আমি সেই মেয়ে(একত্রে)


অভাগীর কোলে,
          জীর্ণ কুটির  ঘরে,
                          জন্ম নিয়েছিলাম
                                   "আমি সেই মেয়ে"।


দুর্বল  অভাগীর বুক চিরে,
            হয়নি প্রবাহিত  দুধের  স্রোত ।
                     বুঝেনি কী স্বাদ  আছে,
                            ওই অভাগীর বুকের দুধেতে,
                                       "আমি সেই মেয়ে"।


ছুটেছে অভাগী  দুধের খোঁজে,
               মানুষের দ্বারে-দ্বারে,
                   ব্যর্থতায় ফিরে এসে করেছে আদর।
             কেঁদেছি  আমি, কেঁদেছে  অভাগী
                       দেখেছি  অভাগীর বুকের ক্রন্দন,
                        "আমি সেই মেয়ে"।


ছোটবেলায় খেলেনি পুতুল  খেলা,
           ছিলনা খেলার সঙ্গী অভাগীর কোল ছাড়া।
         কত রাত কেটেছে রাতের অন্ধকারে,
                              কত দিন গেছে অনাহারে,
  তার তো কোন হিসাব রাখেনি ,
                         "আমি সেই মেয়ে"।


তখনো আমি, অভাগীকে মা বলে ডাকেনি,
               শেখেনি ঠিক ভাবে বসতে।
বসিয়ে দিল অভাগী , ল্যাম্পপোস্টের নীচে,
          ভিক্ষার ঝুড়ি  হাতে দিয়ে,
                  "আমি সেই মেয়ে"।


ভিক্ষার ঝুড়ি নিয়ে ঘুরেছি  কত,
   কখনো  রেল- স্টেশনের টিকিটের লাইনে,
        কখনো  বাস-স্টপের গলিতে।
                     কেউ-বা দিয়েছে একটাকা, কেউ-বা  দিয়েছে দুইটাকা,
                    কেউ-বা ছুঁড়ে ফেলেছে রাস্তায়।
                              দিনের শেষে যা পেয়েছি,
কিনেছি কত খাবার।  
        আমি আর অভাগী  জড়িয়ে  ধরে খেয়েছি সে খাবার,
          "আমি সেই মেয়ে"।


        
রাতের বেলায় দেখেছি  অভাগীকে
ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে,ঝলমলে রাঙা শাড়িতে
রাস্তার অভিমুখে কারও প্রতিক্ষায়।
ফেরেনি কত রাত অভাগী আমার পাশে,
একাই কাটিয়েছি  রাতের বেলা তারা দের মিটি-মিটি আলোর দিকে  চেয়ে।
আমি সেই অভাগীর মেয়ে।

ফিরেছে শেষে রাতের অন্তে, দিনের প্রথম প্রভাতে।
ইতস্তত হয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আমার দিকে চেয়ে 'মা' তুই ভয় পাসনি এই রাতের অন্ধকারে।
তোর মা যে অসহায়  দেখতিস  যদি চেয়ে।
বুক ফেটে এসেছে অন্তরের কান্না,
চুপ করে চেয়ে দেখেছি অভাগীর বুকের বেদনা,
আমি সেই মেয়ে।


দিনের বেলায় দেখেছি  অভাগীকে,  
রাস্তার মুখ পানে চেয়ে দেখতো স্কুল যাবার দৃশ্য।
দেখিতো সে একদৃষ্টে পথের দুই পাশে,
ছোট ছোট  শিশুদের লাল স্কুল ড্রেসে,
কখনো  বা নীল, কালো, সাদা  ইউনিফর্মে
তারা চলেছে বাবার হাত ধরে স্কুল পানে।


বিস্ময়ে সাথে অভাগীর মানসে,
'মা' কথায় যায় ওরা , এমন সাজে।
শুনিয়েছে অভাগী  স্কুলের নানান গল্প,
সেখানে নাকি হয় পড়া, হয় লেখা,আর কত কী?
শুনে জানিয়েছি  অভাগীকে,
তবে কি আমি স্কুল যাব  না,পড়বো না কোনদিন।
শুনে অভাগী  কেঁদেছে আমার তরে,
সান্তনা দিয়েছে আমায় এই ভাবে,
রাস্তার মেয়েদের পড়ার নেই যে নিয়ম।
হতাশায় চোখের দু ফোঁটা  জলে,
আমি সেই মেয়ে।

গভীর রাতে অভাগী কে কারা যেন তুলে নিয়ে গেলো রেললাইনের ঝোপের ধারে।
অভাগীর  কণ্ঠস্বর থেকে  ভেসে এসেছিল বাঁচাও বাঁচাও....বাঁ....   চা....ও.... ও....।
কে  যেন বলেছিল এই শালি  চুপ  নইলে গুলি করে দিবো।
অভাগীর কাকুতিমিনতি   শুনে নি তারা,
বাতাসে ভেসে এলো একটি গুলির শব্দ, তার কিছুক্ষণ  পরে আরেকটি।
অভাগী  কণ্ঠস্বর  ধীর থেকে ধীরতম হলো,
চারিদিক  যেন আবার শান্ত হয়ে এলো।
আমি ভয়ে সারারাত ধরে  রেললাইনের ধারে, ল্যাম্পপোস্ট আলোর নীচে  কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে  পরেছি ।
প্রাণের থেকে প্রিয় অভাগী কে হারিয়ে ছিলাম সেই রাতে, আমি সেই মেয়ে।


অভাগী কে হারিয়ে গতিশীল  মানবসভ্যতার ভীড়ের মধ্যে আমি একা।
আমি ক্ষুধাতুর,  আমার অস্তিত্বের জন্য আমি সংগ্রামী, আমি নির্লজ্জ্।
ভীড়ের মধ্যে আমাকে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে  বলতে হয়েছে 'দাও না গো আমাকে দুটি পয়সা, আমি সারাদিন কিছু খায়নি, আমি ভাত খাব'।
আমাকে চোরের অপরাধে গাছে বেঁধে  জুতো দিয়ে পিটানো  হয়েছে,  অর্ধেক  মাথা ন্যাড়া  করে, কালো কালি দিয়ে চোর লিখে রাস্তায় ছেঁড়ে দিয়েছে।
দুর্বিনীত হয়ে আমি আবার চুরি  করেছি।
মানব সভ্যতার  মানুষ দের কাছে পালাতে পালাতে আমি  অবসন্ন  হয়ে পড়েছি।
পরিশ্রান্ত  হয়ে বাসের নীচে চাপা পড়ে রক্তাক্ত  হয়ে নিমজ্জিত  হয়েছি,  আমি সেই  মেয়ে।


সময়- রাত্রি  ১১টা ০৩ মিনিট,  তং-১০/০২ /২০১৭