সময় বিভ্রাটঃ
গতকাল প্রথম গিয়েছিলাম এবারের একুশে বইমেলায়। এর আগে বিগত বইমেলাগুলোতে যতবার গিয়েছি সব শুক্র বা শনিবারে । আমার জানাই ছিল না, শুক্র শনিবার বাদে অন্যান্য দিন মেলা তিনটে থেকে। চলে গিয়েছিলাম বেশ আগেই। পরে অবস্থা বুঝে সময় কাটাতে চলে গেলাম টি এস সির দিকে। টি এস সি থেকে ফেরার পথে চোখে পড়ল "আবৃত্তি একাডেমী" সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রমিত উচ্চারণ, সংবাদ পাঠ ও আবৃত্তি বিষয়ক সার্টিফিকেট কোর্সে ভর্তির ষ্টল। আবৃত্তির প্রতি আমার আজন্ম দুর্বলতা। স্কুল কলেজ লাইফে নিয়মিত আবৃত্তি করেছি। পুরস্কারও পেয়েছি। পরে গ্যাপ পড়ে গিয়েছিল। তবে সর্বশেষ ভাষাচিত্রের সাহিত্য কর্মশালায় কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের আমন্ত্রনে অনেকদিন বাদে কোন পাবলিক প্রোগ্রামে আবৃত্তি করলাম আমার "আবহমান" কবিতাটি । নিজের স্যাটিসফেকশন ও অডিয়েন্স রিয়েকশন দেখে বুঝলাম একেবারে মন্দ হয়নি। তবে আবৃত্তির একাডেমিক শিক্ষা বলতে যা বোঝায় ঠিক তা আমার নেই। শুনে শুনে, বই পড়ে, নেট ঘেটে শেখা। অনেকটা হুজুগের বসেই পুরণ করে ফেললাম চার মাস মেয়াদী এই কোর্সের এডমিশন ফর্ম। প্রতি শুক্রবারে ক্লাস, চারমাসে মোট ষোলটি ক্লাস। পরে বাসায় ফিরে মনে হল হুট করে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেয়া কি ঠিক হল? উত্তরা থেকে টানা চার মাস টি এস সি দৌড়ানো বাড়ির কাছের কথা নয়, যদিও ওরা বলেছিল, ঢাকার বাইরে গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ থেকেও কিছু মানুষ নাকি ওদের এখানে ক্লাস করে, উত্তরা তো কাছে। কারো জানামতে উত্তরা বা আশেপাশে কি এমন কোন প্রতিষ্ঠান আছে যারা আবৃত্তির উপর কোর্স করায়। যদি কাছাকাছি কোথাও থেকে এজাতীয় কোন কোর্স করা যায় তাহলে আর টি এস সি পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ করতে হয় না।


বইমেলা যখন মিলনমেলাঃ
গতকাল অমর একুশে বইমেলায় প্রথমবারের মত দেখা হল বেশকিছু নেটবন্ধু ও অনলাইনের মানুষের সাথে। মেলা শুরুর আগে টি এস সিতে থাকাকালীন  বাংলা কবিতার ব্যাংকার বন্ধু কবীর হুমায়ুন ফেসবুকে জানালো বাংলা কবিতার এডমিন পল্লব ইউ এস এ থেকে বাংলাদেশে এসেছে, আজ বইমেলায় আসছে, সম্ভব হলে যেন থাকি। এর আগে বাংলা কবিতার অনেকগুলো গেট টুগেদারে আমন্ত্রণ পেয়েও ব্যাটেবলে না হওয়াতে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার যেহেতু আপনা আপনিই সিডিউল ম্যাচ করে গেল তাই দেখা হওয়াটাকে ভবিতব্য বলে মেনে নিলাম। ওরা বইমেলায় আসার আগে যে যে সংকলনে এবার আমার লেখা আছে এবং কুরিয়ারে লেখক কপি পাওয়া যাবে না সেগুলো সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে গেলাম বাতিঘরে, এখান থেকে আমার কবিতা সম্বলিত বিদ্যানন্দ কাব্য সংকলন "এইসব কবিতারা" সংগ্রহ করলাম। এই স্টলে খবর নিয়ে জানলাম গল্প লেখা প্রতিযোগিতা গ্রুপের কাব্য সংকলন "নিসর্গ ০২" এসেছে কিন্তু গল্প সংকলন "বিসর্গ ০৩" এখনো মেলায় আসেনি। এইসব বইয়ের লেখক কপি আমার কাছে কুরিয়ারে যাবে। তাই এরপর চলে গেলাম, ম্যাগনাম ওপাসে, এখানে আমার লেখা ছিল "কাব্য শতদল" কবিতা সংকলনে, পেলাম না বইটি, যে কয় কপি এসেছিল শেষ হয়ে গিয়েছে, ওরা জানালো এটা ওদের সাথে যোগাযোগ করে পরে কুরিয়ারে নেয়া যাবে। ঘুরে ফিরে কিনলাম আরো কিছু পছন্দের বই। তারপর চলে এলাম বাংলা একাডেমী লিটলম্যাগ চত্বরে। দাড়িকমা প্রকাশনীর স্টল থেকে সংগ্রহ করলাম "সাহিত্য জানালা" সংকলনের লেখক কপি। এই সংকলনে আমার লেখা রম্যগল্প ও কবিতা দুটোই ছিল। আমার আরেকটি লেখা ছিল রুপান্তর লিটল ম্যাগে, ওদের স্টলটি বন্ধ পেলাম, পাশের স্টল থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে না পারায় এরপর চলে এলাম বাংলার কবিতার স্টলে, এখান থেকে "চেনাবালি চোরাবালি" কাব্য সংকলনের লেখক কপি সংগ্রহ করলাম। সাথে "অকাল সন্ধার কথন" গল্প সংকলন। আমার আরেকটি লেখা ছিল বাংলার কবিতা "সাহিত্য পত্রে", নিলাম ওটার লেখক কপিও। এরপর জানতে চাইলাম বাংলার কবিতা ব্লগের এডমিন ও প্রকাশনার প্রকাশক আহসান আল আজাদ ভাই আছেন কিনা। উনি এতোক্ষন আমার পেছনেই দাড়িয়ে ছিলেন, আমি চিনতে পারিনি। তার সাথে পরিচয় হল। পরিচয় হল তার সাথে দাঁড়ানো আরেক ফেসবুক বন্ধু সাজ্জাদুজ্জামানের সাথে। এই দুজনেরই নেটে এবং বাস্তব দেখায় যে ফারাক, মনে হল পরিচয় না হলে বা অন্য কোথাও দেখা হলে হয়তো চট করে চিনতে পারতাম না। রেগুলার মেলায় আসতে আসতে দুজনের গেট আপই ক্যাজুয়াল হয়ে গেছে। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফোন দিলাম বাংলা কবিতার কবীর হুমায়ুনকে। সে জানালো টঙ্গী থেকে থেকে রওনা দিয়ে তাদের গাড়ী উত্তরা পার হচ্ছে । তাদের মেলায় আসার কথা চারটা থেকে পাঁচটার ভেতর। ইতিমধ্যে পৌণে পাঁচটা, কমপক্ষে আরো এক ঘন্টা লাগবে ওদের মেলায় আসতে। এই অবসরে সময় কাটানোর জন্য ঢুকে পড়লাম বইমেলা উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। শুনলাম ভাষা ও সাহিত্যের উপর আলী ইমাম, রফিকুল হক, হায়াৎ মামুদ, রোকনুজ্জামান দাদাভাই প্রমুখের বক্তব্য।


এখান থেকে বের হতে না হতেই এল কবীর হুমায়ুনের কল। ওরা সবাই সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের বাংলা প্রকাশের স্টলে আছে। আমি বাংলা একাডেমী প্রান্তর থেকে বের হয়ে চলে এলাম বাংলা প্রকাশের স্টলে। ছবিতে দেখা মুখ, দেখেই চিনতে পারলাম কবির হুমায়ুন ও পল্লবকে। আমার নাম শুনে বুকে জড়িয়ে নিল কবীর । সাথে আরো যারা ছিল এক এক করে তাদের সাথে পরিচয় হল, প্রবাসী কবি রাবেয়া রহিম, কবি গোলাম রহমান, ছাড়াও আরো দুই একজন ছিল যাদের নাম এখন আর মনে পড়ছে না।  পল্লবের বাবা অসুস্থ্য, মুলত সে কারনেই তার বাংলাদেশে আসা। বাবার খোঁজ খবর নেয়া শেষে পল্লব পরিচয় করিয়ে দিল তার পাশে দাঁড়ানো মাথায় ফুলের ব্যান্ডানা পরিহিতা এক তরুণীর সাথে, পল্লবের ছোট বোন, নাম "প্রকৃতি"। পড়াশোনা করে।। ইতিমিধ্যে কবীর ব্যস্ত হয়ে পড়ল আপ্যায়নে। এদের সবার সাথে আমার এই প্রথমবার দেখা, অথচ নেটে জানাজানি প্রায় চার বছর। আমি এর আগের কোন গেট টুগেদারে অংশ নেইনি, এটা নিয়ে কথা উঠল, এটা অহংকার কিনা এরকম একটি প্রশ্নও এলো, জবাবে আমি জানালাম আমি নিভৃতচারী মানুষ, হৈচৈ, কোলাহল এড়িয়ে চলি। যদি মনে হয় কোথাও থেকে কিছু শিখতে পারব সেখানে যাই। একজন লেখকের সাথে সত্যিকার পরিচয়ের জায়গা আসলে তার লেখা। আমার সাথে এর আগে সরাসরি দেখা না হওয়াতে কারো কারো ধারনা ছিল আমি মনে হয় বয়স্ক মানুষ, কেউ কেউ বলেই ফেলল, আপনি তো একদম ইয়াং, আপনি এতো ভাল লিখেন, আমাদের ধারনা ছিল আপনি আরো বয়স্ক মানুষ, আমাকে দেখে কবীর হুমায়ুন তো দুই একবার তুমিই বলে ফেলে, শেষ অবধি বলেই ফেলল, অনলাইনে আপনি বললেও এখন তুমি বলতেই সে সাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, না এটা অবজ্ঞা নয়, ভালবাসা। যদিও আমি সচরাচর আপনি শুনতে এবং বলতেই বেশি পছন্দ করি কারণ সাহিত্যে মানসিক বয়সটাই আসল। শুধু বয়সে ছোট বা বড় হলেই আপনি বা তুমি বলাটা শোভন নয়, তবুও চেপে গেলাম আপাতত। আপনি তুমি নিয়ে কবীরের সাথে আমার সম্পর্কটা বরাবরই কনফিউজিং। প্রথমে আমরা একে অপরকে তুমিই বলতাম, প্রথম গেট টুগেদারের পর হঠাৎ করে কবীর আমি সহ অনেককে আপনি বলা শুরু করল, কারণ জিজ্ঞেস করে জানা গিয়েছিল, নেটে যাদের সাথে তুমি তুমি সম্পর্ক ছিল বাস্তবে সামনাসামনি অনেক সিনিয়র মানুষকে তুমি বলা যায় না, তাই সবাইকে আপনি । বুঝতে পারলাম বাস্তবে দেখা হওয়ার একটি কুফল এটা, সহজ সচ্ছন্দ যে সম্পর্কটি ছিল সেটা রিডিফাইন হয়ে ফর্মাল হয়ে গেছে। আমি না গেলেও তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে ঠিকই। তবে সে বদলালেও আমি বদলাইনি, আমি তুমিতেই ছিলাম। যাইহোক, ফটোশ্যুট শেষে চলে গেলেন রাবেয়া রহিম, আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করে আলাদা করে বিদায় নিলেন তিনি। এরপর এলেন আরেক কবি খায়রুল আহসান। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা । আরেক দফা খাওয়া দাওয়া হল, হল আরেকদফা ফটোশুট । সাথে কবিতা ও সাহিত্য নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে বিরতিহীন। একপর্যায়ে কবীরের কাছ থেকে প্রস্তাব এলো এই গেট টুগেদার নিয়ে এবার যেন আমি লিখি। বুঝতে পারলাম তার এরকম ইচ্ছের কারণ, আমি এইসব প্রোগ্রামে বরাবর গড়হাজির বান্দা, সেটা আবার আলোচিত ও সমালোচিতও, তাই এটা নিয়ে আমার লেখার আলাদা আবেদন থাকবে এটাই স্বাভাবিক।  পল্লবের বোন প্রকৃতি বাদে এখানে সবাই বাংলা কবিতা ব্লগের সদস্য, তাই আমি যেন তার কথা ভুলে না যাই। বিশেষ ভাবে লিখি তার কথা, আলাদা করে সেটা মনে করিয়ে দিল কবীর। তখন প্রকৃতিকে নিয়ে যে কথাটি বলা হয়ে ওঠেনি এখন সেটা লিখছি," মাথায় ফুলের ব্যান্ডানা পড়া "প্রকৃতি", প্রকৃতির মতোই সুন্দর। বাংলা কবিতা পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম ভাষাচিত্র প্রকাশনীর স্টলে। দেখা হল প্রকাশক সোহেল ভাইয়ের সাথে। কুশলাদি বিনিময় শেষে জানতে চাইলাম কবি আবু হাসান শাহরিয়ার কোন স্টলে আছেন। এখানেই তো ছিলেন, বলে খুঁজে না পেয়ে আমার কথা জানিয়ে কবিকে ফোন দিলেন সোহেল ভাই। সাদাত হোসাইনের কথা জানতে চাইলে স্টল থেকে জানালো ও শুক্র ও শনিবারে বসে, জানতে চাইলাম ফেসবুক বন্ধু ও ভাষাচিত্রের আরেক লেখিকা শিল্পী রহমানের কথা, সেও আজ নেই। কিছুক্ষনের ভেতর এসে গেলেন এবারের একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি, তার সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে আমার নেয়া কবির শ্রেষ্ঠ কবিতা ও ১০০ প্রেমের কবিতা  বই দুটিতে তার অটোগ্রাফ নিলাম, এরপর শুরু হল ফটোশুট। কবি পরিচয় করিয়ে দিলেন, মন্দিরা বেদি নামে এক মেয়ে কবির সাথে, আরো দুজন তরুণ কবি ছিল, তাদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলেন কবি। কবির সাথে গল্পে গল্পে কাটলো আরো কিছুক্ষন। এর ভেতরে এল আমাদের আরেক কমন ফেসবুক বন্ধু ও লেখিকা কান্তা রেজা। কান্তা ঢাবির ছাত্রী। ওর সাথেও এই প্রথম দেখা আমার। আলাপে আলাপে গেল আরো কিছু সময়, রাত আটটায় টিভিতে একটি প্রোগাম ছিল কবির, উনি চলে যাবেন জানালেন, আমাদেরও কাজ শেষ, এরপর একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বইমেলা থেকে যে যার বাড়ির পথ ধরলাম।