আমার মনে হয় এই দুনিয়া শূন্যতা পছন্দ করেনা,
সে চায় কিছু না কিছু দিয়া শূন্যস্থানডারে ভরায়া রাখতে।
সে চায় মানুষ যেন পুরানা কিছুরে আঁকড়ায়া না বাঁচে
সে চায় নিত্যনতুন আইসা পুরাতনরে একেবারে মুইছা দিক-
সে চায় পুরাতনরে ধুর ধুর কইরা তাড়ায় দিতে, কোনোরকমে বিদায় করতে।


এই যেমন আমরা হাজার বছর বাঁচার স্বপন দেখি-
মাঝে মাঝে আচরণে প্রকাশ করি- আমার তো আর সমাপন নাই।
কিন্তু খেয়াল করলেই দেখবো-
দুদিন আগে দিব্যি শ্বাস-প্রশ্বাসের অধিকারীর কোনো কিছুই এখন আর নাই।
কিছুই নাই, তার সাথে লাইগা থাকা ছায়াটারও চিহ্ন নাই।
তবে কি সেখানে শূন্যস্থান রয়া গেছে, একরাশ পুরাতন আইসা জটলা বাঁধছে!
নাকি তার শূন্যতায় বেদখল কোনো চর জাগছে সময়ের সীমানায়!


এমন হঠাৎ আমিও খেয়াল কইরা দেখি-
যেই মুরুব্বি আমাদের গ্রামের বাড়িটারে আগলায়া রাখছিলো,
অসভ্যতা নামক আপদটারে বাড়ির কাছ-ধার ঘেষতে দেয় নাই,
সেই মুরুব্বিরে যেদিন রমজান মাসের কোনো এক মধ্যরজনীতে
ঘোর অন্ধকার বাঁশঝাড়ের নিচে সুনসান নীরবতায় শোয়ায়া দিছিলাম
আমরা সবাই মিইল্যা। তারপর কতো এরকম রজনী কাইটা গেছে-
তাঁর শূন্যতা আমরা কেউ অনুভব করিনাই।


ওই যে মসজিদের মাইকে মোটা গলায় সেহরী খাওয়ার ডাক দিতো-
ভোর হওয়ার কিছু আগে বলতো- আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।
রাত-দুপুরে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে একগ্রাম নীরবতা ভাঙতো,
টেলিভিশনের শব্দ জোরে হইলে মাইকে হুশিয়ারি দিতো।
সাদা চুলের-সাদা দাঁড়ির সেই বুড়ো যখন অন্যের মুখের এলান হইলো
তাঁর পর থেইকা আমরা কেউ তারে মনে রাখি নাই,
তাঁর শূন্যতা আমরা কেউ অনুভব করিনাই।


আমার আম্মার কথাও খেয়াল করে দেখি-
এতোগুলো ছেলেমেয়, পাহাড়সমান কাজের তালিকা আর দায়িত্বের বোঝা
কপালের টান টান রগ আর হাজার রকম চিন্তার ভাঁজ-
কতো কিছু নিয়া বাঁচতো আর আমাগোরে বাঁচার স্বপন দেখাইতো।
সকালে মক্তব পাঠানোর তাড়া দেওয়া, রাতদুপুরের আদর-শাসন,
আমাদের শতো দুর্ব্যবহারের স্বাক্ষী, আমাদের দুঃখের স্বান্তনা
আনন্দের হাসি, আরও কতো কী হইয়া বাঁইচা ছিলেন।
তারপর হঠাৎ কোনো দীর্ঘ রাইতে আমাদের চিন্তায় ছটফট কইরা
সকালের খারাপ লাগার পর সেই যে চোখ মুদলেন, আর খুললেন না।
আমরাও তো নিষ্ঠুরের মতো ওনারে সেই একাকী রাইখা আসছি,
ওনার কোনো কাজ আর অবশিষ্ট পইড়া নাই এখন, না ওনার চিন্তারাও।
ওনার অন্তর্ধান একবিন্দু থাইমা থাকার কারণ হয়নাই কারুর
তাঁর শূন্যতাও আমরা কেউ অনুভব করিনাই।


তারপর ভাবলাম নিজেরে নিয়া-
আমার অফিসের চেয়ার কী স্মৃতির কালিঝুলি মাইখা পইড়া থাকবো!
আমার এতো এতো জমানো কাজ, এতো এতো দায়িত্ব-তালিকা,
এতো এতো বড়োমানুষি চিন্তা, আরও হাজার কতো কী!
এসব সব কিছু, সব কিছু কি থাইমা যাইবো?
না আমার জন্য থাইমা যাইবো কারুর সাবলীল জীবন-যাপন?
কারুর নিশ্বাসেও বিন্দুমাত্র ভাটা পড়বো না জানি,
যদি আমি এই মূহুর্তেও নিঃশেষ হইয়া যাই।
একটু আধটু সামাজিক শোক যাপনের পর-
আমার শূন্যতাও কেউ অনুভব করবো না।