কবিতা:- না বলা শেষ কথা
         মনোজ ভৌমিক


এই কালো মেঘ, সরে যা, সরে যা বলছি।
কেন তুই চাঁদটাকে ঢেকে রেখেছিস?
জানিস না আজ পূর্ণিমা!"
চন্দ্রিকা আমার জন্যে অপেক্ষা ক'রে বসে আছে।
মরার সময় ও আমাকে বলেছিল,
" যদি আমি তোমার আগে চলে যাই!
প্রতি পূর্ণিমার রাতে, তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো।
ঐ যে চাঁদের বুকে বড় গাছটা দাঁড়িয়ে রয়েছে,
যার নীচে বসে, বুড়ী, একটা চরকা ঘুরিয়ে
সূতা কাটছে, আমি ওর পাশেই বসে থাকবো।
তোমার জন্যে- শবরীর প্রতীক্ষা নিয়ে।"


সরে যা মেঘ, সরে যা বলছি।
ও আমাকে দেখার জন্য ছট-পট করছে।
দীর্ঘ এক বছর কেটে গেল!
কখনও সাদা মেঘ, কখনও কালো মেঘ,
কখনও বা এই বার্দ্ধক্য যন্ত্রনা,
আমার আর তোমার মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে,
তোমার পুত্র সন্তানদের মত।


চন্দ্রিকা! মেঘ সরে যাচ্ছে চন্দ্রিকা!
চাঁদের ঝলমলে আলোর মধ্যে
আমি তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
" তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ ?
আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?"
তোমার মনে আছে চন্দ্রিকা?
গত বছর মাঘ মাসের ২২ তারিখটা?
আমাদের জীবনের চলার পথের ৫০তম বছর ছিল।
তুমি আমার হাত ধরে খড়াতে খড়াতে,
হাঁপ টেনে টেনে, মন্দিরে-মসজিদে-চার্চে-দরগায়
মাথা ঠুকিয়েছিলে! আর সমস্ত ভগবানদের কাছে
বলেছিলে," হে ঠাকুর! আমাদের একসঙ্গে তুলে নিও।"
কেন তোমার ঠাকুর আমায় একলা ফেলে দিল চন্দ্রিকা?


সেদিন চাঁদনী রাতটা হতবাক হয়ে গেছিল।
বারান্দার চেয়ারে বসে, আমরা দু'জন
সারারাত ধরে পুরানো স্মৃতিকে রোমন্থন
করার চেষ্টা করছিলাম।
তুমি আমার মুখ-পানে চেয়ে বলেছিলে,
" সপ্তর্ষি, বুকের ভিতরটা যেন কেমন হচ্ছে।"
আমি ভয় পেয়ে তোমায় জড়িয়ে ধরেছিলাম।
তুমি আমায় বলেছিলে," ভয় পেয়ো না,
থার্ড এটাকটা এত সহজে আসবে না।"
বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
আমি তো জানি, তুমি বড্ড জিদ্দি।
মোমবাতির মতন তুমি আলোদিয়ে নিরবে
নিঃশ্বেষ হয়ে যাবে, প্রকাশ করবে না।
ভয়ে আঁতকে উঠেছিল আমার মনটা।
কাক ভোরের আকাশটা পাখীদের কিচির-                                   মিচিরের সঙ্গে, কিছু বলতে চাইছিল।


বড় খোকাকে ফোন করলাম। সুইচ বন্ধ।
ছোটো খোকার ফোনে রিং বেজে চলছিল।
বুকের পাঁজড় গুলি কেমন শ্লথ হয়ে আসছিল,
বিচ্ছেদের বেদনায়।


ওরা যে ব্যাস্ত মানুষ!
ওদের কাছে সময় কোথায়!
স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আর পার্টিই ওদের পৃথিবী।
এই বাহ্যিক আবর্জনা দ'টিকে, কে মনে রাখে!
আমি জানি, চন্দ্রিকার আসল যন্ত্রনাটা কোথায়!
গতকাল রাত্রিতে, ওরা কেউ আমাদের মনে করা
তো দূরের কথা, খোঁজও নেয় নি একবার।
নিউআলিপুর আর সল্টলেক থেকে
ঢাকুরিয়ার এই পোড়োবাড়ীট, ওদের কাছে বড্ড দূর!
এম্বুলেন্সে ফোন করলাম।
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের আকাশের বুক চিরে
এম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল আমাদের দু'জনের
স্মৃতি বিজড়িত ভাঙ্গাচোরা ঘরের দরজায়।
তুমি উদাস চোখে আমার দিকে তাকিয়ে,
জড়ানো শব্দে বলেছিলে-
"সপ্তর্ষি, জানি তুমি অনেক কষ্ট পাবে।
একলা হয়ে যাবে, তাই না!
স্বার্থের পৃথিবী থেকে যত শীঘ্র পারো চলে এসো।
তুমি আমার কাছে একটা কণ্যা সন্তন চেয়েছিলে।
না পেয়েছো ভালোই হয়েছে।
নইলে আরো কষ্ট পেতে তুমি।"


নার্সিং হোমের সমনে এসে,
আমায় না ছেড়ে যাওয়ার অদম্য চেষ্টা নিয়ে,
নিভে যাওয়া প্রদীপের শেষ আলোর মতন
আমার বুকে মাথা রাখার চেষ্টা করেও
কোলের উপর নেতিয়ে পড়েছিলে।
হতাশার চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলে।
কিছু বলতে চেয়েছিলে তুমি!
সেটাই ছিল তোমার শেষ কথা।
ভোরের ঊষার আলো নিভেগেল চন্দ্রিকার চন্দ্রমা,


রেখে গেল শুধু, এক রাশ নিরাশা,
হতাশা আর ব্যাথাতুর শেষ কথা।