কবিতা কি জানি না। যা মনে আসে লিখি। কখনো কুয়াশার ভিতরে দেখি অস্পষ্ট মুখচ্ছবি, কখনো মাঠ পোড়া রোদে দেখি মরীচীকা, কখনো অঝোর বৃষ্টি ধারার ভিতরে দেখি কাঁপা কাঁপা হেলুসিনেটেড মুখ, তাকেই ধরে বেঁধে তুলে আনি, কখনো ছেঁড়া কাগজে, কখনো ডায়েরীর পৃষ্ঠায়, কখনো ব্লগে বা টিস্যু পেপারে..টুকে রাখি যত্ন করে, তারপর ভাবনাটা অবয়ব পেলে সাজিয়ে ফেলি শব্দ, বাক্য, সারি বা বন্ধনীর বেড়াজালে, একটু মাখিয়ে দিই উপমার-উৎপ্রেক্ষার রশ্মি, একটু লাগিয়ে দিই পিরামিড জীবনের তাল লয় মাত্রা আর যান্ত্রিকতার সিগন্যাল, আঁকি-বুকি-রেখা এবং ভাইব্রেশন। ব্যস্‌ দাঁড়িয়ে গেল কবিতা।


কবিতায় কখনো দেখি শ্লোগানের বজ্রমুষ্ঠি, অঘোষিত নিনাদ, কখনো দেখি জরা-ব্যধি-বেদনা-যন্ত্রণা-কষ্ট-ত্রাস, কখনো দেখি নদী-জল-ফুল-পাখি-মাটি-কাদা-ঘাষ। কবিতা কখনো থৈ থে করে চোখের জলে, কখনো ভিজে ওঠে তাপে ও ঘামে। কখনো কবিতার শিয়রে পাাই নীল চিঠি, লাল ঠোঁট, গোলাপী গাল, মরালী গ্রীবা, রাজহংসী ডানা, আবার কখনো দেখি হিরোশিমা, বিশাখা, মিশরীয় কলস, বটের পাতা। কবিতার শরীর রেয়ে কখনো ওঠে সুশীতল সরীসৃপ, আবার কখনো বেয়ে ওঠে দুষ্টমতি পিঁপড়ের সরি, মধু বা গুড়ের লোভে। এই কবিতাকেই কখনো দেখি অক্টোবর বিপ্লবের মুহূর্মুহূ কামানের মুখে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে প্রলেতারিয়েত দীর্ঘজীবি হোক বা ইনকিলাব জিন্দাবাদ, আবার এই কবিতাই বলছে আরবী সুরের কম্পমান রাতের তাঁবুর ভিতরে নীনা হাসনাইন বা মুজরা বা ব্যালে। সবই পাই কবিতার শরীর উরু বা উঠোন চষে। যদিও কবিতা যখন কৃষকের কথা বলে, বলে স্বাধীনতার শব্দাবলী, যখন খুলে ধরে কোন মহাগ্রন্থের পাতায় পাতায় কিভাবে শোষকের লালা নদীর মতো বয়ে চলে বা কিভাবে একটি একুশে ফেব্রুয়ারি বা সাতই মার্চ কিভাবে একটি দুর্বল নতজানু জাতিকে উদ্দীপ্ত করে শোষণ-ত্রাসন-গ্লানি মুক্তির কথা বলে তখন মাঝে মাঝে কবিতার উপরে হামলে পড়ে অকবি, কবিতার শরীরে উপগত হতে চায় বর্জ্যজাত নপূংসক তরুণ-যুবা-মধ্য-পৌঢ়-বৃদ্ধ বা অশীতিপর পুরুষ।কবিতা তখন হিজড়া/হারমোফ্রোডাইট/নারী/নিষিদ্ধা বা তারও চেয়ে অবনমিত কিছু। ধরা ছোঁয়া বলা তখন ক্রমশঃ নিষিদ্ধ হয়ে ওঠে।


আমি কবিতার প্রতিটি শব্দের নিচে দেখতে পাই প্রেমের চেয়ে অপ্রেম, গানের চেয়ে অর্গান, মানের চেয়ে অপমান, প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তি, তৃষ্ণার চেয়ে বিতৃষ্ণা, কাজের চেয়ে কাম, শ্রমের চেয়ে ঘাম, চাষের চেয়ে পিশাচ, লাভ এর চেয়ে ক্ষতি, ছাই এর চেয়ে লাভা, ঘামের চেয়ে লালা বেশি। আমি কবিতার প্রতিটি শব্দের পারে দেখি একটি করে সবুজ মাঠ, প্রতিটি লাইনের পরে পাই একটি করে অনাবিষ্কৃত গ্রহ, প্রতিটি স্তবকের পরে পাই একটি করে অনতিক্রম্য গ্যালাক্সী, প্রতিটি যতির পরে একটি করে হাওয়াহীন মহাজগত। আমি কবিতার ভিতরে মহাবিশ্বের কোন শুরু শেষ দেখতে পাইনা, আমি কবিতার ভিতর দিয়ে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না, আমি কবিতার ভিতরে সমর্পিত হয়ে মানব জন্মের কোন হারানো সূত্র খুঁজে পাই না। কবিতা যেন ইনফিনিটি থেকে হঠাৎ অস্তিত্বমান একটি দূরতিক্রমণকারী অবয়ব যে কিছু সময় পরে বিনে ঘোষণায় আবার অদৃশ্য হবে ইনফিনিটির কাছে। আমি কবিতাকে তাই মহাবিশ্বের মত আদিঅন্তহীন, ঈশ্বরহীন অথবা ঈশ্বরজ্ঞানহীন বিদ্যুচ্চমকের চেয়েও-ন্যানো সেকেন্ডের চেয়েও ক্ষণস্থায়ী কোন সময়ের তুলিচিত্র মনে করি। এর জন্ম কবির জঠরে, মৃত্যু অকবির সিথানে।কবিতার মৃত্যু মানে কবির মৃত্যু। কবির মৃত্যু মানে সভ্যতার মৃত্যু। সভ্যতার মৃত্যু মানে তুমি-আমি alfa.


কবিতা তাই তোমার-আমার-মানুষের জন্মের পূর্ব হতে মৃত্যুর পর পর্যন্ত সময়ের জেনোম-জীন মানচিত্র।