একটি ‘কবিতা’ ও একটি ‘চিত্র’ পৃথিবীর সকল অলস, অকর্মণ্য, ভবঘুরে, যাযাবর মানুষের পথের পাথেয়, চলৎশক্তি, ক্ষুধার অন্ন, জীবন অন্বেষা। মানুষগুলো হলো কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর বা পেইন্টার, শিল্পী, পরিব্রাজক, সমালোচক ও এ সবের পাঠক-দর্শক-প্রেমিক।


কবিতাটি কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ আর লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি’র ‘মোনালিসা’। একটির ‘পাখীর নীড়ের মতো চোখ’, আর একটি হলো ‘সায়াহ্নের হাসি’। আজ কয়েকটি কথা বলি জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর বনলতা সেন নিয়ে।


----------------------------------------------


‘‘সারাদিন ট্রাম-বাস-ফেরিওলাদের ডাক- কুষ্ঠরোগী পথের উপর-
হাড়ভাঙা মহিষের গাড়িগুলো-বাজারের রুক্ষ শব্দ-বস্তির চিৎকার।
আমার হৃদয়ে যেই শঙ্খমালা কিশোরীটি বাঁধিতে আসিয়াছিল ঘর
তাহারে ফিরায়ে দেয় শহরের পথ থেকে পাড়াগাঁর কান্তারের পার-


কবে যে কান্তার ছেড়ে আসিয়াছি নির্বাসিত আমি রাজপুত্রের মতন,
কোথায় শিমের গন্ধ? শ্যামা পাখি? কিশোর গেল কি মরে বুকের ভেতর?
দুপুর ঘনায়ে ওঠে ভিজা মেঘে- চিল কাঁদে-কই বলো?
কই হীরামন?-
আমার হৃদয়ে যে গো শঙ্খমালা কিশোরীটি বাঁধিতে আসিয়াছিলো ঘর।’’
-----------------------------------------------
*জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর জীবন*


কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ বরিশাল শহরে। বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক, প্রাবন্ধিক। মা কুসুমকুমারী দাশও কবি ছিলেন, কাব্যগ্রন্থও আছে তার।


তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বাসিন্দা। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৯৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেঁকে স্থানান্তরিত হয়ে বরিশালে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সর্বানন্দ জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন; পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মানব হিতৈষী কাজের জন্যে সমাদৃত ছিলেন।জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বাসন্দের দ্বিতীয় পুত্র। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ এর সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও শিশু শ্রেণীর পাঠ্য। জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তার ডাকনাম ছিল মিলু। তার ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ সালে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন।


পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন বলে বাড়িতে মায়ের কাছেই মিলুর বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের গান শুনতেন। লাজুক স্বভাবের হলেও তার খেলাধুলা, ভ্রমণ ও সাঁতারের অভ্যাস ছিল। ছেলেবেলায় একবার কঠিন অসুখে পড়েন। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে মাতা ও মাতামহ হাসির গানের কবি চন্দ্রনাথের সাথে লক্ষ্নৌ, আগ্রা, দিল্লী প্রভৃতি জায়গা ভ্রমণ করেন।


১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে আট বছরের মিলুকে ব্রজমোহন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। স্কুলে থাকাকালীন সময়েই তার বাংলা ও ইংরেজিতে রচনার সূচনা হয়, এছাড়াও ছবি আঁকার দিকেও তার ঝোঁক ছিল, যদিও তা হালে পানি পায়নি। জীবনানন্দ দাশ ১৯১৫ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯১৭ সালে আইএ পাশ করেন। প্রথম বিভাগ সহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। দু’ বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পূর্বের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটান এবং অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন। কলকাতা থেকে আর ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে ১৯১৯ সালে অনার্সসহ বিএ ও ১৯২১ সালে এমএ পাশ করেন। ১৯২২ সালে তিনি কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।

১৯৩০ সালের ৯ই মে তারিখে কবি কলকাতার ইডেন গার্লস কলেজের ছাত্রী লাবণ্য দেবীকে বিবাহ করেন। বরিশালে তার পরিবার তার বিয়ের আয়োজন করছিল। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকায়, ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরীতে। বিয়ের পর তিনি আর দিল্লীতে ফিরে যাননি। ফলে সেখানকার চাকরি হারান। এরপর প্রায় বছর পাঁচেক সময় জীবনানন্দ কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। মাঝে কিছু দিন ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেন। এছাড়া, ব্যবসায়ের জন্য তিনি ছোট ভাই এর কাছ থেকে অর্থ ধার করেন এবং তাতেও ব্যর্থ হন। এসব টানাপোড়েন তাঁর সারাজীবনের সঙ্গী ছিল। কিন্তু তার জীবনে বৃহৎ স্থান দখল করতে পারে নি। নেহাত জীবিকার্জনের তাগিদে তিনি নানারকম প্রয়াস-প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কখনও সফল কখনও বিফল। কিন্তু কবিতা তাঁর সর্বসঙ্গী এবং তা আমৃত্যু অব্যাহত থাকে।
আর কবিতা যে এক পশলা বৃষ্টির মতো লেখা বা ছোট-খাট সংশোধনীর বারান্দা পেরিয়ে জন্ম নিয়েছে, তা কিন্তু নয়। কবিতা তাঁর কাছে ছিল কারুকার্য্যময় এক শিল্প, নিখুঁত বুনন, যাকে তিল তিল করে ঘষামাজা করে, কারু হস্তে যত্নের ছোঁয়ায় ইমারতের মতো দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কবিতার জগতে পদচারণা শুরু থেকেই নানা ধরণের চড়াই উৎরাই অতিক্রম করেছে। কিন্ত তিনি দমে যাননি। কবিতা তাঁর প্রেম-প্রতীজ্ঞা-সন্তান, কবিতা ছিল তাঁর অধ্যবসায়-ধৈর্য্য, কবিতা ছিল তাঁর অস্তিত্ব।

কলকাতায় শুরু করলেও তিনি জীবনে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন জন্মস্থান বরিশালে শিক্ষকতা করেই। তবে তিনি বরিশাল, বাগেরহাট, দিল্লীসহ বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকতা করেন। সারা জীবন যা ছিলেন তা হলো পথচারী-পরিব্রাজক, বাংলার পথে-ঘাটে-মাঠে, বনে-বন্দরে ভ্রমণ করতেন, ভ্রমণ ছিল তার মনের ভিতর দিয়ে সারা পৃথিবী, সমুদ্র, আকাশ, ভূখন্ড। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি কলকাতায় বাস করতেন। ‍


১৯৫৪ সালে তিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কলকাতার শম্ভুনাথ পন্ডিত হাপাতালে ভর্তি হন, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২২ অক্টোবর। ১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। গুরুতরভাবে আহত জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসেছিল নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা। তাঁকে উদ্ধার করে শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ সহ তখনকার অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন অনেক চেষ্টা করেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাশও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। তাঁর অনুরোধেই পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সে নির্দেশে তেমন কোন লাভ হয়নি, তাতে চিকিৎসার কিছু  উন্নতি হয় নি। জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হতে জটিলতর থাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ডাক্তার, নার্স ও শুভাকাঙ্খীদের সকল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত ১১ টা ৩৫ মিনিটে  হাসপাতালে নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


                                          (ক্রমশঃ)


এস, এম, আরশাদ ইমাম//অপর সময়
০৯ নভেম্বর ২০১৫, সোমবার
------------------------------------------------
এই লেখাটি আকারে দীর্ঘ। লেখার শেষে সহায়ক গ্রন্থ তালিকা ও অন্যান্য তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হবে।  পাঠকের সহৃদয় পরামর্শ ও মতামত শ্রদ্ধাভ’রে গ্রহণ করা হবে।