জাগরণ


অন্যায় যাহা, অসাম্য যাহা আল্লার ধরণীতে –
হে চির-রণবীর মুসলিম! - হবে সব বিনাশিতে!
প্রোজ্জ্বল ঈমান-শিখায় দহিতে তামাম সে অবিচারে –
বেহেশত হতে বীর মুসলিম নামে যেন বারেবারে!
মুসলিমের এ ধর্ম রাখে সে এ বিশ্ব-চরাচর –
অন্যায়-অবিচারে সংহার করি’ চির-মনোহর।
বীরের জাতি সে ধর্ম হারিয়ে শৌর্য-বীর্য-হারা,
বিশ্ব জুড়িয়া মুসলিম নাই, - কাফেরে ভরা এ ধরা!


যুগে যুগে এল কত সে অত্যাচারী এই পৃথিবীতে,
কত মানুষের খুন শুষে ওঠে দানবোল্লাসে মেতে!
কত নিরীহের রক্তের হোলি খেলায় উঠিয়া মাতি’ –
কত জনপদে বইয়ে জালিম দিয়াছে রক্ত-নদী!
কেড়ে নিল কত প্রাণ ইতিহাসে - জালিম, নির্বিচারে,
খোদার আরশ কেঁপে কেঁপে ওঠে পীড়িতের হাহাকারে।
রক্ত-মাংস শুষে মজলুমে করে কঙ্কালসার,
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কত জনপদ করে দিল ছারখার।
সহসা ঊর্ধ্ব হতে গ্রাস করে খোদার আজাব এসে,
জালিম-শাহের তখত-প্রাসাদ গিয়াছে ধুলায় মিশে!
জুলুম করে যে মানুষে, খোদায় দেন তারে অবকাশ,
খোদার গজবে অবশেষে হয় ভীষণ সর্বনাশ!
যুগে যুগে জালিমেরা যেন নব নব রূপে আসে ফিরে,
শত নমরূদ-প্রেতাত্মা দাপিয়ে বেড়ায় বিশ্ব জুড়ে!
অসহায়া এই বিশ্ব বন্দী জালিমের নাগপাশে,
বিষাক্ত হয় ধরা আজ উহাদের বিষ-নিঃশ্বাসে।
পতন আসিবে জালিমের, কোথা হতে - কি জালিম জানে?
হয়ত যুগের ফিরাউন-প্রাসাদে মুসা বাড়ে দিনে দিনে!


                                       কথা কহে ইতিহাস –
জুলুম করিলে সে জুলুম এসে জালিমেরে করে গ্রাস!


                                   কালের অমোঘ বিধি –
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে নিরবধি!


এই কি সে মুসলিম নতশিরে সহে না ক’ অবিচার?
জুলুম-পীড়ন দেখিয়া হাঁকিত শের-সম হুঙ্কার?
দন্ত-নখরহীন বাঘ এরা, শৃগালের তাড়া খেয়ে –
লুকাইতে চাহে ইঁদুর-গর্তে, হাতে করে প্রাণ লয়ে।
যুগযুগান্ত পশুর মতন খেয়ে যায় এরা মার,
মুখ বুজে সয়ে জুলুম, করিছে অপমান মানবতার!
মৃত্যুর ভয়ে কাঁপে; বীরসম মরিতে তো নাহি পারে,
প্রাণ লয়ে ঢোকে গর্তে, ভীতুরা দিনে দশবার মরে।
একি সেই বীর মুজাহিদ? চির-সত্যের সেনাদল?
হুঙ্কারে যার পাপের পৃথিবী কাঁপিত রে টলমল?
মানবরূপী সে শয়তান হবে নাকি আজ পথরোধী?
হার মানিবে কি? ক্ষুদ্রে রুধিবে বৃহতের অগ্রগতি?
ধূর্ত সে জ্ঞানবৃদ্ধের দল বাধা হবে নাকি পথে?
ঠেলে ফেলে ছোটো বিপুল সম্ভাবনার ভবিষ্যতে!
ঊর্ধ্বে ছোটো রে! - দিক যত খুশি গালি, দিক যত বাধা,
মুখে এসে পড়ে ছুঁড়িলে ঊর্ধ্বে সূর্যের পানে কাদা!
বুদ্ধির জোরে মনিব কুকুরে করে তার আজ্ঞাবাহী,
বাঁধা রেখে বিবেক, কতকাল র’বে জালিমের পদলেহী?
আজ্ঞাবাহী সে সারমেয় সম চাটো জালিমের পদ,
মনুষ্যত্ব বিকিয়ে অত্যাচারীর বশংবদ।
খোদা প্রদত্ত ঈমানী শক্তি লয়ে ভাব বলহীন,
জুলুম সহিয়া, জালিমে সেবিয়া পশুসম লাজহীন!
জুলুম করে যে আর মুখ বুজে বসে যে জুলুমে সয়,
সম অপরাধী দু’জনে - ওদের শয়তান পরিচয়!


মিথ্যের পায়ে সত্যের শির লুটাতে পারে কি এসে?
সত্যের জয় অজর, অমর, অক্ষয় অবশেষে।
অসত্য কভু জয় পায় মাঝেমাঝে সে দৈববলে,
চির-অক্ষয় সত্য সে শেষে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলে!


পেয়ে কোরানের জ্ঞান, চেনে না ক’ দুশমন মানবতার,
তাহাদের গতি চিরদিন আঁধার মূর্খতা-কারাগার!
কোন লোভে, কোন মোহে তোমাদের রসাতল পানে গতি?
দুনিয়াবী মোহ হরেছে মুমিন-হৃদয়ের খোদা-জ্যোতি!
দুনিয়াবী মোহ টেনে লয়ে যায় জাহান্নামের পানে,
ক্ষমতা পাইলে স্বার্থান্বেষী, পূজা করে শয়তানে।
শক্তি-ক্ষমতা যদি পায়, হয় দুশমন মানবতার,
নির্যাতিতের খুন শুষে খায়, চুষে খায় এরা হাড়!
অর্থের জোর যত - সে-ই সমাজের তত বড় খোদা,
গরীবের লোহু যত চুষে বাড়ে, তত বাড়ে তার ক্ষুধা।
অর্থ-ক্ষমতা যার যত - সে-ই তত বড় শয়তান,
স্বার্থের তরে দানবের দল কাড়ে মানুষের প্রাণ!
মানুষের মনগড়া আইনের সমুখে যে হয় নত,
মনুষ্যত্বহীন, বোধজ্ঞান-হারা সে পশুর মত!
মানুষ মানুষে পূজিলে - চরম আত্ম-অসম্মান –
নিখিল মানবজাতির লজ্জা - মানবতার অপমান!
দাস হতে চাহে মানুষের যে বা - নহে! মুসলিম নহে!
ইসলাম তার বহিরাবরণ, হৃদয়ে কুফুরী বহে!


কোথা মুসলিম? - এক খোদা বিনে শির নত নাহি করে?
জালিমের গদি কাঁপায়ে তুলিবে হায়দরি হুঙ্কারে?
অত্যাচারীর প্রাসাদে প্রাসাদে কাঁপন তুলিত যারা?
ভীম তকবীরে গগন কাঁপাত? কাঁপাত পাপের ধরা?
স্বৈরাচারীর তখত-প্রাসাদ ধসিয়ে, দম্ভ নাশি’ –
হাসিতে হাসিতে প্রাণ দিয়া আনে পীড়িতের মুখে হাসি?
কোথা মুসলিম?  - অন্যায়ে ওঠে বারুদের সম জ্বলে?
প্রিয়তমা জ্ঞানে বক্ষে জড়ায়ে ধরে সে মৃত্যু এলে?
নিখিল উৎপীড়িতের কাঁদনে যার বুকে উঠে ব্যথা –
আঁখি-নিদ গেছে চিরতরে টুটে - সেই মুসলিম কোথা? –
পদাঘাত হেনে ভাঙে মানুষের গোলামীর জিঞ্জীর,
চির-উন্নত, আকাশ ছোঁয় রে যাহার সত্য-শির!
জালিম-রক্ত-আঁখির সমুখে হাসে ব্যঙ্গের হাসি,
প্রিয়ার হাতের মালা ভেবে পরে ফাঁসির মঞ্চে ফাঁসি!


দিকে দিকে আজ বেজে ওঠে পীড়িতের মুক্তির ভেরী,
বাহুবল ভেঙে মাটিতে মিশিবে নিখিল অত্যাচারী।
মানুষের অধিকার কাড়ে যারা - তারা শয়তানী চেলা,
আর বেশিদিন নাই, শেষ হয়ে আসিছে ওদের খেলা!
তখ্ত-ক্ষমতা-প্রাসাদ ভস্ম হবে ঈমানের তেজে,
পতন-ঘণ্টা জালিমের উঠিবে দিকে দিকে আজ বেজে!
বেহেশত হতে নামিবে শহিদ খোদার শক্তি লয়ে,
জালিমে বিনাশ করিতে আসিবে ঝঞ্ঝার বেগে ধেয়ে।
এরা দুর্জয়, এরা আল্লার চির-নির্ভীক বীর,
মেরে মেরে আজ ক্লান্ত এদেরে খড়্গ অত্যাচারীর!
বিপ্লব ওরা রুখে দেবে নাকি শত বিপ্লবী মেরে?
বিপ্লব তত গতি পায় - যত বিপ্লবী ওরা মারে!
বিপ্লবী তেজ জ্বলে তত বুকে যত সে আঘাত খায়,
বাতিলের আঘাতে প্রাণ নেভে, তবু ঈমান না নিভে যায়!
জুলুম-পীড়নে তত বিদ্রোহ করে যত খায় মার,
যত সে আঘাত খায়, তত হাঁকে শের-সম হুঙ্কার!
যত বিপ্লবী শহিদ হয় তত ওঠে যেন ভূমি ফুঁড়ে,
নির্জীব প্রাণে যুগে যুগে শহিদেরা তেজ সঞ্চারে!
‘দলিত মানবতা’ হতে জন্মে বিপ্লবী অবিরত,
ধ্বংসস্তূপ হতে বারেবারে - ফিনিক্স পাখির মত!
ফাঁসি-গুলি-জেল-জুলুম কি পারে বিপ্লব দিতে রুখে?
যুগে যুগে যত বিপ্লব এল - শহিদের খুন মেখে!
ভীম তকবীরে ফাঁসির মঞ্চ থরথর ওঠে কেঁপে,
ফাঁসির রশ্মি ক্লান্ত আজিকে বীরদের টুঁটি টিপে!


কুসুমকীর্ণ পথে পীড়িতের অধিকার নাহি আসে,
মুক্তি এসেছে পীড়িতের, খুনে রাঙা পথে, ইতিহাসে!
পীড়িতেরে ত্রাণ দিতে প্রাণ দিল কত শত বিপ্লবী,
বুকের রক্তে রেঙে যুগে যুগে ওঠে স্বাধীনতা রবি!


শির তোলে মজলুম, মুখ বুজে স’বে না অত্যাচার,
মুমূর্ষু মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে – “মার! মার!”
রক্ত-মাংস শুষেছে ওদের - দেহে বাকি শুধু হাড়,
কঙ্কাল লয়ে উঠে দাঁড়া - হাড়ে হবে রণ-তলোয়ার!
জালিমের খুন পিইতে পীড়িত মানিবে না কোনো বাধা,
পীড়িতের তরে জালিমের খুন যেন বেহেশতী সুধা!
বীর-বন্দীর হুঙ্কারে কাঁপে জালিমের কারাগার,
আদর্শ সমুখে শির নত করে জালিমের তরবার।
যুগযুগান্ত জুলুম সহিয়া বন্দীরা ভয়-হারা,
বজ্র-হস্তে কারার ভিত্তি দেয় ভীম বেগে নাড়া!
অসহায়া ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে জালিমের হুঙ্কারে,
নাহি কি রে কেহ খালিদের অসি হানে জালিমের শিরে?
মুসলিম সেই - নতশিরে কভু সহে না ক’ নিগ্রহ,
প্রাণভয় ভুলে জুলুম-পীড়নে করে বসে বিদ্রোহ!
পীড়িতের তরে প্রাণ দেয় হেসে মৃত্যুর ভয় ভুলি’,
প্রিয়ার মালার ফুল ভেবে বুক পেতে লয় গোলাগুলি!


যুগে যুগে যারা প্রাণ দান করি’ মজলুমে দেয় ত্রাণ,
চিরঞ্জীব ওরা! মৃত্যু এদের পায়ে এসে যাচে প্রাণ!


হক বাতিলের দ্বন্দ্ব বেঁধেছে - সত্যের জয় হবে,
রাজপথে নামে শত বিপ্লবী শহিদী মৃত্যু লোভে।
প্রাণ হাতে - হেসে মৃত্যুর সাথে খেলে প্রাণ বাজি রাখি’,
চোখ রাঙাইয়া এদেরে - ক্লান্ত জালিম-রক্ত-আঁখি!
অত্যাচারীর চাবুকের আঘাত - প্রিয়ার পরশ ভাবে,
পীড়িতের তরে যত মার খায়, তত ফুঁসে ওঠে ক্ষোভে!
মার খেয়ে পড়ে বারেবারে, তবু বারেবারে দাঁড়ায় উঠে,
বাতিলের আঘাতে শির ছুটে যায়, তবু নাহি পড়ে টুটে!
জলোচ্ছ্বাসের মত কভু ছুটে এসে - বন্ধন-হারা –
জালিমের গদি খড়কুটো সম ভাসাইয়া নেয় এরা!
জুলুমে পীড়িত ধরায় আনিবে মজলুমানের ঈদ,
ফিরদৌসের দরজা খুলিবে বিপ্লবী হয়ে শহিদ!
ক্রন্দন থেমে যাবে, থেমে যাবে তামাম অত্যাচার,
নিখিল আকাশ-বাতাসে ধ্বনিবে – “আল্লাহু আকবার!”


(শব্দার্থঃ জালিম শাহ – অত্যাচারী বাদশাহ বা শাসক, তখত- সিংহাসন, সারমেয়- কুকুর, ফিনিক্স পাখি- রূপকথায় বর্ণিত পাখিবিশেষ, যাকে ধ্বংস করা হলেও ধ্বংসস্তূপ থেকে বারেবারে জন্ম নেয়)


(টীকাঃ


*) নমরূদঃ পৃথিবীর ইতিহাসে আল্লাহর সঙ্গে প্রথম ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী ও নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি  চরম অত্যাচারী  হিসেবে পরিচিত ছিল নমরূদ। আল্লাহকে শেষ করার জন্য আসমান অভিমুখে টাওয়ার নির্মাণ এবং নিজেকে প্রভু দাবী করার দুঃসাহস দেখিয়েছে এই জালিম। দীর্ঘ চারশ বছরের শাসনামলে সে পৃথিবীতে চরম পর্যায়ের ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল। অবশেষে আল্লাহ তা'লা  শাস্তিস্বরূপ একটি মশা তার নাকে প্রবেশ করান। মশার অসহ্যকর জ্বালাযন্ত্রণা থেকে নিজেকে  বাঁচাতে মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত পর্যন্ত করে। কিন্তু এতেও তার শেষ রক্ষা হয়নি। বরং  জ্বালাযন্ত্রণা আরো বেড়েছে। শেষমেশ এই হাতুড়ির আঘাতে মাথা ফেটে মৃত্যু ঘটে এই অত্যাচারী বাদশার।


*) ফেরাউনঃ মিশরের অত্যাচারী বাদশাহ ফেরাউন একবার স্বপ্নে দেখল যে তার রাজ্যে এমন এক ছেলে শিশু জন্মাবে, যে কিনা ফিরাউনের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তৎক্ষণাৎ সে হুকুম জারি করল যে, তার রাজ্যে যত ছেলে শিশু জন্মাবে তাদের সবাইকে যেন হত্যা করা হয়। অতঃপর শুরু হয়ে গেল তার রাজ্যে নির্মম শিশু হত্যাযজ্ঞ।
ঠিক এই সময়ে মিশরে জন্ম নেয় হযরত মুসা (আ)। ফেরাউনের ভয়ে মুসা (আ)-এর মা মুসাকে কাঠের সিন্দুকে বন্দী করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়।


পরবর্তীতে সেই সিন্দুক ভাসতে ভাসতে ফেরাউনের প্রাসাদ সংলগ্ন নদীর পাড়ে গিয়ে থামে। সিন্দুক খুলে ফেরাউনের সৈন্যরা দেখতে পায় ছেলে শিশু মুসাকে। এ-কথা তারা ফেরাউনকে জানালে ফেরাউন তক্ষুনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাধ সাধল ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া। সে ফেরাউনকে নিষ্ঠুর, নির্মম, পাষণ্ড ইত্যাদি বলে তিরস্কার করায় ফেরাউন মুসাকে হত্যা করার নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেয়। আর আছিয়া মুসা (আ)-কে মাতৃস্নেহ দিয়ে লালন-পালন করতে লাগল। আল্লাহর অসীম কুদরতে ফেরাউনের ভবিষ্যৎ-পতনের কারণ ফেরাউনের প্রাসাদেই লালিত-পালিত হতে লাগল)