'সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল'
'At day's end, like hush of dew
Comes evening. A hawk wipes the scent of sunlight from its wings. '

এই আলোচনা সভায় ক্লিনটন বি. সিলি-র 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট'  সম্বন্ধে লিখেছিলাম। https://www.bangla-kobita.com/pkchatter007/a-poet-apart/   (০৫/১০/২০১৭)
কেন উল্লেখ করলাম? কারণ পাঠককে প্রাণিত করবে এই চুনিলাল সম্বন্ধে জানতে। এই বইটি তিনি না লিখলে আমরা কোনোদিনই এই চাওয়ালা চূণীলালকে জানতে পারতাম না। আগ্রহের সেই বীজ বপন করা হয়েছে বইয়ের ‘ভূমিকা’তেই।ক্লিনটন বি. সিলি-র কথায় ":এই জীবনীগ্রন্থের মূল চরিত্রটিকে ব্যক্তিগতভাবে আমার জানার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর বিধবা পত্নী লাবণ্য দাস, দুই সন্তান মেয়ে মনজুশ্রী ও ছেলে সমরানন্দ এবং ভাই অশোকানন্দ ও বোন সুচরিতার সঙ্গে সাক্ষাৎকার। তাদের সবাই বিভিন্ন ভাবে আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।বর্ণনাতীত ভাবে অসংখ্য ব্যক্তি আমাকে সহায়তা করেছেন আমাকে অনেক কিছুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে যা আমার গবেষণার কাজটাকে করে তুলেছেন আরো রোমাঞ্চকর ও সম্পূর্ণ।"

যাই হোক, আমার আজকের বিষয়বস্তু চুনিলাল, তাই বিস্তারিত ভাবে অন্যান্য বিশ্লেষণে যাচ্ছিনা।এ-বইয়ের  ‘ভূমিকা’তেই উল্লিখিত হয়েছে চুনিলালের কথা। তার স্বরূপটা এরকমের : ‘আপনাকে চুনিলালের সঙ্গে দেখা করতে হবে’, বেশ জোর দিয়েই আমার পরিচিত লোকটি বলেন, ‘এই ভদ্রলোকই ট্রামের নিচে চাপা পড়ে থাকা জীবনানন্দকে উদ্ধার করেছিলেন।’ আমি চুনিলালের সঙ্গে দেখা করি ১৯৭০ সালে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলার সবচেয়ে হূদয়লালিত কবির মৃত্যুর ১৬ বছর পর। দক্ষিণ কলকাতায় রাসবিহারী এভিনিউতে তাঁর চায়ের দোকানে রোজকার মতো বসে ছিলেন চুনিলাল।১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় এরকম সান্ধ্য ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি (জীবনানন্দ দাশ)। তখনই রাসবিহারী এভিনিউ পার হওয়ার সময় একটা চলন্ত ট্রামের সামনে পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।" ‘চুনিলাল আমাকে জানান, হইচই শুনতে পেয়ে ঘটনা ঘটার মুহূর্তের মধ্যে সেখানে পৌঁছানোর পর তিনি দেখতে পান, কেউ একজন ট্রামের নিচে পড়ে আটকে আছেন। চুনিলাল – গাট্টাগোট্টা মানুষটি – ঝুঁকে পড়ে ট্রামের একপাশে দুই হাত লাগিয়ে পরিস্থিতির প্রয়োজনে অতিমানবীয় শক্তি প্রয়োগ করে ট্রামের একটা পাশ আলগা করে তুলে ধরেন, যাতে জীবনানন্দের শরীরটাকে টেনে বের করা যায়। ঘটনার আট দিন পর নিউমোনিয়া সংক্রমণের জটিলতায় মারা যান কলকাতার শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।
চুনিলাল জীবনানন্দকে চিনতেন না বা জানতেও পারলেন না যে তিনি ট্রামের ক্যাচারে আটকে যাওয়া বাংলার এক মহান কবিকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন? শুধু চুনিলাল কেন, আসলে যাঁরা চিনতেন তাঁদের সংখ্যাও অল্প। কারণ, তিনি ছিলেন একান্ত একজন, যিনি প্রধানত থাকতেন কবিতার মধ্যেই। জীবনানন্দকে বাঙালি পাঠকবিশ্বে তুলে ধরেছিলেন শুভাকাঙ্ক্ষী বুদ্ধদেব বসু। তাই তিনি জীবনানন্দকে আখ্যায়িত করেছিলেন  ‘আমাদের নির্জনতার কবি’ বলে।
নিজের নির্জনতাকে জীবনানন্দ নিজেও কী টের পেয়েছিলেন? এজন্যই কী আগেভাগেই বলে গিয়েছিলেন পরিসমাপ্তির বর্ণময় ব্যাখ্যা??
    “সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
    সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
    পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
    তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল”
দিনান্তে ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলেছে অন্তর্গত হাহাকার আর অস্থিরতায় কম্পিত একটি চিল। তাঁর একাকিত্ব ও হতাশা এবং প্রকৃতির মধ্যে অণুর মতো তাঁর নিমগ্নতা তাঁকে তাঁর নামের প্রকৃত অর্থে(জীবনের আনন্দ) বিপরীতে ঠাঁই দিয়েছে।
উপসংহার :
আহত জীবনানন্দ দাশকে ট্যাক্সিতে করে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে কয়েকটা ভাঙা পাঁজর, চিড় ধরা কণ্ঠাস্থি ও চূর্ণবিচূর্ণ পায়ের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আহত ও চিকিৎসাধীন জীবনানন্দ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন এবং দুর্ঘটনার আট দিন পর ২২ অক্টোবর মারা যান।  নীরব তিরোধান কালে কেউই স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি যে, এই ‘নিভৃত’ কবি অচীরেই মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পাশে নিজের একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নেবেন এবং তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা ও বৈশিষ্টপূর্ণভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন। আজ এটা বললে কি বেশি বলা হবে যে তাঁর কাব্যরুচিকে ঘিরে তৈরি হওয়া   আজকের আধুনিক কবি ও পাঠক জীবনানন্দ দাশ ও আধুনিক বাংলা কবিতার মধ্যে একটি সমান্তরাল পথরেখা খুঁজে পেয়েছেন?

টিকা:
চা ওয়ালা চুনিলাল। কলকাতার রাসবিহারী এভেন্যু এর রাস্তার ধারে একপাশে ছোট্ট একটু চায়ের দোকান। সেই চুনিলাল হয়ে গেলেন বাংলা সাহিত্যে একজন বিখ্যাত চরিত্র।গায়ে ছিল অসুরের শক্তি। ষণ্ডাগণ্ডা চেহারা। এই চুনিলালের জন্যে কবি জীবনানন্দ কে জীবিত অবস্থায় আমরা আরো সাতদিন বেশি পেয়েছিলাম।

ধন্যবাদ জ্ঞাপন:
ভালো লাগলো লেখাটা আমার আসরের বন্ধুরা? যারা কষ্ট করে আমার লেখাটি পড়লেন তাদের জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ, ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা।