** কর্ম জীবন, সাহিত্য, কবিতা, কাব্যগ্রন্থ ও বনলতা সেন (সূচনা)**


কবি জীবনানন্দের কর্ম জীবন শুরু হয় ১৯২২ সালে। কিন্তু তাঁর সহিত্য জীবন শুরু হয় তারও আগে। ১৯১৯ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘বর্ষা আবাহন’ তাঁর পিতা সদানন্দ দাশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দের সাহিত্যিক জীবন বিকশিত হতে শুরু করে ১৯২৫ সালের দিকে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তার স্মরণে ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ নামে একটি কবিতা রচনা করেন, যা ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পরবর্তীতে তার প্রথম কাব্য সংকলন ‘ঝরা পালক’ এ স্থান পায়। সে কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাস রায় মন্তব্য করেছিলেন যে, কবিতাটি নিশ্চয়ই কোন প্রতিষ্ঠিত কবি ছদ্মনামে রচনা করেছেন। ১৯২৫ সালেই তার প্রথম প্রবন্ধ ‘স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে’ প্রবন্ধটি ‘ব্রাহ্মবাদী’ শীর্ষক পত্রিকায় পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ঐ একই বছরে ‘কল্লোল’ পত্রিকায় কবিলিখিত ‘নীলিমা’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে তা অনেক তরুণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর ধীরে ধীরে কবির কবিতা কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। এ পত্রিকাসমূহের মধ্যে রয়েছে সে সময়কার বিখ্যাত পত্রিকা ‘কল্লোল’, ‘কালি ও কলম’, ‘প্রগতি’ প্রভৃতি।


কবি প্রথম দিকে তাঁর লেখা (প্রবন্ধ বা আলোচনাসমূহ) নিজ নাম জীবনানন্দ দাশগুপ্ত সিগনেচারে প্রকাশ করতেন। পরে তিনি নাম দেশে ‘গুপ্ত’ বাদ দিয়ে কেবল ‘দাশ’ লেখা শুরু করেন। ১৯২৭ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ ‘দাশগুপ্ত’ এর বদলে ফেলে কেবল ‘দাশ’ উপাধীতেই লিখতে শুরু করেন।


প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কয়েক মাসের মাথায় কবি সিটি কলেজে তার চাকরিটি হারান। ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে কলেজটিতে ছাত্র অসন্তোষ দেখা দিলে কলেজে ছাত্রভর্তির হার আশঙ্কাজনকহারে হ্রাস পায়। জীবনানন্দ ছিলেন কলেজটির শিক্ষকদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। অর্থনৈতিক অসুবিধার পড়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকেই চাকরিচ্যুত করে। অন্যদিকে কলকাতার সাহিত্যিক সমাজেও সে সময় তার কবিতা কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হয়। সে সময়কার প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক সজনীকান্ত দাশ ‘‘শনিবারের চিঠি’’ পত্রিকায় তার রচনার নির্দয় সমালোচনায় মত্ত হয়ে ওঠেন।


কলকাতায় তখন কবির করার মত কোন কাজ ছিল না। ফলে তিনি অনেকটা বাধ্য হয়ে ছোট্ট শহর বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে তিন মাস পর তিনি আবার কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েন। জীবনধারণের জন্যে টিউশনি শুরু করেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরির সন্ধান করছিলেন। এর ফলে দিল্লীর ‘‘রামযশ’’ কলেজে তাঁর চাকরী হয় এবং ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লীর সে কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩০ সালের ৯ই মে লাবণ্য দেবীর সাথের বিয়ের পর কবি আর দিল্লীতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ফলে তাঁর সে চাকরীটিও আর থাকলো না। এরপর প্রায় বছর পাঁচেক চলে তাঁর বেকারত্বের জীবন। এ রকম অবস্থার ভিতরে ১৯৩১ সালে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়। প্রায় সে সময়েই তার ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি কবির ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। কবিতাটি প্রকাশের সাথে সাথে তা কলকাতার সাহিত্যসমাজে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। কবিতাটির আপাতঃ বিষয়বস্তু ছিল ‘জোছনা রাতে হরিণ শিকার’। কিন্তু অনেকেই এই কবিতাটিকে অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন।


কবি তাঁর বেকারত্ব, সংগ্রাম ও হতাশার সময়কালে বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেন, তবে তার জীবদ্দশায় সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। এমনকি তাঁর জীবদ্দশায় একদিকে তিনি সাহিত্যের সুধী সমাজে কুণ্ঠিতভাবে গৃহীত হন এবং অনেক ক্ষেত্রেই সমাদৃত হননি। তবে তীব্র ও রূঢ় সমালোচনার অতিরিক্ত শব্দবাণ প্রতিমুহূর্তে তাঁকে তাড়া করেছে। তবে একেবারে যে সমাদৃত হননি তা বলা যাবে না। এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৩৫ সালে ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়  কবির ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছিলেন, ‘জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে’। এই কথার সত্যতা আমরা পাই কয়েকবছর পর। ১৯৩৮ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ সংকলনে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর আগে কবিতাটি সংক্ষিপ্তরূপে প্রকাশিত হয়। কবি বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। মৃত্যুর এতদিন পরও তাঁর অপ্রকাশিত অনেক রচনা-লেখা-কবিতা এখনও প্রকাশিত হচ্ছে। তবে তার জীবদ্দশায় সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। ১৯৩৪ সালে তিনি একগুচ্ছ কবিতা রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে তাঁর ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কবির মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে ১৯৫৭ সালে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কবির মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁর লেখা বা কবিতা এখনও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।


তবে আমার মনে হয় কবির অনেক অপ্রকাশিত কবিতা হিসেবে যা প্রকাশ করা হচ্ছে বা হবে, তা কবির শিল্পীত মনের শিল্প-সাধনার খন্ডিত অংশ। একই কবিতা কবি কয়েক ভাবে লিখেছেন, এমন দেখা গেছে। এই লিখিত রূপগুলোর মধ্যে যেটি কবির কাছে সবচেয়ে লাগসই বা যুৎসই বা মনপুতঃ হয়েছে তাকেই তিনি কবিতা হিসেবে পাঠকের সামনে এনেছেন। কবি যেটা করেন নি সেটা হলো তাঁর দৃষ্টিতে অপূর্ণ কবিতাগুলিকে তিনি ধ্বংস বা বিনষ্ট করেন নি। এ কারণে তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরেই তাঁর লেকা পাওয়া যাচ্ছে, যা অনেক গবেষক ভিন্ন বা পূর্ণ কবিতা হিসেবে সেহুলোকে বিচেনা করছেন। এটা অবশ্য আমার নিজস্ব মতামত। তবে আমি এই লেখায় এ রকম কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরতে সচেষ্ট হবো।


কবি জীবনানন্দ দাশ-এর জীবদ্দশায় মাত্র সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে একটি কবি নিজের অর্থে প্রকাশ করেন। অন্যগুলো বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করে। এর কালানুক্রমিক বিবরণ এরকমঃ
১।  ১৯২৭ সালে শ্রী সুধীর চন্দ্র সরকার কর্তৃক ‘ঝরা পালক’
২।  ১৯৩৬ সালে কবির নিজের উদ্যোগে ‘ধূসর পান্ডুলিপি’
৩।  ১৯৪২ সালে কবিতাভবন থেকে ‘বনলতা সেন’
৪।  ১৯৪৪ সালে পূর্বাশা লিমিটেড থেকে ‘মহা পৃথিবী’
৫।  ১৯৪৮ সালে পূর্বাশা লিমিটেড থেকে ‘সাতটি তারার তিমির’
৬।  ১৯৫২ সালে সিগনেট প্রেস থেকে ‘বনলতা সেন’
৭।  ১৯৫২ সালে নাভানা থেকে ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’


কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ ১ম বার ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থ ২টি সংস্করণে প্রকাশ করা হয়। ১ম সংস্করণ ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে কলকাতা থেকে কবির নিজস্ব উদ্যোগে ও প্রকাশনা সংস্থা ‘কবিতাভবন’ থেকে, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। তখন কবি বরিশালের বিএম কলেজে অধ্যাপনারত। এটি ছিল ১৬ পৃষ্ঠার কৃশকায় পুস্তিকা যার ১ম কবিতা ছিল ‘বনলতা সেন’। এ পুস্তিকাটি কবিকে নিজের টাকায় বের করতে হয়। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি ১ম থেকেই জনপ্রিয় ছিল। এই কবিতাই জীবনানন্দকে বাংলা কবিতায় কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। এতে মাত্র ১২টি কবিতা ছিল। পরে ১৯৫২ কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে এর বর্ধিত ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যাতে আগের ১২টি কবিতার সঙ্গে আরো ১৮টি কবিতা প্রকাশিত হয়। এ সংস্করণের অন্যতম বিখ্যাত কবিতা ছিল ‘সুরঞ্জনা’। বনলতা সেন কবিতা গ্রন্থের বর্তমান সংস্করণে মোট ৩০ টি কবিতা স্থান পায়, তবে ১ম সংস্করণের ১২টির সঙ্গে ২য় সংস্করণের ৫-৬টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, যার অন্যতম ছিল ‘সুরঞ্জনা’ ও ‘পথ হাঁটা’।


‘বনলতা সেন’ কবিকে পুরস্কৃত করে, যার অর্থমূল্য ১০১ টাকা। নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ১ম বারের মত কবিকে এ পুরস্কার প্রদান করে ১৯৫৩ সালে। তখন তিনি হাওড়া গার্লস কলেজে কর্মরত। পরের বছর ১৯৫৪ সালে কবি সম্মেলনে কবি শ্রোতাদের অনুরোধে স্বকন্ঠে কবিতাটি আবৃত্তি করেন। এ কবিতাটি তরুণ কবি ও পাঠক হৃদয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল এবং একই সঙ্গে তিনি দুর্বোধ্য কবি হিসেবে চিহ্নিত হন। এছাড়া ১৯৫৪ সালে ট্রাম দুর্ঘটনার আগের দিন ১৩ অক্টোবর তিনি বেতারে কবিসম্মেলনে ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন। তাঁর আর্থিক ও শারীরিক অবস্থা যাই থাকুক না কেন দেহ-মনে তিনি সচল ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই ট্রাম দুর্ঘটনা তাঁকে মহাকালের অন্ধকারে নিয়ে যায়। তাঁর ভুলোমন তাঁকে এ মত্যু উপহার দিয়ে থাকতে পারে বা দারিদ্র বা পারিবারিক টানাপেড়েন তাঁকে এ মৃত্যুর জন্য গোপন প্রতীক্ষারত করেছিল কি না, তা নিয়ে অনেক পরস্পর বিপরীতধর্মী মন্তব্য বা বক্তব্য রয়েছে। তবে এটাই সত্য এ বছরই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন, মাত্র ৫৫ বছর বয়েসে।
                                          (ক্রমশঃ)
এস, এম, আরশাদ ইমাম//অপর
১১ নভেম্বর ২০১৫; বুধবার, ঢাকা।