(বিশেষ আবেদন : যদি কোন কবি বন্ধুর পাঠকনামা পড়তে গিয়ে কোন ভুল তথ্য গোচর হয় তা হলে তা ধরিয়ে দিলে বিশেষ রুপে বাধিত হব।)


ব্যক্তিগত ভাবে এক বন্ধুর সাথে পাঠকনামা নিয়ে কথা হচ্ছিলো কিছুদিন আগে। সে একটি বিষয়ে বেশী জোর দিচ্ছিল যে নামী কবি দের কবিতা বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে যতটা পরিচিত অনন্য শক্তিশালী বা ভিন্ন ধারার কবিতা বা কবিরা থেকে গেছে আড়ালে। তা সে নতুন হোক বা পুরানো। নতুন কবিদের লেখা যেমন সহজে পাঠকের কাছে পৌঁছায় না তেমনি সেই সব ব্যতিক্রমী কবি দের না হয় আমরা ভুলতে বসেছি না হয় কোন দিন পরিচিত হই নি। তাই আজ কের পাঠকনামা তে এমন ই এক কবি কে স্মরণ করবো যিনি তারিখের চোখে প্রাচীন কিন্তু ভাব ভাবনায় লেখনীতে খুব প্রাসঙ্গিক। আজ পাঠকনামা-১৩ তে কবিতা পাঠ করি কবি সমর সেন এর।  কবি জীবনানন্দের সম-সাময়িক এই কবি, খুব অল্প  কবিতা রেখে গেছেন কবি। কিন্তু কবিতা আজ এই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় ভাব, ভাবনা, আঙ্গিক ও লেখনীতে আজও আধুনিক।


কবি সমর সেন জন্ম ১০ অক্টোবর, ১৯১৬ - মৃত্যু: ২৩ আগস্ট, ১৯৮৭, পিতা অরুনচন্দ্র সেন; বাংলার স্বাধীনতা-উত্তর কালের ভারতীয় কবি । ৭১ বছরের জীবনে তিনি কাব্যসাধনা করেন মাত্র ১২ বছর, ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। এই কালপর্বেই তাঁর পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর কবিতাসংগ্রহ সমর সেনের কবিতা ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়। কর্মজীবনে কিছুকাল অধ্যাপনা ছাড়া বাকি জীবন পেশাগতভাবে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সংগে। এছাড়াও দিল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংবাদ বিভাগে, বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এবং অনুবাদকর্মে নিয়োজিত ছিলেন কিছুকাল। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন "Frontier" নামের প্রগতিশীল পত্রিকার।


মধ্যবিত্ত বাঙালির কামনা বাসনা, চাওয়া পাওয়া অনুভূত দিনকাল রচিত হয়েছে কবিতার মাঝে। অনুভূত হয় সাবলীল বয়ে যাওয়া কাব্যতা, আর অনুভূতির উষ্ণতা। তাই কবি কে অনুভব করুন তার লেখা কবিতায়।  


কাব্যগ্রন্থ: কয়েকটি কবিতা (১৯৩৭), গ্রহণ (১৯৪০), নানা কথা (১৯৪২), খোলা চিঠি (১৯৪৩) এবং তিন পুরুষ (১৯৪৪)।



স্বর্গ হ'তে বিদায় --  সমর সেন


সমুদ্র শেষ হ'লো,
আজ দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে
উড়ন্ত পাখির মতো।
সমুদ্র শেষ হ'লো
গভীর বনে আর হরিণ নেই,
সবুজ পাখি গিয়েছে ম'রে,
আর পাহাড়ের ধূসর অন্ধকারে
দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে
উড়ন্ত পাখির মতো।
সমুদ্র শেষ হ'লো,
চাঁদের আলোয়
সময়ের শূন্য মরুভূমি জ্বলে।


বসন্ত  --  সমর সেন


বসন্তের বজ্রধ্বনি অদৃশ্য পাহাড়ে।
আজ বর্ষশেষে
পিঙ্গল মরুভূমি প্রান্ত হতে
ক্লান্ত চোখে ধানের সবুজ অগ্নিরেখা দেখি
সুদূর প্রান্তরে।


স্তোত্র --  সমর সেন


আদিদেব একা সাজে পুরুষ প্রকৃতি।
মহাজন চাষি তিনি সবাকার গতি।
কৃষ্ণকালো বড়ো মেঘ জুড়েছে আকাশ।
শ্যামবর্ণ মূর্তি তার চাষির আশ্বাস।
ধান দেখে মহাজন বলেছে সাবাস।
আকাশে শুনেছি আজ মেঘের বিষাণ।
ঘরে-ঘরে বুঝি আজ রাসলীলা গান।
সাপ যত বসে আছে শিকারের তালে।
রাত্রি এল, মৃত্যু লেখা ব্যাঙের কপালে।
মহাজন গান গায় নদারৎ ধান।
অন্ধকার প্রেতলোকে ভাবে ভগবান।
অক্ষম এ রায়বার ঈশ্বর কথনে।
প্রভুর বন্দনা শুনি বেনের ভবনে।


নচিকেতা --  সমর সেন


"কে এসেছে কালরাত্রে কৃতান্তনগরে?
এখন হাটের বেলা, এখানে মজার খেলা,
সারি-সারি শবদেহ সাজানো বাজারে।
বজ্রনখ উলূক রাত্রির কালো গানে
দেশভক্ত বিভীষণ, মত্সবন্ধু বকধার্মিকের
কাঁধে হাত রেখে, দেখ, চলে,
মহম্মদী বেগ্ খর খড়্গ শানায়,
বাজার ভরেছে আজ হন্তারক দলে।
দুঃসাহসে তুষ্ট আমি | আশীর্বাদ করি,
পৃথিবীতে জন্ম যেন না হয় তোমার।"


"রক্তজবা সূর্য ওঠে পর্বত শিখরে,
বৃষ্টিবিন্দু দাও দেব বটের শিকড়ে।
অনাবৃষ্টির আকাশ হোক অন্যরূপী
তিন কুল ভ'রে দাও জনে ধনে জনে সুখী।"


বিকলন --  সমর সেন


তোমাকে দেখেছি দেবী লোহিত সকালে,
মাইকেলী মেঘনাদে, বিদ্যাসাগরের
বজ্রগর্ভ করুণায়, বিপ্লবী আরাবে।
আজ বিলাপের কাল! আনন্দ আকাশে
জুটেছএ অন্যান্য জীব, হননের মন্ত্র মুখে।
পোড়ামুখ ভুলে যাও, হে জননী, এ ঘোর দুর্দিনে;
রজকের কি বা লাভ উলঙ্গের কাছে!
বিফলে গভীর রাত্রে চাঁদ ওঠে।
অতীতের ঐশ্বর্যমহিমা চেতনার প্রান্তে আজ
বিভীষিকা মূর্তি ধরে, পদ্দার উদ্দাম গান
মাত্রারিক্ত! করাল জোয়ার! আমার সোনার ধানে
পরিচিত হাত রাখে শত্রুর দালাল।
দিগন্তে ধূসর মাঠে গতপত্র বট
মাথা নাড়ে প্রবীণ ক্লান্তিতে। সে কি জানে
যৌবনে অন্যায় ব্যয়ে বয়সে কাঙালি
দিনগত পাপক্ষয়ে মূঢ় ভ্রান্তমতি
লোকায়ত কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন বিধুর
মধ্যবিত্ত মানসের বিড়ম্বিত গ্লানি?


মেঘদূত --  সমর সেন


পাশের ঘরে
একটি মেয়ে ছেলে-ভুলানো ছড়া গাইছে,
সে ক্লান্ত সুর
ঝ'রে-যাওয়া পাতার মতো হাওয়ায় ভাসছে,
আর মাঝে মাঝে আগুন জ্বলছে
অন্ধকার আকাশের বনে।


বৃষ্টির আগে ঝড়, বৃষ্টির পরে বন্যা। বর্ষাকালে,
অনেক দেশে যখন অজস্র জলে ঘরবাড়ি ভাঙবে,
ভাসবে মূক পশু ও মুখর মানুষ,
শহরের রাস্তায় যখন
সদলবলে গাইবে দুর্ভিক্ষের স্বেচ্ছাসেবক,
তোমার মনে তখন মিলনের বিলাস,
ফিরে যাবে তুমি বিবাহিত প্রেমিকের কাছে।
হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও,
কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে?


মুক্তি --  সমর সেন


হিংস্র পশুর মতো অন্ধকার এলো---
তখন পশ্চিমের জ্বলন্ত আকাশ রক্তকরবীর মতো লাল
সে-অন্ধকার মাটিতে আনলো কেতকীর গন্ধ,
রাতের অলস স্বপ্ন
এঁকে দিল কারো চোখে,
সে-অন্ধকার জ্বেলে দিলো কামনার কম্পিত শিখা
কুমারীর কমনীয় দেহে।


কেতকীর গন্ধে দুরন্ত,
এই অন্ধকার আমাকে কী ক'রে ছোঁবে?
পাহাড়ের ধূসর স্তব্ধতায় শান্ত আমি,
আমার অন্ধকারে আমি
নির্জন দ্বীপের মতো সুদূর, নিঃসঙ্গ।


উর্বশী --  সমর সেন


তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে
দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো!
কিংবা আমাদের ম্লান জীবনে তুমি কি আসবে,
হে ক্লান্ত উর্বশী,
চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে যেমন বিষণ্ণমুখে
উর্বর মেয়েরা আসে
কত অতৃপ্ত রাত্রির ক্ষুধার ক্লান্তি,
কত দীর্ঘশ্বাস,
কত সবুজ সকাল তিক্ত রাত্রির মতো,
আর কতো দিন!


নিরালা --  সমর সেন


বর্তমানে মুক্তকচ্ছ, ভবিষ্যৎ হোঁচটে ভরা,
মাঝে মাঝে মনে হয়,
দুর্মুখ পৃথিবীকে পিছনে রেখে
তোমাকে নিয়ে কোথাও স'রে পড়ি।
নদীর উপরে যেখানে নীল আকাশ নামে
গভীর স্নেহে,
শেয়াল-সংকুল কোনো নির্জন গ্রামে
কুঁড়েঘর বাঁধি;
গোরুর দুধ, পোষা মুরগির ডিম, খেতের ধান ;
রাত্রে কান পেতে শোনা বাঁশবনে মশার গান ;
সেখানে দুপুরে শ্যাওলায় সবুজ পুকুরে
গোরুর মতো করুণ চোখ
বাংলার বধূ নামে ;
নিরালা কাল আপন মনে
পুরোনো বিষণ্ণতা হাওয়ায় বোনে।


তুমি যেখানেই যাও --  সমর সেন


তুমি যেখানেই যাও,
কোনো চকিত মুহুর্তের নিঃশব্ দতায়
হঠাৎ শুনতে পাবে
মৃত্যুর গম্ভীর, অবিরাম পদক্ষেপ।


আর, আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে ?
তুমি যেখানেই যাও
আকাশের মহাশূণ্য হ'তে জুপিটারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি
লেডার শুভ্র বুকে পড়বে।


একটি বেকার প্রেমিক --  সমর সেন


চোরাবাজারে দিনের পর দিন ঘুরি।


সকালে কলতলায়
ক্লান্ত গণিকারা কোলাহল করে,
খিদিরপুর ডকে রাত্রে জাহাজের শব্ দ শুনি;
মাঝে মাঝে ক্লান্ত ভাবে কী যেন ভাবি---
হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি;
আর শহরের রাস্তায় কখনো প্রাণপণে দেখি
ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক।
আর মদির মধ্য রাত্রে মাঝে মাঝে বলি
মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো
হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন।
কলতলায় ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক-সভ্যতার শূণ্য মরুভূমি।


একটি মেয়ে --  সমর সেন


আমাদের স্তিমিত চোখের সামনে
আজ তোমার আবির্ভাব হ'লো
স্বপ্নের মত চোখ, সুন্দর, শুভ্র বুক,
রক্তিম ঠোঁট যেন শরীরের প্রথম প্রেম
আর সমস্ত দেহে কামনার নির্ভিক আভাস
আমাদের কলুসিত দেহে
আমাদের দুর্বল, ভীরু অন্তরে।
সে-উজ্জ্বল বাসনা যেন তীক্ষ্ণ প্রহার।



নিঃশব্দতার ছন্দ --  সমর সেন


স্তব্ধরাত্রে কেন তুমি বাইরে যাও?
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বিশাল অন্ধকারে শুধু একটি তারা কাঁপে,
হাওয়ায় কাঁপে শুধু একটি তারা।


কেন তুমি বাইরে যাও স্তব্ধরাত্রে
আমাকে একলা ফেলে?
কেন তুমি চেয়ে থাক ভাষাহীন, নিঃশব্দ পাথরের মতো?
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বাতাসে গাছের পাতা নড়ে,
আর দেবদারুগাছের পিছনে তারাটি কাঁপে আর কাঁপে;
আমাকে কেন ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত হতে বিরহের স্তব্ধতায়?


মাঝে মাঝে চকিতে যেন অনুভব করি
তোমার নিঃশব্দতার ছন্দ :
সহসা বুঝতে পারি—
দিনের পর কেন রাত আসে
আর তারারা কাঁপে আপন মনে,
কেন অন্ধকারে
মাটির পৃথিবীতে আসে সবুজ প্রাণ;
চপল, তীব্র, নিঃশব্দ প্রাণ—
বুঝতে পারি কেন
স্তব্ধ অর্ধরাত্রে আমাকে কেন তুমি ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত থেকে বিরহের স্তব্ধতায়।



বিরহ –- সমর সেন


রজনীগন্ধার আড়ালে কী যেন কাঁপে,
কী যেন কাঁপে
পাহাড়ের স্তব্ ধ গভীরতায়।
তুমি এখনো এলে না।
সন্ধ্যা নেমে এলো : পশ্চিমের করুণ আকাশ,
গন্ধে ভরা হাওয়া,
আর পাতার মর্মর-ধ্বনি।


বিস্মৃতি –- সমর সেন


ভুলে যাওয়া গন্ধের মতো
কখনো তোমাকে মনে পড়ে।
হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাস।
আর মেঘের কঠিন রেখায়
আকাশের দীর্ঘশ্বাস লাগে।
হলুদ রঙের চাঁদ রক্তে ম্লান হ’লো,
তাই আজ পৃথিবীতে স্তব্ ধতা এলো,
বৃষ্টির আগে শব্ দহীন গাছে যে-কোমল, সবুজ স্তব্ ধতা আসে।


আত্মসমালোচনা –- সমর সেন


একদা আমরা ছিলাম বিমর্ষ বাঁদর ;
আজ আস্ফালনে মত্ত যেন বীর হনুমান।
সেতুবন্ধের অনেক বাকি,
ওপারে রাক্ষসের স্পর্ধা দিনেদিনে বাড়ে,
প্রতিদিন দেখি উষ্টগ্র্রীব প্রতিনিধি তার
এদেশকে নির্বিকারে বলাত্কার করে ;
কিন্তু ভাই, নিশ্চিত জানি
শেষপর্যন্ত ইতিহাস নির্ঘাত্ আমাদের দিকে ;
সেই ঐশী ইতিহাসশক্তির মায়ায়
লেজের জটিল জাল দেখি রাবনের গলায়।


এবার ফিরাও মোরে –- সমর সেন


পড়ন্ত রোদে নগর লাল হল।
বহুদূর দেশে
পাহাড়ের ছায়া প্রান্তরে পড়ে;
সন্ধ্যার অন্ধকারে অন্ধ নদীর
মদির ক্লান্ত টান।


মেমননের স্তব্ধ মূর্তি
রাত্রি হয়ে এল শেষ
এবার ফিরাও মোরে।


একটি কবিতা –- সমর সেন


সন্ধ্যার ট্রেন আকাশে ধোঁয়ার স্তম্ভ আঁকে,
ভারি লাল চাঁদ আসর জমায়;
বহু আশাভঙ্গে ফেঁপেছে মন,
বয়স তো হল, আর কেন ভীমরতি,
প্রভুহীন কুকুরের মতো আর কতোকাল।
আপন চর্চায় শুধু শূন্য ফানুস ফাঁসে,
বিধি হলে বাম
আপনি বাঁচালে বাপের নাম
সে দিন নেই।
চাপা সূর্যের ভ্রূকুটি আকাশ ছিন্ন ক’রে
সবুজ গাছে কালো কাকে সকাল আনে;
সারাদিন আপন মনে মনের উকুন বাছা,
লোকালয়ের খেয়াঘাটে অর্থহীন এ আত্মম্ভরী গান।


কয়েকটি মৃত্যু –- সমর সেন



তার মুখে সূর্যের কাঁচা সোনা,
মনে তার নতুন অরণ্যের স্বাদ
তাই সবি ভালো লাগে।
প্রেমের ব্যাপারে দিব্যি বেপরোয়া
সরম নেই।
আর একটি গুণ –
ছেলেপিলে চায় না মোটেই।
পুন্নামের মুখে মস্ত তুড়ি মেরে
স্বচ্ছন্দে চলে যায় দাম্পত্য জীবন।


অবশেষে ঠকঠকে বুড়ি হয়ে মারা গেল,
সংসার খালি;
দূর ছাই, কিছু ভালো লাগে না,
সঙ্গীহীণ বুড়ো ভাবে সন্ধ্যায়:
সমাজ বদলেছে অনেক, নিরুপায়,
নইলে হে হরি,
এ বয়সে মন্দ লাগত না আর একটি কিশোরী।



চলেছি সমুদ্রে পথে;
বিস্তীর্ণ বালি, হলুদ বালি,
হাতে কাজ নেই, মন খালি,
শূন্য মেঘের ফালি।
চায়ের দোকানে কতদিন পয়সা খসিয়েছ,
কত ধার নিয়েছ, শোধ দিতে গিয়েছ ভুলে,
কত বই চুপি চুপি অক্লান্ত মেরেছ,
প্রায় শূন্য আলমারি।


আজ মৃত্যু সে সব কথা মনে আনে
হলুদ বালির পথে।



বৃষ্টিতে মাজা নীল শূন্য;
জানি, করাল অভিশাপে
এ বস্তের বাগান ভেসে যাবে রক্তস্রোতে;
আমাদের এ টুকরো প্রেম, কৃষ্ণচূড়া দিন,
এ বাসরঘর,
শ্মশান কুরুক্ষেত্রে শকুনের কোলাহলে
মোলায়েম বাঁশির মতো।


এ কথা একদিন তুমি বলেছিলে।
তারপর তুমি চলে গেলে যমলোকে;
মড়াপোড়া ধোঁয়ায় সারাদিন জ্বলেছে চোখ,
ফিরেছি শ্মশান ছেড়ে স্নান সেরে; দেখেছি,
পথেঘাটে স্বচ্ছন্দে চলে বর্বর জীবন,
অশোক, নির্লজ্জ;
বৃষ্টির পরে নীল শূন্য; রক্তঝরা কৃষ্ণচূড়া।


তারপর চায়ের দোকানে ব’সে সহসা ভেবেছি;
আজকাল ঘরে ঘরে সমাজধার্মিক অনেক,
মুখে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বুলি,
মনে রোমান্টিক বুলবুলের অবিরত গান,
তুমি ছিলে তারি একজন।
এ অধমও তারি একজন।
সুতরাং শোক বৃথা; মরে তুমি হয়তো বেঁচেছ,
আমরা বাঁচিনি,
আমাদের বসন্তবাগান ভেসে যাবে রক্তস্রোতে,
আরো কত বল হরি হরি বোলে, দারুণ জোয়ারে।


জয় হিন্দ –- সমর সেন


দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় মালিকের ফের বেঁধেছে ঘাঁটি;
বৈষ্ণবী বিনয়ে ইংরেজ বসেছে বর্মায়,
ফরাসীরা প্রত্যাগত ইন্দোচীনে,
গোলন্দাজহীন ওলন্দাজ ঘোরে যবদ্বীপে।
ভারতের স্বাধীনতা আসন্নপ্রায়।


বম্বেতে দিন রেখে গেল বারুদের গন্ধ;
রাস্তায় রক্তের ছিটে।
বন্দুকের খর শব্দ থামলে শহরে
বিপ্লবী নেতারা জমে বক্তৃতার মাঠে,
সর্দারের ধমকে পার্কের রেলিং কাঁপে,
হয়তো কৃত পাপের লজ্জা জাগে
মর্গে জমা দুশো সত্তরটা লাসে।
ধোঁকায় জব্দ জাহাজেরা বন্দরে স্তব্ধ,
মাঝে মাঝে উদ্যত সঙীন, সাম্রাজ্যের উদ্ধত প্রতীক।


আমাদের স্বাধীনতা আসন্নপ্রায়,
মন্ত্রীসভার বিলিতী দূতেরা আগতপ্রায়
জয় হিন্দ।


মহুয়ার দেশ –- সমর সেন



মাঝে মাঝে সন্ধ্যার জলস্রোতে
অলস সূর্য দেয় এঁকে
গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ,
আর আগুন লাগে জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনায়।
সেই উজ্জ্বল স্তব্ধতায়
ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে
শীতের দুঃস্বপ্নের মতো।


অনেক, অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ,
সমস্তক্ষন সেখানে পথের দুধারে ছায়া ফেলে
দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য,
আর দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস
রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে।
আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল,
নামুক মহুয়ার গন্ধ।



এখানে অসহ্য, নিবিড় অন্ধকারে
মাঝে মাঝে শুনি
মহুয়া বনের ধারে কয়লার খনির
গভীর, বিশাল শব্দ,
আর শিশিরে-ভেজা সবুজ সকালে
অবসন্ন মানুষের শরীরে দেখি ধুলোর কলঙ্ক,
ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়
কিসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন।


পাঁচমিশেলি -- সমর সেন



বাস থেকে দেখি বিরস গাছ,
কিন্তু কি সবুজ ঘাস!
ডিজেল তেলের পোড়াটে স্বাদ।
খালি মনে পড়ে তোমার ঠান্ডা হাত,
গুমোট গরমে পান্তা ভাত,
লঙ্কা, কাসুন্দি, পেঁয়াজ;
বাড়ে বাড়ে বেহাত হওয়া কি তোমার রেওয়াজ?



কারো কারো চোখে দেখি
আলোর কুহেলিকা,
ভুরুর রেখা
নদীর ওপারে বলাকা,
দেওহ-মদির কবিতা
খোঁয়ারির ভোরে লেখা।



ফিকে জ্যোৎস্না ছড়ায়
জোলো, বাসি দুধের রং।
কাকেরা ফিরছে বরষার গাছে
মেয়েটি ভিজে ফুটপাথে;
ভ্রুনসার শিশু তার পাশে
হয়তো দুধের স্বপ্ন দেখে হাসে।
ট্রেনের না ইস্টিমারের গুমোট ডাকে
যশোদা-পৃথিবীর আবেশ কাটে।


তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট, কবির লেখা বই, বিভিন্ন কবিতার সমালোচনা ও পত্রপত্রিকা।
( কবিতার পাঠক হোন, কবিতার বই কিনুন)