ব্রহ্মপুত্র ব্রীজ পেরোতেই দেহ-মনে কিশোরগঞ্জের কিশোরী হাওয়া লাগে
উথাল-পাতাল, একটু পর পর গাছি গাছি উষ্ণতা আসে; ডেকে আনে ভাত ঘুম,
ময়মনসিংহ টু কিশোরগঞ্জ রাস্তাটিও এখন পুরদস্তুর রূপবতী রাজকন্যা
গুঁটি বসন্ত তো দূরের কথা---কোথাও একরত্তি জ্বর ফোঁটা অথবা চিকেন ফক্সের
ক্ষতও নেই; পুরোটাই সদাহাস্য কন্যারাশি ষোড়শী সুন্দরী কন্যার মতো
খিলখিল করে হাসছে; রাস্তার দুই পাশে যতোদূর চোখ যায় যুবক ধানের
চোখে-মুখে কেবল তন্বী সবুজের সহজ-সরল স্বীকারোক্তি; তখনও পৃথিবীর
রাত্রির রঙ মাখতে ঢের বাকি, তবুও আমি কয়েক নিমিষেই হয়ে গেলাম
অনবদ্য, দুর্দান্ত, অসাধারণ এক ভাত ঘুমের সহযাত্রী----------!!


খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি অবারিত সবুজের সুগন্ধি ঘুম!
ভাড়া নিয়ে হেলপার-সুপারভাইজারের সাথে পাবলিকের ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে
চোখ খুলেই দেখি অরণ্যপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হায় অরণ্যপাশা!
হা য় ---- হা য়------!! অরণ্য তো দূরের কথা আশেপাশে কোনো গাছও নেই।
ঘর-বাড়ি নেই, কোনো জনমানব নেই!
একাকি একটি দ্বিতল স্কুল ভবন সমস্ত আকাশের বোঝা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে
আছে; এখানেও উঠতি ছেলে ছোকরার মতো ধানের শিষে কবিতার জয়ধ্বনি!


কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আমি তখন নান্দাইল ব্রীজের উপর, ব্রীজের নিচ
দিয়ে যে নদীটি একদা চপলা হরিণীর মতো বয়ে যেতো চুম্বনের শব্দ; সেই
নদীটির দুই পাশে তাকিয়ে আমি বিস্ময়ে টাসকি খেলাম, এক ফোঁটা জল নেই!
কেবল আমার সমস্ত অবিশ্বাসের চর জুড়ে গাঢ় সবুজ ধানের নিষ্ঠুর চাহনি,
এতোক্ষণ যে ধানের সবুজ মায়া আমার পথক্লান্তি মুছে দিয়েছিলো; এখন
সেই ধান দেখে আমার কাছে মনে হলো ওরা আমার সাথে বিদ্রূপ করছে, ওরা
আমাকে ভারসাম্যহীন বিকলাঙ্গ মানুষ ভেবে একটার পর একটা তামাশা করছে!


অরণ্যপাশায় অরণ্য না দেখে আমি মনে মনে যতোটা আহত হয়েছিলাম, এখন
নদীর এমন মরণ দেখে আমিও মনে মনে মরে গেলাম; আমার কাছে মনে হলো,
শুধু শুধু-ই আমরা গঙ্গা-তিস্তা নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করি—কেউ কেউ আবার
রাজনৈতিক খায়েশ মেটায়; আর কেউ কেউ ফায়দা লুটায়! আমি ভাবি অন্যরকম,
কেউ আছো আমার সমস্ত মৃত নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে দেবে?
কেউ আছো আমার অরণ্যপাশার অরণ্য আবার ফিরিয়ে দেবে?
কেউ আছো কবি নদীর জন্য, অরণ্যের জন্য অন্তত একটি সার্থক কবিতা লিখবে?


এসব ভাবতেই ভাবতেই আমি তখন কিশোরগঞ্জ শহর ক্রস করছি, কোমরের
যে ব্যথাটা এতোক্ষণ বেমালুম ভুলে ছিলাম; সেই ব্যথাটা আবার ফিরতে শুরু
করেছে, তখন মনে হলো আমি এখন ভাঙাচোরা-খানাখন্দে ভরা রাস্তার দাস!
অথচ তখনও আমার বাপ-দাদা-পরদাদার ভিটায় পৌঁছতে চব্বিশ কিলো বাকি,
আমি মায়ের হাতের রান্না করা মলা-ঢেলার চর্চরীর কথা ভাবি, ঘিয়ে ভাজা
সজনে পাতার কথা ভাবি, ছোট মার হাতের নরম তুল তুলে মালা পিঠার কথা
ভাবি, সুরেলা কন্ঠে বাবার গাজী-কালুর পুঁথি পড়ার কথা ভাবি – কোমরের
ব্যথাটা ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি; আমি ভুলেও কোনো মন্ত্রকের
কথা ভাবি না, কোনো সড়ক বিভাগের কথা ভাবি না—--আমি আমার নিরীহ
নিভৃতচারী, শান্তিকামী আমপাবলিকের কথা ভাবি---------------------!!  


আমি আমার কথা ভাবি না, আমি বছরে মাত্র গুঁটিকয়েক বার সেই রাস্তায় যাই;
যারা প্রতিদিন যায় ----আমি তাদের কথা ভাবি, আমি অদৃষ্টের কথা ভাবি!!