কবিতায় আমি এক অল্পবুদ্ধির মানুষ।তবু আজ পর্যন্ত বিভিন্ন বই পড়ে যা জেনেছি ও অনুভব করেছি আপনাদের সাথে শুধু তা ভাগাভাগি করার জন্যই এ লেখা। মন্তব্যে আপনাদের মতামত হয়তো আমাকে আরও অনেক অজানা বিষয়ের সন্ধান দেবে।


কবিতা শুধু মনের ভাবনা ছন্দে বা গদ্যছন্দে লেখার বিষয় নয়।এর বিষয়,প্রকরণ,উপাদান ও তাদের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ সম্পর্কে জানতে হয় বিস্তর।বুঝতে হয় আধুনিক কাব্যভাষার গতি,যুগ আপনার কাছে কি চাচ্ছে।কবিতা কোন পথে কতটুকু এগিয়েছে ইত্যাদি।এই উত্তরাধুনিক যুগে এসে সনাতন পদ্ধতিতে উৎকৃষ্ট কবিতা লিখেও আপনি একজন কার্টুন হয়ে যেতে পারেন।কবিতায় নতুনত্ব দিতে না পারলে সময় একদিন সব কবিকেই মুছে ফেলে।মাইকেল,রবীন্দ্র,নজরুল,জীবনানন্দ তাদের সময়ে তারা যে স্টাইলে লিখেছেন সেটা তাদের জন্য পারফেক্ট ছিল,সে পথে তারা ছন্দ ও ভাষায় নতুনত্বের সন্ধান করেছেন।এ যুগে এসে যদি কবিতায় কেউ মম,তব,তোমা,হিয়া,বংশী....প্রভৃতি শব্দে হুবুহু রবীন্দ্র,নজরুল স্টাইলে লিখেন তবে তা হাস্যকরই বটে।তবে যিনি পারদর্শী,কবিতার অগ্রগতি বিষয়ে যিনি খবর রাখেন তিনিই পারেন যেকোন শব্দকে ব্যবহারে নতুনত্ব দিতে।তিরিশের যুগে বাংলা কবিতায় যে বাঁক পরিবর্তন হয় তা একান্তভাবে এখন মানুষের  কথ্য ভাষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে।ধ্বনি সাম্য,ক্রিয়া পদের ব্যবহার,শব্দ সামঞ্জস্য ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা ছাড়া শুধু ভাবের উপর নির্ভর করে কবি হওয়া সম্ভব নয়।ভাব অনেকেরই আছে,যেটা নেই সেটা হল আলাদা কন্ঠস্বর।প্রতিটি ধ্বনির আলাদা আলাদা চিত্রকল্প আছে,প্রতিটি শব্দেরও তাই।কোন শব্দ মসৃণ,কোন শব্দ খসখসে,কোন শব্দ গোলাকার,কোনটি আবার আয়তকার।কোন শব্দের পাশে কোন শব্দকে ভাল মানায় তা একজন সচেতন শব্দ শ্রমিকই জানেন।রমরমা অট্টালিকায় রমরমা শব্দে যে ধ্বনি মাধুর্য আছে অন্য কোন শব্দ বিন্যাসে তা পাওয়া যাবে না।সুবিশাল অট্টালিক বললে তীব্রতার পারদ অনেকটা নিচে নেমে যায়।উচ্চকন্ঠ কবিতায় যুক্তাক্ষরের ব্যবহার বেশ উপকারি।দোযখ শব্দের চেয়ে জাহান্নাম শব্দের তীব্রতা কত বেশি তা সহজেই বুঝা যায়।কয়লা ও অঙ্গার শব্দ দুটিও ঠিক তেমনি।কি ধরনের কবিতা,তার ভাব কেমন..গীতল না উচ্চকন্ঠী ইত্যাদির উপর নির্ভর করে আপনি কোন শব্দ ব্যবহার করবেন।গম্ভীর বা গীতল কবিতা হলে সেখানে যুক্তাক্ষর এড়িয়ে চলুন।জসীম উদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ গীতল ভাবধারায় লিখেছেন বলে সেখানে ইচ্ছে করেই তিনি যুক্তাক্ষর এড়িয়ে গেছেন।অন্যদিকে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় আছে যুক্তাক্ষরের প্রাবল্য।এসব অসংলগ্ন মনের কাজ নয় বরং   সচেতন প্রয়াস।জীবনানন্দ কবিতার খাতায় প্রচুর কাটাকাটি করতেন।একটি শব্দকে বিভিন্নভাবে বসিয়ে বা তার প্রতিশব্দ দিয়ে তাকে বিভিন্নভাবে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতেন।


ট ধ্বনির যেমন আছে টনটন অভিঘাত,ল ধ্বনির তেমনি তারল্য,গ ধ্বনির গাম্ভীর্য আবার রোমান্টিক কবিতায় শিস ধ্বনির প্রয়োগে কবিতা পায় বিশেষ মাধুর্য।  কবিতা তাই শুধু আবেগের ক্রিয়াকলাপ নয় সেখানে দক্ষতা ও পরিশ্রমেরও মূল্য আছে।


গদ্যে লিখছেন ভাল কথা।তার আগে ছন্দে হাত পাকিয়ে নিন।আপনি যদি ছন্দই না জানেন তাহলে এই যে এত করে বলছেন ভাঙছি ভাঙছি... তাহলে আপনি ভাঙছেনটা কি?ছন্দ ব্যবহার না করে কবিতা সম্ভব তবে ছন্দ না জেনে কবি..সেটা কখনোই সম্ভব নয়।