**বনলতা সেনঃ একটি কবিতা এবং অনেক কিছু**


বনলতা সেন একটি কবিতার নাম একটি কাব্যগ্রন্থের নাম এবং কবির সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার নাম। কবির কবিতার দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ও সমালোচনার ভীড়ে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত এবং সারল্যে, জীবন ঘনিষ্ঠতায় এবং প্রেমে পরিপূর্ণ রহস্যঘেরা কবিতা। কবিতাটি প্রথম প্রকাশ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকায়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘কবিতা’র পৌষ, ১৩৪২ সংখ্যার মাধ্যমে বনলতা সেন সর্বপ্রথম পাঠকের হাতে এসে পৌঁছায়। কবিতাটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় কাবর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ এ ।বাংলা ১৩৪৯, ইংরেজি ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে প্রকাশিত তাঁর কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করেন।  এ কাব্য গ্রন্থটি কবি প্রথমে নিজে প্রকাশ করেছিলেন ১৯৪২ সালে। তখন এটি ছিল একটি কাব্য পুস্তিকা, মাত্র ষোল পৃষ্ঠার ১২টি কবিতার সংকলন পেপারব্যাক গ্রন্থ। এটি প্রকাশনা সংস্থা কবিতাভবন এর ‘‘এক পয়সার একটি’গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত ছিল। কবিতা গ্রন্থের প্রচ্ছদ তৈরী করেছিলে শম্ভু সাহা।কবির জীবিতকালে বাংলা শ্রাবণ, ১৩৫৯, ইংরেজি ১৯৫২ সালে কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে বনলতা সেনের সর্বশেষ সংস্করণটি বের হয়। ৪৯ পৃষ্ঠার বর্ধিত কলেবরে প্রকাশিত সংস্করণে আগের ১২টি কবিতার সাথে আরও ১৮টি কবিতা যোগ করে মোট ৩০টি কবিতা প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায় ও মুল্য ছিল ২ টাকা। প্রকাশক ছিলেন দিলীপকুমার গুপ্ত।পরবর্তীতে মে, ১৯৫৪ এ প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটিতে ও ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত আধুনিক বাঙলা কবিতা শীর্ষক গ্রন্থেও কবিতাটি সংকলিত হয়।কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারেও পাণ্ডুলিপিসমূহের ১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দ চিহ্নিত ৮ নং খাতায় এ কবিতাটি আছে। তাই, পাণ্ডুলিপির হিসেবে, ১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দে কবিতাটি লিখিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়।কবিতাটি প্রকাশের সময় কলকাতার সিটি কলেজে টিউটরের চাকুরী হারিয়ে বেকার জীবনানন্দ সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায়  দিনাতিপাত করছিলেন। এ ঘটনার মাত্র কয়েক বৎসর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিল।স্ত্রীর সাথেও বনিবনা হচ্ছিল না।


‘‘বনলতা সেন’’ কবিতাটি একবারে রচিত হয়নি। এর একটি খসড়ার সন্ধান পাওয়া যায়। খসড়া না বলে কবিতার পূর্বাংশ বলা যেতে পারে, নাম: ‘‘শেষ হলো জীবনের সব লেন দেন’’


শেষ হলো জীবনের সব লেন দেন
     বনলতা সেন।
কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙ্গা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন
তুমি নাই বনলতা সেন।


তোমার মতন কেউ ছিল কি কোথাও?
কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও
    কেন যে সবের আগে তুমি
    পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি
    (কেন যে সবার আগে তুমি)
ছিড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন
    কবেকার বনলতা সেন।
কত যে সন্ধ্যা আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে
    কতো যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে
    কতো যে চমকে উঠবো বাতাসে
হিজল জামের বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রের ট্রেন
    নিশুতির বনলতা সেন


উল্লেখ্য, এখানে বনলতা সেন কিন্তু অন্য, তার অস্তিত্ত্ব শহরে, সম্ভবতঃ কলকাতা শহরে, যেখানে বস্তির সন্ধান মেলে।এ বনলতা সেন কিন্তু নিশুতির, তাকে পাওয়া যায়নি দুপুরে, সে হারিয়ে গেছে অথবা চলে গেছে দূর নক্ষত্রে লোকে। কবি তাকে কল্পনায় খুঁজছেন, স্বপ্নোত্থিত হয়েও।


আরেকটি কবিতা পাওয়া যায় যেখানেও বনলতাকে চিত্রিত করা হয়েছে। এভাবেঃ


আমরা মৃত্যুর আগে জেগে উঠে দেখি
      চারিদিকে ছায়া ভরা ভীড়
      কুলোর বাতাসে উড়ে খুদের মতন
পেয়ে যায়----পেয়ে যায়----অনু-পরমাণুর শরীর


একটি কি দুটো মুখ---তাদের ভিতরে
যদিও দেখিনি আমি কোনদিন---তবু বাতাসে ভাসে
প্রথম গার্গীর মতো----জানকীর মতো হয়ে ক্রমে
অবশেষে বনলতা সেন হয়ে আসে।


এখানেও বনলতা সেন আছে, কিন্তু নেই; আছে উধাও বনলতা। নেই কবি নিজেও, শোনা কথার উপর ভর করে প্রতীতি জন্মে। নিচের কবিতা বা কবিতাংশেও কিন্তু আমরা বনলতাকে পাই-


বনলতা সেন, তুমি যখন নদীর ঘাটে স্নান করে ফিরে এলে
মাথার উপরে জ্বলন্ত সূর্য তোমার,
অসংখ্য চিল, বেগুনের ফুলের মত রঙিন আকাশের পর আকাশ
তখন খেকেই বুঝেছি আমরা মরি না কোনদিন
কোনো প্রেম কোন স্বপ্ন কোনদিন মৃত হয় না
আমরা পথ থেকে পথে চলি শুধু---ধূসর বছর থেকে ধূসর বছরে---
আমরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি শুধু, মুখোমুখি দাঁড়াই:
তুমি আর আমি
কখনওবা বেবিলনের সিংহের মূর্তির কাছে
কখনও বা পিরামিডের নিস্তব্ধতায়
কাঁপে তোমার মাদকতাময় মিশরীয় কলসী
নীল জলের গহন রহস্যে ভয়াবহ
মাথার উপর সকালের জ্বলন্ত সূর্য তোমার, অসংখ্য চিল,
বেগুনফুলের মত রঙিন আকাশের পর আকাশ।


এখানে বনলতাকে কবি গ্রাম্য নারী হিসেবে তুলে ধরেছেন, যে কি না নদীতে স্নান করে, সে নদী কীর্তিনাশা হতে পারে, সে নারী গৃহবন্দী নয়, গ্রাম্য সরলা। এখানেও তিনি বনলতাকে নৈব্যক্তিক করে তুলেছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন, হাজার বছরের বিভিন্ন সভ্যতার প্রাণের ভিতরে লুক্কায়িত কোন কোন প্রেমময় ঘটনাকে সাধারণীকরণ করে, এভাবে ‘‘তখন খেকেই বুঝেছি আমরা মরি না কোনদিন/কোনো প্রেম কোন স্বপ্ন কোনদিন মৃত হয় না’’। এটাই কবি জীবনানন্দ দাশের চিরকালীন বনলতা। এ বনলতা ছিল, সপ্রাণ, তার ছিল দেহসৌষ্ঠব, কামনাময় চোখ, ভালবাসাতুর হৃদয়, কিন্তু তার সঠিক অবস্থান নেই, পাত্রস্থ হবার সংবাদ নেই, কোথাও।


কিন্তু এখানেই শেষ নয় বনলতা কবির অন্তর্জাত একটি নিজস্ব প্রেমের প্রতীক, কোন পাহাড়ের গুপ্ত স্রোতস্বিনী ঝরণাধারা, যেখান থেকে প্রেরণার  অবিরল ধারায় ঝরতে থাকে প্রেম—শৈশবের প্রথম দর্শন, কামনা, অপ্রাপ্তি, অব্যক্ত খেদ, তারপর দীর্ঘ বেদনা, থিতায়িত হয় বুকের কলসে, খাদটুকু-গাদটুকু তলানীতে জমে উপরে থেকে যায় নিটোল প্রেমের দ্যোতনা, শেষে সেটা কালক্রমে হয়ে যায় প্রেমের ফল্গু ধারা। একে আরো বিশুদ্ধ করে তোলে কবির শিল্পীত ভাস্কর্য গড়ার হাত। এতে তিনি পুনঃপ্রাণ সঞ্চার করেন, অমর করেন, অক্ষয় করেন। কিন্তু একটি বারও সেই বনলতাকে সামাজিক পবিত্রতার ধারণায় পবিত্র বলে যে চিত্ররূপ অঙ্কন করা হয়, তার প্রতিমূর্তি হিসেবে গড়ে তোলেন নি। তাই আমরা বনলতাকে পাই এভাবে—


ক। তোমার মতন কেউ কি ছিল কোথাও?...... কেন যে সবার আগে তুমি চলে যাও.....পৃথিবীকে শূন্য মরুভূমি করে, কুহকের ঝিলমিল টানা-পোড়েনকে ছিন্ন করে..... (রাত্রি) নিশুতির বনলতা সেন।
খ। প্রথম গার্গীর মতো,জানকীর মতো, (যা ক্রমে হয়ে ওঠে) অবশেষে বনলতা সেন।
গ। কাঁপে তোমার মাদকতাময় মিশরীয় কলসী (নারীর শরীরের জলভরা কল্পরূপ) /নীল জলের গহন রহস্যে ভয়াবহ....অসংখ্য চিল (ছোঁ মেরে তুলে নিতে চায় শূন্যে বা ভোগের জন্য নিজের অধিকারে)—(পবিত্রতম নারী কিন্তু নয়)


এরপরই আসে কবির সুবিন্যস্ত পূর্ণাঙ্গ কবিতা ‘‘বনলতা সেন’’ উপরের ভাঙ্গা ভাঙ্গা অস্থানিক পৃথিবীময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বনলতাদের একসূত্রে বেঁধে তুলে এনেছেন সামনে, স্থাপন করেছেন ইতিহাসের কোন এক গুরুত্ত্বপূর্ণ স্থানে, যেখানে নিজেকে ধরা দিয়েও দিচ্ছেন না কবি, আবার তাকে ছাড়াও তাঁর চলছে না, যেন দায়িত্বহীন এক পুরুষ বা অপুরুষ। দেখা যাচ্ছে বনলতা বা কবির নিজেরও নিজস্ব কর্মক্ষেত্র বা স্থায়ী ঠিকানা নেই। পরিভ্রমণের কোন এক সময় পরস্পরের মুখোমুখী হন, প্রবল আবেগ কাজ করে, আবার এক ধরণের নির্লিপ্ততাও কাজ করে। তবু সস্থির জন্য তার কাছেই ফিরে আসেন, সাঁঝের অন্ধকারে, নিভু নিভু অস্পষ্ট আলোয়।


(পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পযন্ত ঘুরে শেষে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে, ফিরে আসেন তার জীবন ও কর্মের শেষে অথবা বিশেষ বিশেষ সময়ে কবি হাজির হন তার কুটিরে)
........................
........................
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমাকে দু’দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
........................
........................
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখীর নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
........................
........................
সব পাখি ঘরে আসে---সব নদী---ফুরায় এ-জীবনের লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।।


এছাড়া প্রায় একই ধরণের স্তবক সম্বলিত আরো একটি কবিতার সন্ধান পাওয়া যায় যাতে বনলতাকে চিত্রিত করা হয়েছে। একই কবিতা গ্রন্থে ‘‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’’ কবিতায়ও বর্ণনা করা হয়েছে বনলতাকে। এই কবিতারই যেন শেষ স্তবকঃ


শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের ---ঘুচে গেছে জীবনের সব লেন দেন;
‘মনে আছে?’ শুধালো সে---শুধালাম আমি শুধু ‘বনলতা সেন?’


এখানে কবি যেন আবার বেরিয়েছিলেন, কিন্তু আর যাওয়া হয়নি তার বনলতার কাছে, নাটোরে; বরং কোন এক বিশেষ সময়ে তাদের ফের দেখা হয়, যখন ক্লান্ত কবির...শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ.. আমাদের--


ঘ। (কবির....) শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের ---(কবি এখানে পৃথিবীর সকল ভালবাসাতুর, কিন্তু একচ্ছত্রভাবে সংলগ্ন নন যে নারীর সঙ্গে এমন পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করে বলছেন) ঘুচে গেছে জীবনের সব লেন দেন (যখন শারীরিক চাওয়া-পাওয়া একটা পর্যায়ে এসে স্তিমিত হয়, এমন সময়); ‘মনে আছে?’ শুধালো সে---শুধালাম আমি শুধু ‘বনলতা সেন?’(এবার কিন্তু জীবনের এ পর্বে কবির সঙ্গে বনলতা সেনের আবার দেখা হলো এবং কথোপকথন হচ্ছে। এটা যেন বনলতা সেন এর সঙ্গে তাঁর ঘুমের ঘোরে কথা হচ্ছে বা হেলুসিনেশন হচ্ছে, আবেগ কিছুটা কম, যদিও বনলতা কিন্তু সপ্রাণ জিজ্ঞেস করছে)।


এজন্য সুকুমার সেন তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস এর ৪র্থ খন্ডে বনলতাকে একবাক্যে বলেছেন ‘‘যুগ যুগান্তরের পথচারীর শান্তি ক্লান্তি ক্ষুধা তৃষ্ণা বিনোদনের নীড় বিধায়িনী’’।


কিন্তু এ নারীর সামাজিক অবস্থান কিন্তু কবিতায় স্পষ্টিত হয় না।


আরশাদ ইমাম//অপর জীবন
১২ নভেম্বর ২০১৫; বৃহস্পতিবার//ঢাকা।