ছন্দ বলতে কি বোঝায় এ নিয়ে ভাবতে বসে এক ধন্দে পড়লাম। আসলে ছন্দ তো সব জায়গাতেই। এই যে নিত্যদিনের জীবন অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে, চাঁদ ডুবে সুয্যি টপ করে উঠে পড়ছে পুব দিগন্তে আবার সুয্যি পাটে বসার আয়োজন করতে না করতেই চাঁদবাবাজী স্নো-পাউডার মেখে দিব্যি রেডি। একদিনও এই নিয়মের বাত্যয় হয় না। এটা ছন্দ না? শীতকালে পাতা ঝরে যাচ্ছে, আবার বৃষ্টিকালে ধুয়ে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর, প্রচন্ড দাবদাহে ট্রাম রাস্তার পিচ গলে যাচ্ছে – আমি তো সবেতেই ছন্দ খুঁজে পাই। আর সেই নিয়ম মেনে কোন সুদুর সাইবেরিয়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী ঠিক চলে আসে কলকাতায়, সে তো সেই প্রাকৃতিক ছন্দের নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ। তবে কি ছন্দ শিখতে হবে বই ঘেঁটে? ‘ফুটবল খেলতে শিখুন’ নামক মোটা বইখানি আপাদমস্তক মুখস্ত করলেও এক দানা ফুটবল খেলতে শেখা যায় কি? সম্ভব?


তবে সাহিত্যের খাতিরে ছন্দ শিখতে হয়েছিল বাল্যকালে। সব কি মনে আছে? মনে হয় না। আমরা অনেকেই অ-আ-ক-খ শিখেছি। ক’জন আছে গড়গড় করে ‘ক’ থেকে ‘:’ অবধি বলে যেতে পারে? হয়ত অনেকেই পারে। আমি বাপু থমকে যাই। আসলে ছন্দ বলতে অনেকেই বোঝে অন্ত্যমিল। আমি মনে করি গদ্য কবিতাতেও আছে ছন্দ। তাকে গুঁজে দিলে হবে না, খুঁজে নিতে হবে। তাই মানুষের সাথে ফানুস মিলিয়ে লিখলেই কবিতা হবে না। ছন্দ জিনিষটা কবিতার শিরদাঁড়া। হাত পা, মাথার মত দেখা যায় না, তবে গোটা শরীরটাকে দাঁড় করিয়ে রাখে। কবিতার ছন্দজ্ঞানের প্রয়োগ না ঘটলে কবিতা হয় মেরুদন্ডহীন প্রাণীর মত, বুকে হেঁটে চলা সরীসৃপ। আমরা বরং কবিতাকে বুকে হাঁটতে বাধ্য না করে, একটু দাঁড় করাই। তবে শুরুতেই বলে রাখি আলোচ্য প্রবন্ধটি কিন্তু ছন্দ শেখার কোন ক্লাশ নয়। সে সব শেখানোর জন্য অনেক মহান মহান ব্যক্তি আছেন, বাজারে ছড়িয়ে আছে চমৎকার চমৎকার সব গ্রন্থ। আমি শুধু এক প্রবন্ধে ছন্দের খোঁজে একটু পাড়া বেড়ালাম মাত্র।


সাহিত্যে ছন্দ কি? প্রথমেই দেখে নিই ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় কি বলছেন এই ব্যাপারে। তাঁর মতে, ‘বাক্যস্থিত পদগুলিকে যেভাবে সাজালে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় ও তার মধ্যে ভাবগত ও ধ্বনিগত সুষমা উপলব্ধ হয়, পদ সাজাবার সেই পদ্ধতিকে ছন্দ বলে।’ তাঁর মানে দাঁড়ালো ছন্দ হল ব্যবহৃত শব্দাবলীকে তরঙ্গিত, শ্রুতিমধুর এবং সুখপাঠ্য করে তোলে। এইবার কবিগুরু কি বলছেন? তিনি জানাচ্ছেন – শুধু কথা যখন খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তখন কেবলমাত্র কথার মানেটাকে প্রকাশ করে। কিন্তু সেই কথাকে যখন বক্রভঙ্গি ও বিশেষ গতি দেওয়া যায় তখন সে আপন মানের চেয়ে আরও কিছু বেশি প্রকাশ করে। আবার জীবেন্দ্র সিংহরায় কি বলেন একটু শুনে নিই – কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকেই ছন্দ বলে।


একটা কথা পাঠককে মনে রাখতে হবে, ছন্দ সবসময় উচ্চারণের সাথে জড়িত, বানানের সঙ্গে নয়।



(আবার কাল দেখা হবে)