ও অদৃশ্যতা হে অনিশ্চিতি
লেখক: মেঘ অদিতি
প্রথম প্রকাশ: ২১শে বই মেলা-২০১৪
প্রকাশক: সাম্প্রতিক প্রকাশনী।
প্রচ্ছদ: মেঘ অদিতি
মুল্য: ১৩০ টাকা মাত্র।


==================================


ও অদৃশ্যতা হে অনিশ্চিতি কাব্য গ্রন্থে কবিতা সংখ্যা পঞ্চান্ন। এ যেন একটা শব্দ সাগরে কথাভ্রমন। কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি পাতায় শব্দের নবোদয় দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে প্রতিটি কবিতা। মেঘ অদিতি বর্তমান সময়ের প্রগতিশীলমনা কবি। তার লিখিত শব্দরুপে নির্মিত এটি ২য় কাব্যগ্রন্থ।
হাজারো কবিতার মাঝে, শব্দচয়ন, বাক্য কল্পনা বা কবিতা ভাবনা দেখেই আলাদা করা যায় মেঘ অদিতির সৃষ্টি করা কবিতা গুলো। তার কাব্য নির্মানে, সমকালীন ছাপ মৃদুভাষী এবং নাগরিক জীবন ভাব সুস্পষ্ট আর নিজস্বতায় পরিপূর্ন। যে কারনে কবিতাগুলো হয়ে উঠে জীবন ও নাগরিক দর্শনের দৈনন্দিন ছাপচিত্র। পাঠকালীন সময়ে কবিতার পাঠোদ্ধারে বেরিয়ে আসে কাব্যগুণের ইচ্ছে প্রজাপ্রতির রুপরেখা-


আমি কাউকে ছুঁতে পারিনা...
ইশারা-মাত্র অভিমান খুলে যায় জেনেও
মিলিয়ে গেল এক স্ফুলিঙ্গ...
সেই থেকে ভাষা ভুলে বসে আছি অন্ধকারে
-কনফেশন।


কবির লিখিত বাক্যগুলো কবিতার পাতা থেকে জীবনের অনুষঙ্গে আয়নার মতো বন্ধু হয়ে যায়। মিশে যায় হাসি আর অনুতাপে। এভাবেই ছড়িয়ে যায় অনুরক্ত শব্দগুলো। কখনোবা ঘুমের নদীতে ফুলের গন্ধের বদলে ভয় নিয়ে জন্মের শুরু হয়। আবার কখনো কবি কবিতায় প্রশ্ন করে, চেতনার কোন স্তরে ভালোবাসা নিজেকে চেনায়? কাব্য গ্রন্থের আলোচাঁদ শিরোনামের কবিতায় ভেসে আসে তেমনি অবাক করা শব্দমালা যেখানে দেখতে পাই-


তোকে বলিনি, মলাট খুলে নিলে
সেখানে কখনও আর কবিতা থাকে না
-আলোচাঁদ


তোমার কারুকাজ আলোগোছ চোখ
গভীরে জানি স্থিত তার পরবাস ঘুম
অথচ কিছুতেই ছুঁতে পারি না অনন্তের সে জলভার
ছুঁতে গেলেই বর্ণবিদ্বেষ, ছুঁতে গেলেই অজস্র ভাঙন
-মেঘভাসানের আড়ালে


কবিতায় আরও দেখতে পাই, ইচ্ছের বিষণ্নতা, অপেক্ষার চিরকুট, মুঠোভর্তি আবেগ আর ওমপাখি। এক বিস্ময় ঘোরে, এক একাকিত্বে চন্দ্রালোকে বিষাদগ্রস্ত ভাবে তিনি লিখেছেন-


জ্বর এলে ভাবি কেউ আছে
যে এসে নির্জনে শোনাবে এস্রাজ
জ্বর সেরে গেলে পৌরাণিক গানে
সান্ধ্য-ভ্রমনে ভেসে যাব তার সাথে...
-ওমপাখি


কথা নয়, সংকেত রেখেছ দরজায়, দরজা আটপৌরে, দরজা সাংকেতিক, যেভাবে নতুন পথ ভাষা বদলে চলে তোমার চোখের ভাষা সেভাবে বদলায়। ভেঙ্গে যায় সম্পর্কের দেয়াল, কর্পূরের মতো কথা যখন উড়ে যায় ভুলের রংমাতালে। আবেগী চোখে সুললিত গান মনে হয় বিরহের সুর কে। ইচ্ছে গুলো যেন হাওয়াই মিঠাই ফুরিয়ে আসে বাতাসে। স্রোতের তপ্তরোদে নতজানু মন ব্যার্থ প্রজাপ্রতি রং নক্ষত্রে নক্ষত্রে ছুঁইয়ে অপলক দাড়িয়ে থাকা হয়। এমনি ভাবাবেগে কবি লিখেছেন শব্দশকট যতো। আঘাতের সমুদ্রে সুরের যাত্রায় আশার প্রদীপ নিভু নিভু। স্মৃতিতে ব্যাক্তিগত কথামালার বাকযুদ্ধ। বিষাদ যেন কবির মস্তিষ্ক থেকে কলমের ডগায় আর সেই রঙতালেই হয়তো কলম থেকে বেড়িয়ে এসেছে-


নিভে গেল সম্ভবনার রোদ
প্রহারের মুখে পা ফেলেছি যত-
উঠে আসছে বেহালার সুর
রঙিন জামা, পুরোনো অভিধান।
-রুদ্রাক্ষের পাখি


এমনটাই হয়। প্রতিবারই ছায়া থেকে ছায়ায় এভাবেই ভেসে বেড়ায়। প্রতিবার মেলে ধরা ছায়ায় জন্ম নেয় বাদাম পালকের মায়া। আমাকে ফিরে ফিরে দেখে দু’একটি মুখ। ছায়ারুপ থেকে ছায়া কথায় কবি তার আর্মেনিয়ান আয়নায় বলে গেছেন এভাবেই।
এই কাব্যগ্রন্থে লিপিবদ্ধ কবিতাগুলোয় শব্দ সম্ভারে শব্দ প্রয়োগের যে দক্ষতা তিনি দেখিয়েছেন তাতে কবিতা প্রেমীদের তিয়াসের মিটিয়ে দেবে বলে আশা করি। আবেগী কবি প্রেমীদের জন্যও বেশ কনকনে অনুভূতি জাগানো শব্দযাত্রার আয়োজন রয়েছে নিঃসন্দেহ অভূতপূর্ব। নিচের কবিতায় চোখ রাখলেই তার খানিকটা পরিষ্কার হয়ে যায়।


তুমি-আমি দু’জনেই
নামকরণ থেকে সরছি-
বলব না কেউ আর
ভালোবাসি
ব্যবহৃত ভাষা উড়াল-রুমাল
ছেড়ে গেছে? যাক!
কখনো ডেকো না।
-নামকরণ


কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ কবিতাটির নাম, ধীরে শ্রমণা। যে কবিতার শব্দ মায়াজাল কিছুটা আছন্ন করে রাখে। কবিতার প্রতিটি চরণ বলে যায়-
সেইসব দিনে আমাদের জন্য মহাজাগতিক উষ্ণতা আনতে গিয়ে
রাত্রিজোনাকগুলো ছোট হতে হতে একদিন হারিয়ে গেল...
সেই থেকে আমরা যে যার নাভি মূলে হাত রেখে অপেক্ষায় বুনছি দিন, চাইছি নির্বান।


কবি মেঘ অদিতির কাব্যগ্রন্থটি কবিতা প্রেমীদের ভাবনায় আলোড়ণ তুলতে সক্ষম। কাব্যকথার শিহরণে কেউ কেউ ভালোবেসে ফেলতে পারে এই কবিতার কাব্যতরীটিকে।