পুরাতন দৃশ্য


তখনও ফিরিনি নিজ ঘরে, একচিলতে ছিঁটে বেড়ার ঘর
পরের জমিন, নিজের মুল্লুক হতে অনেক দূর, শরণার্থী;
মাথার উপর দিয়ে শেলিং চলে রাতভর, দূর লক্ষ্যে
পাকি খান সেনাদের মাউন্টেন ব্রিগেডের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে
বাবা ব্যস্ত ত্রিমোহনীতে, মিত্র বাহিনীকে সহায়তা দেয়ায়
তাঁর দু’চোখে নতুন স্বপ্নের ডাক, যুদ্ধে জিতলেই স্বাধীন স্বদেশ।


যেদিন পাকিসেনাদের সারেন্ডার হলো রেসকোর্সে
লাখে লাখে পাখি যেন নেচে উঠেছিল খেয়ার ডাঙ্গায় অথবা মামুদপুরে
সেদিন কত বিহারী পুরুষ যে শাড়ী পরে পালিয়েছিল
সৈয়দপুরে নয়তো সাথিয়া,
সেদিন দেখেছি যুদ্ধে শহীদ মুক্তিসেনার বাবা-মায়ের
বুকের আহাজারি, শুনেছি তাদের আকাশ-বাতাস মথিত
কান্নার রোল, দেখেছি বিজয়ের আনন্দের কান্না, আনন্দাশ্রু।  


এবার ফেরার স্রোতে মানুষ।
ট্রেনে-বাসে-গরু-মোষের গাড়ীতে, অধিকাংশই পায়ে হেঁটে।


গ্রামে ফিরে পোড়া ঘর, গরু-ছাগল শূন্য গোয়াল
যেখানে একসময় ছেলেরা ডাংগুলি খেলত, সেখানে দেখেছি
সেনা বাঙ্কার, পরিত্যক্ত শাড়ী, ভাঙ্গা চুড়ি, শায়া আর
ভাঙ্গা মাটির হাঁড়ি, পচে যাওয়া ভাত-রুটি-হাড়, ছড়ানো ছিটানো।
পরিত্যক্ত মাইন-হেলমেট, পোড়া, দুমড়ানো-মোচড়ানো গাড়ী
খানা-খন্দক ভরা রাস্তাঘাট, যুদ্ধের তিলক কাটা বাংলাদেশ।


হাট বসে হাটবারে, আছে শালপাতায় মোড়া বিড়ি আর হুক্কোর ডাঁট,
নুন আর কেরোসিন ছাড়া বিকি-কিনির আর কিছু নেই;
সন্ধ্যার পর কুপির নিস্তেজ আলোয় অন্ধকার-তাড়িত
ঘুটঘুটে রাত আর নিরন্তর হুক্কাহুয়া।


বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেছেন, নতুন স্বপ্ন ডানা মেলছে,
গাছে প্রচুর পাখি, ধনেশ, বাদুর, শালিক, বক
বটগাছ ছেয়ে থাকে সাদা পালক, বটতলা নেয়ে ওঠে
বকের বিষ্ঠা আর অর্ধভুক্ত বটফল, তার তলে বাঁশের মাচান।
গ্রামের বয়েসী মানুষরা আড্ডায় মেতে ওঠেন।


এর ফাঁকে হঠাৎ দিকে দিকে নতুন অঘোষিত যুদ্ধের হানা
মানুষ হত্যা শুরু হয়েছে, কে যেন কাকে মারছে
প্রতিদিন লাশ পড়ছে, কেউ কেউ বলছেন রক্তপায়ী হায়েনা।
ভোটের আগমনী সুর, সাথে নকশাল বা সর্বহারার আনাগোনা
হঠাৎ উধাও রাজাকার আলবদর বাহিনী,
দেখি সমাজতান্ত্রিক দল-উপদল-শাখা দলের ডানা-পাখনা।


তবুও বুড়ো দীঘির কাকচক্ষু জলে ফোটে রক্তপদ্ম,
দীঘির পাড়ে তালের দীঘল বৃক্ষ, পাকা কালো লাল তাল
দীঘির অারেক পাড়ে মাটির দেয়াল দেয়াল ঘরে চালা নেই
ধ্বসে পড়েছে জানালার কাছে, এমন হাল।


দৃশ্য এখন


খেলার মাঠ ঢেকে গেছে ঈদগাহ্‌ আর মাদ্রাসায়
বট গাছ চিহ্ন-নিশানা হারিয়েছে, সেখানে এখন পাকা সড়ক
চলে গেছে দ্রুত বর্ধিষ্ণু গ্রোথ সেন্টারের দিকে,
পাখির কল-কাকলি হারিয়েছে হিউম্যান হলার আর ভটভটির শব্দে।


নতুন পাকা স্কুল ঘরে ছাত্র যতটা তার চেয়ে বেশি
বেঞ্চ,
ওড়ে বিবর্ণ সবুজ আর বিকৃত লালের জাতীয় পতাকা
জাতীয় সঙ্গীত শুনিনা, তবে পাড়ার তিন রাস্তার মোড়ে
শুনি চিকনি কানাইয়া----
গ্রাম থেকে হুক্কার গুড়গুড়ানি বা পাতার বিড়ি নিখোঁজ
নাগরিক জীবনে হুক্কা এখন সীসায় ভরা আর
তামাক পাতা স্থান নিয়েছে বহুজাতিক বেনসন হেজেজ বা
জন প্লেয়ারের সাদা ফিনফিনে কাগজ আর ফিল্টারের সাথে
দীঘির জলে এখন মাছের চাষ, গা ভেজাবার জো নেই।


ধনেশ বক বা তাল তমাল এখন চিড়িয়াখানা বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে
বেশ মানিয়েছে, ঘুম ভাঙ্গে ।কাকের ডাকে-
ঘুমাতে যাই মধ্যরাতে।
অন্ধকার হারিয়ে দেশ ভাসছে আলোয়
মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযদ্ধের চেতনা হারিয়ে খাঁটি ঈমানী জোস।


মানবতা হারিয়ে দেশ পেয়েছি, বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বাংলা
শাড়ী লুঙ্গী হারিয়ে অারবের জোব্বা-হিজাব, কুমড়ো হারিয়ে মোরব্বা।
কত কী-ই তো পেলাম, কতটা হারিয়ে
নিজেকে পিছিয়ে এগোই নিজেকে ছাড়িয়ে।


১০ জানুয়ারি ২০১৭/মঙ্গলবার/২৭ পৌষ ১৪২৩/ঢাকা।