★কবি ড.সুজিতকুমার বিশ্বাসের "ছেদ ও যতি চিহ্নের ব্যবহার"নামক অালোচনায় কিছু মন্তব্য পড়ে এই অালোচনাটি না লিখে পারলাম না।অামি শ্রদ্ধাভাজন কবি ড.সুজিতকুমার বিশ্বাসের ছেদ-যতির অালোচনায় যে মন্তব্যটি দিয়েছি তা হুবহ এখানে তুলে ধরছি।হয়তো বা কারো উপকারে অাসতে পারে।


★অামি কবি ড.সুজিতকুমার বিশ্বাসকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই বিরামচিহ্ন নিয়ে অালোচনার প্রসঙ্গ প্রথমে তুলে অানার জন্যে।


★এটি হলো অামার নিজস্ব মন্তব্য।যা ঐ শ্রদ্ধাভাজন কবির অালোচনায় দিয়েছি।অামার এ মন্তব্যটিকে অাপনারা অালোচনা হিসেবে ধরে নিতে পারেন এবং যে কেউ বিরোধীতা করতে পারেন।


অলঙ্কার শাস্ত্র ও ভাষা সচেতনতা কবিতাকে সবসময় অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়।কবিতায় ছেদ বা যতির প্রয়োগ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়ে গেছে।কেউ কেউ এর পক্ষপাতী অাবার কেউ কেউ এর ঘোর বিরোধী।অামি ব্যক্তিগত ভাবে কবিতায় ছেদ বা যতির প্রয়োগের পক্ষপাতী।অামি মনে করি, কবিতায় বিশ্রাম না থাকলে অর্থাৎ বিরামচিহ্ন না থাকলে শিল্প-সৌন্দর্য্য ও ভাব-সঙ্গতিতে ব্যাঘাত ঘটে।শিল্প কে শিল্পের মতই থাকতে দেয়া উচিত।তাকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া সুশোভন নয়!


ড.হুমায়ুন অাজাদ কমা ও সেমিকোলনের ক্ষেত্রে নতুন ধারা শুরু করেছিলেন।তিনি দাঁড়ির পরিবর্তে কমা ও সেমিকোলন দেয়া শুরু করেছিলেন।যেমন-


"সুফিয়া আমারই, যেমন আমি তার; সে আমার সুগন্ধ, সে আমার সুস্থতা, আমার জন্যেই সে এখন আরো রূপসী হয়ে উঠেছে; আমি তার চাঁপার সুগন্ধ পাচ্ছি না আমার ইন্দ্রিয়গুলো বিকল হয়ে গেছে ব’লে, ওগুলো অভাবিতভাবে আহত হয়েছে; আমাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে, ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রশমিত করতে হবে। ”
(একটি খুনের স্বপ্ন)


অাসলে গদ্যসাহিত্যে এসব মানা যায়; কিন্তু কবিতা নামক শিল্পে ছেদ বা যতির বিরোধিতা করা অামার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে শিল্প-সৌন্দর্য্য ও ভাব-সঙ্গতিতে ব্যাঘাত ঘটে বলেই মনে হয়।কবিতায় যদি বিশ্রামের জায়গা করে না দেয়া হয় তাহলে পাঠক বিভ্রান্ত হন,ক্লান্ত হন,অন্যদিকে কাব্য তাঁর শিল্প-সৌন্দর্য্য হারায়।


অাবার দেখা যাচ্ছে জহির রায়হান; হুমায়ুন অাজাদের বিপরীত কাজটা করলেন।তিনি কমা ও সেমিকোলনের পরিবর্তে শুরু করলেন দাঁড়ির ব্যবহার।যেমন-
" নানা বয়সের। ধর্মের। মতের। আগে কারও সঙ্গে আলাপ ছিল না। পরিচয় ছিল না। চেহারাও দেখিনি কোনোদিন।"
(সময়ের প্রয়োজনে)


এসব পরস্পর বিরোধী মনোভাব সবসময়ই সাহিত্যে ছিলো এবং থাকবে।


অামি ইথার, সবসময়ই কবিতার ক্ষেত্রে একটা কথাই মনে রাখি,শিল্পকে গড়ে তুলতে হলে যেটা যে স্থানে থাকা দরকার;তাকে সে স্থানটিই দেয়া উচিৎ।ব্যাকরণ মেনে যেমন  কবিতা হয় না,তেমনি অাবার ব্যাকরণ ছাড়াও ভাষাকে সুন্দর,মার্জিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করা যায় না।তাই ব্যাকরণকে যুক্তিসঙ্গতভাবে অামি অস্বীকার করতে পারি না।


অাধুনিক সাহিত্যে সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।বর্তমানে বিরামচিহ্ন প্রয়োগের ব্যাপারে অনেকেই উদাসীন,বিশেষ করে পোস্টমর্ডান যুগের কবিগণ।


অথচ বুদ্ধদেব বসু,শঙ্খ ঘোষ,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অত্যন্ত সচেতনভাবে তাদের কবিতায় চিহ্নের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।কিন্তু অাজকাল বিরামচিহ্ন ব্যবহার না করাই যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।


অামি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি,বর্তমানে কবিতার বাক্-ভাষ্য-রীতি যতই পাল্টাক না কেনো,বিরামচিহ্নের গুরুত্ব অাছে।প্রতিটি শব্দ এক একটি জগৎ।প্রতিটি শব্দের মাঝে লুকায়িত অাছে বিস্তর ভাবনা;তাই অামি মনে করি কবিতার অন্তর্নিহিত ছন্দ-তাল-সুর ও ভাবসঙ্গতি বজায় রেখে বাক্-বিন্যাসে বিশ্রামের প্রয়োজন অাছে।এই বিশ্রামটাও এক ধরণের শিল্প।


একসময় বুদ্ধদেব বসুও,জীবনানন্দের অপ্রকাশিত কাব্যগুলো সংগ্রহ করে তাঁর সেই সমস্ত কবিতায় তিনি(বুদ্ধদেব) (পরিচয় পত্রিকাতে)নিজে বিরাম চিহ্ন বসিয়ে দিতেন।


বর্তমানে নব্য-কবিগণ অবচেতনভাবে তাঁদের অসংখ্য কবিতায় ভাষার অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে দিচ্ছেন,যা সত্যিই চিন্তার বিষয়।


অামি নিজেই অামাদের এই বাংলা কবিতার অাসরে মাঝে মাঝে  দেখতে পাই কবিতার বাক্যে কখনো নির্দেশকজাত অপপ্রয়োগ,কখনো সমাসজাত অপপ্রয়োগ,কখনো শব্দদ্বিত্ব অপপ্রয়োগ,কখনো বাচ্যজাত,কখনো কারকজাত,কখনো চিহ্নজাত অপপ্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে।এসব কাউকে বলতে গেলে অামি হয়ত অারো নিন্দার পাত্র হয়ে উঠবো,যা বাস্তব তাই বললাম।কাউকে অাঘাত দেয়া অামার  উদ্দেশ্য নয়।


অাজ অনেকেই উত্তরাধুনিকতার ছলে পাশ কাটিয়ে যান।অাধুনিকতা সমৃদ্ধ; কবিতা নামক শিল্পের দৈন্যদশা সত্যি মেনে নেয়া যায় না।তবে সব কবিদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।বর্তমানে বহু কবি অত্যন্ত সচেতনভাবে অাধুনিক কবিতা লিখে চলেছেন।পোস্ট-মর্ডান কবিতা লিখে চলেছেন চিহ্নসচেতনতার  মাধ্যমে।


উত্তরাধুনিকতার ধারায় রচিত কবি জফির সেতুর একটি কবিতা " স্যানাটোরিয়াম" পড়লেই বুঝতে পারবেন বিরাম চিহ্ন কিভাবে উঠে যাচ্ছে বর্তমানে।


“আমরা বন্ধুরা রতিযুদ্ধে বেপরোয়া ঈর্ষা আর প্রতিহিংসায় নির্বোধের এক-একটা বীভৎস হাসি এককালে আমাদের সকল মূঢ়তা ভেঙে অস্থির করে তুলেছিল ভেজাবগলের এক সুগণ্দি নারী বহুকাল আমরা নিতম্বের চর্বি ও কপটতাকে কাঠের চুল্লির ঘর্মক্ততায় প্রক্ষালন করতে দিয়েছি আত্মতৃপ্ত ভড়ঙে লতাগুল্মের ভেতর রুগণ সিংহীর কোমরের নিচে হেসেছি মুর্ছা গিয়েছি আবার প্রাচীন কমেডির মতো পানপাত্র হাতে পাগলাটে জাদুকরের মশকরাও লক্ষ করেছি”


এই কবিতায় বিরামচিহ্ন একেবারেই নেই।হয়তো তিনি সচেতনভাবেই এটি করেছেন।কিন্তু একজন পাঠক এটি যখন পড়বে,তখন তাঁর কি অবস্থা হবে তা অাপনারাই নির্ধারণ করবেন।


হা,কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজস্বতা ও মৌলিকতার জন্যে সচেতনভাবে অামরা বিরামচিহ্ন কমিয়ে দিতে পারি কিন্তু বিরামচিহ্নের অাবশ্যকতা নেই,এ কথা বলার দুঃসাধ্য,অন্তত অামি ইথারের হবে না।


অাসলে এসব নস্টালজিক বিষয়, বাংলা সাহিত্যে।কেউ চাইছেন,কেউ চাইছেন না।বিতর্ক অার বিতর্ক!


বিরামচিহ্ন বিরোধী মানসিকতা কত তীব্র হতে পারে তা বুঝার জন্য অামি শূন্য দশকের কবি ও গদ্যকার অনুপম মুখোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য হুবহ তুলে ধরছি----


"কবিতায় ছেদ-যতি নিয়ে প্রথম থেকেই ভাবছিলাম। আমি এদের কবিতার শত্রু মনে করি। তার একমাত্র কারণ এরা বাংলা ভাষায় বহিরাগত। বাংলা ভাষায় বহু কিছুই বহিরাগত, অসংখ্য শব্দ বহিরাগত, সকল ভাষাতেই তাই, কিন্তু ছেদ-যতি যেটা করে, বাংলা কবিতায় ইংরেজির যুক্তি দাবি করে। ওগুলো বিশ্রামের জন্য যতটা না ব্যবহৃত হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় একমাত্রিক ‘মানে’-কে মদত দিতে। আমাদের পয়ারে যে এক দাঁড়ি-দু দাঁড়ি প্রযুক্ত হত, সেগুলো কিন্তু ফুলস্টপ ছিল না। তারা পাঠককে শুধু রয়েসয়ে পড়ার আরাম দিত। চৌকাঠের আল্পনার সঙ্গে তার তুলনা চলে। মাইকেল মধুসূদন পরবর্তী বাংলা কবিতায় আমরা যে পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করি সে আসলে ফুলস্টপ। সে একটা উচ্চারণের একেবারেই সমাপ্তি দাবি করে। আজ থেকে দেড়শ বছর পিছিয়ে গেলেই তার দেখা আর মিলবে না। কমা, সেমিকোলন, কোলন, ড্যাশ, হাইফেন... কোনোটাই আমরা দেখতে পাব না, যদি এমনকি ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগের বাংলা কবিতায় যাই। যে কবিরা এগুলো বাংলা কবিতায় নিয়ে এলেন, তাঁরাও ছিলেন শরীরে বাঙালি, আত্মায় ব্রিটিশ, এবং সেটাই জারি থাকল। "


সত্যিই যুক্তির উপর পাল্টা যুক্তি!


হা,যুগের ধারাবাহিকতায় বাংলা সাহিত্যে নানা ধরণের পরিবর্তন এসেছে।স্বকীয়তা,মৌলিকতা,ভাষা ব্যবহারের কৌশল,ধ্বনিমাধুর্য,শব্দনির্মাণ ইত্যাদি ইত্যাদিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।


যাই হোক,উত্তরাধুনিক কবিতায় অামাদের দৈনন্দিন জীবনের কথাগুলো যেভাবে বলি, সেভাবেই উঠে অাসছে কবিতাসমূহে। দৈনন্দিন কথ্য ভাষা অার কবিতার ভাষা এক সরল রেখায় হাঁটা শুরু করেছে।


সবশেষে বলবো,অামি বিরামচিহ্নের পক্ষপাতী।


ভালো থাকবেন শ্রদ্ধাভাজন কবি।অামার এ মন্তব্যে যে কেউ বিরোধিতা করতে পারেন।এটা অামার নিজস্ব মতামত।ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে বাধিত হব।