এক কালে শিক্ষা ছিল জাতির মেরুদণ্ড । এখন মেরুদণ্ড নাকি জানি না । হয় তো তামাশা নয় তো ব্যবসা । কারণ শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তাহলে শিক্ষক হবে জাতির মাথা । কেননা শিক্ষকই শিক্ষার জন্মদাতা । মা - বাবা যদি হন প্রথম জন্মের উচিলা শিক্ষক তবে দ্বিতীয় জন্মের ।
কিন্তু শিক্ষকের উঁচু মাথা , গর্বিত পিতার আসনটা আজ ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ছে । যেমন ভাবে সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে ।
পুরাকালে শিক্ষক গণ তপোবন পরিবেশে শিক্ষা দান করতেন । বর্তমান কালের মত স্কুল , কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না । ছিল শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে গুরু - শিস্যের পবিত্র সম্পর্ক । শিক্ষকের আদর্শ, দর্শন , চিন্তা , চেতনা ছাত্র সারা জীবন মাথায় করে রাখত । একজন শিক্ষক নিজের সমস্ত সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে শিক্ষা দানে ব্রতী হতেন । মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে ছাত্র তদুপুরি সমাজ ও দেশ পরিচালিত হতো একজন মহান শিক্ষকের
সুযোগ্য পরামর্শ ও নির্দেশনায় ।
আজকের আধুনিক যুগে ছাত্র সমাজ , শিক্ষক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের এমন কি হয়েছে যে , দিন দিন তাদের পারস্প রিক সেতুবন্ধন ধুলায় লুঠিয়ে পড়ছে । ছাত্র , অভিভাবক , সমাজ , দেশ যন্ত্র কেউই শিক্ষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান টুকু দিচ্ছে না ; অন্যদিকে শিক্ষক গণ ও এ নিয়ে খুব একটা ভাবিত নয় । কেন ছাত্ররা তাঁদের আগের মত শ্রদ্ধা ভক্তি করে না , সালাম দেয় না , তর্ক করতে দ্বিধা করে না ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এর কারণ যাই হোক না কেন --- এতে করে আমাদের মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে , এ বিষয়ে আমার কোন সংশয় নেই ।
এখন সময় এসেছে এ বিষয়ে ভাবনার । তা না হলে অদুর ভবিষ্যতে জাতি হিসাবে , পিতা-মাতা হিসাবে, ভাইবোন হিসাবে আমাদেরকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে ।
আমার মতে শিক্ষকদের এহেন হীনতর অবস্থার জন্য দায়ী নিম্নলিখিত কারণ সমূহঃ
০১। শিক্ষক নিজে
০২। শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্র যন্ত্রের অবহেলা
০৩। জাতি হিসাবে আমাদের মূল্যবোধের পারদ ক্রমশ নিম্নগামী হওয়া
০৪। শিক্ষাকে পণ্যের মর্যাদায় উন্নীত করন !
বিশ্লেষণঃ
শিক্ষক নিজে
আধুনিক কালের সিং হ ভাগ শিক্ষকই এ মহান পেশাটিকে ভালবেসে শিক্ষকতা করতে আসেন না । নিতান্তই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে তারা এ পেশাটিকে ব্যবহার করেন । ফলে অতি সহজেই তাদের পক্ষে নীতি বোধ ,আদর্শ বিসর্জন দেওয়া সম্ভব হয় । ক্লাসে পড়া নোর চেয়ে প্রাইভেট, কোচিং , নোট, শীট , গাইড ইত্যাদি কাজে সময় দিতে অধিক পছন্দ করেন । প্রাইভেট, কোচিং নোট না নিলে ছাত্রছাত্রীরা নানা ভাবে হয়রানির শিকার হয় । ব্যবহারিক , ইনকোর্স, টিউটোরিয়েল ভাইভা পরীক্ষায় কম নম্বর প্রদান এমন কি ফেল পর্যন্ত করানো হয় । আমি এমন শিক্ষক  দেখেছি যিনি ছাত্রের সাথে একত্রে বসে ধূমপান করছেন । ইদানীং শিক্ষকের দ্বারা ধর্ষণের মত বর্বরতম ঘটনাও ঘটছে । তাছাড়া নকলে সহায়তা, উত্তর পত্র জালিয়াতি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুর বৃত্তির জন্য শিক্ষকদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে ; যা অত্যন্ত পরিতাপ ও লজ্জার ।
০২। শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্র যন্ত্রের অবহেলা
শিক্ষক হলেন অন্যান্য সকল পেশা জীবি মানুষের জন্মদাতা বাপ । ডাক্তার বলেন , প্রকৌশলী বলেন , প্রশাসক বলেন সকলেই কোন না কোন শিক্ষকের ছাত্র তথা সন্তান । যে সন্তান এক সময় বাবার কথা ভুলে যায় । বাবার মান সম্মান অপমানের তোয়াক্কা করেন না । ফলে মেধাবী ছাত্ররা এখন শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না । কারণ এ পেশায় সম্মান ও আর্থিক নিরাপত্তা কোনটাই নাই । অত্যন্ত দুঃখের সহিত বলতে হচ্ছে , মহান স্বাধীনতার পর চল্লিশটি বসন্ত গেছে --- কিন্তু শিক্ষকদের জীবনে কোকিল আসেনি । তাদের সুখ-বসন্ত নাই । এই চল্লিশ বছরে রাষ্ট্র মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ? আমার জানা নেই ।
যতদুর শুনা যায় এ ব্যাপারে প্রধান বাঁধা এক শ্রেনীর স্বার্থপর ব্যক্তির । যারা নিজেদের বাবা মায়ের উপরও প্রভাব কাটাতে কুন্ঠিত হন না।
৩। জাতি হিসাবে আমাদের মূল্যবোধের পারদ ক্রমশ নিম্নগামী হওয়াঃ
কোন জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রকৃত সূচক পাওয়া যায়,
মূল্যবোধের গ্রাফ বিচার করলে । আমাদের দেশে যেটি
ক্রমে ক্রমে ভেঙে পড়ছে। ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত,
ভাই-বোন, পিতা-পুত্র, বউ-শাশুড়ি, ছাত্র-শিক্ষক সহ যত
রকম সম্পর্কের ব্রীজ আছে, সব গুলো আজ বড় কাতর
ও অসহায় কণ্ঠে মূল্যবোধের বাপের দিকে তাকিয়ে আছে। আর চেয়ে চেয়ে দেখতে সব কিছুর ক্ষয়ে যাওয়া,
ভেঙ্গে যাওয়া । এ যেন মহা ভাঙনের খেলা !
এই ভাঙন থেকে আমাদের মুক্তির কী কোন উপায় নেই? জাতি হিসাবে আমাদের কী মাথা উঁচু করে, বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না? অবশ্যই করে । তাহলে
আমাদের প্রত্যাশা ও কাজের ভিতর এত ফারাক কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই । তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস একজন আদর্শ শিক্ষক তাঁর আদর্শ দিয়ে, মূল্যবোধ দিয়ে, মেধা দিয়ে, সততা দিয়ে এই দেশের কোমল মতি শিশু তথা জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারেন।
আর এই জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র যন্ত্রের সহায়তা ।।