২০১৫ সালে বাংলা কবিতার জগতের যে উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন তিনি কবি উৎপল কুমার বসু। আমার কবিতার প্রতি অনুভূতিতে কবির দীপ্ত উপস্থিতি বিদ্যমান। কবিতা পড়ুন আর অনুভব করুন কি ভাবে কবিতার জন্ম হয় কবির ভাবনা থেকে। তাই তার কবিতাই দিয়ে শুরু হোক এই ২০১৬ সালের পাঠকনামা।


১৯৩৯ সালে ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন কবি। প্রথম কবিতার বই চৈত্রে রচিত কবিতা (১৯৬১) প্রকাশিত হয় কৃত্তিবাস প্রকাশনা থেকে।  ১৯৬৪-তে বিদেশে চলে গেলে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আবার দেশে ফিরে আসেন ১৯৭৭ সালে।  ০৩ অক্টোবর, ২০১৫ মৃত্যু তাকে বিচ্ছিন্ন করে কবিতা থেকে।
বাংলা সাহিত্যে জড়তা ভাঙার আওয়াজ তুলে ষাটের দশকের শুরুর দিকে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেই হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে  ওতপোত ভাবে জড়িত ছিলেন কবি উৎপল কুমার বসু। চিরায়ত পথ ছেড়ে বাস্তব দর্শন হয়ে ওঠে তার কবিতার মূল উপজীব্য। স্বতন্ত্র কাব্যভাষা, প্রকাশভঙ্গি ও আঙ্গিকের সাথে পাঠকের ভাবনার সাথে মিলনের জন্য জন্য পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কবি।


তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পুরী সিরিজ’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে।‌ ‘নরখাদক’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। ‘পিয়া মন ভাবে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০১৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান উৎপল কুমার বসু। ‘সুখ-দুঃখের সাথী’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০০৬ সালে পান আনন্দ পুরস্কার।


‘বক্সিগঞ্জে পদ্মাপাড়ে’, ‘সলমা জরির কাজ’ প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।


আবৃতির লিঙ্কঃ
https://www.youtube.com/watch?v=Tn6IdPDnPSs
https://www.youtube.com/watch?v=Ok0gKt_ZmUY



কয়েকটি সামপ্রতিক কবিতা -- উৎপল কুমার বসু


1.


গাছে উঠে বসে থাকি। ফল খাই। ব্যক্তিমানুষের দিকে
আটি ছুঁড়ে মারি। নিচে হাহাকার পড়ে যায়। বেশ লাগে।
মাঝে মাঝে ধ্রুপদী সংগীত গাই। ওরা শোনে। বাদ্যযন্ত্র
নিয়ে আসে। তাল দেয়। বোধ হয় ছবিও তুলেছে। সেদিন
এক গবেষক বাণী চাইল। ভাবলাম বলি : আমার জীবনই
আমার বাণী। কিন্তু এটিও নাকি বলা হয়ে গেছে। অতএব
নিজস্ব ভঙ্গিতে, কিছুটা বিকৃত ভাবে, বিড় বিড় করি-
"দেখেছি পাহাড়। দেখে জটিল হয়েছি।"


2.


চলো মর্মরসাথী, চলো ভ্রমণে, কান্তারে,
চলো বিদেশীর বেশে কেউ যেন কাউকে না চিনি-


ফলিত জ্যোতিষরূপী, তুমি গানের দেবতা, তুমি জানো
আমার লেখার খাতা অজ্ঞান অনিশ্চয়তায় ভরে গেছে,
এসো নতুন প্রজন্ম হয়ে, এই ভুলভ্রান্তিময়
লেখাগুলি পাঠ করো, অর্থ করো, পর্বতবাসীদের মতো
বিশাল প্রান্তর প্রথম দেখায় অভিভূত হও।
এ-অববাহিকা, বস্তুত জমির ঢাল, ধীরে ধীরে নদীতে নেমেছে।


3.


ভোরবেলা পার্কে বেড়াতে গিয়ে কী দেখব কে জানে, এই ভয়ে
রাত থেকে কাঁপি, ভুল পায়ে জুতো পরি, ছাতা নিতে মনেই
থাকে না, হায় সেই দুর্ঘটনার জীপ-গাড়ি থানার সামনে তেমি্নই
পড়ে আছে, মরচে ধরেছে, চাকায় বাতাস নেই, গাছ থেকে
ঝুলন্ত দড়িটা ওখানে কীভাবে এল, ফাঁস নাকি, লকআপ-য়ের
জানলা থেকে উড়ে আসে দুটো পাখি, ভাঙাচোরা এঞ্জিনে ওদের
বাসা, আপাতত ডিমহীন, নীড়ে শাবক আসে নি, আজ ঝড়ের
আঁধার মেঘে দিন শুরু, এলোমেলো বৃষ্টি নামছে।


4.


চলো নামি দুর্গের বাগানে, খেলা করি। সূর্য
বসে পাটে। বিকেলের ভ্রমণকারীরা অস্তলীন।
ঐখানে অবিনাশী পাথর রয়েছে-মূর্তি আছে
যোদ্ধাদের এবং অনেক ঝুলে-থাকা টায়ার-দোলনা।
ফিরে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে বনটিয়া শহরের দিক থেকে।
আরো নিচে বধ্যভূমি, ফাঁসিকাঠ, লোহার কয়েদ।
শুনি আর্তনাদ-হাহাকার-পাখির উল্লাস। ঐখানে আজ
আমাদের খেলা ও খেলার গান। আমাদের খেলার লড়াই।


5.


কত-না রুদ্ধ ক্রোধ বাক্সে লুকানো থাকে, বাঁধা থাকে বিছানায়।
চেকিঙে পড়েনি ধরা, বৈদু্যতিন কৌশল এড়িয়ে গিয়েছে,
বিমানবন্দর তারা অকাতরে পার হয়, এমনকি দেহরক্ষীদের
বেষ্টনী এড়িয়ে বহু হতবাক প্রেসিডেন্ট-মুখ্যমন্ত্রী-নগরপালের
সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, বলে-'অ্যাই, তোরা ভেবেছিসটা কী?'
সৈন্যরা বৃথাই বন্দুক ছোঁড়ে, কৃপাণ নিজেরা লড়াই করে।
ক্রোধ অদৃশ্যই থেকে যায়।


নবধারাজলে – -উৎপলকুমার বসু


মন মানে না বৃষ্টি হলো এত
সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে।
এখন এক ঢেউ দোলানো ফুলে
ভাবনাহীন বৃত্ত ঘিরে রাখে-
স্রোতের মতো স্রোতস্বিনী তুমি
যা-কিছু টানো প্রবল দুর্বিপাকে
তাদের জয় শঙ্কাহীন এত,
মন মানে না সহজ কোনো জলে
চিরদিনের নদী চলুক, পাখি।
একটি নৌকো পারাবারের ছলে
স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল
অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার,
তোমার গ্রামে, রেলব্রিজের তলে,
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।


চেয়ে দ্যাখো –- উৎপল কুমার বসু


প্রত্যক্ষ করেছ? সেই ভোর থেকে হাত পেতে আছি। ভরে গেছি
দানে ও অবজ্ঞায়। পেয়েছি ক্ষুধার শস্য, প্রেমকণা, দাতার ধিক্কার,
কিছু যেন স্বততই এসেছে – কিছু রাস্তায় কুড়িয়ে পেলাম। সহজ হয়নি।
দৌড়ে গেছি রুষ্ট শ্বাপদের অত্যাচারে। বসে গেছি বিবাহের ভোজে।
এ-মুহূর্তে সন্ধ্যার সানাইটুকু উদ্বৃত্ত। যাকে বলে না-চাইতে পাওয়া।


রাক্ষস –- উৎপলকুমার বসু


সেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল।
তাকে বলি : এই তো তোমারই ঠিকানা-লেখা চিঠি, ডাকে দেব, তুমি
মন-পড়া জানো নাকি? এলে কোন ট্রেনে?
আসলে ও নির্জনতা নয়। ফুটপাথে কেনা শান্ত চিরুনি।
দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ কালো চুল লেগে আছে।


পোপের সমাধি –- উৎপলকুমার বসু


লাল-হলুদ কাচের জানালার দিকে তাকিয়ে
সেদিন অকস্মাৎ
বিকেলের অপরিচ্ছন্ন মুহূর্তে আমি
জটিলতাহীন
সূর্যরশ্মির দিকে চোখ মেলে
“পোপের সাম্রাজ্য আর
তাঁর আসুখের
রহস্যময় বীজাণুর স্হিতিস্হাপকতা”
আঙুলে একটি বড়
গ্লোব পৃথিবীর
বর্তুল পরিধি দেখিয়ে
আমি কলকাতায় তোমাকে বলেছিলাম
“পোপের সাম্রাজ্য
আর তাঁর আসুখের রহস্যময় বীজাণুর স্হিতিস্হাপকতা
কতোখানি দেখা যাক”
বীজাণুর সঙ্গে তুমি চাও না কি যুদ্ধ হোক?
অন্তত আমি তা চাইনা
কারণ সে যুদ্ধ যদি থর্মযুদ্ধ না হয় তাহলে
কুরুক্ষেত্রে কার মুখব্যাদানের অন্ধকারা
আমি ছোট পৃথিবীর গ্লোবের প্রতিচ্ছায়া দেখে
হতচকিতের মতো
কৌরবের খেলার পুতুল হব?
আমি কি নিজেই নিজেকে থলির মতো
নাড়া দিয়ে ভেতরের
বীজাণুর, সন্ত্রাসের, সিকি-আধুলির শব্দ,
গড়াগড়ি তোমাকে শোনাবো?
অন্য বহু
পুরুষের মতো এই সাতাশ আটাশ
বছরের ছোট খিন্ন জীবনের কেবলই
ঝিল্লি শিরা অন্ত্রবহুল
ঐকান্তিক শরীরের প্রেমে
বারবার নেমে এসে
আমাদের দ্বিধা হল কেন?
যথার্থ মাতাল, পাপী,
কর্মজ্ঞানী, সাধু ও চোরের সঙ্গে মাখামাখি হল না তেমন ।
নৌকায় বেশীদূর বেড়ানো হল না
ভালবাসা জোরালো হল না-
খালপারে বিবাদ হল না-
পাঠক, এখন,
রোমের চত্বর থেকে
দূর জানালায় চোখ রেখে
দেখা গেল দ্যুতি নিভে যায়
ক্যাথলিক মিশনের কাছে
আমি ভারতের
অপুষ্ট শিশুর জন্য
গুঁঢ়ো দুধ চাইবো আয়াসে
ঊনচল্লিশ পোপের মৃত্যুর পর
কূটজ্ঞানে
চল্লিশ পোপের
জীবাণুমুক্ত আয়ু ফিরে আসে-
এই বোধে ।
কিন্তু আমাদেরো
অন্য বহু পুরুষের মতো
আরো কুঢ়ি, বাইশ বছরের আয়ু বাকি আছে ।
ততদিন বিমান-বন্দরে গিয়ে বসে থাকি
ঊড়োজাহাজের ওঠানামা দেখি
অথবা ছাপার কলে
গিয়ে বলি কবিতাগুলি
ছেপোনা বা
বুড়ো আঙুলের দাগ ছেপোনা বা
ল্যাজের খুরের দাগ
ছেপোনা বা
আমাকে বদল করো
রহস্যের মূল জানালায়
অন্ধকারে
যখন হলুদ নীল ভিন্ন রং
মুছে গিয়ে পোপের সাম্রাজ্য আজ
বীজাণুর মতো ছোট
সংখ্যাহীন, ধূর্ত ও কোমল
মাতব্বর ঈশ্বরের আবির্ভাব হল সদলবলে ।


সলমা-জরির কাজ ১০ –- উৎপলকুমার বসু


শ্বাসকষ্ট উঠলেই বুঝতে পারি ফুলডুঙরি পাহাড় আর বেশি দূরে নয়
নইলে এমন হাঁপাচ্ছি কেন? কেন ওসুধে সারে না?
ঐ পাহাড়ের মাথায় উঠলে এ-বছর কী দেখব কে জানে-
যে-পাথরে আমরা সবাই নাম লিখিয়েছিলাম সেটি হয়ত
নিচে গড়িয়ে পড়ে গেছে,
যে-জলস্রোত লাফিয়ে পার হয়েছিলাম তাকে ঘুরি
চাষজমির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল-
যদি তাই হয়ে থাকে তবেআর তাকে আমি খুঁজে পাবো না,
এইসব ভাবি আর হাসপাতালের বিছানা শুকনো ডালপালায়,
ছেঁড়া কাগজে আর পরিত্যক্ত সাপের খোলসে ভরে োঠে-
এত জঞ্জাল সরাবে কে? আমি কি সময় করে উঠতে পারবো?
আমি তো ফুলডুঙরি পাহাড়ে প্রায় পৌঁছে গেছি।
চেপারামের ঘরটা
এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। আরেকটু পা চালিয়ে
উঠে গেলেই হয়।


সলমা-জরির কাজ ৭ –- উৎপলকুমার বসু


বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা,
ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে, মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, আজ যা-বলার আছে তুমি আমাকেই
বলো, স্ত্রীর মুখরতার কথা বলো, সহকর্মীদের শটতার কথা বলো, রাতে ঘুম হয় না সেই
কথা বলো, আর যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু।


কহবতীর নাচ ৮ –- উৎপলকুমার বসু


জড়তা নামছে, ঋষি, এসো ভাইবোনেদের ডাকি।
পড়ার টেবিলটুকু ওখানেই পাতা থাক যাতে সহজে নাগাল পাই–
যাতে দ্রুত লিখে যেতে পারি কেমন লাগল আজ এ-বেলার
আভ্যন্তরীণ শান্ত রক্তপাত–শ্রবণ কিভাবে নিল
দূর তরুলতাহীন শূন্য থেকে ভেসে আসা কবিদের বৃন্দগান–
সুতোবাঁধা উপহার পেয়ে তার কেমন ভাবনা হল, মানে এই
পক্ষাঘাতগ্রস্থ জড় দেহটির। কে পাঠাল এতসব ছেঁড়া জার্সি, হাফপ্যান্ট,
ফটোর শুকনো মালা, আর স্কুলের প্রথম অক্ষরটানা খাতাটিও
এতদিন কাদের সংগ্রহে ছিল? কীভাবে বা ফিরে এল?
ভুলগুলি তেমনই রয়েছে। কেউ কেন শুধরে রাখেনি?


কহবতীর নাচ ৭ –- উৎপলকুমার বসু


এবার যদি আমি ফিরে আসি তবে আমি নীল রঙ হয়ে ফিরে আসব।
বৃষ্টিশেষে মেঘের ফাঁক দিয়ে বাংলার আকাশে যে নীল রঙটুকু দেখা যায়
আমি তারই মতো হাল্কা কিছু বলার চেষ্টা করব–
যে-কথায় কোনও জড়তা নেই–যাকে না বুঝলে
কারো ভাতকাপড়ে টান পড়বে না–কেউ বলতে পারবে না
তোমাকে বুঝলুম না হে, তোমাকে একেবারেই বোঝা গেল না।
তখন তুমিও সাদা রঙ হয়ে ফিরে এসো।
হাতে-বোনা খদ্দরের হিংসাহীনতা হয়ে তুমি যেন আমাদের
সবার চৈতন্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকো–যে সাদা রঙ দাবি করে
‘আমাকে বুলেটবিদ্ধ করো, আমাকে রক্তছাপে ভরিয়ে তোলো,
আমাকে স্বাধীনতা দাও।’


কহবতীর নাচ ৬ –- উৎপলকুমার বসু


শ্রীচশ্পা কখনো পথে কখনো-বা মেঘের সদরে ফুটে থাকে। আজ
বৃদ্ধ সমুদ্র আর লোহাজাল খাঁড়ির দেয়ালে আক্রোশে আছড়ে পড়ছে।
অতিশয় ফাটল দেখেছি। উপকূলরক্ষীদের ঘরগুলি
ছন্নছাড়া, ভগ্নদশা–শ্রাবণের কটাল-জোয়ারে থই থই।
ফিরে আসব শীতের ছুটিতে। তখন এ-তটরেখা সরে যাবে বহুদূর।
পথের দু-পাশে শ্বেত, বৃষ্টিহীন মেঘে আর পরিত্যাক্ত ঘরে ঘরে
শুরু হবে ফুলের উৎসব। অনেকেই তখন আসবে।


কহবতীর নাচ ৫ –- উৎপলকুমার বসু


হাড় ও কঙ্কাল শুধু, আমি তাকে পাঁজাকোলে করে
চেয়ারে বসিয়ে দিই, অম্নিই বসে থাকে,
ঝঞ্চাট করে না, কখনো হেলান দিয়ে দেয়ালে
সাজিয়ে রাখি–বেশ থাকে কোনাভাঙা, চাটগাঁ-র ভাষায়
এটা-সেটা বলে, তবে কোনো দাবিদাওয়া নেই,
যেসব পুরুষদের বৌ-রা চাকরি করে তাদের মুখের দিকে
অপলক চেয়ে থাকে–ভয় পায় বিসর্জনের
ঢাক শুনে, ভাবে বুঝি তাকেও নদীর জলে ফেলে দেওয়া হবে।


কহবতীর নাচ ৪ –- উৎপলকুমার বসু


বালক-বালিকা ও পেশীবহুল গ্রাম্য-সভার কাছে আমি দাবি করি- কই হে,
আমাকে একটা ঝুমঝুমি দাও, যে-কটা দিন আছি টেনে বাজাই। অসংখ্য আত্মজীবনী,
দিনলিপি ও সম্পত্তি-হস্তান্তরের দলিল আমি এবারের গ্রীষ্মের ছুটিতে পড়ে
ফেলেছি–জানালা দিয়ে দেখেছি দূরে উড়ে চলা ঐ শুকনো পাতাগুলো ক্রমে বহু
তক্ষকে রূপান্তরিত হল এবং তারপর ঘুরতে ঘুরতে নামহীন চিত্রময় সাপ হয়ে তার
মাটির অধিকতর ভিতরে মিশে গেল– অথচ তোমরা তো বলেই খালাস যে রূপের
কখনো রূপান্তর হয় না, ধুলোর শরীর নাকি ধুলোতেই ফিরে যায়, পর্বতপ্রমাণ ছায়া
এখানে-ওখানে পড়ে আছে দেখেও এ-কথা কেউ কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারে যে
আমাদের দেশে একদা লোকজনের বসবাস ছিল? ওরা ধ্বসস্তুপ থেকে বেরিয়ে-
আসা আমাদের আত্মীয়-পরিজন, যখন এবারের পঞ্চায়েত উপনির্বাচনের কথা ভাবছে,
তখন আমিই হঠাৎ বলে উঠি–যাই চাটুজ্জেদের বাড়ি নতুন বৌটির সঙ্গে দু-কথা কয়ে
আসিগে।


কহবতীর নাচ ৩ –- উৎপলকুমার বসু


দু-হাত শূন্যে তুলে কেঁদে উঠি, ‘প্রভু, ওটা আমাকেই দিতে হবে।’
লোকে প্রচণ্ড আমোদ পায়–বলে, ‘তোর আমড়াগাছির যেন শেষ নাই,
আবার দেখা তো দিকি ঐ খেলা’, আমি আবারো দেখাই
মাঝে-মধ্যে অতিরিক্ত কিছু হাঁপ জুড়ে দিই, যথা, ‘ এসেছিনু ভবে’
অথবা ‘নিঠুর’, এ-সব গৌণ গান তুমিও গাইতে পারো;
লোক হাসে–এর চেয়ে বড় কথা আর আছে নাকি?
দিনের প্রখর রৌদ্রে বনতলে পড়ে রয় অজস্র জোনাকি
মূক ও মৃত্যুমুখী, শরীরের নীল আলো জ্বলে কারো কারো।


কহবতীর নাচ ২ –- উৎপলকুমার বসু


যে তমসা নদীর তীরে আমি আজ বসে আছি তার বালুকণাগুলি আমাকে
জানাতে চাইছে আমি জল থেকে কতটা পৃথক–তার ঢেউগুলি আমাকে
বোঝাতে চাইছে আমি গাছ নই, আর গাছের আড়ালে ঐ ধাঙরবস্তির এক
মদ্যপানরত যুবক আমাকে বলতে চাইছে আমি পক্ষীরাজ, মেঘ থেকে নামলাম,
এইমাত্র, সাক্ষাৎ তারই চোখের সামনে–
হবেও-বা। তাহলে বর্ষার আঁধার সকালে আমি ডানা গুঁজে বসে থাকি। রোদ
উঠলে উড়ে যাব।


কহবতীর নাচ ১ –- উৎপলকুমার বসু


একাধিকবার এই সৈকতে এসে
বলেছি আমার মতো পুরুষকে তো কিছু
কলঙ্কের ভাগ তুমি দিতে পারো। হয়নি,
শোননি কেউ, শুধু বালিয়াড়ি ধসে
পড়েছে সাগরজলে।
স্তব্ধতা থেকে কোলাহলে
আবার যাত্রা শুরু, পাপ থেকে
পাপের স্খালনে। ঝাউবনে উড্ডীন
পতাকাবিদ্রোহ থেকে রঞ্জনরশ্মির অনলে–
চলেছি সকলে।
এই মদ কিভাবে করব পান–
বলে দাও। দাঁড়িয়ে জলের ধারে?
ছিঁড়ে-আনা এই ফুলগুলি
ঘুমন্ত খ্রিস্টগাছে ফুটেছিল–
কীভাবে ভাসবে তারা মাতৃসমা জলে?


উৎসর্গ -- উৎপলকুমার বসু


দয়িতা, তোমার প্রেম আমাদের সাক্ষ্য মানে নাকি?
সূর্য-ডোবা শেষ হল কেননা সূর্যের যাত্রা বহুদূর।
নক্ষত্র ফোটার আগে আমি একা মৃত্তিকার পরিত্যক্ত,বাকি
আঙুর, ফলের ঘ্রাণ, গম, যব, তরল মধু-র
রৌদ্রসমুজ্জল স্নান শেষ করি। এখন আকাশতলে সিন্ধুসমাজের
ভাঙা উতরোল স্বর শোনা যায় গুঞ্জনের মতো-
দয়িতা, তোমার প্রেম অন্ধকারে শুধু প্রবাসের
আরেক সমাজযাত্রা। আমাদেরই বাহুবল বিচূর্ণ, আহত
সেই সব সাক্ষ্যগুলি জেগে ওঠে। মনে হল
প্রতিশ্রুত দিন হতে ক্রমাগত, ধীরে ধীরে, গোধুলিনির্ভর
সূর্যের যাত্রার পথ। তবু কেন ষোলো
অথবা সতের-এই খেতের উৎসব শেষে, ফল হাতে, শস্যের বাজারে
আমাদের ডেকেছিলে সাক্ষ্য দিতে? তুমুল, সত্বর,
পরস্পরাহীন সাক্ষ্য সমাপন হতে হতে ক্রমান্বয়ে বাড়ে।


তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেটর বিভিন্ন সাইট কবির লেখা বিভিন্ন বই ও পত্র পত্রিকা। ( কবিতা ভালবাসুন, কবিতার বই কিনুন)