?<br />এই ঘুরালেম, বাজাও ত দেখি এরি মত কোন সুর,'<br />তেমনি বাহুর পরশের মত বাজে বাঁশী সুমধুর!<br />দুটি করে রাঙা ঠোঁটখানি টেনে কহে বউ, 'এরি মত,<br />তোমার বাঁশীতে সুর যদি থাকে বাজাইলে বেশ হত |'<br />চলে মেঠো বাঁশী দুটি ঠোঁট ছুঁয়ে কলমী ফুলের বুকে,<br />ছোট চুমু রাখি চলে যেন বাঁশী, চলে সে যে কোন লোকে |</p>
<br /><p>এমনি করিয়া রাত কেটে যায় ; হাসে রবি ধীরি ধীরি,<br />বেড়ার ফাঁকেতে উঁকি মেরে দেখি দুটি খেয়ালীর ছিরি |<br />সেদিন রাত্রে বাঁশী শুনে শুনে বউটি ঘুমায়ে পড়ে,<br />তারি রাঙা মুখে বাঁশী-সুরে রূপা বাঁকা চাঁদ এনে ধরে |<br />তারপরে খুলে চুলের বেণীটি বার বার করে দেখে,<br />বাহুখানি দেখে নাড়িয়া নাড়িয়া বুকের কাছেতে রেখে |<br />কুসুম-ফুলেতে রাঙা পাও দুটি দেখে আরো রাঙা করি,<br />মৃদু তালে তালে নিঃশ্বাস লয়, শুনে মুখে মুখ ধরি |<br />ভাবে রূপা, ও-যে দেহ ভরি যেন এনেছে ভোরের ফুল,<br />রোদ উঠিলেই শুকাইয়া যাবে, শুধু নিমিষের ভুল!<br />হায় রূপা, তুই চোখের কাজলে আঁকিলি মোহন ছবি,<br />এতটুকু ব্যথা না লাগিতে যেরে ধুয়ে যাবে তোর সবি!</p>
<br /><p>ওই বাহু আর ওই তনু-লতা ভাসিছে সোঁতের ফুল,<br />সোঁতে সোঁতে ও যে ভাসিয়া যাইবে ভাঙিয়া রূপার কূল!<br />বাঁশী লয়ে রূপা বাজাতে বসিল বড় ব্যথা তার মনে,<br />উদাসীয়া সুর মাথা কুটে মরে তাহার ব্যথার সনে |</p>
<br /><p>ধারায় ধারায় জল ছুটে যায় রূপার দুচোখ বেয়ে,<br />বইটি তখন জাগিয়া উঠিল তাহার পরশ পেয়ে |<br />'ওমা ওকি? তুমি এখনো শোওনি! খোলা কেন মোর চুল?<br />একি! দুই পায়ে কে দেছে ঘষিয়া রঙিন কুসুম ফুল?<br />ওকি! ওকি!! তুমি কাঁদছিলে বুঝি! কেন কাঁদছিলে বল?'<br />বলিতে বলিতে বউটির চোখ জলে করে ছল ছল!<br />বাহুখানা তার কাঁধ পরে রাখি রূপা কয় মৃদু সুরে,<br />'শোন শোন সই, কে যেন তোমায় নিয়ে যেতে চায় দূরে!'</p>
<br /><p>'সে দূর কোথায়?' 'অনেক---অনেক---দেশ যেতে হয় ছেড়ে,<br />সেথা কেউ নাই শুধু আমি তুমি আর সেই সে অচেনা ফেরে |<br />তুমি ঘুমাইলে সে এসে আমায় কয়ে যায় কানে কানে,<br />যাই---যাই---ওরে নিয়ে যাই আমি আমার দেশের পানে |<br />বল, তুমি সেথা কখনও যাবে না, সত্যি করিয়া বল!'<br />'নয়! নয়! নয়!' বউ কহে তার চোখ দুটি ছল ছল |</p>
<br /><p>রূপা কয় 'শোন সোনার বরণি, আমার এ কুঁড়ে ঘর,<br />তোমার রূপের উপহাস শুধু করে সারা দিনভর |<br />তুমি ফুল! তব ফুলের গায়েতে বহে বিহানের বায়ু,<br />আমি কাঁদি সই রোদ উঠিলে যে ফুরাবে রঙের আয়ু |<br />আহা আহা সখি, তুমি যাহা কর, মোর মনে লয় তাই,<br />তোমার ফুলের পরাণে কেবল দিয়া যায় বেদনাই |'<br />এমন সময় বাহির হইতে বছির মামুর ডাকে,<br />ধড়মড় করি উঠিয়া রূপাই চাহিল বেড়ার ফাঁকে |</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-maath-9/নক্সী কাঁথার মাঠ - নয়2012-09-11T15:14:34-04:002023-06-27T07:34:29-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(নয়)</p>
<br /><p>আষাঢ় মাসে রূপীর মায়ে মরল বিকার জ্বরে,<br />রূপা সাজু খায়নি খানা সাত আট দিন ধরে |<br />লালন পালন যে করিত 'ঠোঁটের' আধার দিয়া,<br />সেই মা আজি মরে রূপার ভাঙল সুখের হিয়া |<br />ঘামলে পরে যে তাহারে করত আবের পাখা ;<br />সেই শাশুড়ী মরে, সাজুর সব হইল ফাঁকা |<br />সাজু রূপা দুই জনেতে কান্দে গলাগলি ;<br />গাছের পাতা যায় যে ঝরে, ফুলের ভাঙে কলি |<br />এত দুখের দিনও তাদের আস্তে হল গত,<br />আবার তারা সুখেরি ঘর বাঁধল মনের মত |</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-maath-8/নক্সী কাঁথার মাঠ - আট2012-09-11T15:13:46-04:002023-06-27T19:41:32-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(আট)</p>
<br /><p>বিয়ের কুটুম এসেছে আজ সাজুর মায়ের বাড়ি,<br />কাছারী ঘর গুম্-গুমা-গুম্ , লোক হয়েছে ভারি |<br />গোয়াল-ঘরে ঝেড়ে পুছে বিছান দিল পাতি ;<br />বসল গাঁয়ের মোল্লা মোড়ল গল্প-গানে মাতি |<br />কেতাব পড়ার উঠল তুফান ; ---চম্পা কালু গাজী,<br />মামুদ হানিফ সোনবান ও জয়গুন বিবি আজি ;<br />সবাই মিলে ফিরছে যেন হাত ধরাধর করি |<br />কেতাব পড়ার সুরে সুরে চরণ ধরি ধরি |<br />পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোড়ল নাচিয়ে ঘন দাড়ি,<br />পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোল্লা মাঠ-ফাটা ডাক ছাড়ি |</p>
<br /><p>কৌতুহলী গাঁয়ের লোকে শুনছে পেতে কান,<br />জুমজুমেরি পানি যেন করছে তারা পান!<br />দেখছে কখন মনের সুখে মামুদ হানিফ যায়,<br />লাল ঘোড়া তার উড়ছে যেন লাল পাখিটির প্রায় |<br />কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেমন কলার বাগ,<br />মেষের পালে পড়ছে যেন সুন্দর-বুনো বাঘ !<br />স্বপ্ন দেখে, জয়গুন বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে ;<br />মেঘের বরণ চুলগুলি তার পড়ছে এসে ভূঁয়ে ;<br />আকাশেরি চাঁদ সূরুজে মুখ দেখে পায় লাজ,<br />সেই কনেরে চোখের কাছে দেখছে চাষী আজ |<br />দেখছে চোখে কারবালাতে ইমাম হোসেন মরে,<br />রক্ত যাহার জমছে আজো সন্ধ্যা মেঘের গোরে ;<br />কারবালারি ময়দানে সে ব্যথার উপাখ্যান ;<br />সারা গাঁয়ের চোখের জলে করিয়া গেল সান |</p>
<br /><p>উঠান পরে হল্লা-করে পাড়ার ছেলে মেয়ে,<br />রঙিন বসন উড়ছে তাদের নধর তনু ছেয়ে |<br />কানা-ঘুষা করত যারা রূপার স্বভাব নিয়ে,<br />ঘোর কলিকাল দেখে যাদের কানত সদা হিয়ে ;<br />তারাই এখন বিয়ের কাজে ফিরছে সবার আগে,<br />ভাভা গড়ার সকল কাজেই তাদের সমান লাগে |<br />বউ-ঝিরা সব রান্না-বাড়ায় ব্যস্ত সকল ক্ষণ ;<br />সারা বাড়ি আনন্দ আজ খুশী সবার মন |<br />বাহিরে আজ এই যে আমোদ দেখছে জনে জনে ;<br />ইহার চেয়ে দ্বিগুণ আমোদ উঠছে রূপার মনে |<br />ফুল পাগড়ী মাথায় তাহার 'জোড়া জামা' গায়,<br />তেল-কুচ্-কাচ্ কালো রঙে ঝলক্ দিয়ে যায় |</p>
<br /><p>বউ-ঝিরা সব ঘরের বেড়ার খানিক করে ফাঁক,<br />নতুন দুলার রূপ দেখি আজ চক্ষে মারে তাক |<br />এমন সময় শোর উঠিল--- 'বিয়ের যোগাড় কর,<br />জলদী করে দুলার মুখে পান শরবত ধর |'<br />সাজুর মামা খটকা লাগায়, 'বিয়ের কিছু গৌণ,<br />সাদার পাতা আনেনি তাই বেজার সবার মন |'<br />রূপার মামা লম্ফে দাঁড়ায় দম্ভে চলে বাড়ি ;<br />সেরেক পাঁচেক সাদার পাতা আনল তাড়াতাড়ি |<br />কনের খালু উঠিয়া বলে 'সিঁদুর হল ঊনা!'<br />রূপার খালু আনিয়া দিল যা লাগে তার দুনা!</p>
<br /><p>কনের চাচার মন উঠে না, 'খাটো হয়েছে শাড়ী |'<br />রূপার চাচা দিল তখন 'ইংরাজী বোল ছাড়ি'|<br />'কিরে বেটা বকিস নাকি?' কনের চাচা হাঁকে,<br />জালির কলার পাতার মত গা কাঁপে তার রাগে |<br />'কোথায় গেলি ছদন চাচা, ছমির শেখের নাতি,<br />দেখিয়ে দেই দুলার চাচার কতই বুকের ছাতি!<br />বেরো বেটা নওশা নিয়ে, দিব না আজ বিয়া ;'<br />বলতে যেন আগুন ছোটে চোখ দুটি তার দিয়া |</p>
<br /><p>বরপক্ষের লোকগুলি সব আর যে বরের চাচা,<br />পালিয়ে যেতে খুঁজছে যেন রশুই ঘরের মাচা |</p>
<br /><p>মোড়ল এসে কনের চাচায় অনেক করে বলে,<br />থামিয়ে তারে বিয়ের কথা পাতেন কুতূহলে |<br />কনের চাচা বসল বরের চাচার কাছে,<br />কে বলে ঝড় এদের মাঝে হয়েছে যে পাছে!<br />মোল্লা তখন কলমা পড়ায় সাক্ষী-উকিল ডাকি,<br />বিয়ে রূপার হয়ে গেল, ক্ষীর-ভোজনী বাকি!</p>
<br /><p>তার মাঝেতে এমন তেমন হয়নি কিছু গোল,<br />কেবল একটি বিষয় নিয়ে উঠল হাসির রোল |<br />এয়োরা সব ক্ষীর ছোঁয়ায়ে কনের ঠোঁটের কাছে ;<br />সে ক্ষীর আবার ধরল যখন রূপার ঠোঁটের পাছে ;<br />রূপা তখন ফেলল খেয়ে ঠোঁট ছোঁয়া সেই ক্ষীর,<br />হাসির তুফান উঠল নেড়ে মেয়ের দলের ভীড় |<br />ভাবল রূপাই---অমন ঠোঁটে যে ক্ষীর গেছে ছুঁয়ে,<br />দোজখ যাবে না খেয়ে তা ফেলবে যে জন ভূঁয়ে |</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-maath-7/নক্সী কাঁথার মাঠ - সাত2012-09-11T15:12:26-04:002023-06-27T18:34:25-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(সাত)</p>
<br /><p>কান্-কানা-কান্ ছুটল কথা গুন্-গুনা-গুন তানে,<br />শোন্-শোনা-শোন সবাই শোনে, কিন্তু কানে কানে |<br />'কি করগো রূপার মাতা? খাইছ কানের মাথা?<br />ও-দিক যে তোর রূপার নামে রটছে গাঁয়ে যা তা!<br />আমরা বলি রূপাই এমন সোনার কলি ছেলে,<br />তার নামে হয় এমন কথা দেখব কি কাল গেলে?'<br />এই বলিয়া বড়াই বুড়ি বসল বেড়ি দোর,<br />রূপার মা কয়, 'বুঝিনে বোন কি তোর কথার ঘোর!'<br />বুড়ি যেন আচমকা হায় আকাশ হতে পড়ে,<br />'সবাই জানে তুই না জানিস যে কথা তোর ঘরে?'<br />ও-পাড়ার ও ডাগর ছুঁড়ী, সেখের বাড়ির 'সাজু'<br />তারে নাকি তোর ছেলে সে গড়িয়ে দেছে বাজু |<br />ঢাকাই শাড়ী কিন্যা দিছে, হাঁসলী দিছে নাকি,<br />এত করে এখন কেন শাদীর রাখিস বাকি?'<br />রূপার মা কয়, 'রূপা আমার এক-রত্তি ছেলে,<br />আজও তাহার মুখ শুঁকিলে দুধের ঘিরাণ মেলে |<br />তার নামে যে এমন কথা রটায় গাঁয়ে গাঁয়ে,<br />সে যেন তার বেটার মাথা চিবায় বাড়ি যায় |'</p>
<br /><p>রূপার মায়ের রুঠা কথায় উঠল বুড়ীর কাশ,<br />একটু দিলে তামাক পাতা, নিলেন বুড়ী শ্বাস |<br />এমন সময় ওই গাঁ হতে আসল খেঁদির মাতা,<br />টুনির ফুপু আসল হাতে ডলতে তামাক পাতা |<br />ক'জনকে আর থামিয়ে রাখে? বুঝল রূপার মা ;<br />রূপা তাহার সত্যি করেই এতটুকুন না |<br />বুঝল মায়ে কেন ছেলে এমন উদাস পারা,<br />হেথায় হোথায় কেবল ঘোরে হয়ে আপন হারা |<br />ও পাড়ার ও দুখাই মিয়া ঘটকালিতে পাকা,<br />সাজুর সাথেই জুড়ুর বিয়ে যতকে লাগুক টাকা |</p>
<br /><p>শেখ বাড়িতে যেয়ে ঘটক বেকী-বেড়ার কাছে,<br />দাঁড়িয়ে বলে, 'সাজুর মাগো, একটু কথা আছে |'<br />সাজুর মায়ে বসতে তারে এনে দিলেন পিঁড়ে,<br />ডাব্বা হুঁকা লাগিয়ে বলে, 'আস্তে টান ধীরে |'<br />ঘটক বলে, 'সাজুর মাগো মেয়ে তোমার বড়,<br />বিয়ের বয়স হল এখন ভাবনা কিছু কর |'<br />সাজুর মা কয় 'তোমরা আছ ময়-মুরুব্বি ভাই,<br />মেয়ে মানুষ অত শত বুঝি কি আর ছাই!<br />তোমরা যা কও ঠেলতে কি আর সাধ্য আছে মোর?'<br />ঘটক বলে, 'এই ত কথা, লাগবে না আর ঘোর |<br />ও-পাড়ার ও রূপারে ত চেনই তুমি বোন্,<br />তার সাথে দাও মেয়ের বিয়ে ঠিক করিয়ে মন |'<br />সাজুর মা কয়, 'জান ত ভাই! রটছে গাঁয়ে যাতা,<br />রূপার সাথে বিয়ে দিলে থাকবে না আর মাথা |'</p>
<br /><p>ঘটক বলে, 'কাঁটা দিয়েই তুলতে হবে কাঁটা,<br />নিন্দা যারা করে তাদের পড়বে মুখে ঝাঁটা |<br />রূপা ত আর নয় এ গাঁয়ে যেমন তেমন ছেলে,<br />লক্ষ্মীরে দেই বউ বানায়ে অমন জামাই পেলে!'<br />ঠাটে ঘটক কয় গো কথা ঠোঁট-ভরাভর হাসে ;<br />সাজুর মায়ের পরাণ তারি জোয়ার-জলে ভাসে |<br />'দশ খান্দা জমি রূপার, তিনটি গরু হালে,<br />ধানের-বেড়ী ঠেকে তাহার বড় ঘরের চালে |'<br />সাজু তোমার মেয়ে যেমন, রূপাও ছেলে তেমন,<br />সাত গেরামের ঘটক আমি জোড় দেখিনি এমন |'</p>
<br /><p>তার পরেতে পাড়ল ঘটক রূপার কুলের কথা,<br />রূপার দাদার নাম গুনে লোক কাঁপত যথা তথা |<br />রূপার নানা সোয়েদ-ঘেঁষা, মিঞাই বলা যায়---<br />কাজী বাড়ির প্যায়দা ছিল কাজল-তলার গাঁয় |<br />রূপার বাপের রাখত খাতির গাঁয়ের চৌকিদারে,<br />আসেন বসেন মুখের কথা---গান বজিত তারে |<br />রূপার চাচা অছিমদ্দী, নাম শোন নি তার?<br />ইংরেজী তার বোল শুনিলে সব মানিত হার |<br />কথা ঘটক বলল এঁটে, বলল কখন ঢিলে,<br />সাজুর মায়ে সবগুলি তার ফেলল যেন গিলে |</p>
<br /><p>মুখ দেখে বুঝল ঘটক---লাগছে অষুধ হাড়ে,<br />বলল, 'তোমার সাজুর বিয়া ঠিক কর এই বারে |'<br />সাজুর মা কয়, ' যা বোঝ ভাই, তোমরা গ্যা তাই কর,<br />দেখ যেন কথার আবার হয় না নড়চড় |'</p>
<br /><p>'আউ ছি ছি!' ঘটক বলে, 'শোনই কথা বোন,<br />তোমার সাজুর বিয়া দিতে লাগবে কত পণ?<br />পোণে দিব কুড়ি দেড়েক বায়না দেব তেরো,<br />চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় এই গে ধর বারো |<br />সবদ্যা হল দুই কুড়ি এ নিতেই হবে বোন,<br />চাইলে বেশী জামাইর তোমার বেজার হবে মন!'<br />সাজুর মা কয়, 'ও-সব কথার কি-ইবা আমি জানি,<br />তোমরা যা কও তাইত খোদার গুকুর বলে মানি |'<br />সাধে বলে দুখাই ঘটক ঘটকালিতে পাকা,<br />আদ্য মধ্য বিয়ের কথা সব করিল ফাঁকা |</p>
<br /><p>চল্-চলা-চল্ চলল দুখাই পথ বরাবর ধরি,<br />তাগ্-ধিনা-ধিন্ নাচে যেন গুন্ গুনা গান করি |<br />দুখাই ঘটক নেচে চলে নাচে তাহার দাড়ি,<br />বুড়োর বটের শিকড় যেন চলছে নাড়ি নাড়ি ;<br />লম্ফে লম্ফে চলে ঘটক দম্ভ করে চায়,<br />লুটের মহল দখল করে চলছে যেন গাঁয়!<br />ঘটকালিরই টাকা যেন ঝন্-ঝনা-ঝন্ বাজে,<br />হন্-হানা-হন্ চলল ঘটক একলা পথের মাঝে |<br />ধানের জমি বাঁয় ফেলিয়া ফেলিয়া, ডাইনে ঘন পাট,<br />জলীর বিলে নাও বাঁধিয়া ধরল গাঁয়ের বাট |<br />'কি কর গো রূপার মাতা, ভবছ বসি কিবা,<br />সাজুর সাথেই ঠিক কইরাছি তোমার ছেলের বিবা |<br />সহজে কি হয় সে রাজি, একশ টাকা পণ,<br />এর কমেতে বসেইনাক সাজুর মায়ের মন |</p>
<br /><p>আমিও আবার কুড়ি তিনেক উঠিনে তার পরে,<br />সাজুর মায়ও নাছোড়-বান্দা, দিলাম তখন ধরে ;<br />আরেক কুড়ি, তয় সে কথা কইল হাসি হাসি,<br />আমি ভাবি, বিয়ার বুঝি বাজল সানাই বাঁশী |<br />এখন বলি রূপার মাতা, আড়াই কুড়ি টাকা,<br />মোর কাছেতে দিবা, কথা হয় না যেন ফাঁকা!<br />আসব দিয়ে গোপনে তায়, নইলে গাঁয়ের লোকে,<br />মেজবানী দাও বলে তারে ধরবে চীনে জোঁকে |<br />বিয়ের দিনে নিবে সে তাই তিরিশ টাকা যেচে,<br />যারে তারে বলতে পার এই কথাটি নেচে |<br />চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় তার লাগিবে ষোলো,<br />এই ধরগ্যা রূপার বিয়া আজই যেন হল |'</p>
<br /><p>রূপার মায়ের আহ্লাদে প্রাণ ধরেইনাক আর,<br />ইচ্ছে করে নেচে নেচে বেড়ায় বারে বার |<br />'ও রূপা তুই কোথায় গেলি? ভাবিসনাক মোটে,<br />কপাল গুণি বিয়ে যে তোর সাজুর সাথেই জোটে!'<br />এই বলিয়া রূপার মাতা ছুটল গাঁয়ের পানে,<br />ঘটক গেল নিজের বাড়ি গুন্-গুনা-গুন্ গানে |</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-maath-6/নক্সী কাঁথার মাঠ - ছয়2012-09-11T15:08:53-04:002023-06-27T16:42:12-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(ছয়)</p>
<br /><p>ঘরেতে রূপার মন টেকে না যে, তরলা বাঁশীর পারা,<br />কোন বাতাসেতে ভেসে যেতে চায় হইয়া আপন হারা |<br />কে যেন তার মনের তরীরে ভাটির করুণ তানে,<br />ভাটিয়াল সোঁতে ভাসাইয়া নেয় কোন্ সে ভাটার পানে |<br />সেই চিরকেলে গান আজও গাহে, সুরখানি তার ধরি,<br />বিগানা গাঁয়ের বিরহিয়া মেয়ে আসে যেন তরি!<br />আপনার গানে আপনার প্রাণ ছিঁড়িয়া যাইতে চায়,<br />তবু সেই ব্যথা ভাল লাগে যেন, একই গান পুনঃ গায় |<br />খেত-খামারেতে মন বসেনাকো ; কাজে কামে নাই ছিরি,<br />মনের তাহার কি যে হল আজ ভাবে তাই ফিরি ফিরি |<br />গানের আসরে যায় না রূপাই সাথীরা অবাক মানে,<br />সারাদিন বসি কি যে ভাবে তার অর্থ সে নিজে জানে!<br />সময়ের খাওয়া অসময় খায়, উপোসীও কভু থাকে,<br />'দিন দিন তোর কি হল রূপাই' বার বার মায় ডাকে |<br />গেলে কোনখানে হয়তো সেথাই কেটে যায় সারা দিন,<br />বসিলে উঠেনা উঠিলে বসেনা, ভেবে ভেবে তনু ক্ষীণ |<br />সবে হাটে যায় পথ বরাবর রূপা যায় ঘুরে বাঁকা,<br />খালার বাড়ির কাছ দিয়ে পথ, বাঁশ-পাতা দিয়ে ঢাকা |</p>
<br /><p>পায়ে-পায় ছাই বাঁশ-পাতাগুলো মচ্ মচ্ করে বাজে ;<br />কেউ সাথে নেই, তবু যে রূপাই মরে যায় যেন লাজে |<br />চোরের মতন পথে যেতে যেতে এদিক ওদিক চায়,<br />যদিবা হঠাৎ সেই মেয়েটির দুটি চোখে চোখ যায় |<br />ফিরিবার পথে খালার বাড়ির নিকটে আসিয়া তার,<br />কত কাজ পড়ে, কি করে রূপাই দেরি না করিয়া আর |<br />কোনদিন কহে, 'খালামা, তোমার জ্বর নাকি হইয়াছে,<br />ও-বাড়ির ওই কানাই আজিকে বলেছে আমার কাছে |<br />বাজার হইতে আনিয়াছি তাই আধসেরখানি গজা |'<br />'বালাই! বালাই! জ্বর হবে কেন? রূপাই, করিলি মজা ;<br />জ্বর হলে কিরে গজা খায় কেহ?' হেসে কয় তার খালা,<br />'গজা খায়নাক, যা হোক এখন কিনে ত হইল জ্বালা ;<br />আচ্ছা না হয় সাজুই খাইবে |' ঠেকে ঠেকে রূপা কহে,<br />সাজু যে তখন লাজে মরে যায়, মাথা নিচু করে রহে |</p>
<br /><p>কোন দিন কহে, 'সাজু কই ওরে, শোনো কিবা মজা, খালা!<br />আজকের হাটে কুড়ায়ে পেয়েছি দুগাছি পুঁতির মালা ;<br />এক ছোঁড়া কয়, 'রাঙা সূতো' নেবে? লাগিবে না কোন দাম ;<br />নিলে কিবা ক্ষতি, এই ভেবে আমি হাত পেতে রইলাম |<br />এখন ভাবছি, এসব লইয়া কিবা হবে মোর কাজ,<br />ঘরেতে থাকিলে ছোট বোনটি সে ইহাতে করিত সাজ |<br />সাজু ত আমার বোনেরই মতন, তারেই না দিয়ে যাই,<br />ঘরে ফিরে যেতে একটু ঘুরিয়া এ-পথে আইনু তাই |'</p>
<br /><p>এমনি করিয়া দিনে দিনে যেতে দুইটি তরুণ হিয়া,<br />এ উহারে নিল বরণ করিয়া বিনে-সূতী মালা দিয়া |</p>
<br /><p>এর প্রাণ হতে ওর প্রাণে যেয়ে লাগিল কিসের ঢেউ,<br />বিভোর কুমার, বিভোর কুমারী, তারা বুঝিল না কেউ |<br />---তারা বুঝিল না, পাড়ার লোকেরা বুঝিল অনেকখানি,<br />এখানে ওখানে ছেলে বুড়ো মিলে শুরু হল কানাকানি |</p>
<br /><p>সেদিন রূপাই হাট-ফেরা পথে আসিল খালার বাড়ি,<br />খালা তার আজ কথা কয়নাক, মুখখানি যেন হাঁড়ি |<br />'রূপা ভাই এলে?' এই বলে সাজু কাছে আসছিল তাই,<br />মায় কয়, 'ওরে ধাড়ী মেয়ে, তোর লজ্জা শরম নাই?'<br />চুল ধরে তারে গুড়ুম গুড়ুম মারিল দু'তিন কিল,<br />বুঝিল রূপাই এই পথে কোন হইয়াছে গরমিল |</p>
<br /><p>মাথার বোঝাটি না-নামায়ে রূপা যেতেছিল পথ ধরি,<br />সাজুর মায়ে যে ডাকিল তাহারে হাতের ইশারা করি ;<br />'শোন বাছা কই, লোকের মুখেতে এমন তেমন শুনি,<br />ঘরে আছে মোর বাড়ন্ত মেয়ে জ্বলন্ত এ আগুনি |<br />তুমি বাপু আর এ-বাড়ি এসো না |' খালা বলে রোষে রোষে,<br />'কে কি বলে? তার ঘাড় ভেঙে দেব!' রূপা কহে দম কসে |<br />'ও-সবে আমার কাজ নাই বাপু, সোজা কথা ভালবাসি,<br />সারা গাঁয়ে আজ ঢি ঢি পড়ে গেছে, মেয়ে হল কুল-নাশী |'</p>
<br /><p>সাজুর মায়ের কথাগুলি যেন বঁরশীর মত বাঁকা,<br />ঘুরিয়া ঘুরিয়া মনে দিয়ে যায় তীব্র বিষের ধাকা |<br />কে যেন বাঁশের জোড়-কঞ্চিতে তাহার কোমল পিঠে,<br />মহারোষ-ভরে সপাং সপাং বাড়ি দিল গিঠে গিঠে |<br />টলিতে টলিতে চলিল রূপাই একা গাঁর পথ ধরি,<br />সম্মুখ হতে জোনাকীর আলো দুই পাশে যায় সরি |</p>
<br /><p>রাতের আঁধারে গালি-ভরা বিষে জমাট বেঁধেছে বুঝি,<br />দুই হাতে তাহা ঠেলিয়া ঠেলিয়া চলে রূপা পথ খুঁজি |<br />মাথার ধামায় এখনও রয়েছে দুজোড়া রেশমী চুরী,<br />দুপায়ে তাহারে দলিয়া রূপাই ভাঙিয়া করিল গুঁড়ি |<br />টের সদাই জলীর বিলেতে দুহাতে ছুঁড়িয়া ফেলি,<br />পথ থুয়ে রূপা বেপথে চলিল, ইটা খেতে পাও মেলি |<br />চলিয়া চলিয়া মধ্য মাঠেতে বসিয়া কাঁদিল কত,<br />অষ্টমী চাঁদ হেলিয়া হেলিয়া ওপারে হইল গত |</p>
<br /><p>প্রভাতে রূপাই উঠিল যখন মায়ের বিছানা হতে,<br />চেহারা তাহার আধা হয়ে গেছে, চেনা যায় কোন মতে |<br />মা বলে, 'রূপাই কি হলরে তোর?' রূপাই কহে না কথা<br />দুখিনী মায়ের পরাণে আজিকে উঠিল দ্বিগুণ ব্যথা |<br />সাত নয় মার পাঁচ নয় এক রুপাই নয়ন তারা,<br />এমনি তাহার দশা দেখে মায় ভাবিয়া হইল সারা |<br />শানাল পীরের সিন্নি মানিল খেতে দিল পড়া-পানি,<br />হেদের দৈন্য দেখিল জননী, দেখিলনা প্রাণখানি |<br />সারা গায়ে মাতা হাত বুলাইল চোখে মুখে দিল জল,<br />বুঝিল না মাতা বুকের ব্যথার বাড়ে যে ইহাতে বল |</p>
<br /><p>আজকে রূপার সকলি আঁধার, বাড়া-ভাতে ওড়ে ছাই,<br />কলঙ্ক কথা সবে জানিয়াছে, কেহ বুঝি বাকি নাই |<br />জেনেছে আকাশ, জেনেছে বাতাস, জেনেছে বনের তরু ;<br />উদাস-দৃষ্টি য়ত দিকে চাহে সব যেন শূনো মরু |</p>
<br /><p>চারিদিক হতে উঠিতেছে সুর, ধিক্কার! ধিক্কার!!<br />শাঁখের করাত কাটিতেছে তারে লয়ে কলঙ্ক ধার |<br />ব্যথায় ব্যথায় দিন কেটে গেল, আসিল ব্যথার সাঁজ,<br />পূবে কলঙ্কী কালো রাত এল, চরণে ঝিঁঝির ঝাঁজ!<br />অনেক সুখের দুখের সাক্ষী বাঁশের বাঁশীটি নিয়ে,<br />বসিল রূপাই বাড়ির সামনে মধ্য মাঠেতে গিয়ে |</p>
<br /><p>মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি ;<br />মিছেই মোদের সুখ-দুখ দিয়ে তার সুখ-দুখ খুঁজি |<br />আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা, পড়িলেই বোঝা যায় ;<br />যে লেখে বেদনা বে-বুঝ বাঁশীতে কেমন দেখাব তায়?<br />অনন্তকাল যাদের বেদনা রহিয়াছে শুধু বুকে,<br />এ দেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে ;<br />সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব? তবুও মাটিতে কান ;<br />পেতে রহি কভু শোনা যায় কি কহে মাটির প্রাণ!<br />মোরা জানি খোঁজ বৃন্দাবনেতে ভগবান করে খেলা,<br />রাজা-বাদশার সুখ-দুখ দিয়ে গড়েছি কথার মালা |<br />পল্লীর কোলে নির্ব্বাসিত এ ভাইবোনগুলো হায়,<br />যাহাদের কথা আধ বোঝা যায়, আধ নাহি বোঝা যায় ;<br />তাহাদেরই এক বিরহিয়া বুকে কি ব্যথা দিতেছে দোল,<br />কি করিয়া আ দেখাইব তাহা, কোথা পাব সেই বোল?<br />---সে বন-বিহগ কাঁদিতে জানে না, বেদনার ভাষা নাই,<br />ব্যাধের শায়ক বুকে বিঁধিয়াছে জানে তার বেদনাই |</p>
<br /><p>বাজায় রূপাই বাঁশীটি বাজায় মনের মতন করে,<br />যে ব্যথা সে বুকে ধরিতে পারেনি সে ব্যথা বাঁশীতে ঝরে |<br />বাজে বাঁশী বাজে, তারি সাথে সাথে দুলিছে সাঁজের আলো ;<br />নাচে তালে তালে জোনাকীর হারে কালো মেঘে রাত-কালো |<br />বাজাইল বাঁশী ভাটিয়ালী সুরে বাজাল উদাস সুরে,<br />সুর হতে সুর ব্যথা তার চলে যায় কোন দূরে!<br />আপনার ভাবে বিভোল পরাণ, অনন্ত মেঘ-লোকে,<br />বাঁশী হতে সুরে ভেসে যায় যেন, দেখে রূপা দুই চোখে |<br />সেই সুর বয়ে চলেছে তরুণী, আউলা মাথার চুল,<br />শিথিল দুখান বাহু বাড়াইয়াছিঁড়িছে মালার ফুল |<br />রাঙা ভাল হতে যতই মুছিছে ততই সিঁদুর জ্বলে ;<br />কখনও সে মেয়ে আগে আগে চলে, কখনও বা পাছে চলে |<br />খানিক চলিয়া থামিল করুণী আঁচলে ঢাকিয়া চোখ,<br />মুছিতে মুছিতে মুছিতে পারে না, কি যেন অসহ শোক!<br />করুণ তাহার করুণ কান্না আকাশ ছাইয়া যায়,<br />কি যে মোহের রঙ ভাসে মেঘে তাহার বেদনা-ঘায় |<br />পুনরায় যেন খিল খিল করে একগাল হাসি হাসে,<br />তারি ঢেউ লাগি গগনে গগনে তড়িতের রেখা ভাসে |</p>
<br /><p>কখনও আকাশ ভীষণ আঁধার, সব গ্রাসিয়াছে রাহু,<br />মহাশূণ্যের মাঝে ভেসে উঠে যেন দুইখানি বাহু!<br />দোলে-দোলে-বাহু তারি সাথে যেন দোলে-দোলে কত কথা,<br />'ঘরে ফিরে যাও, মোর তরে তুমি সহিও না আর ব্যথা |'<br />মুহূর্ত পরে সেই বাহু যেন শূণ্যে মিলায় হায়---<br />রামধনু বেয়ে কে আসে ও মেয়ে, দেখে যেন চেনা যায়!<br />হাসি হাসি মুখ গলিয়া গলিয়া হাসি যায় যেন পড়ে,<br />সার গায়ে তার রূপ ধরেনাক, পড়িছে আঁচল ঝরে |<br />কণ্ঠে তাহার মালার গন্ধে বাতাস পাগল পারা,<br />পায়ে রিনি ঝিনি সোনার নূপুর বাজিয়া হইছে সারা ;</p>
<br /><p>হঠাৎ কে এল ভীষণ দস্যু---ধরি তার চুল মুঠি,<br />কোন্ আন্ধার গ্রহপথ বেয়ে শূণ্যে সে গেল উঠি |<br />বাঁশী ফেলে দিয়ে ডাক ছেড়ে রূপা আকাশের পানে চায়,<br />আধা চাঁদখানি পড়িছে হেলিয়া সাজুদের ওই গাঁয় |<br />শুনো মাঠে রূপা গড়াগড়ি যায়, সারা গায়ে ধূলো মাখে,<br />দেহেরে ঢাকিছে ধূলো মাটি দিয়ে, ব্যথারে কি দিয়ে ঢাকে!</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-math-5/নক্সী কাঁথার মাঠ - পাঁচ2012-09-11T15:07:51-04:002023-06-27T00:59:36-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(পাঁচ)</p>
<br /><p>আশ্বিনেতে ঝড় হাঁকিল, বাও ডাকিল জোরে,<br />গ্রামভরা-ভর ছুটল ঝপট লট্ পটা সব করে |<br />রূপার বাড়ির রুশাই-ঘরের ছুটল চালের ছানি,<br />গোয়াল ঘরের খাম থুয়ে তার চাল যে নিল টানি |<br />ওগাঁর বাঁশ দশটা টাকায়, সে-গাঁয় টাকায় তেরো,<br />মধ্যে আছে জলীর বিল কিইবা তাহে গেরো |<br />বাঁশ কাটিতে চলল রূপাই কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া,<br />দুপুর বেলায় খায় যেন সে---মায় দিয়াছে কিরা |<br />মাজায় গোঁজা রাম-কাটারী চক্ চকাচক্ ধার,<br />কাঁধে রঙিন গামছাখানি দুলছে যেন হার |<br />মোল্লা-বাড়ির বাঁশ ভাল, তার ফাঁপগুলি নয় বড় ;<br />খাঁ-বাড়ির বাঁশ ঢোলা ঢোলা, করছে কড়মড় |<br />সর্ব্বশেষে পছন্দ হয় খাঁ-বাড়ির বাঁশ :<br />ফাঁপগুলি তার কাঠের মত, চেকন-চোকন আঁশ |</p>
<br /><p>বাঁশ কাটিতে যেয়ে রূপাই মারল বাঁশে দা,<br />তল দিয়ে যায় কাদের মেয়ে---হলদে পাখির ছা!<br />বাঁশ কাটিতে বাঁশের আগায় লাগল বাঁশের বাড়ি,<br />চাষী মেয়ের দেখে তার প্রাণ বুঝি যায় ছাড়ি |<br />লম্বা বাঁশের লম্বা যে ফাঁপ, আগায় বসে টিয়া,<br />চাষীদের ওই সোনার মেয়ে কে করিবে বিয়া!<br />বাঁশ কাটিতে এসে রূপাই কাটল বুকের চাম,<br />বাঁশের গায়ে বসে রূপাই ভুলল নিজের কাম |<br />ওই মেয়ে ত তাদের গ্রামে বদনা-বিয়ের গানে,<br />নিয়েছিল প্রাণ কেড়ে তার চিকন সুরের দানে |</p>
<br /><p>'খড়ি কুড়াও সোনার মেয়ে! শুকনো গাছের ডাল,<br />শুকনো আমার প্রাণ নিয়ে যাও, দিও আখার জ্বাল |<br />শুকনো খড়ি কুড়াও মেয়ে! কোমল হাতে লাগে,<br />তোমায় যারা পাঠায় বনে বোঝেনি কেন আগে?'<br />এমনিতর কত কথাই উঠে রূপার মনে,<br />লজ্জাতে সে হয় যে রঙিন পাছে বা কেউ শোনে |<br />মেয়েটিও ডাগর চোখে চেয়ে তাহার পানে,<br />কি কথা সে ভাবল মনে সেই জানে তার মানে!</p>
<br /><p>এমন সময় পিছন হতে তাহার মায়ে ডাকে,<br />'ওলো সাজু! আয় দেখি তোর নথ বেঁধে দেই নাকে!<br />ওমা! ও কে বেগান মানুষ বসে বাঁশের ঝাড়ে!'<br />মাথায় দিয়ে ঘোমটা টানি দেখছে বারে বারে |</p>
<br /><p>খানিক পরে ঘোমটা খুলে হাসিয়া এক গাল,<br />বলল, 'ও কে, রূপাই নাকি? বাঁচবি বহকাল!<br />আমি যে তোর হইযে খালা, জানিসনে তুই বুঝি?<br />মোল্লা বাড়ির বড়ুরে তোর মার কাছে নিস্ খুঁজি |<br />তোর মা আমার খেলার দোসর---যাকগে ও সব কথা,<br />এই দুপুরে বাঁশ কাটিয়া খাবি এখন কোথা?'</p>
<br /><p>রূপাই বলে, 'মা দিয়েছেন কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া'<br />'ওমা! ও তুই বলিস কিরে? মুখখানা তোর ফিরা!<br />আমি হেথা থাকতে খালা, তুই থাকবি ভুখে,<br />শুনলে পরে তোর মা মোরে দুষবে কত রুখে!<br />ও সাজু, তুই বড় মোরগ ধরগে যেয়ে বাড়ি,<br />ওই গাঁ হতে আমি এদিক দুধ আনি এক হাঁড়ি |'</p>
<br /><p>চলল সাজু বাড়ির দিকে, মা গেল ওই পাড়া |<br />বাঁশ কাটতে রূপাই এদিক মারল বাঁশে নাড়া |<br />বাঁশ কাটিতে রূপার বুকে ফেটে বেরোয় গান,<br />নলী বাঁশের বাঁশীতে কে মারছে যেন টান!<br />বেছে বেছে কাটল রূপাই ওড়া-বাঁশের গোড়া,<br />তল্লা বাঁশের কাটল আগা, কালধোয়ানির জোড়া ;<br />বাল্ কে কাটে আল্ কে কাটে কঞ্চি কাটে শত,<br />ওদিক বসে রূপার খালা রান্ধে মনের মত |</p>
<br /><p>সাজু ডাকে তলা থেকে, 'রূপা-ভাইগো এসো,'<br />---এই কথাটি বলতে তাহার লজ্জারো নাই শেষও!<br />লাজের ভারে হয়তো মেয়ে যেতেই পারে পড়ে,<br />রূপাই ভাবে হাত দুখানি হঠাৎ যেয়ে ধরে |</p>
<br /><p>যাহোক রূপা বাঁশ কাটিয়া এল খালার বাড়ি,<br />বসতে তারে দিলেন খালা শীতল পাটি পাড়ি |<br />বদনা ভরে জল দিল আর খড়ম দিল মেলে,<br />পাও দুখানি ধুয়ে রূপাই বসল বামে হেলে |<br />খেতে খেতে রূপাই কেবল খালার তারীফ করে,<br />'অনেক দিনই এমন ছালুন খাইনি কারো ঘরে |'<br />খালায় বলে 'আমি ত নয়, রেঁধেছে তোর বোনে,'<br />লাজে সাজুর ইচ্ছা করে লুকায় আঁচল কোণে |<br />এমনি নানা কথায় রূপার আহার হল সারা,<br />সন্ধ্যা বেলায় চলল ঘরে মাথায় বাঁশের ভারা |</p>
<br /><p>খালার বাড়ির এত খাওয়া, তবুও তার মুখ,<br />দেখলে মনে হয় যে সেথা অনেক লেখা দুখ |<br />ঘরে যখন ফিরল রূপা লাগল তাহার মনে,<br />কি যেন তার হয়েছে আজ বাঁশ কাটিতে বনে |<br />মা বলিল, 'বাছারে, কেন মলিন মুখে চাও?'<br />রূপাই কহে, 'বাঁশ কাটিতে হারিয়ে এলেম দাও |'</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nokshi-kathar-math-4/নক্সী কাঁথার মাঠ - চার2012-09-11T15:06:18-04:002023-06-27T00:59:37-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(চার)</p>
<br /><p>চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে,<br />এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামল না গাঁর বাটে |<br />ডোলের বেছন ডোলে চাষীর, বয় না গরু হালে,<br />লাঙল জোয়াল ধূলায় লুটায় মরচা ধরে ফালে |<br />কাঠ-ফাটা রোদ মাঠ বাটা বাট আগুন লয়ে খেলে,<br />বাউকুড়াণী উড়ছে তারি ঘূর্ণী ধূলী মেলে |<br />মাঠখানি আজ শূণ্য খাঁ খাঁ, পথ যেতে দম আঁটে,<br />জন্-মানবের নাইক সাড়া কোথাও মাঠের বাটে :<br />শুকনো চেলা কাঠের মত শুকনো মাঠের ঢেলা,<br />আগুন পেলেই জ্বলবে সেথায় জাহান্নামের খেলা |<br />দরগা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নি আসে ভারে :<br />নৈলা গানের ঝঙ্কারে গাঁও কানছে বারে বারে |<br />তবুও গাঁয়ে নামল না জল, গগনখানা ফাঁকা ;<br />নিঠুর নীলের বক্ষে আগুন করছে যেনে খাঁ খাঁ |</p>
<br /><p>উচ্চে ডাকে বাজপক্ষি 'আজরাইলে'র ডাক,<br />'খর দরজাল' আসছে বুঝি শিঙায় দিয়ে হাঁক!<br />এমন সময় ওই গাঁ হতে বদনা-বিয়ের গানে,<br />গুটি কয়েক আসলো মেয়ে এই না গাঁয়ের পানে |<br />আগে পিছে পাঁচটি মেয়ে---পাঁচটি রঙে ফুল,<br />মাঝের মেয়ে সোনার বরণ, নাই কোথা তার তুল |<br />মাথায় তাহার কুলোর উপর বদনা-ভরা জল,<br />তেল হলুদে কানায় কানায় করছে ছলাৎ ছল |<br />মেয়ের দলে বেড়িয়ে তারে চিকন সুরের গানে,<br />গাঁয়ের পথে যায় যে বলে বদনা-বিয়ের মানে |<br />ছেলের দলে পড়ল সাড়া, বউরা মিঠে হাসে,<br />বদনা বিয়ের গান শুনিতে সবাই ছুটে আসে |<br />পাঁচটি মেয়ের মাঝের মেয়ে লাজে যে যায় মরি,<br />বদনা হাতে ছলাৎ ছলাৎ জল যেতে চায় পড়ি |<br />এ-বাড়ি যায় ও-বাড়ি যায়, গানে মুখর গাঁ,<br />ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে যেন-রাম-শালিকের ছা |</p>
<br /><p>কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো,<br />ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো!<br />কানা মেঘা, টলমল বারো মেঘার ভাই,<br />আরও ফুটিক ডলক দিলে চিনার ভাত খাই!</p>
<br /><p>কাজল মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া,<br />তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া!<br />আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি,<br />নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি |<br />কৌটা ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়,<br />আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়!</p>
<br /><p>দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো |<br />দেয়ারে তুমি নিষালে নিষালে নামো |<br />ঘরের লাঙল ঘরে রইল, হাইলা চাষা রইদি মইল ;<br />দেয়ারে তুমি অরিশাল বদনে ঢলিয়া পড় |<br />ঘরের গরু ঘরে রইল, ডোলের বেছন ডোলে রইল ;<br />দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো |</p>
<br /><p>বারো মেঘের নামে নামে এমনি ডাকি ডাকি,<br />বাড়ি বাড়ি চলল তারা মাঙন হাঁকি হাঁকি<br />কেউবা দিল এক পোয়া চাল, কেউবা ছটাকখানি,<br />কেউ দিল নুন, কেউ দিল ডাল, কেউ বা দিল আনি |<br />এমনি ভাবে সবার ঘরে মাঙন করি সারা,<br />রূপাই মিয়ার রুশাই-ঘরের সামনে এল তারা |<br />রূপাই ছিল ঘর বাঁধিতে, পিছন ফিরে চায়,<br />পাঁটি মেয়ের রূপ বুঝি ওই একটি মেয়ের গায়!<br />পাঁচটি মেয়ে, গান যে গায়, গানের মতই লাগে,<br />একটি মেয়ের সুর ত নয় ও বাঁশী বাজায় আগে |<br />ওই মেয়েটির গঠন-গাঠন চলন-চালন ভালো,<br />পাঁচটি মেয়ের রূপ হয়েছে ওরই রূপে আলো |</p>
<br /><p>রূপাইর মা দিলেন এনে সেরেক খানেক ধান,<br />রূপাই বলে, 'এই দিলে মা থাকবে না আর মান |'<br />ঘর হতে সে এনে দিল সেরেক পাঁচেক চাল,<br />সেরেক খানেক দিল মেপে সোনা মুগের ডাল |<br />মাঙন সেরে মেয়ের দল চলল এখন বাড়ি,<br />মাঝের মেয়ের মাথার ঝোলা লাগছে যেন ভারি |<br />বোঝার ভারে চলতে নারে, পিছন ফিরে চায় ;<br />রূপার দুচোখ বিঁধিল গিয়ে সোনার চোখে হায়!</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nakshi-kathar-math-3/নক্সী কাঁথার মাঠ - তিন2012-09-11T15:04:18-04:002023-06-27T06:14:10-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(তিন)</p>
<br /><p>ওই গাঁখানি কালো কালো, তারি হেলান দিয়ে,<br />ঘরখানি যে দাঁড়িয়ে হাসে ছোনের ছানি নিয়ে;<br />সেইখানে এক চাষীর মেয়ে নামটি তাহার সোনা,<br />সাজু বলেই ডাকে সবে, নাম নিতে যে গোনা।<br />লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী,<br />ভোরের হাওয়া যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ি।<br />মুখখানি তার ঢলঢল ঢলেই যেত পড়ে,<br />রাঙা ঠোঁটের লাল বাঁধনে না রাখলে তায় ধরে।<br />ফুল-ঝর-ঝর জন্তি গাছে জড়িয়ে কেবা শাড়ী,<br />আদর করে রেখেছে আজ চাষীদের ওই বাড়ি।<br />যে ফুল ফোটে সোণের খেতে, ফোটে কদম গাছে,<br />সকল ফুলের ঝলমল গা-ভরি তার নাচে।</p>
<br /><p>কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনার খেলা,<br />তুলসী-তলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা।<br />গাঁদাফুলের রঙ দেখেছি, আর যে চাঁপার কলি,<br />চাষী মেয়ের রূপ দেখে আজ তাই কেমনে বলি?<br />রামধনুকে না দেখিলে কি-ই বা ছিল ক্ষোভ,<br />পাটের বনের বউ টুবাণী, নাইক দেখার লোভ।<br />দেখেছি এই চাষী মেয়ের সহজ গেঁয়ো রূপ,<br />তুলসী-ফুলের মঞ্জরী কি দেব-দেউলের ধূপ!<br />দু একখানা গয়না গায়ে, সোনার দেবালয়ে,<br />জ্বলছে সোনার পঞ্চ প্রদীপ কার বা পূজা বয়ে!<br />পড়শীরা কয় - মেয়ে ত নয়, হলদে পাখির ছা,<br />ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে তাদের গাঁ।</p>
<br /><p>এমন মেয়ে - বাবা ত নেই, কেবল আছেন মা;<br />গাঁওবাসীরা তাই বলে তায় কম জানিত না।<br />তাহার মতন চেকন 'সেওই' কে কাটিতে পারে,<br />নক্সী করা পাকান পিঠায় সবাই তারে হারে।<br />হাঁড়ির উপর চিত্র করা শিকেয় তোলা ফুল,<br />এই গাঁয়েতে তাহার মত নাইক সমতুল।<br />বিয়ের গানে ওরই সুরে সবারই সুর কাঁদে,<br />'সাজু গাঁয়ের লক্ষ্মী মেয়ে' - বলে কি লোক সাধে?</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nakshi-kathar-math-2/নক্সী কাঁথার মাঠ - দুই2012-09-11T15:02:35-04:002023-06-27T18:40:55-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(দুই)</p>
<br /><p>এক কালা দতের কালি যা দ্যা কলম লেখি,<br />আর এক কালা চক্ষের মণি, যা দ্যা দৈনা দেখি,</p>
<br /><p> --- ও কালা, ঘরে রইতে দিলি না আমারে ।<br /> (মুর্শিদী গান)</p>
<br /><p>এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,<br />কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!<br />কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া,<br />তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া ।<br />জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু,<br />গা-খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু ।<br />বাদল-ধোয়া মেঘে কে গো মাখিয়ে দেছে তেল,<br />বিজলী মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল ।<br />কচি ধানের তুলতে চারা হয়ত কোনো চাষী,<br />মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি ।</p>
<br /><p>কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,<br />কালো দতের কালি দিয়েই কেতাব কোরাণ লেখি ।<br />জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভূবনময়;<br />চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয় ।</p>
<br /><p>সোনায় যে জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার'<br />রঙ পেলে ভাই গড়তে পারি রামধণুকের হার ।<br />কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন,<br />তারি পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন ।<br />সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ,<br />কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক ।<br />যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও!<br />সেই কালোতে সিনান করি উজল তাহার গাও ।</p>
<br /><p>আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী,<br />খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি ।<br />জারীর গানে তাহার গলা উঠে সবার আগে,<br />'শাল-সুন্দী-বেত' যেন ও, সকল কাজেই লাগে ।<br />বুড়োরা কয়, ছেলে নয় ও, পাগাল লোহা যেন,<br />রূপাই যেমন বাপের বেটা, কেউ দেখেছ হেন?<br />যদিও রূপা নয়কো রূপাই, রূপার চেয়ে দামী,<br />এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে নামী ।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/nakshi-kathar-math-1/নক্সী কাঁথার মাঠ - এক2012-09-11T15:01:15-04:002023-06-27T18:35:25-04:00জসীমউদ্দীনhttps://www.bangla-kobita.com/jasimuddin/<p>(এক)</p>
<br /><p>বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী,<br />উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি ।<br /> --- রাখালী গান</p>
<br /><p>এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও --- মধ্যে ধু ধু মাঠ,<br />ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ ।<br />এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ ;<br />গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলি সব দাঁড়ায় তারি পাছ ।<br />ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল কায়া,<br />ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় বনের মায়া ।</p>
<br /><p>এ-গাঁও চেয়ে ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে,<br />কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে!<br />মাঝখানেতে জলীর বিলে জ্বলে কাজল-জল,<br />বক্ষে তাহার জল-কুমুদী মেলছে শতদল ।<br />এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে,<br />জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে!<br />কেউবা বলে --- আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী,<br />ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি ;<br />এ-পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে,<br />ও-গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে!</p>
<br /><p>এইখানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়,<br />জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায় ।<br />কেইবা জানে হয়তো তাদের মাল্য হতেই খসি,<br />শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি ।<br />মাঠের মাঝের জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ,<br />জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ !<br />বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি,<br />মিলায় সেথা নতুন জগৎ নানান সুরে ডাকি ।<br />সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি ও-গাঁর পানে ধায়,<br />ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল ছায় ।<br />এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকেও আসে<br />জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে ।</p>
<br /><p>এ-গাঁও ও-গাঁও মধ্যে ত দূর --- শুধুই জলের ডাক,<br />তবু যেন এ-গাঁয় ও-গাঁয় নেইকো কোন ফাঁক ।<br />ও-গাঁর বধু ঘট ভরিতে যে ঢেউ জলে জাগে,<br />কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয় এসে লাগে ।<br />এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাঁশের বাঁশীর সুরে,<br />ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে!<br />এ-গাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান,<br />ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান ।<br />এ-গাঁও ও-গাঁও মেশামেশি কেবল সুরে সুরে ;<br />অনেক কাজে এরা ওরা অনেকখানি দূরে ।</p>
<br /><p>এ-গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও-গাঁর লোকের সনে,<br />কাইজা ফ্যাসাদ্ করেছে যা জানেই জনে জনে ।<br />এ-গাঁর লোকেও করতে পরখ্ ও-গাঁর লোকের বল,<br />অনেকবারই লাল করেছে জলীর বিলের জল ।<br />তবুও ভাল, এ-গাঁও ও-গাঁও, আর যে সবুজ মাঠ,<br />মাঝখানে তার ধূলায় দোলে দুখান দীঘল বাট ;<br />দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা,<br />এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা ।</p>@ 2024 - জসীমউদ্দীন